গল্প: প্রতিদান|তাসনূভা ঝিনুক!
বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমাদের চার ভাই বোনের ঠাঁই হয় বড় মামার বাড়িতে। মামা মামী নিতান্ত সাধারণ মনের মানুষ এবং মধ্যবিত্ত। তাদের নিজেদের তিন সন্তানের মাঝেও কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আশ্রয় দিলেন। আমাদের কোন আদিখ্যেতা ছিল না। মামীও কখনো বৈষম্য করেননি। নিজেরা যা খেতেন পরতেন, আমাদের জন্যও তা বরাদ্দ হতো।
হ্যাঁ,আমাদের বাড়তি যোগ হওয়ার কারণে মামাতো ভাই বোনেরা বিলাসিতা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। কিন্তু এতে তাদের মনে কখনো ক্ষোভ দেখিনি। মনে হতো এটাই স্বাভাবিক। মাঝে মধ্যে মামীর আক্ষেপ শোনা যেত,আমাদের জন্য খরচ বেড়ে গেছে অথবা তার সন্তানদের সাধ আহ্লাদ পূরণ হচ্ছে না। ঘরের কাজ আমরা সব ভাই বোনেরা ভাগ করে করতাম।তিনটে শোবার ঘর, ড্রয়িং -ডাইনিং আর রান্নাঘর মিলে পাঁচ কামরার সরকারি কোয়ার্টার। মামার চাকরির সুবাদে পাওয়া পুরোনো ধাঁচের এই কোয়ার্টার গুলোয় আধুনিক সুবিধা না থাকলেও পর্যাপ্ত জায়গা ছিল। বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় মামী মৌসুমি সবজি ফলাতেন। আবার এককোনে ছোট ঘর তুলে হাঁস মুরগী পালতেন। সে সুবাদে বাজার খরচ কিছুটা কমতো।
একটা শোবার ঘরে মামা মামী আর দুটো তে আমরা বোনেরা থাকতাম। সামনের ড্রয়িং রুমে একটা খাট পাতা ছিল। সেখানে মোরশেদ ভাই আর বেনু ঘুমাতো। বেনু আমার ছোট ভাই। বড় আপা, রুনু আপা আর আমি একটা রুমে গাদাগাদি করে শুইতাম। অন্যরুমটা একটু ছোট, সেখানে মনু আপা আর মেজ আপা শুতেন।
আমি দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বড় আপার জন্য দুটো প্রস্তাব আসে। প্রথম দেখাতেই বড় আপাকে একপক্ষ পছন্দ করে ফেললো। দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল মামার এক কলিগের ভাগ্নের জন্য। ওরা আপাকে আগে থেকেই দেখে পছন্দ করেছিল। প্রথম পক্ষ নাছোড়বান্দা হয়ে অল্প দিনের মধ্যে আপা জন্য পাকা কথা নিয়ে নিলেন। দ্বিতীয় পক্ষ একটু মন খারাপ করলেও পরে তারা মেঝ আপাকে তাদের পাত্রের জন্য চেয়ে বসলেন। এভাবে আমার দুই বোনের বিয়ে প্রায় একই সময়ে অনাড়ম্বর ভাবে হয়ে গেল। অবশ্য আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে দেয়ার সামর্থ্য মামার ছিলও না।
আমি এইচএসসি দেয়ার আগেই রুনু আপার আর মনু আপারও বিয়ে হয়ে গেল খুব সাদামাটা ভাবে। বোনেরা শ্বশুরবাড়িতে মোটামুটি সুখেই আছে। বাড়িতে এখন মামা মামী, আমি আর মোরশেদ ভাই। বেনুকে বড় দুলাভাই নিয়ে গেছেন। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি দুলাভাইয়ের ব্যবসায় সাহায্য করে। ঘরের কাজে আমি যতক্ষণ পারি মামীকে সাহায্য করি।
মোরশেদ ভাই একটা বেসরকারি ব্যাংকে আছেন। আমাদের ভাইবোন সবার বড় মোরশেদ ভাই। গতমাসে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ভাবী খুব সুন্দরী। ভাবীর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার জন্য বিয়েটা এখনো হয়নি। পরীক্ষার পর বিয়ে হবে। মোটামুটি দুই পরিবারের আসা যাওয়া চালু আছে।
গত পরশু মামা মামী, রুনু আপার বাসায় দাওয়াতে গেছিলেন। আমার পরীক্ষা তাই সাথে যাইনি। মোরশেদ ভাইয়ের অফিসে পার্টি। ওনি ওখানে খেয়ে আসবেন তাই আমি খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। মামা মামী দশটার দিকে ফিরেছিলেন। ওরা ক্লান্ত ছিলেন বলে একটু তাড়াতাড়ি শুতে গেলেন।
