তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-৩

জীবনের গল্প: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-৩

তোর কাছে মেয়েদের এই ঘড়ি কেনো ইয়াদ?", মায়ের এমন প্রশ্নে ইয়াদ হকচকিয়ে তাকালো। ইয়াদের মা মনোযোগ দিয়ে ঘড়িটা দেখছে। ইয়াদ কিছু বললো না সে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত।

কিরে কিছু জিজ্ঞেস করেছি। কথা বলছিস না কেনো? সব বিয়ের প্রস্তাব কি এই কারণেই ফিরিয়ে দিস?", গম্ভীর গলায় ইয়াদের মা আবার প্রশ্ন করলো।

ইয়াদ ব্যাগ গুছানো বন্ধ করে দুই হাত বুকের কাছে গুঁজে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো," সবসময় বিয়ে বিয়ে করো কেনো মা?"

ইয়াদের প্রশ্নে ইয়াদের মা বললেন," ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে বিয়ে করবো না? নাতি নাতনিদের মুখ না দেখেই মরে যাবো নাকি? সারাদিন একা বাসায় থাকতে তো আর আমার ভালো লাগে না।"

ইয়াদ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে আবার নিজের কাপড় গুছিয়ে নিতে নিতে  বললো," একা কোথায় বাবা তো এখন রিটায়ার্ড করেছে, তোমার সাথেই তো থাকে।"

" তোর বাবা মানুষের কাতারে পড়ে বুঝি? তোর বাবার মতো বেরসিক মানুষের সাথে আবার কথা বলা যায় নাকি। তুই কথা  না ঘুড়িয়ে বল এই ঘড়ি কার। তোর কাছেই বা কেনো? এর আগেও ঘড়িটা দেখেছি এতো বছর ধরে এতো যত্নে রেখেছিস কেনো বলতো?"

ইয়াদ মায়ের কাছ থেকে ঘড়িটা  নিয়ে ব্যাগ এ রাখতে গিয়ে বললো,"  ঘড়ির মালিককে পেলে নিয়ে আসবো তোমার কাছে।" বলে ইয়াদ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

ইয়াদের মা বললেন," খুঁজে পেলে মানে? মেয়েটা কোথায়?"

ইয়াদ ব্যাগের চেইন লাগাতে গিয়ে একটু থমকে গিয়ে বললো," হারিয়ে ফেলেছি মা।"

তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আর হটাৎ ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছিস সেটাও তো বললি না।", মায়ের প্রশ্নের উত্তরে ইয়াদ বললো," তোমাকে না বললাম আজকে  একটা এনজিওর সাহায্যে একটা গ্রামে যাবো সেখানে ফ্রী ট্রিটমেন্ট দিয়ে তারপর কাল রাতে ঢাকায় ফিরবো।"

তুই নাকি নতুন শহরে একটা হসপিটালে জয়েন করেছিস?", ইয়াদ মায়ের প্রশ্নে না সূচক মাথা নেড়ে বললো," নতুন না মা আমার খুব চেনা এক শহর। তুমিও শহরটাকে চিনো।" তখনই ইয়াদের ফোন বেজে উঠল। ইয়াদ ফোনটা টেবিল থেকে তুলে রিসিভ করল।ওপাশ থেকে বললো," স্যার, আমি গাড়ী নিয়ে আপনার বাসার সামনে এসে গেছি।

আচ্ছা, আমার সব গোছানো হয়ে গেছে। আমি আসছি।", বলে ইয়াদ ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে  বললো," মা, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসেছে আমার এক্ষুণি যেতে হবে।"

ইয়াদ সব কিছু রেডি করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে মায়ের কাছে গেলো। ইয়াদের মা আবার প্রশ্ন করলো," বিয়েটা কি তাহলে করছিস না? এই মেয়েকেও না করে দিবো?"

ইয়াদ নিজের মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো," হুম।" ইয়াদের মা আর কিছু বললেন না আজ এতো বছর ধরে তার ছেলে একটা ঘড়ি আগলে রেখেছে। তিনি নিজেও চান সেই মেয়ের সাথেই ইয়াদের বিয়ে হোক যাকে ছেলেটা এতো ভালোবাসে।

ইয়াদ মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করায় ইয়াদ বেশি দেরি করলো না গাড়িতে উঠে রওনা হলো। গ্রামটায় এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেলো। 

গ্রামের ভিতরের কোন জমিদার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, এদিকে নাকি হোটেলের ব্যবস্থা অনেক দূরে। ইয়াদকে যে লোকেশন এ আসতে বলা হয়েছে সেখানে এসে সে দাঁড়িয়ে আছে কিছুক্ষণ হলো। গ্রামের পরিবেশটা ভালোই লাগছে তার। এর মাঝেই ইফতি চলে এসেছে ইয়াদকে নিতে। ইফতি এই এনজিওর একজন সহযোগী।

" স্যার,আপনার কোনো সমস্যা হয় নি তো?", ইফতি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো।

ইয়াদ হেসে না সূচক মাথা নাড়ল। ইফতি ইয়াদের ব্যাগ হাতে নিতে চাইলো ইয়াদ তা দিলো না। লোকটা জোর করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো," আরে আরফিন সাহেব দিন ব্যাগটা। এতক্ষন আসতে অসুবিধা হয় নি এবার হবে। বিশ মিনিট হাঁটার পর খাল পেরিয়ে বড় রাস্তায় গাড়ী পাবো বুঝলেন?"

