রূপকথার শহর! (পর্ব-২০) | নবনী নীলা

ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-২০

ইশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই আরহান ইশার কানে কানে নিজের অভিযোগ জানালো। সে এক  নির্লজ্জ অভিযোগ মুহূর্তে ইশার কানদুটি রক্ত বর্ন হয়ে গেলো।

ইশা চোখ বড় বড় করে আরহানের দিকে তাকালো। আরহান কৌতূহল নিয়ে ইশাকে দেখছে।

“ এতো অবাক হওয়ার কি আছে?”, আরহান ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো।

ইশা নিচু স্বরে বললো, “ আমি পারবো না।”

আরহান ভ্রু কুঁচকে বললো, “ কেনো?”

ইশা অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, “ কারণ আমি আপনার মতন নির্লজ্জ নই।”

আরহান একটা ভ্রু তুলে তাকালো। তারপর আস্তে করে নিজের বাধন ইশার থেকে সরিয়ে নিলো।

আরহান তার থেকে সরে যেতেই ইশা হতবাক হয়ে তাকালো। লোকটা কি তার উপর রাগ করলো! নাকি ভঙ্গ ধরেছে ইচ্ছে করে?

রাগ করলে করবে। এতো সহজে আবদার পূরুণ হচ্ছে না জনাব। আজকে সারাদিন আমি আপনার অপেক্ষা, করেছি না? আপনিও অপেক্ষা করবেন। তারপর ইশা ঠোঁট চেপে হাসলো। আরহানকে আরো রাগিয়ে দিয়ে সে আরহানের দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়লো।

কায়ান নিজের রুমের বাইরে বিরক্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কারণ লজ্জায় রাহি রুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা আটকে দিয়েছে।

কায়ানের মেজাজ বেশ ফুরফুরা। সে বিরক্তি দেখাতে চেষ্টা করলেও তার ঠোঁটের কোণের হাসি রুবান সহ বাকি সবার চোখ কাড়ছে। সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।

কায়ান দরজায় আবার টোকা দিয়ে কন্ঠ কিছুটা কঠিন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো, “ রাহি। দরজা খুলো।”

ভিতরে রাহি অনুশোচনায় যেনো গর্তে ঢুকে পড়েছে। 

ছিঃ ছিঃ

কি হয়ে গেলো? সে ক্রমাগত নিজের ঠোঁট ডলে যাচ্ছে। রাহি পারছে না হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কিভাবে এই ভুল হয়ে গেলো! 

তাও আবার কায়ান। 

আস্তাগফিরুল্লাহ!

ইচ্ছে করছে নিজেকেই যেনো জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে দেয়। রাগে জেদে রাহির ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। এর মাঝে আবার দরজায় টোকা পড়তেই রাহি চেঁচিয়ে উঠে বললো, “ আমি দরজা খুলবো না। আর তোমার মুখও আমি দেখতে চাই না।”

রাহির কথায় কায়ান মনে মনে হাসলো। তারপর বললো, “ দেখো সুইটহার্ট। সুন্দর করে বলছি। দরজা খুলো।” তারপর কায়ান রুবানের দিকে তাকিয়ে বললো, “ এমন করছে যেনো আমি জোর করে তাকে কিস করেছি। কিন্তু সে নিজে ইচ্ছাকৃত আমার উপরে পড়েছে।”

কায়ান শেষ করতেই ভিতর থেকে রাহি গর্জে উঠে বললো, “ আমার বয়েই গেছে তোমার উপর পড়তে। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।”

কায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “ তাহলে দরজা বন্ধ করে আছো কেনো?”

