গল্প: হিম শীতল|অনামিকা আহমেদ| পর্ব-৩
ভোরের আজান কানে আসতেই শীতলের ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকিয়ে নিজের চারপাশে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়না, হয়তো বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। কেননা শীতলের স্পষ্ট মনে আছে ঘুমানোর আগে সে বিছানার পাশের দুটো ল্যাম্প জ্বালিয়ে রেখেছিল। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে শীতলের ভীষণ ভ*য়।
বালিশের নিচ থেকে দ্রুত ফোন টা হাতে নিয়ে ফ্লেশ লাইটটা জ্বালায় শীতল। তারপর গায়ের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে পা রাখে মসৃণ মেঝেতে। পরনে তার সাদা সালোয়ার, কামিজ। ঘুমের কারণে খোলা চুলগুলো খানিক এলোমেলো হয়ে আছে। কাপা হাতে বারান্দার দরজার ছিটকিনিটা খুলতেই আবছা আলোয় তার ঘর আলোকিত হয়ে উঠে। সেই সাথে ঠান্ডা হাওয়া শীতলের সর্বাঙ্গ স্পর্শ করে।
মোবাইলটা রেখে শীতল বারান্দার রেলিং ধরে দাড়ায়। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকায়। তখন অবশ্য রাতের তিমির অন্ধকার কেটে গিয়ে হালকা বর্ণ ধারণ করেছে। শীতল সেখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। ওযু করে নামাজ সেরে ফেলে। ততক্ষণে ইলেক্ট্রিসিটি ফিরে আসে। যাক, এবার সে দুদণ্ড শান্তিতে পড়তে পারবে। আমজাদ হোসেন রাত জেগে পড়াশোনা করা পছন্দ করেন না। তাই শীতল ভোর ভোর উঠে নিজের পড়াটা তৈরি করে নেয়।
টেবিলের ওপর থেকে বইগুলোর মধ্যে একটা বইয়ের মোড়কের ওপর তাক চোখ আটকে যায়। বইয়ের ওপর বড় বড় করে লেখা "Anatomy"। সেই সাথে শীতলের মনে পড়ে যায় গতকালের ঘটনা। অপরিচিত লোকের প্রতি তার মনে বেশ ক্ষো*ভ জমেছে। আর আজকে সেই লোকের ক্লাস করতে হবে তার। ব্যাপারটা যে সহজ হবে না সেটা সে ভালই বুঝতে পারছে। তবুও তার করার কিছু নেই। এসব ভেবে শীতল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পড়তে বসে যায়।
প্রতিদিনকার মত আজও আমজাদ হোসেনের দিন শুরু হয়েছে পত্রিকার শিরোনাম পড়ার মধ্য দিয়ে। সকালে নাস্তা না করুক, একবার অন্ততপক্ষে তাকে পত্রিকায় চোখ বোলাতেই হবে। আর সে সময় যদি হারুনের চা হয় তো কোনো কথাই নেই। হারুন চাচা এবাড়ির কেয়ার টেকার প্লাস রাঁধুনি। বউ এর এক ছেলে নিয়ে হোসেন ম্যানশন এ তার বাস বহুদিনের। বউটা এক বছর আগে মা*রা গেছে, এখন এক ছেলে রহিম কে নিয়েই থাকেন তিনি। রহিম এবার মাত্র কলেজে উঠেছে। বাজার করাসহ বাইরের কাজকর্ম রহিমই করে থাকে। বিশ্বস্ত মানুষ হওয়ায় আমজাদ হোসেন কে এসব ব্যাপারে নাক গলাতে হয় না, তিনি সবটুকু সময় তার বাপ দাদার ব্যবসা সামলাতেই ব্যয় করেন।
ঘুম থেকে উঠে একবার বাবা কে না জড়িয়ে ধরলে শীতলের দিন যেনো শুরু হতেই চায় না। তাই আজকেও পেছন থেকে আমজাদ হোসেনকে "বাবা " বলে জড়িয়ে ধরতে সে ভুলে না। আমজাদ এতে চমকে উঠলেও পরক্ষণে একগাল হেসে বলে,
পাগ*লি একটা, ছোটবেলার অভ্যাসগুলো এখনও ছাড়তে পারলি না।
শীতল আমজাদ সাহেবের সামনের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। মুখটা খানিক ভার করে বলে,
কেনো ছাড়বো? আমি কি বড় হয়ে গেছি নাকি। মাত্র উনিশ গিয়ে বিশ পড়ল। এতেই আমাকে বুড়ি বানিয়ে দিচ্ছ?