ইয়াদ ড্রাইভারকে গাড়ী নিয়ে আশেপাশের  কোনো গ্যারেজে বা কোনো খালি ঘরে রাখার ব্যাবস্থা করতে বলেই ইফতির সাথে হাটা ধরলো।

ইফতি কথা বলতে বলতে হাটছে," আরফিন সাহেব আর বইলেন না কেও এই গ্রামে এসে সাহায্য করতে ইচ্ছুক না। আমরা বলেছি টাকা দিবো সেটাতেও কেও রাজি না। আর আপনি তো ফ্রী ট্রিমেন্ট দিতে রাজি হয়ে গেলেন। অনেক কষ্টে তিন জন ডক্টরের ব্যাবস্থা করতে পারলাম।"

কথা বলতে বলতে ইয়াদ আর ইফতি বড় রাস্তায় পৌঁছে একটা রিক্সা ভাড়া করলো। তবে এই রিক্সা গুলো একটু অন্য রকম অনেক জায়গা থাকলেও একটু নিচু। ইয়াদ জমিদার বাড়িতে এসে একটু অবাক হলো। বাড়িটা পুরনো লাগছে তবে ভিতরে যে পরিমাণ হাসাহাসি কথা শুনা যাচ্ছে মনে হচ্ছে জমিদারের নাতি নাতনী পিকনিক করতে এসেছে।

ভিতরে  নয় দশ জনের মতো ছেলে মেয়ে রয়েছে। দেখে সবাইকে ভার্সিটির স্টুডেন্ট বলেই মনে হচ্ছে।

 ইফতি বললো," এরাই হল সব। আমাদের দৌড় তো এনজিও খোলা পর্যন্তই ছিলো। সব ধরনের সাহায্য এরাই করে থাকে বাকি দুজন  ডক্টর এরাই ম্যানেজ করে। আর এই জমিদার বাড়ির সাথে এদের কারোর যোগসূত্র থাকায় সুবিধা হয়েছে। নয়তো থাকার জায়গা নিয়ে বিপাকে পড়ে যেতাম।" কথা বলতে বলতে ইফতি খেয়াল করলো ইয়াদকে ক্লান্ত লাগছে।

ইফতি ম্যাডাম বলে একজনকে ডাকলো। মধ্য বয়সী এক মহিলা এগিয়ে আসলেন।" ম্যাডাম ওনাকে  একটু ওনার ঘরটা দেখিয়ে দিন।"

মহিলা ইয়াদকে ওর ঘর দেখিয়ে দিলো। ইয়াদ যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলো এতো খারাপ না যথেষ্ট ভালো ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ইয়াদ ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে এসে মাকে ফোন করলো। তারপর নিচে নেমে এলো। 

এনজিওর লোকজন একপাশে বসে আছে কিন্তু অল্প বয়সী ছেলমেয়েরা একজন মহিলাকে এনে তাকে দিয়ে চিতই পিঠা আর পাটিসাপটা বানাচ্ছে। ইয়াদের ভিতরে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না সে বাহিরে বের হয়ে এলো। বাড়ির পেছনের নারিকেল বাগানটা খুব সুন্দর লাগছে।

ইয়াদ অনেকদিন পর গএতো গ্রামীণ কোনো জায়গায় এসেছে। যদিও এখন সন্ধ্যা প্রায় তবুও হাঁটতে ভালো লাগছে।ইয়াদ হেঁটে হেঁটে বাগানটা দেখছিল হটাৎ কেউ তাকে পিছন থেকে হাত টেনে সরিয়ে নিলো।ইয়াদ যখন পিছনে ফিরলো তখন চোখে চশমা পড়া একটা মেয়ে তার হাত ধরে  তাকে সরিয়ে এনেছে। ইয়াদ মেয়েটার হাতের দিকে তাকাতেই মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে হাত সরিয়ে নিলো।

তখনই উপর থেকে জোড়ে কোনো কিছু পড়ার শব্দে ইয়াদ পিছনে ফিরলো। গাছ থেকে ডাব পাড়া হচ্ছিলো, মেয়েটা যদি না সরিয়ে আনতো তাহলে ডাবটা ইয়াদের মাথায় পড়তো। ইয়াদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,"ধন্যবাদ।"

মেয়েটা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো," আপনাকে তো চিনলাম না আপনি কি সেই নতুন ডাক্তার?"

ইয়াদ মাথা নাড়ল তবে কিছু বলার আগে আরেকটা মেয়ে অর্নীহা বলে ডাকলো। নামটা শুনে ইয়াদ চোখ বড় করে তাকালো। যেই মেয়েটা তাকে বাঁচিয়েছে তার নাম অর্নিহা। অন্য মেয়েটি এগিয়ে এসে বললো," মাগরিবের আজানের পর জমিদার বাড়ির বাহিরে বের হতে বারণ করেছে। চল যাই আর থাকা ঠিক হবে না। 

অন্য মেয়েটি ইয়াদকে উদ্দেশ্য করে বলল," স্যার আপনিও চলুন।" বলে মেয়ে দুইটি বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

ইয়াদ চুপ করে আছে কারণ টয়ার নাম ছিল অর্ণিহা তাবাসসুম। এই মেয়ে কি কোনো ভাবে টয়া?এমন লম্বা চুল চোখে চশমা এই কয় বছরে এতো পরিবর্তন সত্যিই কি সম্ভব!

"ডক্টর আরফিন আপনি একটা গান ধরুন তো। শুনেছি আপনি অনেক ভালো গান করেন।", সিনিয়র একজনের কথা ইয়াদ ফেলতে পারলো না।  এইরকম এক পরিস্থিতিতে সে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।ছোট বড় সবাই একসাথে মোমবাতি আর চাঁদের আলোয় বসে আড্ডা দিচ্ছে। 

টয়াও সেখানে একপাশে বসে আছে। সে মনোযোগ দিয়ে একটা জোনাকি পোকা দেখছে। হ্যা এই সেই টয়া যাকে সবাই অর্নীহা বলে ডাকে। স্কুলের সার্টিফিকেট থেকে টয়া নামটা বাদ পড়ে যাওয়ায় টয়া নামে শুধূ কাছের মানুষরাই তাকে চেনে। বাকি সবাই তাকে অর্নীহা বলে ডাকে।

ইয়াদকে টয়ার চেনার কথা না কারণ সাত বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। তেমনি টয়া নিজেও বদলেছে। হটাৎ দেখায় একেওপরকে চিনতে পারা মুশকিল।

ইয়াদ একটা গান ধরলো।এই গান গাওয়ার পিছনে ইয়াদের একটা কারন ছিলো। টয়ার অনেক প্রিয় গান ছিলো এইটা।  প্রায় টয়া কাগজে গানের কিছু লাইন লিখে ইয়াদের বারান্দায় ছুঁড়ে মারতো। অনেকবার টয়াকে গুন গুন করে গাইতেও শুনেছে সে। 

গান গাওয়ার সময়,ইয়াদের দৃষ্টি ছিল অর্নিহা নামের সেই মেয়ের দিকে। সে যদি সত্যি টয়া হয় তাহলে তার আচরণেই সবটা বলে দিবে।

