একই পথের বিপরীত সঙ্গী|ঈশিতা রায়|পর্ব-৩

ভালবাসার গল্প: একই পথের বিপরীত সঙ্গী|ঈশিতা রায়|পর্ব-৩

ভোরের আলো ফুটতেই ট্রেন এসে থামল নিউসিটি স্টেশনে। মুখে আলো পড়তেই চোখ খিচে ধরলাম। নিভু নিভু চোখে তাকালাম। দেখলাম ট্রেন থেমে গেছে। পাশে তাকাতেই আশ্চর্য হলাম।

লোফার লোকটা এখন আমার,পাশে ঘুমোচ্ছে। এই মানুষটাকে আমার একদম সুবিধার ঠেকছে না।কাল রাতে হঠাত্ গায়েব হয়ে গেল আবার সকালে উদয় হয়ে গেল? মানুষ টা ছিনতাইকারী না তো? সাথে সাথে ব্যাগ চেক করলাম। টাকা পয়সা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলাম। না সব ঠিকঠাক আছে। সিট ছেড়ে উঠতে যাব তার আগেই শোরগোল শোনা গেল ট্রেন এর বাথরুম থেকে। লোফার পাও দেখি হকচকিয়ে চোখ খুলল। 

বাথরুমের সামনে ইতিমধ্যে ভীড় জমেছে।ভিড় ঠেলে ভেতরে দেখার চেষ্টা করলাম। যেটা দেখলাম।সেটা দেখার পর মাথা আমার ঘুরে এল। আশ্চর্য হলাম দৃশ্য দেখে। সাথে সাথে পুলিশ এল। ট্রেন থেকে সবাইকে নামিয়ে দিল। আমি ট্রেন থেকে মেরে থম মেরে বসে ছিলাম। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ছে ক্রমশ। 

বাথরুমে মধ্য বয়স্ক পুরুষের লা*শ ছিল। শরীরে কোনো রক্তের চিহ্ন নেই না আছে ক্ষত। কিন্তু মানুষ টা মারা গেছে। হাত,পা বাঁধা ছিল আর মুখ টাও বাঁধা। মরে পড়েছিল বাথরুমে। এক প্যাসেঞ্জার সকালে বাথরুমে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে চিত্কার দেয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল লোকটার পরনে ছিল মহিলার জামা কাপড় ,মাথায় ছিল উইগ। অর্থাৎ সে মহিলা হয়ে ট্রেনে উঠেছিল কিন্তু কেন? 

স্টেশনে ইতিমধ্যে হইহুল্লোড় লেগে আছে। চোখে মুখে জল দিলাম। হঠাত্ করেই মস্তিষ্কে খেলে গেল একটা প্রশ্ন 

" ঐ লোফার,লোকটা খু*ন করেনি তো?" 

আশ্চর্যে চোখ বড় হয়ে এল আমার। আশে পাশে তাকালাম। লোকটাকে দেখতে পেলাম না। তীব্র সন্দেহ জাগল। রাতে লোকটা সিটে ছিল না। তার মানে এটাই যে লোকটাই মেরেছে। পুলিশ তদন্ত করছে

একে তাকে জিজ্ঞেস করছে। একজন পুলিশ অফিসার আমাকে দেখে কাছে আসলেন। তীক্ষ্ম চোখে পরখ করে বললেন 

যে ট্রেনে লা*শ পাওয়া গেছে সেই ট্রেনের যাত্রী আঁটানো ছিলেন? 

আমি অস্পষ্ট স্বরে উত্তর দিলাম

- জি।

-জেনারেল কামরায় এভাবে চালাকির,সাথে কেউ একজনকে মেরে চলে গেছে অথচ কেউ খুনি কে দেখে নি।আপনি কি কিছু জানেন বা বলতে পারবেন এই বিষয়ে? রাতে কিছু দেখেছিলেন ? 

আমি কি বলব খুঁজে পেলাম না। সন্দেহ কেবল সেই লোকটার উপর জাগছে। কিন্তু আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া এই সব মামলায় এখন নিজেকে জড়ানো মানে এক্সট্রা হেডেক

- ঘাবড়াবেন না ম্যাডাম আপনি কিছু জেনে থাকলে বা দেখে থাকলে বলতে পারেন।

সত্যিই তত আমি এত ঘাবড়াচ্ছি কেন? আমি যা দেখেছি তাই তো বলব? এতটা দুর্বল হলে সামনে এগোব কি করে? দম নিয়ে বললা

- আমার,পাশে এক লোক বসেছিলেন।তার চাল চলন আমার একদম সুবিধার মনে হয় নি।রাতের বেলাও সে গায়েব ছিল। 

পুলিশ অফিসার,ভেবে জিজ্ঞেস করলেন 

- নাম জানেন?

