তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-৪

জীবনের গল্প: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-৪

এই ফ্ল্যাটে আমার গার্লফ্রেন্ড থাকে, বুঝলেন?"

নিরব যদিও কথাটা ইয়াদকে সাবধান করার জন্যে বলেছে যাতে টয়াকে কেউ বিরক্ত না করে। এই ফ্ল্যাটের সবাইকে সে এই কথা বলে রেখেছে। তাই ইয়াদকেও বাদ দেয় নি।

ইয়াদের কথাটা শুনার সাথে সাথে  ইচ্ছে করছে এক্ষুণি একটা চর মেরে ছেলেটাকে শিক্ষা দিয়ে দেয়। ইয়াদ নিজের রাগটা প্রকাশ করলো নীরবের সামনে সজোড়ে দরজা খুলে। ইয়াদের চোখ মুখ দেখে যে কেউ বুঝবে যে সে কতটা রেগে আছে। 


নিরব আর কিছু বললো না কারণ তার এখন মনে হচ্ছে কথাটা বলা ঠিক হয়নি ভেবে চিন্তে বলা উচিৎ ছিলো। ইয়াদ দাতে দাত চিপে বললো," আর কিছু ?"।

নিরব একটু হেসে না সূচক মাথা নেড়ে চলে গেলো।

ইয়াদ রুমে গিয়ে সোফায় গা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাগ সামলাচ্ছে। ছেলেটার এমন সাহস হয় কীভাবে? আর টয়া কেনইবা এই ছেলের সাথে ছিলো। এটা কি সেই ছেলেটা? ইয়াদের এই সব প্রশ্নের জবাব শুধু টয়াই দিতে পারবে। ইয়াদ উঠে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো কিন্তু রাগ কমছে না। ইয়াদ কিছু না ভেবেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

তারপর টয়ার দরজার সামনে এসে বেল তার বাসার বেল বাজাতে লাগলো। টয়া গোসল সেরে বেরিয়েছে মাত্র, কলিংবেলের আওয়াজ শুনে সে ভেবেছে ঋতু এসেছে হয়তো। টয়া মাথা মুছতে মুছতে দরজা খুললো, খুলেই ইয়াদকে দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না।

এতো রাতে চাইছে টা কি? টয়া ভ্রু কুঁচকে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে রইল। টয়ার কিছু বুঝে উঠার আগেই ইয়াদ তাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে চলে এলো।

টয়া বিস্ময় নিয়ে বললো," আরে আরে! আপনি চাইছেন টা কি? ভিতরে যাচ্ছেন কেনো?" 

ইয়াদ মহা বিরক্তি নিয়ে টয়ার দিকে তাকিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। টয়া ইয়াদের আচরণ দেখে আরো রেগে গিয়ে বলল," এ কেমন পাগলামি! একে তো অনুমতি ছাড়া ভিতরে এসেছেন আবার বিনা অনুমতিতে বসে পড়লেন।"

ইয়াদ রাগ সামলে সুন্দর করে হাসলো তারপর বললো," তোমার বয়ফ্রেন্ড তো তোমাকে দেখে রাখতে বলে গেলো। তাই দেখতে এলাম ঠিক আছো কিনা?" 

যদিও নিরব এমন কোনো কথা বলেনি কিন্তু টয়ার মুখ থেকে কথা বের করতে একটু চালাকি করেছে ইয়াদ। টয়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। এই বয়ফ্রেন্ড এলো কোথা থেকে? টয়া রেগে বলল," আজেবাজে কথা বলবেন না।কিসের বয়ফ্রেন্ড? কোথাকার বয়ফ্রেন্ড? শুনুন আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। এসব ট্রিক আমার সাথে করবেন না। এক্ষুনি বেরিয়ে যান বাসা থেকে।"

ইয়াদ তারপরও বললো," নেই বললেই হলো নাকি? তোমার বয়ফ্রেন্ড নিজে আমাকে বলেছে।"

টয়ার রাগে গজগজ করছে। বলা নেই কয়া নেই কোথা থেকে আবার বয়ফ্রেন্ড উদয় হলো। আর রাতের বেলা এই লোকটা আবার সেই বয়ফ্রেন্ডের খোঁজ জানাতে এসেছে। 

টয়া ভীষণ রেগে বলল," কে সেই হতচ্ছাড়া? কে রটিয়েছে এসব?"