সেটাই হলো টয়া একটু অবাক হয়ে তাকালো। অনেকদিন পর আবার এই গানটা তার কানে বাজছে। এই ডাক্তারটাকে দেখে তার মোটেও রোমান্টিক মনে হয় নি যে এমন একটা গান এমনি এমনি গাইবে। লোকটাকে দেখে তো গম্ভীর মেজাজের মানুষ মনে হয়।

টয়া আজ আবার পুরোনো কথাগুলো মনে পড়লো। একসময় এই গানটা সে গুনগুন করে একজনের জন্য গাইতো।

সবাই মনোযোগ দিয়ে ইয়াদের গান শুনলো। গান শেষে সবাই ইয়াদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এর মাঝে ইয়াদ খেয়াল করলো অর্নীহা মানে টয়া উঠে এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ইয়াদের অনুমান কিছুটা সঠিক বলে তার নিজের ধারণা। 

কিন্তু কয়েক বছরে এত পরিবর্তন টয়ার মাঝে যে মেয়ে নিজের চুল নিজে বাঁধতে পারে না সে চুল লম্বা করেছে আবার চোখে চশমা। 

টয়ার চেহারার মায়াবতী ভাবটা চলে গেছে রূপবতী একটা ভাব এসেছে। ইয়াদ যেনো আবার এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছে।

নিচে সবাই হই হুল্লোড় করলেও টয়ার আর ভালো লাগছে না।টয়া  মোমবাতি হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকেই যাচ্ছিলো। 

এতো বড়ো জমিদার হয়ে লাভ হয়েছে কি যদি ঘরে বিদ্যুতের ব্যাবস্থা না থাকে। টয়া বির বির করতে করতে হাটছে। শুধু নামের জমিদার হয়েছে কাজের কাজ কিছুই করে নি। টয়ার ঘর দোতলার গলির শেষ মাথায়। বাড়ির রুম গুলো সারি আকারে একের পর এক। টয়া গলি দিয়ে মোমবাতি নিয়ে হেঁটে যেতেই মনে হচ্ছে কোনো ভুতের মুভির সিন। মোমবাতি হাতে এবার তার রাক্ষসদের সাথে লড়াই করতে হবে।

হটাৎ ভীষণ বাতাস শুরু হলো, জমিদার বাড়ির প্রতিটা জানালা বাতাসের সাথে বাড়ি খাচ্ছে একে অপরের সাথে।বাতাসে মোমবাতির আলোর নিভো নিভো অবস্থা হয়েছে হাত দিয়ে সেটা সামলানো যাচ্ছে না। হুট করে বাতাস বইতে শুরু করেছে কেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাসে মোমবাতি নিভে গেলো। টয়া ঘাবড়ে গেল। সে নিজের রুমে ফোন নিতে যাচ্ছিলো কিন্তু মোমবাতি নিভে যাওয়ায় সে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তার মারাত্মক ভয় হচ্ছে।

নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেও উপায় হলো না চাঁদের আলোর কারণে আরো ভয় লাগছে। এই পুরনো জায়গায় কোথায় কি বাসা বেধে আছে কে জানে। যেদিকে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেও এসে তাকে গিলে খাবে। নিজের জায়গা থেকে এক পা বাড়াতে পারছে না টয়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। এমন সময় কারোর হাঁটার শব্দে বুকের ভিতরটা তার ধুক করে উঠলো। তার আত্মাটা মনে হচ্ছে এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে।

টয়া আর কিছু না বলে একটা চিৎকার দিয়ে পিছনের দিকে দৌড় দিতেই অন্ধকারে ইয়াদের বুকে এসে ধাক্কা খেল। ধাক্কা খেয়ে আরো জোরে চিৎকার করতেই ইয়াদ নিজের ফোনের টর্চটা অন করলো। ইয়াদ বুঝতে পারছে না টয়ার চিৎকারের কারন কি? ইয়াদ কে ভুত ভেবে থাকলে ভূতকে জড়িয়ে ধরে কেনো চিৎকার করবে। টর্চের আলোয় টয়া চোখ খুললো। তারপর ইয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে সরে আসলো। কিন্তু তার ভয় কমেনি তাই ইয়াদের শার্টের হাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। টয়া ভয়ে এমন দৌড় দিয়েছে যে চশমাটা হারিয়ে ফেলেছে। ইয়াদের বুঝতে বাকি নেই এই মেয়েই টয়া কারণ চশমা পরে থাকায় টয়ার চোঁখ স্পষ্ট দেখা যায়নি, মেয়েটার চোখ আর ভ্রুয়ের কাছে দুইটা ছোটো তিল বলে দিচ্ছে এই মেয়েই টয়া।

ইয়াদ আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভয়ার্ত টয়াকে প্রশ্ন করলো," তোমার পুরো নাম কি?" 

এমনিতে ভয়ে টয়ার হাত পা কাপছে। কিন্তু এই লোক কি হয়েছে?ভয় পেয়েছো কেনো? না জিজ্ঞেস করে পুরো নাম জানতে চাইছে। লোকটার কোনো বিবেক বোধ নেই নাকি?

কাপা কাপা গলায় অর্নীহা তাবাসসুম বলে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে টয়া। নাম শুনে ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

টয়ার সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।টয়া খালি এদিকে ওদিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইয়াদ একটু বুদ্ধি খাটিয়ে প্রশ্ন করলো," এতো বড়ো নামে ডাকা যায় নাকি? ডাকনাম বলো।"

টয়া এই লোকটার হাব ভাব বুঝতে পারছে না। কিসব প্রশ্ন করছে লোকটা। ভয়ের চোটে বাড়তি কথা বলার সাহস নেই তার মধ্যে তাও ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে বললো টয়া।

ইয়াদের চোখে মুখে যেনো অন্য রকম খুশি। ইয়াদ একটু হেসে বলল," চিৎকার করছিলে কেনো?"

