আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-২
আমি রান্নাঘরে এসে দেখলাম মেজো মা মেঝেতে বসে পেঁয়াজ কাটছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে উনার হাত থেকে বটিটা নিতে নিতে বললাম,"আমায় দাও মেঝো মা,আমি কেটে দিচ্ছি । তুমি শুধু শুধু কষ্ট করে নিচে বসতে গেলে কেন?আমাকে ডাকলেই পারতে।"
আমি কথাটা বলে নিজে বসে গেলাম পেঁয়াজ কাটতে । মেঝো মা হাত ধুয়ে উঠে দাড়ালেন। চুলার তরকারিতে খুন্তি নাড়তে নাড়তে মলিন কন্ঠে বললেন,"এতোক্ষণ কোথায় ছিলি রে আলো?বাড়িতে কত লোকজন,আমি কি একা এতো রান্না করতে পারি?বয়সের দৌড়ে কোমড়টাও এখন আর সাথ দেয়না । বাতের ব্যাথার কথা নাহয় বাদই দিলাম।"
আমি মেঝো মার মলিন হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম,"চিন্তা করো না মেজো মা। এখুনি রান্নাটা শেষ করে আমি তোমাকে গরম পানির সেক দিয়ে দিবো,দেখবে বাতের ব্যাথা সব নিমিষেই উড়নছু।"
মেঝো মা আমার কথা শুনে নির্বিকার হাসলেন। আমিও মুচকি হেসে মনোযোগ দিলাম পেঁয়াজ কাটায় ৷ মেঝো মা চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে আমার সামনে এসে বসলেন। পাশ থেকে গরম পানির ব্যাগটা পায়ের গোড়ালিতে ঠেকিয়ে বললেন,"আর কত দিন এইভাবে অন্যের ব্যাথা নিরাময় করে বেড়াবি রে আলো?এবার তো একটু নিজের দিকটা ভাব। আমি তো ভাবছি চাঁদের বিয়েটা হয়ে গেলে ওকে বলবো তোর জন্য একটা ভালো পাত্রের খোজ করতে।"
মেজো মার মুখে ওই নামটা শুনে আমার বুকের ভেতর কেমন জানি ধুপ করে উঠলো ৷ আবেগেরা আবারও উঁকি দিতে চাইলো। কি হাস্যকর পরিস্থিতির স্বীকার আমি!!শেষমেষ কীনা আমার নিজের স্বামী আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খুজবে?
মেজো মা নিজের মতো কথা বলে যাচ্ছেন। আমার তাতে কোনো ধ্যান নেই। মনে হচ্ছে যেন আমি দুনিয়াতে থেকেও নেই । আমার স্বামী নামক মানুষটি ভোরের আলো ফুটলেই অন্য কারো দখল নামায় বন্দী হয়ে যাবেন ভাবতেই হৃদযন্ত্রটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে । শ্বাস আটকে আসছে বারবার। হঠাৎই মেজো মার চিৎকারে আমার সম্বিত ফিরলো।
"ও মা গো...কীভাবে র*ক্ত পরছে । কতোটা কেটে গেছে হাতটা।"
মেজো মার কথাগুলো শুনে প্রথমে কিছু বুঝতে পারলাম না। পরে আমি আমার হাতের দিকে তাকাতেই দেখালাম হাত কেটে র*ক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে । অসাবধানতা বশত ধা*রা*লো বটিতে তর্জনীর মাথাটা বোধহয় খুব ভালোভাবেই কেটেছে । গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে,অথচ আমার এতে কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না । পাথরের মূর্তির মতো হাতের দিকে তাকিয়ে আছি শুধু।
এদিকে মেজো মার চিৎকার শুনে ততোক্ষণে রান্নাঘরের দরজায় ভীড় জমে গেছে। বাড়ি ভর্তি লোকজনের একাংশ কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য উৎসাহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রান্নাঘরের ভেতরের দিকে । সবার মতো চিৎকার শুনে মিহুও ছুটে এসেছে ।
"এতোটা কিভাবে কাটলে আলো আপু?...দেখো তো কতোটা র*ক্ত বেরিয়েছে । একটু সাবধান হয়ে কাজ করবে না?"
