রূপকথার শহর! | নবনী নীলা

 ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর!

প্রথম পর্ব!

লেখা: নবনী নীলা

সামনে বসা লোকটিকে দেখে ইশার চোখ বেরিয়ে আশার উপক্রম হলো কারণ সামনে বসা লোকটি আর কেউ নয় তার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। শুধু তাই নয় আজ যে পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে এসেছে, তাদের মধ্যে পাত্র সে নিজেই। ঘটনা শুধু এইটুকু হলেও ইশা ব্যাপারটা হজম করে নিতো। কিন্তু ঘটনা শুধু এইটুকুতে থেমে নেই।অসস্তিতে ইশার হাত পা কাঁপছে। এইতো গতকালের ঘটনা,



-ইশার দিন শুরু হয়েছিলো ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরের গায়ে চা ছুঁড়ে মেরে।-


চিবুক শক্ত করে, রক্তচোখে আরহান সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার সাদা শার্টে চায়ের দাগ স্পষ্ট। ছেলেমেয়েরা প্রায় হেসেই ফেলছিল, কিন্তু আরহানের গলায় ঝুলে থাকা আইডি কার্ড দেখে সবাই থমকে গেল। এ তো সেই নতুন প্রফেসর! যার জন্য আজ এত আয়োজন! সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে—কি হবে এখন?


পরিস্থিতি বুঝে উঠতে ইশার এক সেকেন্ডও লাগল না। লোকটার আইডি কার্ডের লাল-কালো ফিতা দেখে তার চোখ প্রায় কপালে উঠে এলো। আরহানের চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট, তার অগ্নিমূর্তি দেখে ইশার গলা শুকিয়ে গেল। কিছু বলার আগেই আরহান হনহনিয়ে ভিসির রুমের দিকে রওনা দিল। ইশা কোনো উপায় না দেখে তার পেছনে দৌড়ে যেতে লাগল।


 "স্যার! স্যার!" বলে ডেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আরহান নির্লিপ্তভাবে হেঁটে যাচ্ছেন।


ভিসির দরজার সামনে পৌঁছেই ইশা দুই হাত মেলে আরহানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

"স্যার! প্লিজ, একবার আমার কথা শুনুন। আমি ইচ্ছে করে করিনি। বিশ্বাস করুন, এটা... এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। I'm really sorry."


আরহানের চোখে মুখে নির্লিপ্ত ভাব। সে যে ভীষণ রেগে আছে তা বোঝাই যাচ্ছে।


"Get out from my sight."

আরহানের ভারী কণ্ঠে ইশার শরীর কেঁপে উঠল।


বাইরে হইচই শুনে ভিসি আমিনুল সাহেব বেরিয়ে এলেন। দরজা খুলেই দেখলেন—ইশা তার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে, আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে নতুন প্রফেসর আরহান আহমেদ। আরহানের চোখেমুখে রাগ যেমন স্পষ্ট তেমন শার্টে চায়ের দাগ। এমন দৃশ্য দেখে আমিনুল সাহেব হতভম্ব।


" আমার দরজার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? You stupid!",চশমা ঠিক করতে করতে বলে উঠলেন তিনি।


ঝাড়ি খেয়ে ইশা মুখ কালো করে একপাশে সরে দাঁড়াল। আজ  কার মুখ দেখে উঠেছিলো কে জানে? এত লোক থাকতে এই বদরাগী লোকটার গায়েই চা পড়তে হলো! চেহারাটা কি করে রেখেছে দেখো, মনে হচ্ছে যেনো তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।


ভিসি সাহেব আরহানকে তার অফিসে নিয়ে গেলেন। ইশা অসহায়ভাবে অফিসের বাইরে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর একজন এসে জানালো, ইশাকে ভেতরে ডাকা হয়েছে। মামা হলেও আমিনুল সাহেব আজ তাকে ছাড় দেবেন না।