টয়া যেনো এই প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিল সে গর গর করে বলতে লাগলো। ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে টয়ার কথা শুনছে সব পাল্টালেও টয়ার কথা বলার ভঙ্গি এক রকম আছে।ইয়াদ টয়াকে আসস্ত করে বললো, সে যেটা শুনেছে সেটা ইয়াদের পায়ের আওয়াজ ছিলো নীচে অনেক গন্ডগোল তাই সে উপরে নিজের রুমে যাচ্ছিলো।গন্ডগোলের কারণেই টয়ার চিৎকারের শব্দ কারোর কানে  পৌঁছায় নি।

ইয়াদ আবার প্রশ্ন করলো," তুমি যাচ্ছিলে কোথায়?" প্রশ্নে টয়া ফোন আনতে যাওয়ার কথা বললো। ইয়াদ টর্চের আলো বাড়িয়ে দিয়ে বললো," যাও তাহলে নিজের ফোন নিয়ে আসো।এবার তো জানতে পেরেছো যে ওটা আমি ছিলাম।"

টয়া কাদো কাদো চেহারা করে বললো," আপনি একটু আমার রুম পর্যন্ত যাবেন? একা একা যেতে ভয় লাগছে।"

টয়ার বাচ্চাদের মতন আবদার শুনে ইয়াদ একটু হেসে বলল," আচ্ছা চলো।"

ইয়াদ টয়াকে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিলো টয়া এমন ভাবে হাঁটছে যেনো পিছন থেকে এক্ষুণি কেউ এসে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। রুমে পৌছে টয়া বললো," আপনি একটু লাইটা ধরে দাড়ান। আমি এক্ষুনি ফোনটা নিয়েই বেরিয়ে আসবো।"

ইয়াদ হা সূচক মাথা নাড়ল। টয়া যেনো ট্রেনের বেগে গিয়ে ফোনটা নিয়ে বাইরে এলো। তারপর ইয়াদকে প্রশ্ন করলো," আপনি এখন কি নিচে যাবেন?" ইয়াদ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো," ঠিক বুঝতে পারছি না।"

টয়া হাসো হাসো করে  বললো," বুঝতেই যখন পারছেন না।তাহলে চলুন নিচে যাই। আমিও নিচে যাবো, পরে আবার আপনার ভয় লাগবে একা একা।" বলেই একটা ঢোক গিললো টয়া। 

ইয়াদ একটা ভ্রু তুলে টয়ার দিকে তাকালো নিজের ভয়টা সে ইয়াদের ঘাড়ে দিয়ে দিচ্ছে। নিজের যে একা একা নিচে যেতে ভয় লাগছে সেটা বলতে পারছে না। ইয়াদ ব্যাঙ্গ করে বললো," আসলেই একা একা যেতে গেলে যদি কারোর পায়ের আওয়াজ পাই তখন ভয় লাগবে, চলো একসাথেই যাই।" টয়া হালকা করে মুখ বাকিয়ে তাকালো। কিন্তু তার বলার বা করার আপাদত কিছুই নেই। তাই চুপ থাকাই ভালো। টয়া অন্ধকারে পা বাড়াতেই কোনো কিছুর ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেলো। পা সরিয়ে দেখে  চশমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে সে। চশমাটা হাতে নিয়ে একবার আড় চোখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো," অন্ধকার তো তাই দেখতে পাই নি।"  ইয়াদ ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে মাথা নাড়ল। টয়া মুখ কালো করে হাঁটা শুরু করলো।ইয়াদ টয়ার কাণ্ডে বেশ মজা পাচ্ছে। নিচে চারিদিকে মোম আর হারিকেন জ্বালানো টয়ার মনে হচ্ছে সে আফগানিস্তানের কেনো জঙ্গলে আছে। রাতের বেলা জমিদার বাড়ির বাহিরে চোখ গেলেই শুধু চাঁদের আলো।  আশে পাশে মানুষ কম বলবো কি নেই বললেই চলে। 

ভয় পেয়ে তিনটা মোমবাতি আর দুইটা হারিকেন সাথে নিয়ে বসে আছে সে। টয়ার ফ্রেন্ডরা বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করছে তবে এতে টয়ার মাথা ব্যাথা নেই, হাসুক ওরা। যত হাসি ততো কান্না।ইয়াদ টয়ার থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না।আচ্ছা টয়ার কি ইয়াদকে মনে আছে ? নাকি সত্যি ইয়াদকে ভুলে গেছে।

আমি কি এই সিটে বসতে পারি।" ইয়াদের কথায় টয়া হা করে তাকিয়ে রইলো তারপর কান  থেকে হেডফোন খুলে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিয়ে আবার ইয়াদের দিকে তাকালো। ইয়াদ আবার জিজ্ঞেস করতেই টয়া ইতস্তত বোধ করে হা সূচক মাথা নাড়ল। এইভাবে একজনকে না বলাও যায় না।

এনজিওর গ্রামে ফ্রী ট্রিটমেন্ট দেওয়ার কাজ আজ বিকেল পর্যন্ত গড়িয়েছে। সবাই খেয়ে দেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় বাসে উঠলো। ইয়াদের গাড়ি করে যাবার কথা ছিলো কিন্তু সে ড্রাইভারকে ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিয়ে সেখানে চলে যেতে বললো। সে বাসে করে সবার সাথে যাবে।

 ইয়াদ বাসে উঠেই টয়ার পাশের সিট খালি দেখে অন্য কোথাও বসার চিন্তা করলো না।

টয়া জানালার পাশে বসে গান শুনছিলো সে ইয়াদকে না করেনি কারন কাল রাতে লোকটা তাকে হেল্প করেছে। এভাবে একজন ছেলের সাথে পাশাপাশি বসে যেতে তার কেমন জানি লাগছে। 

ইয়াদ পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করতে গেলে কিন্তু ফোনের সাথেই তার আইডি কার্ড ছিল সেটা নিচে পরে যায়। ইয়াদ তুলতে যাওয়ার আগেই টয়া সেটা তুলে নেয়।

টয়া কার্ডটা ইয়াদের দিকে বাড়িয়ে দিতেই নামটা চোখে পড়লো তার। ইয়াদ আরফিন। এই নামটা তার চেনা লাগছে কেনো এত। ইয়াদ thank you বলে কার্ডটা নিয়ে আবার পকেটে রাখলো। টয়া কিছু বললো না। সে কিছুক্ষণ পর পর ইয়াদের দিকে তাকাচ্ছে। ভালোভাবে তাকানোর পর এবার তার চেহারাটা চেনা চেনা লাগছে। এটা কি করে সম্ভব? এতো বছর পর হটাৎ আজ..!