রাত সাড়ে বারোটার দিকে মোরশেদ ভাই এলেন। ওনাকে দরজা খুলে দিতে হবে তাই আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় শুয়েছিলাম। আমার খুব বাজে অভ্যাস দরজায় বেল দিলেই জিজ্ঞেস করার আগেই দরজা খুলে দিই। সেদিনও তাই হলো। ঘুম চোখে দরজা খুলে দিলাম। মোরশেদ ভাই কেমন চোখে যেন তাকিয়ে ছিলেন।
গা থেকে কেমন উদ্ভট একটা গন্ধ পেলাম। কথা না বাড়িয়ে দরজার বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে যেতেই মোরশেদ ভাই ডাক দিলেন পানি দিয়ে যেতে। মোরশেদ ভাই এখন মনু আপাদের ঘরটায় থাকেন।
আমি পানি নিয়ে ঘরে টেবিলে রাখতেই দেখি মোরশেদ ভাই দরজা বন্ধ করছেন। আমি জিজ্ঞেস করতেই আমাকে ইশারা দিলেন চুপ থাকতে। ভাবলাম কোন সারপ্রাইজ দিবেন হয়তো। কাছে এসে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁট দুটো জোরে তার ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরলেন। আমি আতংকে চিৎকার দিলেও গোঙানি ছাড়া কিছু বের হলো না।
মোরশেদ ভাই আমার মুখে তার গামছা ঢুকিয়ে দিলেন। ধস্তাধস্তি এক পর্যায়ে আমাকে বিছানায় টেনে নিলেন। তার শক্ত জোরালো শরীরের সাথে আমার দূর্বল শরীর পেরে ওঠল না। সে রাতে আমারই মামাতো বড় ভাইয়ের হাতে আমার ধ'র্ষন হলো।
মাতাল মোরশেদ ভাই তার শারীরিক তৃপ্তি নিয়ে মরার মতো পড়ে ঘুমালেন। আর আমি ফজরের আজান পর্যন্ত হতবিহ্বল জেগে রইলাম। দুচোখ বেয়ে শুধু পানি ঝরেছিল। কি বলবো,কাকে বলবো? যে মামা মামীর নিমক খেয়েছি তার ছেলের কথা কিভাবে বলি। নিজের ঘরে এসে বালিশে মুখ চেপে কেঁদেছি। তারপর গোসল করে দু' রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহকে বলেছি। এ বিচার আমি আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে চাইতে পারি না। বিচার চাইতে গেলে সন্দেহের তীর ছুটে আসবে। কথা উঠবে আমি নিশ্চয়ই মোরশেদ ভাইকে বিয়ে করতে চাই। আমি তাদের আশ্রিতা।
গত দুইদিন ধরে মোরশেদ ভাই অনেক চেষ্টা করছেন আমার সাথে কথা বলতে। আমি ঘরে কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না যতোটা সম্ভব। তবুও মামী মামা জিজ্ঞেস করেছেন কি হয়েছে। ন্যূনতম খেতাম, সারাদিন ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে থাকতাম। আমার ইনকোর্স পরীক্ষাগুলো কোনমতে দিচ্ছি। পড়া আমার কিছুই হয় না, শুধু বারবার সেই রাত, সেই ক্ষণ আমাকে তাড়া করে ফিরছে।
রাতে মোরশেদ ভাই আসার আগেই আমি খেয়ে রুমে চলে গেলাম। পিছন থেকে মামীর ভৎসনা শুনতে পাচ্ছি, ‘কি এমন পড়া,সারাদিন দরজা বন্ধ করে রাখিস। আগে তো ঘরের টুকিটাকি করে দিতি। আমারও বয়স হয়েছে সেটা কি দেখিস না?’ আমি চুপচাপ চলে গেলাম।
আধাঘন্টা পরে মোরশেদ ভাই এসেই বোমা ফেললো ঘরে। তিনি বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন এবং তিনি আমাকে বিয়ে করবেন। ভাবীর বাড়ি থেকেও ফোন আসা শুরু হয়ে যাবে একটু পর হয়তো। মামা মামী হতবাক, সাথে আমিও। এতোটা আশা করিনি। কিছুটা হাসিও পেল। তিনি তার অনুশোচনার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমায় স্বীকৃতি দেবেন। তাতে কি আমার ভেতরের ঘৃণা মিটবে?