বলতে বলতে মিহু আমার কাটা আঙ্গুলটা তার সুতির ওড়না দিয়ে চেপে ধরেছে । রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে হয়তো । কিন্তু অনেকটা কেটে যাওয়ায় র*ক্ত বন্ধ হওয়ার নামই নিচ্ছে না । মেজো মা,মিহু দুজনই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে । মেজো মা তাড়াতাড়ি গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,"পানি খা আলো। তুই উঠ ওখান থেকে,তোকে আর পেঁয়াজ কাটতে হবে না। কেটে কুটে হাতটার একদম যা তা অবস্থা করে ফেলেছিস। উঠ তুই।"
এরপর মিহুর দিকে তাকিয়ে বললেন,"মিহু ওকে ঘরে নিয়ে যা। ঘরে নিয়ে গিয়ে হাতটা ব্যান্ডেজ করে দে।"
মেজো মার কথা শুনে আমি তৎক্ষনাৎ বললাম,"ঘরে যাবো মানে?আমি ঠিক আছি,সামন্য একটু হাতই তো কেটেছে। এতে এতো ব্যস্ত হয়ো না তো তোমরা। আর আমি ঘরে চলে গেলে এদিকের রান্না সামলাবে কে?তুমি একা পারবে না মেজো মা। আমি থাকি এখানে।"
মেজো মা আমার কথা শুনে ধমকে উঠে বললেন,"ঘরে যেতে বলেছি ঘরে যা। পুরো মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে আর উনি বলছেন সামান্য কেটেছে । অনেক সাহায্য করেছিস মা আমার,এবার ঘরে গিয়ে হাতটা ব্যান্ডেজ করে আমাকে উদ্ধার কর।"
"কিন্তু মে...।"
"আর কোনো কিন্তু নয়। এই মিহু যা তো ওকে ঘরে নিয়ে যা। দিদি এদিকটাই আসার আগেই আমাকে এগুলো সব পরিষ্কার করতে হবে। নইলে আরেক তুলকালাম কান্ড হয়ে যাবে।"
মেজো মা আমার কথা শুনলেন না। জোর করে আমাকে মিহুর সাথে পাঠিয়ে দিলেন। বিয়ে বাড়ির এতো কাজ থাকা সত্ত্বেও উনি একবারের জন্যও আমার হাত কেটে যাওয়া নিয়ে রাগ দেখাননি। মানুষটা অনেক বেশি অমায়িক। আমি এবাড়িতে আসার পর থেকেই আমাকে কেমন আপন করে নিয়েছেন। উনার নিজের কোনো সন্তান নেই। আমি এবাড়িতে আসার পর থেকে আমাকেই নিজের সন্তান বলে মনে করেছেন তিনি। উনার ভালোবাসা,আদর,যত্নে আমিও আপ্লূত হয়েছি বারংবার।
মিহু আমাকে দোতলায় তার রুমে নিয়ে এলো। আমাকে বিছানা বসিয়ে রেখে ও ছুঠে গেলো ফার্স্ট এইডসের বক্স খুজতে । আমি নিরব,নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি মিহুর রুমে,তখনই গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে মিহুর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে কেউ একজন মিহুর রুমের দরজায় এসে দাড়ালেন । আমি দরজার উল্টো দিকে মুখ করে বসায় মানুষটার চেহারা দেখলাম না। তবে কন্ঠ শুনে আমার বুঝতে বাকি রইল না মানুষটা আর কেউ নয়,বরং আমার প্রণয়সিক্ত শুদ্ধ পুরুষ। আমার স্বামী নামক সেই ব্যক্তি। ড.শুভ্রনীল চৌধুরী চাঁদ!!চাঁদের মতোই সুন্দর উনি। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়। চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আছে,আর উনার একটা ফেলে আসা বউ । যদিও দুটোই একে অপরের সমতুল্য। লোক সম্মুখে আমাদের সম্পর্কটা জানাজানি হলে তো আমি উনার কলঙ্কই হতাম । আমি আবারও থমকে গেলাম,একবারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকালাম না পর্যন্ত।
মিহুকে রুমে কোথায়ও না দেখতে পেয়ে উনি দরজা থেকেই জিজ্ঞেস করলেন,"মিহু রুমে নেই?"
আমি গলার স্বর ছোট করে বললাম,"না,বাইরে গেছে।"
পিছন দিক থেকে আমার কথাটার আর কোনো প্রতিউত্তর এলো না। বুঝতে পারলাম উনি চলে গেছেন।
কি অদ্ভুত!! গত তিন তিনটে বছর ধরে উনার বাড়িতে আছি আমি। অথচ কখনো জানতেও চাইলেন না আমি কে?এই বাড়িতে কি করছি?এই তিন বছরে আমার মুখটা পর্যন্ত দেখেননি উনি। অবশ্য এর সব কৃতিত্ব আমার নিজের। আমিই কখনো উনাকে আমার মুখ দেখায়নি। না সেদিন রাতে,না বিগত তিন বছরে।
সেদিন রাতে যখন আশ্রয়ের জন্য উনাদের বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাড়িয়েছিলাম তখনও আমি জানতাম না এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আমার স্বামী নামক ব্যাক্তিটির বাড়ি। নিয়তির কি অদ্ভুত খেল!!সব কিছু হারিয়ে দিয়েও পাইয়ে দিয়েছে আমাকে । অতঃপর আমি সব পেয়েও হারাতে যাচ্ছি আবার ।
মিহু ফার্স্ট এইডসের বক্স নিয়ে রুমে এসে আমার কাটা আঙ্গুলটা ব্যান্ডেজ করে দিলো। একটা পেইন কিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেটা খেতে বলল। আমিও বাদ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলাম। এতোক্ষণে আমার কেটে যাওয়া অংশে ব্যাথার চেতনা ফিরছে । ওষুধ লাগানোর পর পরই মাং*স বেরিয়ে আসা কা*টা অংশটা জ্বলতে শুরু করেছিল,এখনও করছে। মিহু আমাকে রেস্ট করতে বলে নিচে রান্নাঘরে মেজো মাকে সাহায্য করতে চলে গেল। বিয়ে বাড়ির এতো রান্না উনি একা করে কুলিয়ে আসতে পারবেন ভেবে আমিই যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মিহু আমাকে আটকে দিয়ে সে নিজে গেলো। যাওয়ার আগে দরজাটা হালকা ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। আমি মিহুর বিছানায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছি। দৃষ্টি মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকার পর আমি আমার চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলাম। নিজের অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা উষ্ণ নোনতা অশ্রুকণা বেড়িয়ে আসলো। আমি আটকালাম না সেটাকে,সত্যি বলতে আটকাতে পারলাম না । জীবনের সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগছে আমার। আমি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলাম তিনবছর আগে ঘটে যাওয়া সেইদিনের ঘটনাগুলো।
0 Comments