ইয়াদ কি জানে সে যে টয়া। নাহ্ জানবে কীভাবে নিশ্চয়ই ভুলে গেছে, ভুলে গেলেই ভালো।কিন্তু আসলে কি ভুলে গেছে? কাল রাতেই তো তার পুরো নামটা জিজ্ঞেসই  করেছিলো। তাহলে কি ইয়াদ জানে এই সেই টয়া।

এইগুলো ভেবেই টয়ার অস্থির লাগছে, ইয়াদ আবার তার পাশেই বসে আছে । অনেক কষ্টে যেই দিনগুলো সে ভুলে থেকেছে এতো বছর আজ হটাৎ এক মুহুর্তে সবটা মনে পড়ল তার। 

ইয়াদ কি কাজে ফোন নিয়ে ব্যাস্ত ছিলো টয়া উঠে দাঁড়ালো। ইয়াদ একটু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো, হটাৎ আবার কি হলো? 

টয়া অন্য দিকে তাকিয়ে বললো," আমি বের হবো।" ইয়াদ 

কিছু চিন্তা না করেই টয়াকে বের হবার জায়গা দিতেই টয়া বের হয়ে পিছনে দুই সিট পরে তানিমার পাশে গিয়ে বসলো।

ইয়াদ প্রথমে বুঝলোই না কি হলো? হটাৎ এভাবে উঠে চলে গেলো কেনো?

তখন তার আইডি কার্ডের কথাটা মনে পড়লো, তার মানে টয়া নামটা পড়ে বুঝতে পেরেছে সে যে ইয়াদ। ইয়াদ চোখ বন্ধ করে সীটে মাথা রাখলো। এভাবে উঠে যাওয়ার মানে কি টয়া সেদিনের কথা গুলোর এখনো ভুলেনি। তা না হলে সে এভাবে উঠে যাবে কেনো? 

টয়া তানিমার পাশে বসতেই তানিমা বলে উঠলো," কিরে হ্যান্ডসাম ছেলেটাকে রেখে আমার পাশে আসলি যে? কিছু কি করেছে?"

টয়া শুধু বললো," ঘুম পাচ্ছে। একটু আমাদের লাইটা অফ করে দিতে বলবি?"

ইয়াদ সবটাই খেয়াল করলো এভাবে উঠে চলে যাওয়ায় ইয়াদের রাগ হচ্ছে। সে রাগটা সামলে নিয়ে সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।

রাত সাড়ে দশটার দিকে বিকট এক শব্দে টয়ার ঘুম ভাঙ্গলো। গাড়ির টায়ারের হাওয়া শেষ হয়ে গেছে। এর থেকেও বিরক্তিকর কথা হচ্ছে ড্রাইভারের কাছে এক্সট্রা কোনো টায়ার নেই, টায়ার আনতে নাকি এক ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। কথা শুনে সিনিয়র কিছু মানুষ চেঁচামেচি করতে লাগলো। কিছুক্ষন পরে কোনো মতে পরিবেশ ঠাণ্ডা হলো। সবাই সিদ্ধান্ত নিলো তারা  বাসের বাহিরে গিয়ে দাঁড়াবে এই কিছুক্ষণ। ইয়াদ নিজের সিটে বসে আছে টয়ার অপেক্ষায়,সে কখন নামবে। টয়া উদাস হয়ে বাস থেকে বের হতেই পিছু পিছু ইয়াদও বাস থেকে নেমে আসে।

টয়া অপন মনে ঘুরছে চারিপাশ। আশেপাশে জঙ্গলের মতন জায়গা আছে। বাসের বাকিরা উল্লাস করে রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে চা খাচ্ছে।  এদিকে টয়ার পিছু পিছু ইয়াদও হাঁটছে।

 ইয়াদের মনে হচ্ছে সাত বছর আগের সাথে আজকের অনেক মিল পার্থক্য শুধু আগে টয়া পিছু পিছু আসতো, এখন ইয়াদ পিছু পিছু যাচ্ছে। টয়া নিজের মতো হাঁটতে হাঁটতে হটাৎ তার কানে এলো," ওদিকে জঙ্গল , ওদিকে যাওয়াটা সেফ না।"

হটাৎ আওয়াজেই টয়া লাফিয়ে ওঠে পিছনে তাকালো। পিছনে ইয়াদ দাড়িয়ে, এবার সে চারপাশে তাকাতেই ভয়ে নাজেহাল অবস্থা টয়ার। যেদিকে তাকাচ্ছে চারিদিকে শুধু গাছপালা। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় চলে এসেছে সে নিজেও জানে না। আর টয়ার পিছু পিছু ইয়াদ এসেছে কেনো সেটাও সে বুঝতে পারছেনা। টয়া বুঝতে পারছে না যে কোন বিষয় নিয়ে বেশি বিচলিত হবে এমন ঘন জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া নাকি ইয়াদের তার পিছু পিছু আসা।

ইয়াদ এগিয়ে এসে বললো,"  চলো এখান থেকে, জায়গাটা ভালো মনে হচ্ছে না।" 

টয়ার হাত পা যেনো শীতল হয়ে গেছে। কেনো এমন হচ্ছে? সাত বছরেও কি টয়ার অনুভুতি পাল্টায় নি? সব কেনো আগের মত লাগছে। টয়া সেই দিনগুলোতে আর ফিরে যেতে চায় না অনেক কাদিয়েছে সেই দিনগুলো তাকে। ইয়াদ টয়াকে আবার বললো," চলো।" 

টয়া ভারী গলায় বললো," আমি যাবো না  আপনার সাথে। যেতে হলে একাই যেতে পারবো।"

ইয়াদ কিছুটা চমকালো কিন্তু বুঝতে পারলো যে রাগে কিংবা অভিমানের জন্যই বলছে এসব। ইয়াদ এক হাত পকেটে ভরে বললো," কেনো আমার সাথে গেলে কি আমি তোমাকে গিলে ফেলবো? আর আমার সাথে না যেতে  চাইলে থাকো, একটু পর সিঙ্গেল ভূতেরা পেত্নী খুঁজতে বের হলে তাদের সুবিধাই হবে, হাতের কাছে একটা পেত্নী পেয়ে যাবে।"

ভুত পেত্নীর কথা টয়া সহ্য করতে পারে না। টয়া একটা চিৎকার দিয়ে ইয়াদের আশেপাশে এসে দাড়ালো তারপর মেজাজ দেখিয়ে বললো," আপনি আমাকে পেত্নী বললেন কেনো?" 