মামা হুঙ্কার দিলেন। মামী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ছিল তাহলে তোর মনে? এতোই যদি এইঘরের বউ হওয়ার শখ ছিল তবে আগে বললি না কেন? এতো লোক হাসিয়ে আমাদের অপমান করার জন্য?’
মামী আরও বিভিন্ন ভাবে আমায় কথা শোনাচ্ছিলেন। একসময় আমি মুখ খুললাম। মামা মামীর সামনে সেদিনের ঘটনা বলে দিলাম। মামী চিৎকার করতে করতে এসে আমার চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে বললেন,
‘হতচ্ছাড়ি! আমার ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করার জন্য ফাঁদে ফেলে আবার আমার ছেলের চরিত্রে কলঙ্ক দিচ্ছিস? সারাজীবন খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করলাম,তার এই মূল্য দিলি? কোনদিন আমি,আমার বাচ্চারা শখ আহ্লাদও করতে পারিনি তোদের জন্য। আজ এই মূল্য দিলি? এখুনি বের হয়ে যা,কাল সাপের বাচ্চা।’
মোরশেদ ভাই একবারও তার বাবা মাকে সত্যিটা বললেন না, স্বীকার করলেন না। মামী আমার বড় দুই বোনকে ফোন করে সব জানালেন, গালি গালাজ করতে লাগলেন আমার মৃত বাবা মাকে,শাপশাপান্ত করতে লাগলেন আমাকে। মামীর সাথে মামাও।
সইতে না পেরে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ। খুব কান্না পেল। ধীরে ধীরে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিলাম। সারারাত মামী একে তাকে ফোন করে আমার কৃতকর্মের কথা সবাইকে মোটামুটি জানিয়ে ফেলেছেন। ভোর হওয়ার আগে মোরশেদ ভাইকে একটা চিঠি লিখলাম।
❝❝❝
'মোরশেদ ভাই।'
‘আপনার সাথে কথা বলার রুচি আমার নেই। সারাজীবন আপনাদের আশ্রিত ছিলাম। মামা মামী ছায়ায় ছিলাম। কখনো নিজেকে এতিম মনে হয়নি। আজ নিজেকে এতিম মনে হচ্ছে। এতোদিন আমাদের ভাইবোনের জন্য আপনাদের স্যাক্রিফাইসগুলো শোধ দিতে না পারার কষ্টও কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। প্রতিদান কিভাবে দেব সেটা খুঁজে পেতাম না। আপনাদের ত্যাগের প্রতিদান আমার সতীত্বের দামে নিবেন জানা ছিলো না।’
ইতি
'আশ্রিতা।'
❝❝❝
ভোর হতেই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। বড় আপা বারবার ফোন দিয়েছে রাতভর, ওর ওখানে চলে যেতে। আমি ফোনটা বন্ধ করে সিমটা ফেলে দিলাম। দ্বিতীয়বার কারও আশ্রিতা হতে চাই না।
'এ্যাঁই, যাবি? রেট কত তোর?'
কথাগুলো শুনে মনে হল গায়ে কেউ এসিড ছুঁড়ে দিয়েছে। তাকিয়ে দেখি পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সী একলোক আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরনে সস্তা টেট্রনের শার্টটার বুকের তিনটা বোতাম খোলা। লুঙ্গি টাখনু ছুঁয়ে নেমে গেছে মাটিতে। মুখ দিয়ে সুরভী জর্দার গন্ধ ভুরভুর করে বের হচ্ছে। মামীর সুরভী জর্দা কৌটা থেকে এমন গন্ধ পাওয়া যেত।
'কি রে, তোর তো ভারী দেমাগ! রেট কত তোর?'
আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে আস্তে আস্তে চোখ নামিয়ে নিলাম। পার্ক থেকে বের হয়ে গেলাম।
বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে বান্ধবীর হোস্টেলে গেলাম। ওর কাছে ব্যাগটা রেখে সারাদিন বিভিন্ন মহিলা হোস্টেল গুলোতে খোঁজ নিলাম। কোথাও বাসা ভাড়া নেয়ার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
সম্বল বলতে বড় আপার ঈদে দেয়া দুই হাজার টাকা যেগুলো আমি জামা না কিনে কলেজে পাওনা পরিশোধের জন্য রেখেছিলাম। আর নিজের জমানো সাতাশ'শ টাকা। মামা কলেজে যেতে প্রায়ই গাড়ি ভাড়া বাবদ বিশ পঞ্চাশ টাকা দিতেন। দুলাভাইরা বেড়াতে এক দুইশ টাকা হাত খরচের জন্য দিতো। আমার কখনো কোন বাড়তি বিলাসিতা ছিল না। এগুলো আমি জমাতাম ফর্ম ফিলাপ বা বই খাতা কেনার জন্য। ভবিষ্যতে কি হবে বা কি খাব আপাতত কিছু মাথায় আসছে না,একটা থাকার জায়গা দরকার।
বান্ধবীর হোস্টেলে সিট খালি নেই বলে একটু বিপদেই পড়লাম। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। পা যেন আর চলতে চাইছে না। বিকেলের পর একটু জিরোতে পার্কে বসে ছিলাম। বিভিন্ন কথা মনের মধ্যে উথাল-পাতাল করছিল যে, কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমার খেয়াল ছিল না।
লোকটার কথায় খারাপ লাগলেও তাকে আমি দোষ দেই না। কারণ, ভর সন্ধ্যাবেলা ওখানে কোন ভদ্রঘরের মেয়ে একা, বিহবল বসে থাকবে এটা আশাতীত।
আবার এলাম বান্ধবীর কাছে। আমার খুব লজ্জা হতে লাগলো। কারো আশ্রিত হতে চাইনি কিন্তু আমি নিরুপায়। আমার সারাদিনের না খাওয়া চিমশে মুখ দেখে সে অনেক প্রশ্ন করতে লাগল। মোরশেদ ভাইয়ের অংশটুকু ছাড়া তাকে যতটুকু বলা যায় ততটুকু বললাম। সে-ও তার পরিচিত কয়েকজনকে নক দিল। কোথাও খালি নেই।
ওর রুমে বোর্ডার তিনজন। ওরাই প্রস্তাব দিল, যতদিন কোথাও ব্যবস্থা না হয়, আপাতত ওদের ওখানে গেস্ট হিসেবে থাকার। তবে সেটা এক সপ্তাহের বেশি যেন না হয়। ততদিন কিন্তু মিল চালিয়ে যেতে হবে। আমি মনে মনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালাম। সারারাত আমার প্রায় নির্ঘুম কেটে গেল।
সকালবেলা ওঠে প্রথমে কলেজে গেলাম। এক বান্ধবী তার খালাতো ভাই বোনের জন্য গৃহশিক্ষক খুঁজচ্ছিল। কয়েকদিন আগে ওরই মুখে শুনে আমি নিজেও অনেককে বলেছি। ভাগ্যের ফের,আজ আমাকে এখনে দাঁড় করিয়ে দিল। মামার বাসায় থাকতেও বেশ কয়েকটা টিউশনের অফার এসেছিল কিন্তু মামীর কাজে সাহায্য করার জন্য সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি।
বান্ধবীর সাথে দেখা হলে ওকে বললাম, ‘টিউশনটা আমি করতে চাই।’ সে একটু অবাক হলেও মুখে কিছু বললো না। কথায় বলে, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন। ঐদিন আমি একসাথে দুটো টিউশন পাই। দুটো টিউশন করলে মাস শেষে পাঁচ হাজার পাবো। আমার কোনমতে চলে যাবে।
এক সপ্তাহ হওয়ার আগেই একটা পরিবারের সাথে পেয়িংগেস্ট হিসেবে উঠে গেলাম। পরিবারটি এক বোর্ডার আপুর পরিচিত। স্বামী স্ত্রী এবং তাদের তিন মেয়ে নিয়ে পরিবার। পরিবারের কর্তা একটা বেসরকারি অফিসের কেরানী। দেখতে রোগা,অপুষ্ট চেহারা। তার স্ত্রী এবং তিন মেয়ে, চারজনেই স্থুলকায়।
