একই পথের বিপরীত সঙ্গী|ঈশিতা রায়|পর্ব-১

ভালবাসার গল্প: একই পথের বিপরীত সঙ্গী|ঈশিতা রায়|পর্ব-১

নয় ছরের  এক মেয়ে কে বিয়ে করে যে মানুষটা পাড়ি জমিয়েছিল বিদেশে, সেই মানুষটা দশ বছর পরে ফিরল তার বিবাহিত স্ত্রী নিয়ে। অর্থাৎ আমার সতিন।


কি আশ্চর্য!যার জন্য এত বছর ধরে মুখ বুজে সব সহ্য করে একা একা সংসার করলাম এই ভেবে যে হয়ত এই একার সংসার দোকা তে পরিণত হবে কিন্তু আফসোস। নিজের নিয়তির ওপর হাসলাম।  হাসি মুখে সতীন আর বর কে বরণ করে ঘরে তুললাম। আমার ননদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল 

এটা কি করছ বৌমণি? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? সতীন করি বরণ করে ঘরে তুলছ?

কোনো কথা বললাম না আর। শাশুড়ি মা কে ভীষণ খুশি দেখাল। দেখাবে নাই বা কেন? ফর্সা বিদেশি সুন্দরী বউমা পেয়েছেন যে। আমার গা এর রঙ চাপা,দেখতে অতটা ভালো না। শাশুড়ি আমাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতেন না। শ্বশুর মশাই মারা গেছেন দু বছর হল। তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন ।তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এই স্বামী নামক কলঙ্ক টাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিতেন। আমার অভিব্যক্তি শূন্য। বিদেশি রমণীর দিকে তাকালাম। সত্যিই মেয়ে টা ভীষণ সুন্দর। বাদামি চুল এর সাথে ফর্সা উজ্জ্বল গা এর রঙ বেশ মানাসই। তার পাশে বেশ লম্বা বলিষ্ঠ দেহ নিয়ে আমার স্বামী দাঁড়িয়ে আছে অরূপ চৌধুরী। শাশুড়ি মা বেশ আপ্যায়ন করে ঝরে তুলছে বসালেন। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম।বুঝলাম এই বাড়িতে আমার সময় শেষ হয়ে আসছে।আমার এই মুহুর্তে এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়া উচিত।

সময় ব্যয় করলাম না আর।  চলে গেলাম ঘরে যে ঘরটায় এতদিন ধরে সংসার করার স্বপ্ন বুনেছিলাম। সেই স্বপ্ন এক নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে থাকল। সব কিছু গুছিয়ে নীচে নামলাম। আমার ননদ ইচ্ছা আমার হাতে ব্যাগপত্র দেখে বলল,

কোথায় যাচ্ছ তুমি বৌমণি? এভাবে ছেড়ে চলে যাবে আমাদের?

মৃদু হাসলাম।এতদিন যে আত্মসম্মান বোধ আমার নুইয়ে ছিল সেটা জ্বলজ্বল করে উঠল প্রখর ভাবে। বললাম

থেকেই বা কি করব ইচ্ছা? এক বিশ্বাস ঘাতকের নতুন সংসার দেখব?

তাচ্ছিল্যের সুর টা কানে বাধল অরূপের। খানিকটা রাগী স্বরে বলল 

দেখো ইরা আমাদের যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমাদের বিয়ের বয়স ছিল না।বিয়ে টা ছিল অবৈধ আর ঐ বিয়ে আমি মানি না..

আমি তো মানতাম। 

তোমার মানা না মানা নিয়ে আমার কোনো যায় আসে না। আমার বর্তমানে একজন স্ত্রী আর সেটা হল লিজা। যাকে আমি ভালোবাসি। দুদিন পরে ধুমধাম করে রিসেপশন করব।আর হ্যাঁ তোমাকে নিমন্ত্রণ করলাম। খেতে চলে এসো কেমন? 

