রূপকথার শহর! (পর্ব-৩)| নবনী নীলা

 ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর!

পর্ব-৩

নবনী নীলা

ইশা নিচের ঠোঁট কামরে বলল, “ বলেছে শাড়ি খুলতে, সে নাকি দেখবে। কি রকম অসভ্য ভেবে দেখো ?”



জেবুন্নেসা হো হো হেসে উঠলেন। ইশা অবাক হয়ে তার দাদির হাসি দেখছে। “ এই বুড়ি হাসছো কেনো?”


“ বিয়ের পর তো এমনিতেই দেখাতে হবে, সেই জন্যে আগেই দেখতে চেয়েছে।”, বলেই আবার হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি।


“ ইস! বিয়ে করছে কে ওই বদরাগীকে? শুধু কি বদরাগী? অসভ্য একটা।”, বলেই দাদীর পেটে আস্তে করে একটা গুতা দিতেই দুইজনেই হেসে ফেললো।


পরের দিন,


আরহান ক্লাসে উপস্থিত হলো। নেইভি ব্লু শার্ট আর গ্রে কালার প্যান্টে তাকে দারুন লাগছে। বদরাগী হলে কি হবে? আর বাকি সব দিকে যেনো লোকটা যেনো পারফেক্ট। ইশা আবারো হা করে তাকিয়ে আছে। 


মেয়ে মানুষ সুন্দর হলে মানা যায় , কিন্তু ছেলে মানুষ কেনো এতো সুন্দর হবে? 


 ইশা কয়েকবার চোখের পলক ফেলে অন্য দিকে তাকালো। বাহ! ক্লাসের সব মেয়ের তাহলে এক অবস্থা। ইশা ভ্রু কুচকে আবার আরহানের দিকে তাঁকালো। আরহান প্রজেক্টরে ক্লাস করাতে ব্যাস্ত। 


ইশার পাশে থেকে নাইমা ফিস ফিস করে বলল,” উফ। স্যারটা কি হ্যান্ডসাম দেখ। লোকটাকে একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”


ইশা আড় চোখে নাইমার দিকে তাকিয়ে বলল,“ চুপ।”


“ শুনেছি তুই নাকি ওনার গায়ে চা ছুঁড়ে মেরেছিস?” বলেই নাইমা একটা বাকা হাসি দিলো। 


“ চুপ করবি তুই?”, ইশা কড়া চোখে তাকালো নাঈমার দিকে, তাকাতেই নাইমা মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো।


তখনই আরহান তার হাতে থাকা মার্কার দিয়ে পয়েন্ট করে বলল, “ রোল একশ এগারো।” 


নিজের রোল কর্নপাত হতেই ইশার বুকটা ধুক করে উঠলো। ইশা দাঁড়িয়ে পড়লো। আরহান সিঁড়ি বেয়ে তার বেঞ্চের সামনে এসে ইশার দিকে তাঁকালো। এই মেয়েটা যেখানে যায় সেখানে সমস্যা করে।


সামনের বেঞ্চে বসা মেয়ে গুলো পিছনে ঘুরে আরহানকে দেখছে। আরহান বুকের কাছে হাত গুজে প্রশ্ন করলো, “ কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো?”


ইশা চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে একটি বারের জন্যও আরহানের দিকে তাকাচ্ছে না।


ইশা প্রতি উত্তরে কিছু না বলায় আরহান ভ্রু কুঁচকে বললো,” "Get out of my class.I will not tolerate any kind of disturbance. Anyone who wants to talk instead of learning—leave now." 


বলতে বলতে আরহান নিজের ডেস্কের সামনে চলে গেলো। ইশা বিরক্তি নিয়ে আরহানের চলে যাওয়া দেখছে। কথা কি সে একা বলেছে? পাশের যে ডাইনি লোকটাকে খেতে চাইলো তাকে তো কিছুই বলল না। ইশাও নিজের ব্যাগ নিয়ে আরহানের সামনে দিয়ে হনহনিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলো।


আরহান ভ্রু কুঁচকে ইশার চলে যাওয়া দেখলো। তারপর মনে মনে বলল “ স্টুপিড”।


এরপর থেকে কোনো এক কারণে প্রতিদিনই আরহান ইশাকে ক্লাস চলাকালীন রুম থেকে বের করে দিচ্ছে। স্যার মানুষ দেখে ইশা কিছু বলতেও পারছে না। দাঁতে দাঁত চিপে রাগে গজ গজ করতে সে বেরিয়ে যায়। লোকটা একেকদিন একেক অজুহাত দিয়ে সমানে তাকে ক্লাস থেকে বহিস্কার করছে। আজকেও তাই হলো, ইশা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই আমিনুল সাহেবের সামনে পড়ে গেলো।


আমিনুল সাহেব রাউন্ডে বেরিয়েছিল। ইশাকে বের হতে যেতে দেখে তিনি চোখ গরম করে বললেন,” ক্লাস না করে কোথায় যাচ্ছো? জলদি ক্লাসে যাও।”

 

ইশা অভিযোগ করার আগেই আরহান ব্যাপারটা খেয়াল করে সাথে সাথেই ইশাকে ডাকলো, “ একশ এগারো ”


ইশা দাঁতে দাঁত চিপে আরহানের দিকে তাকালো। একশ এগারো কি? তার কি কোনো নাম নেই। সারাদিন শুধু একশো এগারো, একশো এগারো। কি যে করতে মন চাইছে এই লোকটাকে!!