ইয়াদ দুই হাত পকেটে ভরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,"এতো কথার উত্তর আমি দিতে পারবো না, ইচ্ছে হলে আমার সাথে এসো না হলে  ভূতেদের জন্য অপেক্ষা করো।"

টয়া ইয়াদের পিছু পিছু হাটছে তার কাছে আর কোনো উপায়ও নেই। কি ধরনের কথা বলছে, সিঙ্গেল ভুত আবার কি? ভূতেরা কি আবার প্রেম করে নাকি? আজই শেষ দেখা এরপর টয়া আর কোনোদিন ইয়াদের মুখোমুখি হতে চায় না।

ইয়াদের পিছু পিছু টয়া রাস্তার পাশের খালি জায়গা যেখানে সবাই আছে সেখানে এলো।

কিছুক্ষণ পর টায়ার নিয়ে লোকটা এসে যায়। টায়ার বদলাতে লোকটার আরো কিছুক্ষণ সময় লাগে এর মাঝে টয়া এক কাপ চা খেয়ে নেয়। টায়ার বদলানো শেষে ড্রাইভার সবাইকে তাড়া দেয় টয়া চায়ের টাকা দিয়ে বাসে উঠবে এমন সময়  ইয়াদ টয়ার সামনে এসে বলে," এখন গিয়ে চুপচাপ আমার পাশের সিটে বসবে।"

টয়ার যেনো মাথার উপরে ভারী কিছু দিয়ে কেউ বাড়ি দিচ্ছে ইয়াদের কথা শুনে তার এমন লাগছে। টয়া কেনো তার পাশে বসতে যাবে, আর এমন হুমকি বা দিচ্ছে কেনো? টয়া আরো রেগে বললো," আমি কেনো আপনার সাথে বসতে যাবো? জীবনেও বসবো না।"

এমন সময়ে গাড়ির কন্ডাক্টার এসে বললো," গাড়িতে উইঠ্যা কথা বইলেন। অহন চলেন, উডেন।" 

ইয়াদ মুখ শক্ত করে টয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, টয়া সেটা গ্রাহ্য না করে বাসে উঠে পড়ল। বাসে উঠে টয়া থ। যে যার সিটে না বসে সবাই ইচ্ছে মতন উল্টা পাল্টা করে বসেছে নিজের মতন। টয়া দেখলো শেষের দুইটা সিট বাদে সবগুলো ভরাট। টয়া ফ্রেন্ডদের উঠে পিছে যেতে বললে তারা বলেছে," তুই দেরী করে উঠেছিস কেনো? যা এবার, পিছনে যা। বাকি রাস্তা  এইভাবে যাবি।"

টয়া ভালোই বুঝতে পড়ছে এই বেয়াদবগুলো ওকে বসতে দিবে না। এর মাঝে ইয়াদ শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে পিছের সিটে এসে বসে পড়লো। টয়া বাধ্য হয়ে ইয়াদের পাশের সীটে গাল ফুলিয়ে বসলো। ইয়াদ বাকা হাসি দিয়ে বললো," আমি যা চাইলাম হলো তো সেটাই।"

ইয়াদের কথায় টয়া রাগ আরো বেড়ে গেছে তার ইচ্ছে করছে গাড়ি থেকে নেমে যায় কিন্তু সেটা সম্ভব না, বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে।

টয়া এতো রাগী হলো কবে ইয়াদ সেটাই বুঝতে পারছে না। তখন থেকে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এমন ভাব করছে যেনো চিরো শত্রুর পাশে বসে আছে। টয়া কানে হেডফোন লাগিয়ে বাসের সীটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। সামনের ছোটো চুল গুলো গালের দুপাশে এসে পড়েছে, কিছুক্ষণ পর পর চুলগুলো উড়ে টয়ার মুখে পড়ছে। ইয়াদ বিস্ময় নিয়ে টয়াকে দেখছে। হটাৎ করে এভাবে মেয়েটার সাথে তার দেখা হয়ে যাবে এটা সে ভাবেনি। 

টয়া ঘুমে কাহিল সে অন্য পাশে মাথা রেখেছে। ইয়াদ ভেবেছিলো মাথাটা ঠিক করে দিবে, হাত বাড়ালো কিন্তু সে সেটা করলো না। উপকার করতে গিয়ে ঘুম ভেঙে ফেললে মহারানী আবার তেলে বেগুনে রেগে উঠবে। টয়া নিজে নিজে ঘাড় সোজা করেলো। তারপর চোখ খুলতেই দেখলো ইয়াদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। টয়া বিরক্তি চোখে তাকালো কিন্তু ইয়াদ চোখ সরালো না। আরো এমন ভাবে তাকিয়ে থাকলো যেনো টয়ার দিকে তাকিয়ে থাকার অধিকার আছে তার। 

টয়া কিছু বলার আগেই বাস থামলো। সবাই বাস থেকে নামতে শুরু করেছে। টয়া আর ইয়াদ দুজনেই নেমে পড়লো। 

ইয়াদ অবাক হয়ে শহরটা দেখছে। অনেক কিছু বদলেছে  কিন্তু আকাশটা আজও সেদিনের মতন তারায় ভরা। ইয়াদ কিছুক্ষণ  এদিকে ওদিকে তাকিয়ে চারিপাশ দেখছিল এর মাঝে টয়া একটা রিক্সায় উঠে চলে গেলো।  ইয়াদ পরে আর টয়াকে আশে পাশে দেখলো না। মেয়েটা হটাৎ করে আবার উধাও হয়ে গেছে। দুই জনে নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা হলো।

টয়ার ভার্সিটির ফাইনাল বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখার পাশাপাশি টয়া একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। একটা অফিসে পার্ট টাইম জব করছে। টয়ার পুরো ফ্ল্যাট এর সব ওয়ালম্যাট টয়ার নিজের ডিজাইন করা। নিজের রুমটা মনের মত করে সাজিয়েছে সে। টয়া আর ঋতু মিলে ফ্ল্যাটটায় থাকে। ঋতু টয়ার সাথেই পড়ে, তবে বেশির ভাগ সময় ঋতু ঘুড়ে বেড়িয়ে কাটায়। তাই পুরো ফ্ল্যাট এ তার একাই থাকতে হয়। বাবা মা গ্রামে চলে গেছে, তারা এখন সেখানেই নাকি থাকতে চায়। টয়ার পড়ুয়া ভাই বিয়ে করে বড়ো ভাইয়ার কাছে চলে গেছে। 