ইশা ভেতরে ঢুকে বারবার ক্ষমা চাইলো, নিজের ভুল স্বীকার করল। কিন্তু আরহানের চোখে মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। বোঝাই যাচ্ছে, এ বিষয়ে ইশার ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমিনুল সাহেবও দ্বিধায় পড়ে গেলেন—এই মেয়েটা আবার তাকে বিপদে ফেলে দিল।


প্রায় একঘণ্টা ঝাড়ি খেয়ে ইশা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।


"এই ধরনের গাফিলতি বা অসভ্যতা এই ক্যাম্পাসে সহ্য করা হবে না," বললেন আমিনুল সাহেব।


"এটাই তোমার লাস্ট ওয়ার্নিং। তবে তোমাকে ক্ষমা করা না করার বিষয়, সেটা স্যারের ব্যক্তিগত ব্যাপার।"


আরহান উঠে দাঁড়াল। অহেতুক তার সময় নষ্ট হচ্ছে। আমিনুল সাহেবের ইশার প্রতি পক্ষপাতিত্ব তার মোটেও পছন্দ হয়নি। আমিনুল সাহেবকে বিদায় জানিয়ে সে বেরিয়ে গেল।


ইশা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল।


"তুমি আর কত স্টুপিডিটি করবে বলো তো? আমার মান-সম্মান কিছুই থাকল না! যখন আরহান জানবে তুমি আমারই ভাগ্নি, তখন তাকে আমি কি জবাব দিবো?"


" আমি কি করবো? লোকটা হঠাৎ আমার সামনে চলে আসলো, আমি না বুঝার আগেই তো সব গেলো। তারপর এতবার ক্ষমা চাইলাম, লোকটা একবার আমার দিকে তাকিয়েও দেখল না। এমন বদরাগী লোক আমি জীবনে দেখিনি!"


"এইবার দেখে নেও। ক্যাম্পাসের সবার সামনে তুমি একজন প্রফেসরের গায়ে চা ছুঁড়ে মেরেছো। তুমি কি মনে করো এটা কোনো ছোটখাটো ভুল? তার যেই অপমান হয়েছে, তার প্রতিশোধ সে নিতেই পারে। আবার সে জয়েন করেছে তোমারই ডিপার্টমেন্টে।"


"উফ্, আমি কি করব এখন? আবার গিয়ে ক্ষমা চাইব?" ইশা দিশেহারা হয়ে বললো।


"চেষ্টা করো। ক্ষমা করে দিলে তোমারই ভালো।"


এই কথা শুনে ইশা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

"আচ্ছা, লোকটাকে খুঁজে দেখি।",বলেই সে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়েই দেখলো ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কথায় বলে না দিনটা খারাপ ভাবে শুরু হলে পুরোটাই খারাপ যায় এই অবস্থা।


দূর থেকে আরহানকে দেখতে পেয়ে ইশা দৌড়ে গেলো। দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। আরহান সবে মাত্র গাড়ির দরজা খুলেছে তখনই ইশা দৌড়ে সেইখানে উপস্থিত। বৃষ্টিতে ভেজা কোনো পুরুষ মানুষকে দেখে এই প্রথম ইশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আরহানের চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ইশা এক পলকে তাকিয়ে আছে।


আরহান এই মেয়ের সাহস দেখে সত্যিই অবাক। সে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দুই হাত বুকে গুঁজে দাঁড়ালো ইশার দিকে তাকালো। 


ইশা কিছু বলার আগেই আরহান বলল," কি সমস্যা তোমার? এইখানে কি? আর আমিনুল ইসলাম তোমার কি হয় ? "


আরহানের ভারী কন্ঠে ইশা হা করে তাকিয়ে রইলো। লোকটা হঠাৎ এই প্রশ্ন করছে কেনো? এখন সে কি বলবে হ্যাঁ নাকি না ? নাকি এড়িয়ে যাবে? এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে একটা সুদর্শন পুরুষের কাছ থেকে কিনা তাকে ঝাড়ি শুনতে হবে? অবশ্য লোকটা সুদর্শন হলে কি হবে, আসলে তো বদরাগী।


ইশা কি বলবে ভেবে ঠিক করার আগেই আরহান বলল," আমিনুল সাহেব কি কারণে তোমাকে ছাড় দিয়েছেন আমার তা জানা নেই, তবে আমি তোমাকে ছাড় দিচ্ছি না। So, Be prepared for that.",বলেই  আরহান এক হাত দিয়ে নিজের ভেজা চুল গুলো পিছনে নিলো।


" মানে?" ইশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি তাকে হুমকি দিচ্ছে?