অপমানে গা জ্বলে উঠল আমার। দৃঢ় কন্ঠে বললাম

আমার ভাবতেই ঘৃণা ধরছে যে আপনার মতো ফালতু মানুষের জন্য আমি স্ত্রী হয়ে দশ বছর একা একা সংসার করে থেকেছি। নির্লজ্জ বিবেকহীন আপনি,

আমার থেকেও তুমি বড়ো নির্লজ্জ যে লোকের কথায় এক অচেনা মানুষকে বিয়ে করে ফেলে। অন্যের গলায় ঝুলতে দু সেকেন্ড ভাবে না। আমি তোমাকে আগেই বারণ করেছিলাম আমার তোমার ওপর কোনো ইন্টারেস্ট নেই আর না তো আমি বিয়ে করতে চাই কিন্তু তুমি আমার বাবার এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলে। তুমি ঐ দিন না বললে  আমার বাবা কখনোই তোমার সাথে আমার বিয়ে দিত না।

শাশুড়ি এবার মাঝখান থেকে বললেন,

আহহ বাবু আর কথা বলিস না। এই অলক্ষী বিদেয় হোক দিলেই মঙ্গল। এই যে অলক্ষ্মী  যাও অনেক অন্ন নষ্ট করেছ যাও তো এবার। জঞ্জাল দূর হোক।

ইচ্ছা বিরোধ করে বলল,

মা এইসব কি ধরনের কথা? বৌমণি এখানে শুয়ে বসে কিন্তু দিন কাটায় নি।তুমি তাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছ।

মা এর মুখে মুখে তর্ক করিস না ইচ্ছা।

বড় ভাই এর ধমকে  ইচ্ছা আর কিছু বলতে গিয়েও আমি থামিয়ে দিলাম। মৃদু হেসে বললাম 

তুমি কিছু বলো না আর ইচ্ছা। সময় বলে দেবে তাদের আমার হয়ে।তুমি ভালো থেকো কেমন? একদম মন খারাপ করবে না। যখন করে আমার কথা মনে পড়বে আমাকে কল করবে।

ইচ্ছা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।লিজা এতক্ষণ ধরে সব দেখছিল। একটা সময় গিয়ে বিরক্ত স্বরে বিড়বিড় করল "মেলোড্রামা"

শাশুড়ি পাছে বললেন,

ঢং যতসব। এত তেজ আসে কোথা থেকে?

অরূপ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, 

রূপ নেই গুণ নেই অথচ অহংকার আকাশ সমান।

আমি মুচকি হেসে বললাম!

আপনাকে সৃষ্টিকর্তা রূপ দিয়েছে ,গুণ দিয়েছ কিন্তু আফসোস একটা ভালো মন দিতে পারে নি।মনটা আপনার বড্ড কুত্সিত। আর হ্যাঁ ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেব সাইন করে দেবেন।আপনার মুখ আর ভবিষ্যতে দেখতে চাই না।

অরূপ ক্রোধিত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল।আমি হেসে বেরিয়ে পড়লাম। জানি না কোথায় যাব? আমার গন্তব্য কোথায়? কি করব? কিন্তু এতটুকু জেদ ছিল যে আর,পেছনে মুড়ে তাকাব না। অজানা ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালাম। আমার কাছে টাকা আছে অল্প পরিমাণে। ভাবলাম এই শহরে আর থাকব না।শহরের হাওয়া গা এর লাগলে গা আমার ঝলসে যাবে।বিচ্ছিরি স্মৃতি সব উঁকি পাড়বে আমি চাই না দুর্বল হতে তাই স্টেশনে এসে টিকিট কেটে উঠে পড়লাম ট্রেনে।জানি না এই ট্রেন কোথায় যাচ্ছে শুধু এই টুকু জানি যেখানেই নিয়ে চলুক অন্তত এই শহরের আবহাওয়া থেকে যেন নিস্তার পাই।

কোনোরকম একটা সিট পেয়ে বসে পড়লাম। ভীষণ গরম লাগছিল তাই চুল গুলো খোপা করে বেঁধে নিলাম। এরপর জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম বাইরে।ট্রেন এখনো ছাড়েনি।  তবে ছাড়তে বেশি দেরি নেই।  আমার বয়স এখন উনিশের কোঠায়। আমার বিয়ে যখন হয়েছিল তখন ন বছর বয়স ছিলাম আর আমার স্বামী এর ছিল কুড়ি।

 হঠাত করেই ট্রেন ছেড়ে দিল। প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে ট্রেন ছাড়ছে। আমি বাইরে চেয়ে রইলাম মাথা ঠেকিয়ে।হঠাত্ করেই একজনের ওপর চোখ আটকে গেল আমার।বড্ড বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম।ট্রেন ছেড়ে দিতেই মানুষটা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ছুটতে লাগল। ট্রেন তখন গতি নিয়ে নিয়েছে। মানুষটা জোরে ছুটতে লাগল ট্রেনটা ধরার জন্য।

আরও পড়ুন: একই পথের বিপরীত সঙ্গী|ঈশিতা রায়|পর্ব-২

Post a Comment

0 Comments