“ ভিতরে আসো।”, 


ইশা ভিতরে এসে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো।


আরহান একদম তার সামনে থাকা টেবিলের দিকে ইশারা করলো। ইশা বুঝতে না পেরে পাল্টা ঈশারা করে বলল, “কি?”


“ এইখানে বসো।”, আরহান ধমক দিতেই ইশা চুপ করে সামনের বেঞ্চে বসে পড়লো। একদম টিচারের মুখের সামনে হওয়ায় এই বেঞ্চে সাধারনত কোন স্টুডেন্ট বসে না। ইশার মনে হচ্ছে আরহানকে কেউ ৩x জুম করে তার মুখের সামনে ধরে রেখেছে। ইশা বাইরে তাকিয়ে দেখলো আমিনুল সাহেবও নেই।


ইশা নিজের  ফাঁকা খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। এই বৃহৎ লোকটা তার সামনে দাড়িয়ে থাকলে সে লিখবেটা কি? ইশা আড় চোখে একবার আরহানের দিকে তাঁকালো। আরহানের দৃষ্টি তার দিকে স্থির।


“ কি ব্যাপার। এটা না আমি গতকাল সলভ করে দিলাম?”,


“ গতকাল তো খুব আপনি আমাকে ক্লাস করতে দিয়েছিলেন?”, ইশা দাঁতে দাঁত চিপে আস্তে করে বললো।


আরহানের কপালের ভাজ দূর হয়ে গেলো। সে ভাঙবে কিন্ত মচকাবে না। 


“ এটা তো বেসিক প্রবলেম। এটা সলভ করতে পারছো না! তুমি কি চা ছুঁড়ে মারা, অজ্ঞান হবার নাটক ছাড়া কিছুই পারো না?”, বলতে বলতে আরহান ঝুকে এসে ইশার হাত থেকে কলম নিয়ে নিতেই ইশা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকালো।


 “ শুধু চা না। আরো অনেক কিছু ছুঁড়ে মারতে পারি।”, ইশা বির বির করলো। 


“ Shut up.”, আরহানের ধমকে ইশা আড় চোখে তাকালো।

 

ইশা প্রতি উত্তরে কিছু বলল না। আরহান ইশার খাতায় প্রবলেম সলভ করে দিতে দিতে বলল, “ এখন থেকে আমার ক্লাস করতে চাইলে এই বেঞ্চে বসবে। আমার ঠিক সামনে। আর যদি আমি তোমাকে পিছনে বসতে দেখি, তাহলে…”, আরহান বলে শেষ না করতেই ইশা আনমনে বলে উঠলো, “Get out?”


আরহান ইশার দিকে তাকিয়ে বলল, “ exactly,” বলেই আরহান উঠে দাড়ালো।


ক্লাস শেষে ইশা বেরিয়ে যাবে এমন সময় নাইমা তার সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লো। ইশা বিরক্ত হয়ে তাকালো। আবার কি চায় এই মেয়ে? নাইমা টান দিয়ে ইশার হাতে থাকা কলমটি নিয়ে যেতে যেতে বলল, “এটা আমি নিয়ে গেলাম।”


ইশা হা করে তাকিয়ে আছে। এটা কি হলো? আশ্চর্য!


 একপাশ থেকে নেহা বলল, “ ও কলমটা কেনো নিয়ে গেলো বুঝেছিস?”


ইশা না সূচক মাথা নাড়ল।


কলম নিয়ে যাওয়ার কারণটা ইশা পরের দিন ঠিকই বুঝলো। আরহান ইশাকে যেই বেঞ্চে বসতে বলেছিল নাইমা আগে এসে সেই জায়গা দখল করে বসে আছে। স্কুল কলেজের মেয়েরা এমন করলে মানা যায় কিন্তু ভার্সিটিতে! মনে হয় ডাইনিটা নির্লজ্জ লোকটার প্রেমে পড়েছে।

ইশা কোনো কথা না বলে পিছনে গিয়ে বসে।


প্রতিদিনের মতন আরহান ক্লাসে এলো। ঢুকেই তার নজরে পড়লো সামনের বেঞ্চে বসা মেয়েটির দিকে। আরহান ভ্রু কুচকে বলল, “ রোল একশ এগারো আসেনি?”