টয়ার কথায় ইয়াদ একগাল হাসলো তারপর বললো," যে হতচ্ছাড়া তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিলো। সে নিজে বলেছে।"

টয়া অবাক হয়ে বললো," নিরব বলেছে ?"

ইয়াদ মাথা নাড়িয়ে বললো," ইডিয়েটটার নাম তাহলে নিরব!"

টয়া আরো রেগে বললো," নিরব আমার খালাতো ভাই। ও এসব কেনো বলবে? আপনি ইচ্ছে করে এইসব বানিয়ে বলছেন।"

ইয়াদ চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে বললো," ওই ইডিয়েটাকেই জিজ্ঞেস করো সে কি বলেছে।" বলতে বলতে ইয়াদ বেরিয়ে এলো। এভাবে ভিতরে যাওয়াটা তার উচিৎ হয় নি সে নিজেও বুঝতে পেরেছে।

টয়া চিন্তায় পড়ে গেলো, কথাগুলো টয়ার ঠিক হজম হচ্ছে না। ইয়াদ ফিরে এসে টয়ার মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললো," এসো দরজা বন্ধ করো।" টয়া হা করে তাকিয়ে আছে।

 সে এতক্ষন ইয়াদকে নিজের রুমে বসিয়ে রেখেছে! তার উচিৎ ছিলো আরো আগে লোকটাকে বের করা। বাহ্ কি ভদ্রতার নমুনা জোর করে বাসায় ঢুকলো আবার নিজে নিজে চলে যাচ্ছে।

ইয়াদ দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে গিয়ে বললো,"ইডিয়েটটার নাম যেনো কি?" 

টয়া ভ্রু কুঁচকে বললো," আপনি কাকে ইডিয়েট বলছেন?"

 ইয়াদ হাসো হাসো চেহারা করে বললো," তুমি যাকে হতচ্ছাড়া বলেছিলে।" 

সে আমি বলতেই পারি, আপনি কেনো বলবেন? আর আমি আপনার সাথে এতো কথাই বা কেনো বলছি। আপনি প্লীজ যান।" 

ইয়াদ মনে করে বললো," ও হ্যা নিরব দেট ইডিয়েট । মনে পড়েছে।"

টয়া ইয়াদকে ঠেলে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। ইয়াদের এবার রাগ কমেছে, সে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। টয়া কিছুতেই বুঝতে পারছেনা নিরব এসব উল্টা পাল্টা কথা ইয়াদকে কেনো বলতে যাবে? নিরব যদি বলে থাকে তাহলে ওর বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে টয়া। আর এই ইয়াদ? এর  কতো বড় সাহস হুট করে রুমে চলে এলো, যদিও ভদ্র ভাবে চলেও গেছে তাও সে আসবে কেনো? আমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে এতো মাথা ব্যাথা কেনো উনার?

সকালে কলিং বেলের শব্দে ইয়াদের ঘুম ভাঙ্গলো এতো সকালে কে আসবে? ইয়াদ কোনো মতে চোখ খুলে উঠে এসে দরজা খুললো। দরজা খুলে ইয়াদ একটু চমকালো তার মা এত সকালে এখানে কি করছে? ইয়াদের মা ইয়াদকে সরিয়ে ভিতরে এসে সোফায় বসলো। ইয়াদ ঘুম ঘুম চোখে দরজা বন্ধ  করলো। তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না তার মা এখানে কেনো এসেছে।

ইয়াদের মা ঘাম মুছতে মুছতে বললেন," বুঝলি ফজরের নামাজ পড়ে রওনা দিয়েছি তাই এতো তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছি।"

ইয়াদ চুপ করে একপাশে বসে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের কথা শুনছে। তারপর প্রশ্ন করলো,"  মা বাবা কি করবে তুমি যে চলে এলে?"