- না স্যার। নাম টা জানি না।

- অভিক চৌধুরী।

পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ শুনে আমি সাথে পুলিশ অফিসার ও পেছনে তাকাল। পুলিশ অফিসার এর ভ্রু কুচঁকে এল। আমিও হতবাক হলাম। মানুষ টি আয়েশী ভঙ্গিতে হেলে দুলে এসে পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসল।পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন 

- আপনি কে?

উনি যার কথা বলছেন সে।ওনার পাশে আমি বসেছিলাম।

পুলিশ অফিসার,তীক্ষ্ম চোখে পরখ করলেন।বললেন 

- ওহ তো আপনি। তো বলুন মিস্টার অভিক আপনি গত রাতে ট্রেন থেকে নাকি উধাও হয়ে গিয়েছিলেন? কথাটা সত্যি?

মানুষটার হাসি প্রশস্ত হল।আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল।মানুষ টার হাবভাব দেখে বড্ড গা জ্বলল আমার। এরপর হেঁয়ালি করে বলল 

- পুলিশ মশাই মহিলার সাথে সাথে দেখছি আপনার বুদ্ধি ও হাঁটুতে। চলন্ত ট্রেন থেকে মানুষ উধাও হবে কি করে? ঝাঁপ দিয়ে? 

পুলিশ অফিসার এর চোয়াল শক্ত হল। বলল 

-ভদ্র ভাবে কথা বল বুঝলি? তোকে জেলে পুরতে দু সেকেন্ড ও সময় লাগবে না আমার।

- ভদ্র ভাবেই তো কথা বললাম। শুধু শুধু চাকরি করতে আসা ছেলেকে সন্দেহ করছেন। আমি ভাই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। এই শহরে চাকরি পেয়েছি। এই সব ফালতু মামলায় আমাকে জড়াবেন না।

-তাহলে এটা বলুন রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি সন্দিহান গলায় বললাম। লোকটা আমার উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখল। আমি ভড়কালাম। কিন্তু পিছু হাটলাম না। লোকটা মুচকি হাসল। বলল 

সিগারেট খেতে গিয়েছিলাম। 

পুলিশ অফিসার,চমকে বলল 

- ট্রেনে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ।তার পরেও আপনি সিগারেট খেয়েছেন? আপনার জরিমানা হতে পারে তা কি আপনা জানেন না? 

লোকটি হেঁয়ালি কন্ঠে বলল 

-কি করব স্যার  সারাদিনে একটা সিগারেট না খেলে যে ভালো লাগে না।মরে যেতে ইচ্ছে করে। এবার বলুন আপনাদের নিয়ম পালন করা বেশি জরুরি নাকি মানুষের জীবন বাঁচানো? তাছাড়া ঐ সব নিয়ম নিয়ম হয়েই থেকে গেছে কেউ সেরকম পালন আর করে না। এই যেমন আমি কাল কি সুন্দর সিগারেট টা খেলাম নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও অথচ কেউ ধরতেই কিছুই বলল না। হ্যাঁ তবে আমি ভাই ভালো মানুষ চুপচাপ জরিমানা দিয়ে দিয়েছিলাম। 

মানুষটা বেশ ভালো কথার,জালে  ফাঁসাতে  পারে তার কথায় বুঝতে পারলাম। পুলিশ অফিসার চুপ করে থেকে বললেন

- কিন্তু আপনি যে সঠিক কথাই বলছেন তার তো গ্যারান্টি নেই।

- চাইলে যারা ট্রেনে যারা ডিউটি করছিলেন তাদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।

পুলিশ অফিসার আর কিছু বললেন না। শুধু এইটুকু বললেন

- ঠিক আছে।আপনার নাম ও ফোন নাম্বার দিয়ে যান দরকার হলে আপনাকে ফোন করা হতে পারে।আর ম্যাডাম আপনিও দিন।

আমার কাছে কি প্যাড ওয়ালা ছোট্ট ফোন ছিল যার সিম আমি ফেলে দিয়েছি। যাতে কেউ যোগাযোগ না করতে পারে। খানিকটা বিব্রত হলাম।বললাম 

- আসলে আমার নিজের কোনো নাম্বার নেই।আপনি শুধু নামটা লিখে রাখুন।

পুলিশ অফিসার সন্দিহান চোখে তাকালেন। আমি ঘাবড়ালাম। অভিক নামের লোকটাও আমার দিকে চোরা দৃষ্টিতে তাকাল

- আশ্চর্য আপনার নাম্বার নেই? কোথায় থাকেন ঠিকানা বলুন  তাহলে।

- ঠিকানাও নেই।

আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে তিনি। বললেন 

- বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন নাকি?নতুন শহরে?