তোর বয়স যতই বাড়ুক, আমার কাছে তুই ওই ছোট্ট শীতল হয়েই থাকবি মা। তুই যেদিন হলি সেদিন যেমন আমার কাছে ছিলিস, আজও ঠিক একই রকম আছিস। দু*ষ্ট, অ*বুঝ, ছোট্ট একটা পুতুলের মত।
বাপ বেটির আলাপ শেষ হলে নাস্তা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন দেখি। আমার আরও অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। শীতল মামুনি, তুমি তো আজ কলেজ যাবে নাকি?
শীতলের আজকে কলেজ যেতে একটুও মন চাইছে না। অবশ্য সে জানে তার অনিহার কারণ, কিন্তু কাউকেই তা বলে না।
হে হারুন চাচা একটু পরেই যাবো।
তাহলে তাড়াতাড়ি খাও দেখি, তোমার প্রিয় খিচুড়ি করেছি। সবটা শেষ করে তারপর উঠবে।
ওরে বাবা চাচা, এত আমি খেতে পারব না। এত খেলে পেট ফেটে নির্ঘাত মা*রা যাবো।
ঠিক ওই সময় রহিম বাজারের ব্যাগ হাতে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে আসে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিস্ময় ছেলেটাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। ব্যাগটা খাবার টেবিলের ওপর রেখে সে বলতে শুরু করে,
আমজাদ চাচা, এক খবর শুনে এলাম বাজার থেকে।
কি খবর?
তেহরান চাচা নাকি কাল মা*রা গেছেন। বেশ কিছুদিন ধরেই আইসিইউ তে ছিলেন। আজ ভোররাতে হাসপাতালেই মা*রা গেছেন।
খবরটা শুনে আমজাদ আর শীতল দুজনেরই খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। শীতল পাথর চোখে খাবারের প্লেট দিকে তাকিয়ে আছে। আমজাদ হোসেন খানিকক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বলে,
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।
গম্ভীর পরিবেশ কাটাতে হারুন নিজ ছেলেকেই ধমকে বলে,তোকে যে জিনিস আনতে বলেছিলাম এসেছিস সেগুলো? নাকি সারাটা সময় মানুষের কথায় আড়ি পেয়েছিস? ফর্দ মিলিয়ে এনেছিস কি সব?
- এনেছি।
রহিম আবারো আমজাদ হোসেনের দিকে ফিরে চায়। চাপা কন্ঠে বলে,
চাচা, আজ বাদ আসর তার জানাজা। আপনি গেলে ভালো হয়।
কখনোই না। আমার মেয়েকে যে অ*পমান করেছে তার জানাজায় যাবো আমি?!! আমজাদ হোসেনের এত খারা*প দিন আসে নি।
বাবা, আমার মতে তোমার যাওয়া উচিত।
আমজাদ হোসেন তখন বিস্ময়ের শীর্ষে।
কি বলছিস মা? ভুলে গেলি ওরা তোকে
অতীত মনে রেখে কি হবে? আর উনি তো কিছু করেননি, যা করার তো ওনার ছেলে .............
শীতল আর কিছু বলে না। সোজা উঠে যায় খাবার টেবিল থেকে। হারুন অনেকবার পিছু ডাকলেও সে সারা দেয় না। কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হতে থাকে সে।
ক্লাসে পড়ানোর মাঝে বারবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন নতুন স্যার। হয়তো কারো আসার তীব্র প্রতীক্ষা তাকে ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত রাখছে। ক্লাসে ঢুকেই ডাইসের ওপর দাঁড়িয়ে ভালো করে রুমের প্রতিটা কোনা পর্যবেক্ষণ করে নেয় সে। না, শীতল তখনও আসেনি। তাহলে আজকে কি সে আসবে না? আজকে কি শীতলকে হেন"স্তা করার সুখ ভোগ সে করতে পারবে না?
চিন্তার বিষয়, তার মুখেও চিন্তার ছাপ দেখা যায়। ক্লাসের সবার সাথে পরিচয় পর্বটা শেষ করে সে তখন ব্লেক বোর্ডে টপিকের নাম লিখছে। ঠিক তখনি এক শ্বাসরুদ্ধকর মায়াবী মেয়েলি কন্ঠ সে শুনতে পায়। মাথাটা বাঁকিয়ে ক্লাসের দরকার দিকে তাকালে সে শীতল কে দেখতে পায়। পা চালিয়ে হেঁটে আসায় বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে।
মিস শীতল হোসেন, প্রথম দিনই লেট। তাও আবার গুনে গুনে দশ মিনিট। প্রথম দিন দেখে ছাড় পাবেন এটা ভুলে যান। সারাটা ক্লাস আপনাকে এখানে দাঁড়িয়ে নোট করতে হবে। It's your punish*ment.
0 Comments