টয়া একাই এই শহরে আছে দু বছর ধরে। এই ফ্ল্যাটটা  তার বড়ো ভাইয়ের দেওয়া। টয়া চাইলে তাদের পাঁচতলা বাসাটায় থাকতে পারতো কিন্তু ওই বাসায় একা থাকতে তার ভালো লাগে না। বারো তলা বিল্ডিংটার এগারো তলায় থাকছে টয়া।

বাসাটা অনেক সুন্দর দুইটা রুম, ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন আর সবচেয়ে ভালো লেগেছে করিডরটা। উপরে তাকালেই তারায় ভরা আকাশটা দেখা যায়। টয়ার আজ কিছু ডিজাইন জমা দিতে হবে। 

এমনেই সে লেট করে ফেলেছে। তাই জলদি ডিজাইন গুলো নিয়ে সে লিফটে দাড়ালো। লিফটটা বন্ধ হয়ে আসতেই একজন হাত দেওয়ায় দরজাটা খুলে যায়। ফরমাল ড্রেসে একজন লিফটে উঠলো। কালো প্যান্ট , সাদা শার্ট , হাতে সিলভার কালারের ঘড়ি। টয়া নিজের ডিজাইন গুলো গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত তাই সে লোকটাকে খেয়াল করেনি।এতক্ষন ডিজাইনগুলো ধরে রাখতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে সবগুলো  এলো মেলো লিফটে হয়ে পরে যায়। 

টয়া বিরক্তি নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর মাথা তুলতেই বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো কারণ সামনে ইয়াদ দাড়িয়ে আছে। তারা দুজনেই বিস্ময় নিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইয়াদ দুদিন ধরে যাকে খুজে বেড়াচ্ছে সে কিনা তার সাথে একই বিল্ডিং এ আছে। ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঘাড় কাত করে হেসে ফেললো। টয়া একটা ঢোক গিলে ডিজাইন গুলো তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। ইয়াদ কিছু ডিজাইন তুলে নিয়ে দেখতে লাগলো, ডিজাইন গুলো দেখে বুঝতে দেরী হলো না যে টয়া একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার।

ইয়াদ কিছুক্ষণ সেগুলো দেখে তারপর বললো," বাহ্ , impressive!"

এর মাঝে টয়ার ডিজাইন গুলো তোলা শেষ। সে উঠে দাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে ইয়াদের হাত থেকে বাকিগুলো  টান দিয়ে নিয়ে নেয়।

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো," কি সমস্যা তোমার? "

টয়া বিরক্তি নিয়ে বললো," বুঝলাম আপনি ডক্টর তার মানে এই না যে সবসময় জিজ্ঞেস করে বেড়াবেন কি সমস্যা। কি সমস্যা। আমার সমস্যা থাকলেও সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।"

টয়ার কথা শেষ হতেই লিফট নিচে নেমে দরজা খুলে দিলো। টয়া বেড়িয়ে যাচ্ছিলো ইয়াদ টয়ার হাত ধরে অন্য হাতে আবার লিফটের ১০ বাটনে প্রেস করলো। টয়ার চোখ রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো। ইয়াদ টয়ার হাত ধরে টেনে লিফটের দেওয়ালে সাথে দাড় করালো। টয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। কি হয়েছে এই ছেলের? টয়া দাতে দাঁত চিপে বললো," কি করলেন এটা আপনি? আবার কেনো উপরে যাচ্ছি আমরা?"

ইয়াদ টয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের পকেটে হাত ভরে বললো," আমার ঘড়ি লাগবে তাই।" টয়া ভালোভাবেই দেখতে পারছে ইয়াদের হাতে ঘড়ি আছে তাহলে. আবার ঘড়ি লাগবে কেনো..? 

টয়া কটাক্ষ করে বললো," আপনার কি চোখে সমস্যা? নাকি দুই হাতে দুটো ঘড়ি পড়বেন?"

ইয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো," কালারটা ভালো লাগছে না। তাই চেঞ্জ করবো।"

এই কথা শুনে যেনো টয়ার মাথা আরো গরম হয়ে গেল। সামান্য একটা ঘড়ি বদলাতে উপরে উঠছেন তিনি। ভেবেই রাগে গা জ্বলছে। টয়া রাগ চেপে বললো," দেখুন আপনার কাছে অফুরন্ত সময় থাকতে পারে কিন্তু আমার কাছে নেই। আমার এগুলো অফিসে জমা দিয়ে আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।"

ইয়াদ লিফটের দেওয়ালে হেলান দিয়ে প্রশ্ন করলো," সমস্যাটা তাহলে কার?" 

টয়া রেগে গিয়ে বলল," অবশ্যই আমার সমস্যা।"

ইয়াদ বললো," তোমার সমস্যা নিয়ে আমি কেনো ভাববো? একটু আগেই তো বললে তোমার সমস্যা নিয়ে আমার ভাবনার  দরকার নেই।" 

রাগে টয়ার গা জ্বলে যাচ্ছে। টয়া ওই কথা বলেছে বলে এভাবে বদলা নিচ্ছে তো, ঠিক আছে। সুযোগ পেলে টয়াও ছেড়ে কথা বলবে না। টয়া অপেক্ষা করে আছে কখন ইয়াদ লিফট থেকে বের হবে ঘড়ির জন্য। একবার বের হলেই টয়া বাঁচে। লিফট এসে ফ্লোরে থামলো কিন্তু ইয়াদ বের হচ্ছে না, এটা দেখে টয়ার আরো রাগ হচ্ছে। " কি ব্যাপার? যাচ্ছেন না কেনো আপনি?"