আমি অপ্রস্তুত হলাম।কি বলব খুঁজে পেলাম না বিধায় চুপ রইলাম। হঠাত্ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলে উঠল

- আপনি নাম টাই লিখে রাখুন স্যার। হতেই পারে কোনো প্রবলেম এ আছেন উনি। 

আমি পাশে তাকালাম। মানুষ টা নিজের ফোন নাম্বার নাম পুলিশ কে দিল। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম

- আপনার নাম?

আমি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম। দৃঢ় কন্ঠে বললাম


- ইরা।

পুলিশ অফিসার এরপর চলে গেলেন। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।আমি ভ্রু কুচঁকে তাকালাম। মানুষটা বিড়বিড় করল "নাইস নেম"।এরপর চলে গেল। আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেলাম। অচেনা অজানা শহরে পা রাখলাম। কোথায় যাব কি করব এই নিয়ে আপাতত মাথা ব্যাথা হচ্ছে না। নিজের উপর ভরসা আছে।আত্মবিশ্বাস আছে যে আমি ঠিক আমার জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারব।তাছাড়া সৃষ্টিকর্তা তো আমার সাথে আছেন। 

ব্যাগ নিয়েই হাঁটতে লাগলাম। নিজেকে খোলা আকাশের মুক্ত পাখি মনে হল। এত দিন সংসার করেছি যদিও তা ছিল একতরফা তবুও এইভাবে একা কোনো অজানা শহরে নিজের জীবন আবার,শুরু করব তা ভাবিনি কখনো।পথচলা টা হয়তো এবার আরো কঠিন হয়ে উঠবে। কিন্তু নিজের উপর আস্থা আছে।

পেটে ইদুঁর দৌড়াচ্ছে। হাতে গুটি কয়েক পয়সা আছে আগে কিছু একটা খেতে হবে তারপর বাকি কথা ভাবব। এখন সকাল আটটা। অনেক হাঁটার আশে পাশে একটা দোকান দেখে ঢুকে পড়লাম। একজন দাদা কে জিজ্ঞেস করলাম

- দাদা ডিম টোস্ট হবে?

দাদা টা গামছা কাঁধে নিয়ে বলল 

অবশ্যই হবে দিদি। আসুন। 

সব সিট দেখতে পাচ্ছি ফুল। কোথাও খালি নেই।অনেক চোখ বুলিয়ে দেখলাম কোণের একটা জায়গায় একটা সিট খালি আছে।কিন্তু ওখানে একটা লোক অলরেডি বসে আছেন।পেছন টা দেখা যাচ্ছে শুধু মুখটা সামনের দিকে।আমি আর,আগা গোড়া না এগিয়ে গিয়ে ।ব্যাগটা রেখে চেয়ার,টেনে বসে পড়লাম সেই জায়গায়। সামনের লোকটা কে দেখে মাথায় বজ্রপাত ঘটল। আবার সেই লোকটা। উফফ ঘটনা টা কাকতালীয় কি না বুঝতে পারলাম না। প্রচুর বিরক্ত হলাম। ইচ্ছে হল উঠে চলে যেতে কিন্তু খিদে পেয়েছে ভীষণ।কিছু না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই বসেই রইলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হল লোকটা আমার দিকে তাকাল পর্যন্ত না। সে নিজের মতো খেতে থাকে। মাঝে মাঝে ফোনে কি দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।আমি যে তার অপোজিট এ বসে আছি তা বুঝতেই পারে নি এমন একটা ঢং।আমার কোনো অস্তিত্ব নেই এমন হাবভাব। একটা সময় পরে তার চোখ পড়ল আমার ওপর।  এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে ফেলল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে। যেন চেনেই না। আমিও বেশি কিছু আর ভাবলাম না। জলের বোতলে বের করে জল ভরতে চলে গেলাম। খাবার আসতে দেরি হবে দাদা বলল।

জল ভরে এসে দেখি লোকটা চলে গেছে।যাক বাবা হাফ ছাড়লাম। মনে মনে সৃষ্টিকর্তা কে বললাম 

- আর যেন এই লোকটার মুখোমুখি না হতে হয়।

কিছু ক্ষন এর মধ্যেই খাবার এল। জলের বোতল রেখে খেতে বসলাম। খেতে খেতেই ভাবলাম একটা বাড়ি ভাড়া নিতে হবে এরপর দেখা যাবে কি করা যায়।

Post a Comment

0 Comments