ক্লাসের সবার সাথে সাথে আরহান নিজেও একটু অবাক হলো। মেয়েটির খোঁজ কেনো নিচ্ছে সে? ইশা ভয়ে ভয়ে উঠে দাড়ালো। এখন না আবার তাকে বের করে দেয়। এই লোকটা দেখছি তার জীবনটা নরক বানিয়ে ছাড়বে।


“ তোমাকে কোথায় বসতে বলেছি? হয় সামনে এসে বসো নয়তো আমার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও।” আরহানের স্পষ্ট কথা।


ইশা বিরক্তি নিয়ে সামনে আসতেই নাঈমার চোখে মুখে  দেখলো স্পষ্ট হিংসার ছাপ, একি বিপদ !


ইশা মুখ কালো করে নাঈমার পাশে বসতেই আরহান তার হাতে থাকা মার্কার নিয়ে ইশার মাথায় আলতো করে বাড়ি দিয়ে বলল,” পিছনে গিয়েছিলে কেনো?”


ইশা চোখ কড়মড় করে দাঁতে দাঁত চিপে আরহানের দিকে তাকালো তারপরই আড় চোখে নাঈমার দিকে এক পলক তাকালো। 


ক্লাসের সবাই আরহানের ইশা এমন খুনসুটি দেখে অবাক। কি ব্যাপার! এই মেয়েই তো স্যারের গায়ে চা ফেলেছিলো আর সে মেয়েকে কিনা স্যার তার সামনে ডেকে বসাচ্ছে। অনেকে অনেক আজে বাজে কথাও বলে বেড়াচ্ছে। 


ক্লাস শেষে ইশা আরহানের পিছন পিছন ছুটতে লাগলো। কিছুদূর গিয়ে আরহান নিজের ফোন হাতে থমকে দাঁড়াতেই, ইশা বেগ হারিয়ে আরহানের পিঠের সাথে ধাক্কা খেলো। বুজতে পেরে মুহূর্তেই উল্টো দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবে এমন সময় আরহান ধাক্কা খেয়ে পিছনে ফিরে বিস্ময় নিয়ে বললো,” ওয়েট ; একশ এগারো!”


ইশা নিচের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে পিছন ঘুরে আরহানের দিকে তাকালো। তারপর একটা ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করতেই আরহান কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো।


“ আসলে আমি …।”, ইশা বাকিটা বলার আগেই হঠাৎ এক চিৎকার ভেসে এলো সবার কানে। ইশা চোখ বড় বড় করে তাকালো। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো। পাঁচতালার বারান্দায় ছেলেমেয়েদের ভিড়। আরহান দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ইশা ও তার পিছু পিছু যেতেই দেখলো তাদের ভার্সিটির গেটের সামনে গুলিবিদ্ধ একটি মরদেহ। ইশার শরীর কাপতে লাগলো। 


আরহানের দৃষ্টি সেই মরদেহের দিকে স্থির। এইভাবে মারার স্টাইলটা শুধু একজনেরই হতে পারে। ভিক্টিমের মাথার পিছনের থেকে রক্ত ঝরছে , আরহান নিশ্চিত এটা কায়ানের লোকেরাই করেছে। মাথার ঠিক পিছনে গুলি করা, ব্রেইনস্টেমের একদম কাছাকাছি যাতে করে শ্বাসপ্রশ্বাস ও হার্টবিট বন্ধ হয়ে মুহূর্তে টার্গেটের মৃত্যু। এটাই ওর স্টাইল, এক নিমিষে সব শেষ করে ফেলা। আরহান তাহলে ঠিক ধরেছে কায়ান এই শহরেরই আছে।


আরহান ইশার দিকে তাকাতেই দেখলো সে কাপছে। আরহান ইশার একদম সামনে এসে দাড়িয়ে মরদেহ থেকে তার দৃষ্টিপথ আড়াল করে ফেললো। ইশার হুশ ফিরলো যখন আরহান তার সামনে দাড়ালো।


“ কি ব্যাপার! সবাইকে না বলেছি ক্লাসে যেতে, তুমি এইখানে কি করছো?”, বলে শেষ না করতেই ইশা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই আরহান হাত বাড়িয়ে ইশাকে ধরে নিজের কাছে আনলো। তারপর ইশার মাথা নিজের কাধে রেখে ইশার গালে হাত দিয়ে তাকে ডেকে তুলতে চেষ্টা করলো কিন্তু না, মেয়েটা আজ অভিনয় করছে না। সত্যিই সে অজ্ঞান হয়ে আরহানের বাহুতে লুটিয়ে পড়েছে। 


আরহান এই প্রথম ইশাকে ভালো করে খেয়াল করলো। এতো নাজুক মানুষও হয়? যে কিনা একটা মৃত্যু দেখে সহ্য করতে পারে না। আরহানের কাছে তো মৃত্যু জীবনেরই একটা অংশ।


আরহান ইশাকে নিজের বাহুতে ধরে এদিকে সেদিক তাকালো। সব ফ্লোর একদম খালি সবাই মৃত মানুষটাকে দেখতে নিচে ভিড় জমিয়েছে। আরহান কিছু না ভেবেই ইশাকে কোলে তুলে নিলো।

আরোও পড়ুন:

রূপকথার শহর পর্ব-৪| নবনী নীলা

Post a Comment

0 Comments