আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-৩

আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-৩

দাদীর মৃত্যুর পর প্রায় দেড় মাস হয়ে গিয়েছে আমি আমার দূরসম্পর্কিয় সেই চাচার বাসায় আছি।এই  দুনিয়াতে আমার আপনজন বলতে একমাত্র দাদীই ছিলেন। জন্মের পর পরই মাকে হারিয়েছি,

দাদীর কাছে শুনেছিলাম,আমার বাবা নাকি আমার মাকে অনেক ভালোবাসতেন । এককথায় চোখে হারাতেন। এই নিয়ে অনেকেই বাবাকে বউ পাগল বলে ক্ষেপাতো,তবে বাবা সেসব আমলে নিতেন না। যেদিন মা জানতে পারলেন আমি তার পেটে এসেছি সেদিন বাবা,মা দুজনেই নাকি অনেক কেঁদেছিলেন। উহুম...দুখের কান্না নয়,সেটা ছিল সুখের কান্না। আনন্দের কান্না । কতটা খুশি ছিলেন তারা,এইসব গল্প দাদী ঘুমানোর আগে প্রতিদিন আমাকে বলতেন। আমিও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম সব।

আমার জন্মের দিন সকালবেলাও নাকি বাবা খুব যত্ন করে মায়ের চুল আঁচড়ে দিয়ে বেনুনি করে দিয়েছিলেন। কপালে  ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে বলেছিলেন,আমাদের রাজকন্যাকে নিয়ে ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। আমি তোমাদের অপেক্ষায় থাকবো। 

কিন্তু মা বাবার কথা শুনলেন না। বাবার কাছে তার রাজকন্যাকে দিয়ে চলে গেলেন দূর অজানায়। বাবা মায়ের এমন চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি। অতঃপর মায়ের মৃত্যর দুদিনের দিনই তিনি আত্ম*হত্যা করেন। কী স্বার্থপর তারা!!নিজেদের ভালোবাসাকে বাচাতে গিয়ে আমাকে ফেলে যান বৃদ্ধ দাদীর হাতে,যার নিজেরই ঠিক মতো চলার সামর্থ্য নেই।

আমার পুরো নাম আলোরেণু শিকদার । দাদী আমাকে আদর করে রেণু বলে ডাকতেন। তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। আগলে রাখতেন। যত্ন করতেন। আমাদের তেমন কোনো টাকা পয়সা ছিলো না। দাদী হাতের কাজ করে যা রোজগার করতেন তাতেই দুবেলা দুমুটো খেয়ে বাঁচতাম আমরা। তবে এতো কষ্টের মধ্যে দাদী আমাকে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে পড়াশোনার মূল্য শিখিয়েছিলেন আমায় । আমিও দাদীর শেখানো আদর্শ ভেসে যেতে দেইনি। কষ্ট করে টিউশন পড়িয়ে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছি। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম দেখে শিক্ষকরাও অনেক সাহায্য করেছিলেন আমাকে ।

আমাদের দাদী-নাতনী দুজনের ভালোই দিন যাচ্ছিল। হাজারো অভাব-অনটনের মধ্যেও বেশ সুখে ছিলাম আমরা। দাদী তো ছোট থেকে আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী,আমার ছায়া হয়ে ছিলেন। তারপর একদিন হঠাৎ সেই দাদীও আমাকে চিরদিনের জন্য একা করে পাড়ি জমালেন পরপারে ৷ আমার বয়স তখন সবে সতেরো বছর। আমার পরিবার পরিজন বলতে আর কেউ না থাকায় দূরসম্পর্কিয় সেই চাচা লোকজনের কথার মুখে বাধ্য হলেন আমাকে নিজের সাথে নিয়ে আসতে। চাচী আমাকে দেখে অনেক রেগে গিয়েছিলেন সেদিন। পরে চাচা কি বলে চাচীকে বুঝ দিয়েছিলেন আমার তা জানা নেই।

চাচী আমাকে থাকতে দিতে রাজি হলেন। তবে শর্ত একটাই তাদের বাড়িতে ফ্রি ফ্রি থাকা খাওয়া যাবে না। বাড়ির সব কাজ করতে পারলেই আমাকে থাকতে দেওয়া হবে। অতঃপর আমিও বিনাবাক্য ব্যয়ে তাদের শর্ত মেনে নিলাম। না মেনে আর কোনো উপায়ও তো ছিল না আমার। দাদীর মৃত্যুর আগে যে ভাঙ্গা ঘরটাতে আমরা থাকতাম সেই জায়গাটাও গ্রামের মাতব্বরেরা দখল করে নিয়েছে। আমার যে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই । এমতাবস্থায় চাচার বাসায় ছিল আমার শেষ আশ্রয়স্থল।