কিছুদিনের মধ্যে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, ভদ্রলোকের স্ত্রী এবং তার মেয়েদের ব্যবহার এমন, যেন আমি তাদের বাসায় আশ্রিত। কথায় কথায় খাবার খোঁটা দেয়, কাজ নিয়ে ভাগাভাগি করে, নিম্নমানের খাবার আমার জন্য দিচ্ছে। অথচ টাকা পুরোটায় নিচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে বাড়তি টাকাও আবদার করছে।
একদিন বাসি হয়ে যাওয়া নষ্ট ছোট মাছের তরকারি আমাকে খেতে দিল। ওরা আমার খাবার রুমে রেখে যেত। ভাবলাম হয়তো গরমে তরকারি নষ্ট হয়ে গেছে। এরকম একসপ্তাহে তিন বার হয়ে গেলে আমি আন্টিকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করতেই তিনি প্রথমে অস্বীকার করলেন। তারপর আমাকে বলেন, ‘এতো ফুটানি হলে অন্য কোথাও চলে যাও। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাদের বদনাম করতে চাও? তোমাদের মতো ছোটলোক পরিবারের মেয়েদের মুরোদ নাই, কিন্তু ফুটানি যায় না। এসব স্বভাবের জন্য নিজের পরিবারেও থাকতে পারো না।’
সে রাতেই আমাকে ঘর ছেড়ে দিতে বলা হল। তখনো মাসের মোটে দশ তারিখ, আন্টি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘পুরো মাসের টাকা দিয়েই যেন বের হই। নয়তো তিনি জানেন কিভাবে টাকা আদায় করতে হয়।’ অথচ তার কাছে আমার জামানতের তিন হাজার রয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘আমার জামানত থেকে মাসের টাকা রেখে বাকি টাকা ফেরত দিতে।’ তারপরদিন সকালে টাকার সাথে সাথে আমার কপালে মিথ্যা অপবাদ জুটল। ‘আমি নাকি তার স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করছি তাই আমাকে বের করে দিচ্ছেন।’ তিনি আশেপাশের মানুষ জড়ো করে উচ্চস্বরে এসব কথা বলতে লাগলেন। আমি কথা না বলে বের হয়ে এলাম কারণ আমার পায়ে যখন মাটি নেই প্রতিবাদ সেখানে শব্দ হবে না।
এক পরিচিত আপুকে নক দিয়ে আগেই একটি মেসে সিট নিয়েছি। তল্পিতল্পা নিয়ে সেখানে উঠে গেলাম।
বানভাসি মানুষের মতো একবার এখানে আরেকবার ওখানে করতে গিয়ে আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার ফলাফল নিয়ে ভাবার সময় পাইনি। একমাস পার হয়ে আরও বিশদিন চলে গেলেও আমার চলতি মাসের পিরিয়ড হলো না। ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর এটা নিয়ে কোন ইমোশন কাজ করেনি। এই দূর্ঘটনাকে আবেগ দিয়ে ভাবলে আমার পথচলা দায় হয়ে যাবে।
প্রথম মাসের টিউশনের টাকাটা পেয়ে সোজা চলে গেলাম কমিউনিটি ক্লিনিকে। ওরা নানা প্রশ্ন করতে লাগলো। বিয়ে হয়েছে কি-না, স্বামী কই, সাথে এলো না কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি বলার ইচ্ছে ছিল না, মিথ্যা বলার দরকার মনে করিনি, তাই চুপ ছিলাম।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে একজন আয়া বলে উঠলেন, ‘কার সাথে লটরপটর করতে গিয়ে ওটা বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছে আরকি। এগুলো টাকা পেলেই যার তার সাথে শুয়ে পড়ে। বাপ মায়ের দেয়া টাকায় তো আর বিলাসিতা করতে পারে না!’