 ইয়াদের মা কটাক্ষ করে বললো," কি করবে মানে? খেয়ে দেয়ে ঘুমাবে। সব রান্না করে বক্স ভরে ফ্রিজে রেখে এসেছি। আমি কয়েকদিন তোর কাছেই থাকবো বুঝলি।" ইয়াদ গালে হাত দিয়ে হা সূচক মাথা নাড়ল। 

ইয়াদের মায়ের নাম মিলি আক্তার। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন," বাপ বেটা হয়েছে একরকম।" 

মায়ের কথায় ইয়াদ হাসলো তারপর উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে রেডি হয়ে ক্লিনিকে গেলো। যাবার আগে মাকে কোথাও বের হতে বারণ করেছে ইয়াদ কিন্তু কে শুনে কার কথা। মিলি আক্তার বের হয়ে কিছু কেনা কাটা করলেন। লিফটে উঠে টয়ার সাথে দেখা কেউ কাউকে চিনে না যদিও, তারপরও টয়া মিলি আক্তারকে সালাম দিলো। টয়া সাথে কথা বলে টয়াকে  বেশ ভালোই লাগলো তার। কি মিষ্টি চেহারা! 

টয়ার ওনার সাথে কথা বলতে ভালোই লাগছিলো কারন উনি অনেক আদর ভরা কণ্ঠে কথা বলে ঠিক তার বাবা যেভাবে বলে। লিফট থেকে বেড়িয়ে মিলি আক্তার যখন ইয়াদের দরজার লক খুলছিলেন সেটা দেখে টয়ার কেমন যেন লাগলো। টয়া তাকিয়ে রইলো।

মিলি আক্তার হাসতে হাসতে বললো," এই ফ্ল্যাটে আমার ছেলে থাকে। এতো বদজ্জাত আর বলো না নিজের সুবিধা অসুবিধা কাউকে বলে না। আরে আমি মা আমাকে বল। আচ্ছা আমাকে বলতে মনে না চাইলে বিয়ে করিয়ে দেই বউকে বলিস সেটাও করতে রাজি না। এ কয়দিন কি খেয়েছে জানো? শুধু নুডুলস খেয়েছে। রান্নার কোনো জিনিস কেনার সময় পায়নি সে।" ইয়াদের মায়ের কথা শুনে কেমন জানি মায়া লাগছে টয়ার। মহিলাটা সব কথা কি অবলীলায় বলছে তাকে।

রাতে ইয়াদ বাসায় ফিরে  মাকে  না দেখে একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর  মিলি আক্তার বাসায় এলো। ইয়াদ এতোক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এলো। 

তারপর রেগে বললো," মা তোমাকে না আমি বারন করলাম বাসা থেকে বের হতে না।"

মিলি আক্তার বললো," বাসা থেকে বের হবো না কোনো? আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি যে বাসায় বসে থাকবো। ছেলের বিয়ে দেই নি, নতিনাতনির মুখ দেখিনি।"

ইয়াদ সরু চোখে বললো,"এবার বলো কোথায় গিয়েছিলে?"

তোর সামনের ফ্ল্যাটের মেয়েটাকে কে দেখেছিস? কি মিষ্টি দেখতে!" 

কথাটা বলতেই ইয়াদ চুপ করে থেকে, তারপর বললো," হুম, তা কি হয়েছে?"

মিলি আক্তার সোফায় বসে বললো," ওর কাছেই ছিলাম এতক্ষন। কি ভালো হাতের রান্না! আমাকে গরম মাংসের সঙ্গে পরোটা করে খাওয়ালো অসাধারন!" ইয়াদ নিজের মায়ের মুখে  টয়ার প্রসংশা শুনে নিচের ঠোঁট চেপে হাসছে।

মিলি আক্তার ছেলেকে ব্যাঙ্গ করে বললো,"  হাসবি না, একবার দেখলে বুঝতি। মেয়েটার নাম জানিস?" ইয়াদ দুইহাত বুকের কাছে ভাজ করে না সূচক মাথা নাড়ল। মায়ের কথা  শুনতে বেশ মজাই লাগছে তার।

মিলি আক্তার বললো," মেয়েটার নাম টয়া। নামটা মিষ্টি না! দেখবি ওর জামাই  আদর ওকে টিয়া পাখি বলে ডাকবে।" ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। টিয়া পাখি নামটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি। সে আর যাইহোক টিয়া পাখি বলে ডাকবে না। 

মিলি আক্তার উঠে এসে বললো," তোর সেই ঘড়িওয়ালিকে পেয়েছি? তোর ঘড়িওয়ালি কেমন দেখতে রে?"

ইয়াদ মায়ের কথায় হাসি থামিয়ে রাখতে পারলো না। মিলি আক্তার অবাক হয়ে বললো," কিরে এভাবে হাসছিস যে?"