“ আমার ইচ্ছে।”, বলেই আবার চেঁচিয়ে উঠলো রাহি।

“ I'm sorry কিন্তু তোমার ইচ্ছে পূরন হচ্ছে না সুইটহার্ট।”, বলেই কায়ান এক ধাক্কায় দরজার লক ভেঙে ভিতরে ঢুকলো।

কায়ান ভিতরে ঢুকতেই রাহি আরো রেগে গেলো। কায়ান এক পা, দু’পা এগিয়ে আসতেই রাহি হঠাৎ হাতের কাছে থাকা একটি শোপিস তুলে আছড়ে ফেললো নীচে। শোপিসটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো পুরো ফ্লোরে।

কায়ান চোখের পলক ফেলারও সুযোগ পেলো না। পিসটি তার কালেকশনের সবচেয়ে দামি ছিলো। শুধু দামি নয়, এটি একটি অমূল্য অ্যান্টিক—যা কেবলমাত্র কায়ানেরই সংগ্রহে ছিলো।

রুবান স্তব্ধ হয়ে কায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে জানে, এই জিনিসটি কায়ানের সবচেয়ে প্রিয়। অথচ কায়ানের মুখে কোনো ক্ষোভের ছাপ নেই। রাগ, অভিমান বা বিস্ময়—কিছুই প্রকাশ পেলো না।

রুবান বিস্মিত। এমন নির্লিপ্ততা কায়ানের স্বভাববিরুদ্ধ।

কায়ান ধীরে ধীরে রাহির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “ সাবধান। কাচের টুকরো পায়ে বিধবে।”

রাহির অস্থিরতা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। সে মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাচের টুকরোগুলোর দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। একটু আগেও যে ক্ষোভে সে কাঁপছিল, এখন সেখানে শুধু ক্লান্তি আর দ্বিধা।

কায়ান গভীর এক নিশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রুবানকে বলল, “জায়গাটা পরিষ্কার করে দিও।”

তার কণ্ঠে কোনো রাগ ছিল না, বরং একধরনের ক্লান্ত বোধ। কায়ান বেরিয়ে যেতেই রাহি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সোফায় বসে পড়লো।

ভোর হয়েছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা নরম আলো রুমটাকে হালকা করে ভরিয়ে দিচ্ছে। সারারাত কায়ান এই ঘরে আসেনি।

রাহি চুপচাপ ভাবছে।

কায়ানকে যতটা খারাপ ভেবেছিল, সে ঠিক ততটা নয়। তবুও... সব কিছু কি ভুলে থাকা যায়? খুন, গুম, দখলদারি—এইসব অপরাধে কায়ান পারদর্শী।

অন্যদিকে, কায়ান নিজের অফিসে বসে গভীরভাবে চিন্তায় ডুবে আছে। এক হাতে সিগারেট, চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা।

রাহির প্রতি যে এক অদ্ভুত টান তৈরি হয়েছে, তা সে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু এই অনুভূতিকে কি প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে?

সকালে ঘুম থেকে উঠে ইশা হাত বাড়িয়ে আরহানকে খুঁজলো কিন্তু নেই। দ্রুত চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো বিছানায় আরহান নেই। তাকে না বলেই কাজে চলে গেলো? এতো রাগ!

ইশা কিছুক্ষণ চুপ করে বিছানায় বসে রইলো। মনটা কেমন যেনো করছে, সকালে না বলে চলে গেলো। রাতে আবার কখন আসবে কে জানে? এতো নির্দয় একটা মানুষ। 

আজকে না তাকে বাবার বাড়িতে নিয়ে যাবে? রাত হলেই সব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, আর সকালে কাচকলা দেখিয়ে চলে যায়।

নিজেকে সামলে ইশা ফ্রেশ হয়ে নেমে এলো নিচে।

ড্রয়িং রুম থেকে আসা কথাবার্তার আওয়াজ কানে এলো।উঁকি দিয়ে তাকাতেই চমকে গেলো—আরহান তার টিম নিয়ে নিচে মিটিংয়ে বসে আছে।

ইশা হতবাক হয়ে নিচে নামলো।

তাহলে সে যায়নি? বাড়িতেই আছে? কিন্তু বাড়িতে বসেই মিটিং কেনো?

চোখ চলে গেলো আরহানের বাবার দিকে—তিনি ডাইনিং টেবিলে বসে বিরক্ত মুখে চা খাচ্ছেন।

এই সময়ে সাধারণত তিনি খবরের কাগজ পড়েন, কিন্তু আজ জায়গাটা দখল করে নিয়েছে আরহান ও তার ল্যাপটপ।

রান্নাঘরের দিকে যেতেই শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন,“তোমাকে কিছু বলেছে এই ব্যাপারে?”