আমার দু'চোখ জ্বলতে শুরু করেছে। তবুও কিছু বলিনি। এবরশন যখন ডাক্তার করছিলেন প্রচন্ড ব্যথায় 'মাগো' বলে চিৎকার দিয়েছিলাম মনে আছে। মেসে ফেরার সময় রিকশার ঝাঁকুনিতে মনে হল প্রাণ বেরিয়ে যাবে। মেসে ফিরে বাথরুমের ঢুকে হাউমাউ করে কেঁদেছি। দিনে মেসের বোর্ডাররা তেমন কেউ থাকে না বলে নিজেকে ধরে রাখিনি। মনে মনে এটুকুই চাওয়া ছিল নিজের কাছে, এ জীবনে শোনা প্রতিটি কথা, প্রতিটি প্রশ্নের জবাব একদিন নিশ্চিত দেব।
তারপর থেকে শুধু কলেজ, টিউশন আর বিভিন্ন কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য নিজেকে তৈরী করা। এর ভেতর বড় দুলাভাই কলেজে খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু আমি দেখা করিনি। একদিন হঠাৎ রাস্তায় বেনুর সামনাসামনি পড়ে গেলাম। আমার খুব ইচ্ছে হলো একবার ভাইটাকে একটু আদর করি। কিন্তু বেনু আমায় দেখে খুব সহজেই মুখ ফিরিয়ে চলে গেল, যেন আমি চলতি পথে কোন পথচারী।
বছর দুয়েক পরের ঘটনা। অনার্স পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। আমি মেসেই ছিলাম। একজন এসে বললো, ‘কেউ একজন আমায় খুঁজতে এসেছে।’ আমার রুমমেটরা অবাক। আমাকে তো এতোদিনে কেউ কখনো খুঁজতে বা দেখা করতে আসেনি?
আমি বাইরে এসে দেখি মোরশেদ ভাই আর মামা। খোঁজ কিভাবে পেলেন জানি না। একই শহরে থাকি,খোঁজ পাওয়া অসম্ভব কিছু না। মামা খুব নরম কন্ঠে আমায় কাছে ডাকলেন। এটাও বললেন যে, ‘মোরশেদ ভাই সব স্বীকার করেছেন। তিনি এখনো আমায় বিয়ে করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান।’
আমি আশ্চর্য হলাম। কারণ খেয়াল করলাম এদের কারো প্রতি কোন রকম সহানুভূতি কাজ করছে না। আমার নির্লিপ্ততা এবং আড়ষ্টতা দেখে ওরা আর কথা বাড়ালো না। মোরশেদ ভাই বারবার ক্ষমা চাচ্ছেন। প্রচণ্ড ঘৃণায় আমার সারা গা রি রি করতে লাগল। কিসের ক্ষমা?
আমি সরাসরি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনাদের ত্যাগের মূল্য তো শোধ হয়ে গেছে, এখন ক্ষমা চাওয়ার নাটকটা বাদ দিন। দয়া করে বিদেয় হন।’
ওই সপ্তাহে আমি মেসটি ছেড়ে দিয়ে নতুন আরেকটা মেসে ওঠলাম। সে বছর আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে জয়েন করি। চাকরির পাশাপাশি সমানে পড়াশোনা চলতে থাকে। লক্ষ্য একটাই বিসিএস দেব। রোজ অফিস শেষে একটা কোচিং সেন্টারে পড়তে যাই। ফিরতে রাত হলে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর চোখ অনেক কথা বলে। তাদের দৃষ্টিতে শরীরে সাপ ছেড়ে দেয়ার মতো মনে হয়। রোজ রাতে আল্লাহকে বলি, ‘আরেকটু ধৈর্য্য দাও,আরেকটু যেন সইতে পারি।’
প্রথম বার বিসিএস পরীক্ষার জন্য খুব পরিশ্রম করে তৈরি হলাম। পরীক্ষার দুই সপ্তাহ আগে হঠাৎ জ্বরে পড়লাম। প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতাম। পরীক্ষায় টাইফয়েড ধরা পড়ল। রুমমেটরা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিল। ওরা সকাল বিকেল পালা করে দেখতে যেত, রাত জাগতো।