আমার দূরসম্পর্কিয় চাচার আর্থিক সচ্ছলতা ভালোই ছিল,অর্থসম্পত্তি বিচার বিবেচনা করলে উনাকে মধ্যবিত্তের কাতারে ফেলা যায়। উনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা মোট সাতজন । চাচা-চাচীর তিন সন্তান। বড় ছেলে ইলফাত একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। বছর চারেক আগে ইলমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে এবং বর্তমানে তাদের তিনবছরের একটা ছেলে আছে,নাম ইলাফ । মেঝো ছেলে ইরফাত অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ে । নামেই পড়ে। আদতে ভার্সিটিতে যাওয়ার তার প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাপের টাকা উড়ানো আর লাফাঙ্গাগিরি করা। মেয়েবাজি,জু*য়ার আসর,ম*দের আড্ডার কথা নাহয় নাইবা তুললাম । বাবা-মার অতিরিক্ত আদরে বখে গেলে যা হয়!!

চাচা চাচীর দুই ছেলে বাদেও একটা মেয়ে আছে,নাম ইলাফি। সে আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। যেমন চঞ্চল,তেমনি দুষ্টু। তবে কারো বিপদ দেখলে সাহায্য করতে পিছপা হয় না। স্বভাবসুলভভাবে আমার ক্ষেত্রেও হয়নি । আমিও তার সাহায্যের ঋণী!!

আমি চাচার বাসায় আসার দুতিন দিন পরই ইলফাত ভাইয়া ইলামা ভাবি ও ইলাফকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তারা নিজেরা নিজেদের সংসার গুছাতে চাই। কোনো এক অজানা কারণে ভাইয়ার এমন আলাদা সংসার পাতার জন্য চাচী আমাকে দায় করেন। উঠতে বসতে আমাকে শুনতে হয় উনার 'কুফা' সম্বোধন। চাচী গুরুজন,তাই উনার এহেন সম্বোধনকে আমি প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারতাম না। অতঃপর চুপচাপ শুনে যেতাম ।

এতোকিছুর মধ্যেও আমার জীবনে হাজির হয়েছিল নতুন বিপর্যয় । ইরফাত ভাইয়ার কুনজর পড়েছিল আমার উপর। শুধু যে আমার উপর দৃষ্টি ফেলে তিনি ক্ষান্ত থাকতেন বিষয়টা তেমনটা নয়,মাঝে মাঝে সুযোগ খুজতেন আমার শরীরে বাজে স্পর্শ করার। আমি অনেকবার সাবধান করেছিলাম উনাকে। কিন্তু উনার শোধরানোর কোনো নামই উঠছে না। বিষয়টা অনেকবার চাচীকে জানাতে গিয়েও আমি পিছপা হয়েছি। কারণ আমার জানা আছে। চাচী এবারও দোষটা আমার ঘাড়েই চাপাতেন। হয়তো বলতেন আমিই উনার ছেলের মাথা খেয়েছি। রূপ দেখিয়ে শরীরের লালসায় লালোসিত করেছি!!চারদিক থেকেই আমি অসহায় হয়ে গেলাম। কারো কাছে সাহায্য চাইতে যাবো সেই সুযোগটাও আমার ছিল না।

তারপর এলো সেইদিন যেদিন আমি আমার প্রণয়সিক্ত শুদ্ধ পুরুষটির সাথে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। আমার জীবনের দুঃসময় শুরু হয়েছিল সেদিনের আগের দিন থেকে।

সকালবেলা চাচা-চাচী দুজনই চাচীর এক আত্মীয়ের বিয়েতে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছেন। তাদের সাথে ইলাফিও গিয়েছে। দুপুরের বিয়ে,তাই সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবেন তারা । ইরফাত ভাইয়া তাদের সাথে যাননি । চাচী অনেকবার জোড় করেও ইরফাত ভাইয়াকে বিয়েতে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারেননি। শরীর খারাপের মিথ্যা অজুহাত দিয়ে তিনি বাসাতেই থেকে গেছেন। উনার বিয়েতে যেতে না চাওয়ার কারণ আমি কিছুটা আন্দাজ করলাম । স্বাভাবিকভাবে চাচা-চাচী আর ইলাফি চলে গেলে বাসায় শুধু আমি আর ইরফাত ভাইয়া থাকবো। 

বুঝতে বাকি রইল ইরফাত ভাইয়া মনে মনে এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন । ভয়ে আমার আমার গলা শুকিয়ে আসছিল বার বার। কয়েকঘন্টারই তো ব্যাপার,সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবেন চাচা-চাচী । এইসব ভেবেই নিজেকে নিজে সাহস দিতে শুরু করলাম । বুকের ভেতর কেমন ধুকপুক করছে । চাচা-চাচী বেরোনোর পর আমি থম মেরে বসে রইলাম রান্নাঘরে । একটু পর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেলাম। রান্নাঘর থেকেই গলা উঁচিয়ে দেখে বুঝতে পারলাম ইরফাত ভাইয়া বাইরে গেছেন । উনাকে বাইরে যেতে দেখে যেনো আমি ধরে প্রাণ ফিরে পেলাম। আপনাআপনি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার ভেতর থেকে । আমার ভয়ের রেশ ততোক্ষণে অনেকটা কেটে গেছে। 