ইয়াদ হাসি থামিয়ে বললো," যদি বলি তুমি তাকে চেনো?"

ইয়াদ হাসি থামিয়ে বললো," যদি বলি তাকে তুমি চিনো?"

মিলি আক্তার হা করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো," চিনি মানে? কোথায় সেই মেয়ে?" 

ইয়াদ লক্ষ করলো তার মায়ের চেহারাটা কেমন হয়ে গেলো।," কিন্তু কোনো লাভ হয়নি মা। মেয়েটা আমার উপর রেগে আছে নাকি বিরক্ত হয়ে আছে কিছুই বুঝতে পারছিনা।

মিলি আক্তার একটু চিন্তিত হয়ে বললেন," কিছু করেছিস তুই? রাগ করে থাকবে কেনো?"

ইয়াদ নিচু স্বরে বললো," তুমি তো জানো রাগ হলে আমি কি করি আমার ঠিক নেই, হয়তো তাই।" 

আচ্ছা ঠিক আছে আমাকে বলতে ভালো না লাগলে। বলতে হবে না।কিন্তু তুই কি মেয়েটাকে সরি বলেছিস?" বলে ছেলের কাধে হাত রাখলেন। 

ইয়াদ মনে মনে বললো," সরি বলার সুযোগ দিয়েছে নাকি? দেখলেই পালাই পালাই করে।" 

ইয়াদ না সূচক মাথা নাড়ালো। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন," মনে হয় মেয়েটা অভিমান করেছে। রাগ জিনিসটা অনেকদিন পুষে রাখা যায় না। শুধু অভিমান আর ঘৃনা জমে থাকে। তোকে ঘৃনা করলে তোকে কখনো সহ্য করতে পারতো না ঠিকই কিন্তু রাগ দেখাতো না। মেয়েটা অভিমান করেছে বুঝলি। বাপ আর ছেলে হয়েছে এক রকম কিচ্ছু বুঝে না।"

ইয়াদ নিজের মায়ের কথা ফেলতে পারছে না। হয়তো সত্যিই অভিমান করে বসে আছে টয়া।

ইয়াদ প্রসঙ্গ ঘুড়িয়ে বললো," তোমার কি বাবার কথা খুব মনে পড়ছে ? কিছুক্ষণ পর পর বাবার কথা বলছো যে?"

তোর বাবা! ওই লোক কি জানে কিভাবে বউয়ের খেয়াল রাখতে হয়। সে দিনে যতবার খাবার খায় নিয়ম করে ততবার ফোন করে। সকালে একবার, দুপুরে একবার, রাতে একবার। এর বাহিরে একবার ও ফোন করে খোঁজ নেয় নি।"বলতে বলতে মিলি আক্তার কিচেনে চলে গেলেন। 

ইয়াদ পিছু পিছু গিয়ে বললো," তুমি তো বলো আমি বাবার মতো তাহলে আমারও নিশ্চই বিয়ের পর বউয়ের মুখে এসব শুনতে হবে। থাক বাবা বিয়ে নামক ভেজালে আমি পড়ছি না।"মিলি আক্তার আর কিছু বললেন না।

টয়া বের হয়েছিলো ছাদে হাঁটতে যাবে বলে এমন সময় ইয়াদ ও বের হয়। ইয়াদকে দেখে টয়া রুমের ভিতরে চলে যাবে এমন সময় ইয়াদ হাত ধরে ফেলে। 

টয়া বিস্ময় নিয়ে ইয়াদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে তারপর বললো," আপনি আমার হাত ধরেছেন কেনো? ছাড়ুন । কেউ দেখলে কি ভাববে ছাড়ুন।" বলে হাত ছড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। 

ইয়াদ হটাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে বললো," ছাদে যাবো চলো।"

টয়া আড় চোখে তাকিয়ে বললো," ছাদে যাবো চলো মানে? আমি কেনো আপনার সাথে ছাদে যাবো? আপনার যেতে ইচ্ছে হলে আপনি যান।"

ছাদে যেতে বলেছি, ছাদ থেকে লাফ দিতে বলিনি। " বলেই একটা ভ্রু তুলে তাকালো ইয়াদ।

টয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে ছাদের দিকে হাঁটতে লাগলো, তার এমনিতেই খুব আকাশ দেখতে ইচ্ছে করছে। ইয়াদের জন্যে ইচ্ছে নষ্ট করার কোনো কারণ নেই।

 ইয়াদ ভেবেই পায় না, এই মেয়েটার মাথায় যে কি চলে? একটু আগে কি বলল আর এখন কি করছে?