 টয়ার প্রশ্নে ইয়াদ বললো," না ঘড়িটা ভালোই লাগছে এখন। বদলানোর প্রয়োজন নেই, চলো নিচেই যাওয়া যাক।" বলে আড় চোখে টয়ার দিকে তাকিয়ে বাটন প্রেস করলো।

টয়ার রাগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে সে রোলার কোস্টারে উঠেছে, একবার উপরে আবার নিচে অসহ্য লাগছে। এই ছেলেটা আর কোনো বাসা পেলো না? ঢাকা শহরে কি বাড়ির অভাব পড়েছে?  যত দূরে দূরে সরে থাকতে চাইছে টয়া ততবার কাছে চলে আসছে ইয়াদ।

লিফটটা নীচে এসে থামতেই টয়া দৌড়ে বেড়িয়ে এলো। মনে হচ্ছে যেনো পিছনে ডাকাতরা ধাওয়া করেছে। ইয়াদ একটু হেসে লিফট থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর ইয়াদ নিজের গাড়িতে উঠে বসলো,

টয়া আজ এমনিতেই দেরী করে ফেলেছে। ভার্সিটিতে আবার শয়তান নিরবটা আবার এসে হাজির। এই ছেলেটা কি  চাইছে টয়া বুঝতে পারছে না। টয়া এড়িয়ে যেতে চাইলো নিরব এসে হাত ধরে ফেললো।

টয়া হাত ছাড়িয়ে বললো," দেখ আমার ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। একদম জ্বালাবি না এখন।"

নিরব টয়ার দিকে রেগে বললো,"তোকে কতবার ফোন করেছি কোনো খেয়াল আছে?এনজিও থেকে ফিরে এসে দেখাও তো করলি  না।"

টয়া রেগে বলল," দেখ, নিরব আমি এখন ক্লাস এ যাবো।"

নিরব কপাল কুচকে বললো," আচ্ছা বাবা যা। আমি বাহিরে ওয়াইট করছি ।"

টয়া হাতের ইশারায় নিরবকে থাকতে বলে ক্লাসের দিকে গেলো। টয়ার ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরব বসে রইলো ক্যান্টিনে। টয়ার ক্লাস শেষে টয়া এসে নিরবকে হাত ধরে টেনে দাড় করালো। নিরব দাড়াতে দাড়াতে বললো," আবার কি হলো? শেষ তোর ক্লাস?" 

টয়া তাড়া দিয়ে বললো," হুম, চল এবার আমায় বাসায় দিয়ে আসবি।" 

নিরব না সূচক মাথা নেড়ে বললো," এতো তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে কেনো? আমার তোর সাথে কথা আছে। আর এমনিতেই তোর বাসায় যাওয়া আমার জন্য নিষেধ করেছিস। তুই কুমারী মেয়ে , ফুলের মত পবিত্র ব্লা ব্লা.......  । তুই  তো বাহির থেকেই তাড়িয়ে দিস। তাই তুই আমার সাথে থাকবি কিছুক্ষণ।" বলেই নিরব আবার বসে পড়ল।

টয়া নিরবের শার্ট টেনে বললো," উঠ এখান থেকে। গাড়ীতে যেতে যেতে কথা বলবো।চল।" 

নিরব উঠে দাড়ালো এই মেয়ে নাছোড় বান্দা। নিরব একটা ট্যাক্সি ডাকলো।ট্যাক্সি ফ্ল্যাটের সামনে এসে থামতেই টয়া আর নিরব নেমে যায়। নিরব বিরক্তি নিয়ে বলে," যা বাসায় যা।" 

টয়া সেদিকেই যাচ্ছিলো হটাৎ মনে হলো এবারও  যদি লিফটে ইয়াদ থাকে। ভেবেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। টয়া তাই নিরবের কাছে এলো। 

নিরব ভ্রু কুঁচকে বললো," আমাকে তোর ফ্ল্যাটে যেতে তো বলবি না তাহলে আবার ফিরে এলি যে।"

টয়া আমতা আমতা করে বলল," আমাকে একটু লিফট করে বাসার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিবি।" 

নিরব কথাটা শুনে হাসি থামাতে পারলো না। টয়া মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে। নিরব হাসি থামিয়ে বললো," লিফটে ভুত দেখেছিস নাকি আবার?" 

নিরবের কথায় টয়া বির বির করে বললো," ভুত না রাক্ষস।" তারপর নিরবকে টেনে নিয়ে গেলো নিজের সাথে।

লিফটে ইয়াদ ছিলো না। টয়া শান্তির নিশ্বাস ফেললো। তারপর লিফট থেকে বেরিয়ে যেই নিজের ফ্ল্যাটের সামনে যাবে তখনই দেখলো ইয়াদ ঠিক তার অপজিট ফ্ল্যাটের সামনে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে আর দরজা খুলছে। এটাই হবার বাকি ছিলো। টয়া নিরবকে যেতে বলেই পা বড় বড় পা ফেলে নিজের ফ্ল্যাটের সামনে গেলো। ইয়াদ খেয়াল না করলেই সে বাঁচে। ইয়াদ ফোনে ব্যাস্ত, টয়া এর ফাঁকে দরজা খুলে ফেললো। তারপর দরজা আটকে ফেললার আগে আবার নিরবকে যেতে বললো।

নিরব বলে উঠলো," তুই ভিতরে গিয়ে দরজা বন্ধ কর তারপর যাবো।"

নিরব ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিরবের কথায় ইয়াদ পিছে ফিরতেই টয়াকে দেখলো। টয়া সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে দিল। ইয়াদের চোখ গেলো এবার নিরবের দিকে, টয়া কার সাথে এতক্ষন ছিলো। ইয়াদ কান থেকে ফোন নামিয়ে কলটা কেটে ফোনটা পকেটে রেখে দিল। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে নিরবের দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিরব কি ভেবে ইয়াদের দিকে এগিয়ে বললো," এই ফ্ল্যাটটায় আপনি থাকেন?"

 ইয়াদের এমনেই মেজাজ খারাপ নিরবকে দেখে তাই সে কিছু বলল না। ইয়াদকে চুপ থাকতে দেখে নিরব খুশি হয়। সে ধরেই নেয় এই ছেলেটা বোকা রকমের হয়তো। তাই নিরব নিজে থেকেই একটু হুমকির মতো দিয়ে বললো," এই ফ্ল্যাটে আমার গার্লফ্রেন্ড থাকে, বুঝলেন?"

আরও পড়ুন: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-৪

Post a Comment

0 Comments