তবে তখনই সবটা শেষ হয়ে যায়নি। কথায় আছে না সময় যখন খারাপ হয় দূর্ভাগ্য তখন চারদিক থেকেই আক্রমণ করে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে। দিনের কোলাহল ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে রজনীর নিস্তব্ধতা। সন্ধ্যার আকাশে কালো মেঘেদের ভেলা ভেসে যাচ্ছে বাধাহীনভাবে। ঘন্টা খানেক পর অঝোরে নেমে আসে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে শুরু হয় ভয়াবহ বজ্রপাত। বাড়িতে আমি একা। সন্ধ্যার সময় শেষ হয়ে রাতের প্রহর শুরু হয়ে গিয়েছে অথচ চাচা-চাচী এখনও বাড়ি ফেরেননি। চিন্তায় অস্থির লাগছিল খুব। পরক্ষণেই চাচীর ফোন আসলো। আমি কলটা রিসিভ করতেই তিনি জানালেন বৃষ্টির কারণে উনারা আটকে গেছেন। আজ রাতে আর বাড়ি ফিরবেন না। ফিরলে কাল সকালেই ফিরবেন। চাচী কলটা কাটতেই এক অদ্ভুত আতংক তৈরি হলো আমার মনে। সকালের দমে যাওয়ার ভয়টা আবারও মাথা চারা দিয়ে উঠল। চাচা-চাচী রাতে না ফিরলেও ইরফাত ভাইয়া তো ফিরবেন। মনে মনে আবারও নিজেকে সাহস দিতে শুরু করলাম। সবকিছু বিচার বিবেচনা করে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সিদ্ধান্তটা এই যে ভাইয়া বাসায় ফেরার আগেই আমি আমার যাবতীয় কাজ শেষ করে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বসে থাকবো । 

যেমন ভাবনা তেমন কাজ । আমি কাজ শেষ করে আমার ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলাম। গুটিশুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখজোড়া একটু একটু করে লেগে আসছিল। ঠিক তখনই দরজায় ধাম ধাম শব্দ করে বারি পরতো শুরু হলো। ইরফাত ভাইয়া বাইরে থেকে চিৎকার করছেন,"এই আলোর বাচ্চা,দরজা লাগিয়েছিস কেন?খোল দরজা...জলদি দরজা খোল নয়তো  ভালো হবে না কিন্তু । দরজা খোল বলছি ।"

কথাগুলো বলতে বলতে ইরফাত ভাইয়া দরজায় আরো জোরে জোরে বারি মারতে থাকেন । আমি তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম উনার কথাগুলো। বৃষ্টির কারণে কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে না পারলেও যতোটুকু শুনেছি তাতেই ভয়ে আমার আত্মা বের হয়ে আসছিল। 

ইরফাত ভাইয়ার আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছিল উনি ম*দ খেয়ে মাতাল হয়ে এসেছেন । গলার স্বর কেমন অদ্ভুত শুনাচ্ছিল । 

অনবরত দরজায় বারি মারার কারণে আমি ভয়ে আরো জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডাকতে শুরু করলাম । দোয়া করছিলাম যেন আমার সম্ভ্রম তিনি রক্ষা করেন। ইরফাত ভাইয়া এবার দরজায় লাথি মারতে শুরু করলেন। আগের থেকে দ্বিগুণ গলা উঁচিয়ে বললেন,"ওই মা* দরজা খোল,অনেক নাটক সহ্য করছি তোর। আজকে রাতেই তোর সব নখড়া শেষ করবো। তোর কত তেল সেটা আমিও দেখবো।"

আমি ইরফাত ভাইয়ার কথার কোনো উত্তর করলাম না,আর না তো দরজা খুললাম। আমার গলা কাপছে। ভয়ে হৃদযন্ত্রটা যেনো বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই বিপদের আশঙ্কায় তো সকালে আমার মনে হানা দিয়েছিল। 

"হে উপরওয়ালা,রক্ষা করো আমায়। তোমার এই নিকৃষ্ট বান্দার এতো বড় সর্বনাশ হতে দিও না তুমি ।"

দরজায় বারি পরার শব্দ বন্ধ হলো। বুঝতে পারলাম ইরফাত ভাইয়া ক্লান্ত হয়ে দরজা ধাক্কানো বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি একটা সস্থির নিশ্বাস ফেলে আবারও গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। চোখে ঘুম নেই। ভয়েরা জেঁকে ধরেছে আমারকে।  আর আমি তখনও জানতাম না যে সকালে আমার জন্য এর থেকেও ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে।

আরও পড়ুন: আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-৪

Post a Comment

0 Comments