টয়া ছাদের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত আপন মনে হেটে চলে চলেছে। ইয়াদ কিছুক্ষণ বসে থেকে টয়ার হাটাহাটি দেখলো। এই মেয়ে দেখি থামার নাম নিচ্ছে না। ইয়াদ উঠে দাড়িয়ে টয়ার হাত ধরে ওকে  দাড় করালো। টয়া সেই আবার শুরু করেছে আপনি আমার হাত ধরলেন কেনো...?

ইয়াদ রেগে বলল," চুপ, আমি হাত ধরলে কি তোমার হাত খসে পড়বে?" 

টয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো," সে তো পড়বেই, শুনুন আমার হাত ধরার অধিকার আপনার নেই বুঝলেন?"

ইয়াদ রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো। টয়া সেটা তোয়াক্কা না করে বললো," রাগ দেখাচ্ছেন আমাকে? শুনুন আপনার রাগকে না আমি ভয় পাই না। রাগ দেখাচ্ছে কেনো আমাকে?" 

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে টয়ার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। টয়া সন্দেহের চোখে বললো," আপনি এগিয়ে আসছেন কেনো? "

কথায় কোনো কাজ হলো না। ইয়াদ এগিয়ে আসছে দেখে টয়া পিছিয়ে যেতে লাগলো। বেশি কথা বলা ঠিক হয় নি এবার রাগের মাথায় কিছু করে বসলে। 

পিছাতে পিছাতে টয়া ছাদের রেলিং আর সাথে ঘেঁষে দাড়িয়ে পড়ল। ইয়াদ এগিয়ে এসে টয়ার দুপাশের রেলিং এ দুই হাত রাখলো। 

টয়া এক ঢোক গিলে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। ইয়াদের স্থির দৃষ্টি যে টয়ার দিকে, টয়া সেটা বুঝতে পারছে। টয়া ঘামতে লাগলো, এর মাঝে ইয়াদ বলে উঠলো " এখন ঘামছো কেনো? "

টয়া একবার ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো," আপনি সরুন।"

ইয়াদ একটু কাছে এসে বললো," আচ্ছা আমি কাছে আছি বলে নার্ভাস লাগছে তাই কি ঘামছো।"

ইয়াদের এই কথাগুলো শুনে টয়ার হার্টবিট বেড়ে গেছে।

টয়া কিছু বলতেও পারছে না।

 ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল," একটা কথা বলার ছিলো শুনবে?" 

টয়া ইয়াদের চোখের দিকে তাকালো, তাকানোর সাথে সাথে আবার চোখ নামিয়ে ফেললো। ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ইয়াদের নিরবতায় টয়ার ভয় লাগছে। কি বলবে এবার সে? ভয় গলা শুকিয়ে এসেছে টয়ার। টয়া যেনো ইয়াদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।

ইয়াদ নিরবতা ভেঙ্গে বললো," সেদিনের জন্য কি আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না?" কথাটা শুনার সাথে সাথে বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো। কোনদিনের কথা বলছে ইয়াদ? টয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বললো," কোন দিন?" নিজের বলা কথায় ইয়াদ নিজেও লজ্জিত। 

ইয়াদ একটু চুপ থেকে বললো," আমি তোমাকে যেই কথাগুলো বলেছিলাম.... আসলে আমি নিজেও বুঝিনি কথাগুলো কতটা ভুল। সেদিনের ভুলের জন্য...." ইয়াদ বলে শেষ করার আগেই টয়া চোখ ছল ছল করে এলো টয়া নিজেকে সামলে বললো," থাক, আমি সেসব কথা শুনতে চাই না। আর ক্ষমা চাওয়ার কি আছে আপনার যা মনে হয়েছে, আপনি যা বিশ্বাস করেছেন সেটাই বলেছেন। আর আপনি ঠিকই বলেছিলেন.... কারণ আপনি না বললে আমি বুঝতেই পারতাম না আমি যে কতটা খারাপ।"

ইয়াদ কিছু বলতে নিলো টয়া থামিয়ে বললো," দেখুন যা হবার সেটা হয়েগেছে। আমি ভুল করেছি তার শাস্তিও পেয়েছি। এখন আর আমি কিছু মনে রাখি নি তাই আপনিও ভুলে যান।"

টয়ার কথাগুলো যেনো ইয়াদের বুকে গিয়ে বিধলো। তারপরও সে বললো," তুমি কি এইসব রাগ করে বলছো?" 

