আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| প্রথম পর্ব
ছোটবেলায় দাদী বলতো আমি নাকি বিয়ের পর স্বামী সোহাগী হবো। আমারে যে বিয়ে করবে সে নাকি আজীবনের জন্য আমার মায়ায় আটকে যাবে। কিন্তু তখনও আমি বুঝিনি কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা আর বানোয়াট ছিলো।
দাদীর মৃত্যুর পর আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা-মাকে তো পাওয়ার আগেই হারিয়েছি । তাই তাদের নিয়ে কোনো শোক নেই আমার মনে ।দাদীর মৃত্যুর পর যাও একটা দূরসম্পর্কের চাচার ছায়ায় ঠাঁই মিলেছিলো সেটাও হারালাম একটা মিথ্যা অপবাদের দায়ে। রাগে,দুঃখে বেড়িয়ে আসলাম তাদের বাড়ি থেকে । কোথায় যাবো?কি করবো?তখনও কিছুই জানি না। তারপর হঠাৎ সেদিনই বিধির খেয়ালে বাধা পড়লাম আমি।
অজানা,অপরিচিত এক পুরুষ সত্তার সাথে আত্মার সম্পর্কে জড়ালাম। বলা ভালো পরিস্থিতির চাপে পড়ে জড়াতে বাধ্য হলাম। আমার মতো আমার সেই স্বামী নামক ব্যক্তিটিও সেদিন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলেন। তবে তিনি দায়বদ্ধতায় আটকে থাকেননি। বিয়ের পর পরই আমাকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে,ফেলে চলে গিয়েছিলেন তিনি । আমার মৃত দাদীর কথা সেদিন রাতেই মিথ্যা প্রমাণিত হলো। আমার মায়ায় আটকানো তো দূর,স্বামী নামক মানুষটা আমার দায়িত্বেই আটকালেন না ।
সেদিনের পর মাঝে কেটে গিয়েছে তিন তিনটে বছর। এই তিন বছরে আমি কখনোই আমার স্বামী নামক ব্যক্তিটিকে খোজার চেষ্টা করিনি। করে বিশেষ কোনো লাভও হতো না। কারণ,যে হারিয়ে যায় তাকে খুজে বের করা সহজ,তবে যে পালিয়ে যায় তাকে খুজে বের করা কঠিন থেকে কঠিনতর। তবে আমার ক্ষেত্রে নিয়তিই সেই কঠিনতর কাজটি সম্পাদন করে দিয়েছে ।"
কথাগুলো বলা শেষ হতেই আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। আমার কথাগুলো শুনে মিহু এখনো আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে ওর চোখ ছলছল করছে। তবে আমার চোখে ওর মতো ওতো আবেগ নেই। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা টেনে একটানে নির্দ্বিধায় কথাগুলো বলে থামলাম।
মিহুর অশ্রুকণা আর বাধ মানলো না। ডুকরে কেদে উঠলো মিহু,অঝোরে বেড়িয়ে এলো বেধে রাখা উষ্ণ অশ্রু । মিহু হঠাৎই ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো আমায়। আমি তাল সামলাতে না পেরে পরতে নিয়েও পরলাম না। আমিও জড়িয়ে ধরলাম মিহুকে। মিহু বিরামহীনভাবে কাঁদছে। কান্নার চোটে মাঝে মাঝেই ওর শরীরটা কেমন কেপে উঠছে। আমি অনুভব করলাম,ওর আবেগটা বোধহয় এবার ভাইরাসের মতো আমাকেও আক্রমণ করছে। না চাইতেও আমার চোখের কোটরে পানি জমতে শুরু করেছে। তাও যথা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখলাম। ভেঙ্গে পরলে চলবে না। মনে মনে নিজেকে সাহস জোগালাম। তারপর আলতো করে আমার হাতটা মিহুর মাথার পিছনে রাখলাম। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,'কাঁদছিস কেনো পাগল?আমি কি তোকে কান্না করার মতো কিছু বলেছি?'
কান্নার তোড়ে মিহুর এবার হেঁচকি উঠতে শুরু হলো। ও সেই অবস্থাতেই আধো আধো কন্ঠে বলল,'আমাকে ক্ষমা করে দাও আলো আপু। না জেনে,না বুঝে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায়। ভাইয়া যে তোমার সাথে এতো বড় একটা অন্যায় করেছি....আমি ভাবতেও পারছি না আমার ভাই এমন!!আজ যদি তোমার জায়গায় আমি থাকতাম তাহলেও কি ভাইয়া আমাকে ওভাবে ফেলে আসতে পারতো?হয়তো পারতো না। রক্তের টানে আটকে যেতো। তবে তোমার সাথে ও বিরাট বড় অন্যায় করে ফেলেছে,ইভেন এখনও করছে।"
আমি বুঝতে পারলাম আমার কথাগুলো শুনে মিহু তার ভাইকেই সবকিছুর জন্য দোষী ভাবছে। যেটা ভুল। ওই মানুষটা তো আমাকে বাচাতে গিয়ে আমার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলি। মানুষটার তো এতে কোনো দোষ নেই। উনার জায়গা অন্য কেউ থাকলে সেও বোধহয় একই কাজ করতো। উনি তো তাও আমাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন,অন্য কেউ থাকলে হয়তো তাও আসতো না।
আমি মিহুকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম,ওকে বোঝানোর জন্য বললাম,"তুই শুধু শুধু ওনাকে দোষারোপ করছিস মিহু। আমি তো আগেই বললাম সবটা পরিস্থিতির বাধ্যবাদকতা ছিলো। অতীতের কোনো ঘটনায় উনার কোনো দোষ নেই।"
"আর এখন?"আমার কথার মাঝে মিহু তৎক্ষনাৎ আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলো। আমি ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবো তার আগেই আমার বাহু ঝাকিয়ে ও বলে উঠল," দুদিন পর ভাইয়া আবারও বিয়ের আসরে বসবে আলো আপু। আর তুমি এখনো অতীতের দোষ ঢাকছো? আজ বাদে কাল তোমার স্বামী অন্য নারীর হাত ধরে বাড়িতে ঢুকবে। আর তুমি এখনও সত্যিটা চেপে যাবে?একটা বারের জন্য হলেও ভাইয়ার মুখোমুখি হবে না?জিজ্ঞেস করবে না সেদিন রাতে কেন তোমাকে ফেলে রেখে এসেছিল?"
এবার মিহুর প্রশ্নের তার কোনো উত্তর দিতে পারলাম না আমি। কি বা উত্তর দিতাম আমি?ওই মানুষটাকে কোন অধিকারে প্রশ্নের সম্মুখীন করতাম?বউয়ের অধিকারে?সেটা তো কোনো দিন পাই-ইনি আমি। ঠোঁটের কোণে আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে আমি নেমে গেলাম ছাঁদ থেকে। মিহুও পিছু পিছু এসেছিলো বোধহয়। তবে সেটা আর খেয়াল করলাম না। আজ বাদে কাল আমার স্বামীর বিয়ে বলে কথা। কত কাজ বাড়িতে । এইভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে গল্প করা সাজে না আমার। তাই ছাদ থেকে নেমেই ছুটে গেলাম রান্নাঘরের দিকে।
0 Comments