প্রায় দুই সপ্তাহ পরে জ্বর একটু কমল। রিলিজ নিয়ে বাসায় আসার পর অফিসে ফোন দিলে জানা গেল আমার চাকরিটা প্রায় নেই। আমাকে তারপরের দিন জয়েন করতে বলা হলো। গেলাম, সারাদিন অফিস করে মেসে ফিরে আবারও জ্বর। এবার সেই জ্বর মাস দুয়েক ভুগিয়ে ছাড়ল। আমার ওজন কমে গেল, লম্বা চুল প্রায় ঝরে গেল। আমার চাকরি চলে গেছে, হাতে টিউশনও নেই। এর তার কাছ থেকে ধার করে কিছুদিন চলার পর আবারও টিউশন শুরু করলাম।
এবার আর চাকরি নিলাম না। টিউশন পড়াই আর নিজের পড়া পড়ি। হঠাৎ একদিন পরিচয় হলো এক ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে। চমৎকার সুদর্শন মানুষটিকে আমার ভালো লাগতে শুরু করল। সে আমাকে উৎসাহ দিতো বিসিএস পরীক্ষার জন্য পড়তে। আমরা একসাথে স্বপ্নও দেখেছি সুন্দর ভবিষ্যতের। সে বলতো আমার অতীত নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।
আমরা বিয়ে করব ঠিক করলাম। সে আমার বিসিএস না হওয়া পর্যন্ত বাসায় জানাবে না। বিসিএস হলে তবে একসাথে দুটো সারপ্রাইজ দিবে। ওর পরিবার মোটামুটি চিনত আমাকে। এরমধ্যে একদিন ভাবলাম আমাদের সম্পর্ক তো একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছে, আর আমার অতীত নিয়েও তার কোন মাথাব্যথা নেই। আমার নিজস্ব স্বচ্ছতার জন্য তাকে সব জানানো উচিত।
আমরা দেখা করলাম। সে আমার হাত ধরেই ছিল। আমি তাকে সব বলে দিলাম। আমি মামার কাছে মানুষ, এতিম এসব সে জানত। তাতে কোন সমস্যা ছিল না। যখনি সে রাতের ঘটনা এবং আমার এবরশনের কথা জানালাম, তখন সে অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দিল। বললো, ‘এই একুশ শতকে এসব নিয়েও সমস্যা হয় নাকি?’
আমার বুকের পাথরটা নেমে গেল। খুশি হয়ে মেসে ফিরলাম। এরপর থেকে ওর সাথে কথা বা দেখা হওয়া কমতে লাগলো। খালি ব্যস্ততার অজুহাত। কিছু বললেই রেগে যেত। বিয়ের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে লাগলো। একদিন খুব কথা কাটাকাটি হলে এক পর্যায়ে আমাকে বললো, ‘এতো যে গলা উঁচু করে কথা বলো, তোমার আছেটা কি? ভার্জিনিটিও তো নেই।
এই কথার পর আমার জবাব আমি পেয়ে গেলাম। নিজেকে নিজেই জুতা পেটা করতে ইচ্ছে করছিল। আমি নিজের লক্ষ্য ভুলে স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসই বা করলাম কেন?
তারপর স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়ে আবারও পড়াশোনায় মনযোগ দিলাম। আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন। পরের বছরই আমি বিসিএস পাশ করে যাই। নিয়োগ হওয়ার পর যতবার আমার বদলি হতো, চয়েস করার সুযোগ পেলে নিজ জেলায় পোস্টিং না নেয়ার চেষ্টা করেছি সর্বোচ্চ।
বিয়েও করেছি। পেশাগত দিক দিয়ে পরিচয়ের পর যখন হৃদ্যতা বাড়ল তখনই তাকে সব জানিয়েছি। তিনি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই। কোন নায়কোচিত কিছু করেননি। শুধু বলেছেন, ‘মানুষ দূর্ঘটনায় হাত,পা হারায়। আমি মনে রাখব আমার স্ত্রী দূর্ঘটনায় তার কুমারিত্ব হারিয়েছেন, নিজেকে নয়।’
এখন আমার জীবন একবারে হ্যাপিলি এভার আফটার জাতীয় কিছু নয় হয়তো, তবে আমি যা হারিয়েছি তার প্রতিদানে অনেক বেশি পেয়েছি। আমার পরিবার আছে, সেখানে আমি আশ্রিত নই। আমার সামাজিক প্রতিষ্ঠা আছে, সেখানে কেউ চাইলেই আমার রেট কত জিজ্ঞেস করতে পারে না। আমার আর্থিক নিরাপত্তা আছে,আমাকে কেউ খাবার খোঁটা দিতে পারে না।
(সমাপ্ত)...
0 Comments