“কোন ব্যাপারে?”—ইশার চোখে বিস্ময়।

“বলে নি? ও নাকি এখন থেকে বাসা থেকেই কাজ করবে।”

“বাসা থেকে? মানে অফিসে যাবে না?”—ইশা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না।

“হ্যাঁ, সেটাই তো বললো।”শাশুড়ির কথায় ইশার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো।

যা-ই হোক, লোকটা অন্তত সামনে থাকবে।

ইশা চুপচাপ আরহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিজেই শ্বাশুড়ীকে বললো,“আচ্ছা, আপনাকে সাহায্য করি।”

কিন্তু সাহায্য করতে গিয়ে পুরো রান্নাঘরেই যেন যুদ্ধ লাগিয়ে ফেললো!

হঠাৎ করে আটার ড্রাম নিচে পড়ে ভেঙে পড়লো, আর সেই শব্দে গোটা বাড়ি থমকে গেলো।

সবার চোখ রান্নাঘরের দিকে।

ইশা নার্ভাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে শাশুড়ি বললেন,“থাক, থাক! তুমি গিয়ে বসো। আমরা সামলে নিচ্ছি।”

“না না, আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি,”—ইশা আগ্রহ নিয়ে বললো, কিন্তু তাতেও লাভ হলো না।

শাশুড়ি হাসিমুখে একরকম জোর করেই ইশাকে এনে বসিয়ে দিলেন ডাইনিং টেবিলে।

ইশার মুখে লজ্জার ছাপ দেখে আরহানের বাবা বললেন,

“আহা, এইসব কোনো ব্যাপার না। এসো, বসো।”

ইশা চুপচাপ বসে রইলো।

সামনেই ডাইনিং টেবিল থেকে দেখা যাচ্ছে আরহানকে।সে মিটিংয়ে ব্যস্ত, কিন্তু একবারও চোখ তুলে তাকালো না ইশার দিকে।

কিছুক্ষণ পর দরকারি ফাইল হাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো আরহান।

ইশা চুপচাপ তার পেছনে পেছনে রওনা দিলো।

আরহান রুমে ঢুকতেই ইশা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

আরহান একবার তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,“কিছু বলবে?”

ইশা কিছুটা অভিমান আর কিছুটা আগ্রহ নিয়ে বললো,“হ্যাঁ। আপনি তো বলেছিলেন আজ আমাকে বাবার বাড়ি নিয়ে যাবেন!”

তার চোখে একরাশ আশা—এই বুঝি আরহান হেসে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে, কিছু মিষ্টি কথা বলবে।

কিন্তু না।

আরহান চোখ না তুলে ফাইলের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললো,“তাহলে তৈরি হয়ে নিচে এসো।”

এই বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই,ইশা হঠাৎই তার হাত ধরে ফেললো।

আরহান থেমে গিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,“ছিঃ! তোমার লজ্জা করছে না?”

ইশা হতবাক।

সে বলে কিনা লজ্জা করছে না!

ভূতের মুখে রাম নাম!

গাল ফুলিয়ে ইশা বললো,

“লজ্জা করবে কেনো? আমি নিজের বরকে ধরেছি, অন্য কাউকে নয়!”বলেই তাকে টানতে লাগলো রুমের ভিতর।

আরহান ধীরে ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“আমি নির্লজ্জ হতে পারি, তুমি না।”এই কথা বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

ইশা থ হয়ে তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে।

 ঠিক ইশা কাল রাতে যা বলেছে এই অসভ্য লোকটা তাকে সেই সব কথা শুনিয়ে গেলো।

তাহলে কালকে রাতের প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে? আচ্ছা! আমিও দেখবো আমাকে ইগনোর করে এই জনাব কতক্ষণ দূরে দূরে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন: রূপকথার শহর! (পর্ব-২১) | নবনী নীলা

Post a Comment

0 Comments