ইশার মেজাজ বিগড়ে গেলো। ছাড় দিবে না মানে?  কতবার ক্ষমা চাইলো সে, অথচ এই আইরন ম্যানের মন গলার নাম নেই! এইদিকে বৃষ্টিতে ভিজে ক্ষমা চাইতে এসেছে কিন্তু দেমাগ দেখো এই লোকটার। 


ইশা রেগে গিয়ে শাসিয়ে বলল," আপনি এইভাবে কোনো স্টুডেন্টকে বলতে পারেন না। আমি মানছি ভুল করেছি , তার জন্য আমি যথেষ্ট ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু আপনি কি করছেন? এতো বড় হয়েও নাকের ডগায় রাগ নিয়ে বসে আছেন।" বলতে বলতে ইশা ঠোঁট চেপে  মুখ বন্ধ করে ফেললো। এটা কি বলে ফেললো সে! লাস্টের কথাটা কি বলা ঠিক হয়েছে? 


আরহানের কপালের ভাজ পড়লো।


না মানে আমি বলতে চাইছি যে। ভুল তো মানুষই করে... ইশা কথা শেষ না করতেই আরহান একধাপ এগিয়ে আসলো।


ইশা চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর আরহান ঝুকে এসে ইশার গলায় ঝোলা আইডি কার্ডটা হাতে নিতেই ইশা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো। 


ইশার নাম না পড়ে আরহান ইশার একাডেমিক রোলটা পড়ল," একশো এগারো"। আরহানের মুখে নিজের রোল শুনতেই ইশার বুকের ভিতরটা ধুক  করে উঠলো।


 আরহান আইডি কার্ড থেকে চোখ তুলে ইশার চোখের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল ," ভুল আর বেয়াদবির মধ্যে একটা পাতলা সীমারেখা  আছে। ভুল করলে ক্ষমা করে দেওয়া যায় কিন্তু বেয়াদবি? বেয়াদবির ক্ষমা হয় না।" বলেই ইশার আইডি কার্ডটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে  আরহান নিজের গাড়িতে উঠে পড়লো। ঝুম বৃষ্টিতে ইশা অবাক হয়ে চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো।


ঠিক তার পরেরদিন, মানে আজকে। আজকেই ইশার বাসায় পাত্রপক্ষ হাজির। আর পাত্র স্বয়ং আরহান আহমেদ। ইশার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।


ইশার বড় খালা আমিনা বেগম আরহানের ইশার দিকে নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা খেয়াল করে বললেন, ‘ ওদের দুজনকে একটু একা কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। বিয়ের ব্যাপার যেহেতু একে অপরকে জেনে নেওয়া ভালো।”


ইশা চোখ বড় বড় করে নিজের খালার দিকে তাকালো। বিয়ের আগে একা কথা বলতে হবে মানে? বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে? না। না, এই বদরাগী লোককে সে জীবনেও বিয়ে করবে না।


ইশার মাথা ঘুরাচ্ছে। একি বিপদ! ইশা সামনে তাকাতেই দেখলো আরহান চোয়াল শক্ত করে তার দিকেই তাকিয়ে। এই বদরাগী লোকটার সাথে তার বিয়ে? ভেবেই ইশার দম বন্ধ হয়ে এলো। 

সাথে সাথে ইশা চোখ উল্টে তার খালার কাঁধে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।

আরোও পড়ুন:

রূপকথার শহর পর্ব-২| নবনী নীলা

Post a Comment

0 Comments