টয়া একটু হেসে বললো," রাগ কেনো করবো বলুনতো? রাগ করিনি। বললাম তো আপনিও ভুলে যান। যদি কখনো মনে পড়ে ভাববেন সবটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো।"

ইয়াদ আর কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না , ইয়াদ রেলিং থেকে হাত সরিয়ে নিলো। টয়ার গাল বেয়ে পানি পড়তেই টয়া সেটা মুছে নিয়ে ছাদ থেকে বেড়িয়ে যাবে এমন সময়ে টয়া থমকে গেলো। টয়ার পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে গেছে। সামনে ইয়াদের মা দাড়িয়ে, তাহলে তিনি কি এতক্ষন সবটা দেখেছেন?

"তোমরা এতো রাতে কি করছো ছাদে?" ইয়াদের মায়ের প্রশ্নে টয়া ঘাবড়ে গেলো।

 টয়া আমতা আমতা করে বলল," আসলে আণ্টি, আমি একটু বাতাসে দাড়ানোর জন্যে এসেছিলাম।"

ইয়াদ নিজের মাকে দেখে কোনো মাথা ব্যাথা নেই, সে চুপ করে আছে। 

মিলি আক্তার হাই তুলতে তুলতে বললো," আচ্ছা, আমার ছেলেটাও কি হাওয়া খেতে এসেছে?" বলে ইয়াদের দিকে তাকাতেই ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তার মাকে ঈশারায় চুপ থাকতে বললো।

এটা দেখে মিলি আক্তার বললো," ও আচ্ছা তোর রুমের এসি তো নষ্ট!"

ইয়াদ মলিন চোখে মায়ের কান্ড দেখছে। বানিয়ে আবার কি বলছে দেখো। টয়া অপ্রস্তুত হয়ে বললো," আণ্টি আমি তাহলে যাই।"

মিলি আক্তার টয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন," আচ্ছা যাও, গুড নাইট।"

টয়া ছাদ থেকে নেমে সোজা নিজের রুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসলো এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে সেটা সে কল্পনাও করেনি।ইয়াদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই তার মা তাকে একটা মেয়ের সাথে তাকে এতো রাতে ছাদে দেখেছে এটা তার কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। সেটা তো হবেই যেখানে মিলি আক্তার নিজেই তুচ্ছ করেই ধরেছেন। 

তিনি বললেন," কিরে পছন্দ হয়েছে? তোর ঘড়িওয়ালি থেকে বেটার না? ইয়াদ ছাদে রেলিং এ হেলান দিয়ে ঠোঁট উল্টে না সূচক মাথা নাড়ল।

মিলি আক্তার আড় চোখে তাকিয়ে রইলেন। ইয়াদ হেসে উঠে বললো," এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? আমার পছন্দ বেটার হবে কেনো আমারটা বেস্ট।"

" কি ভালোবাসা! হাওয়া খাওয়া শেষ হলে চলেন রোমিও স্যার ঘুমাতে যাই।", ইয়াদ পৃথিবীতে দুজন নারীকে আজ পর্যন্ত বিস্ময় নিয়ে দেখেছে। কারণ এরা তার কাছে একদম আলাদা, একজন তার মা আরেকজন টয়া। ইয়াদের ইচ্ছে করে এদের আসে পাশে থাকতে, এই ভালোলাগা এই বিস্ময় সে আর কোথাও খুঁজে পায় নি।

টয়ার আজ ঘুম ভেঙেছে দেরী করে। আজ তার এক ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস ছিল। সে হুড়োহুড়ি করে রেডি হয়ে দরজা খুলে বের হতেই দেখতে পেলো ইয়াদও বের হচ্ছে। এই ছেলেটা আর সময় পেলো না? আবার যদি একসাথে লিফটে উঠে তাহলে উপর নীচে উপর নীচে না এই ঝামেলায় টয়া আর পড়তে চায় না। ইয়াদ টয়াকে দেখার আগেই টয়া দৌড় দিয়ে লিফটে পৌঁছে যায়। কারোর দৌড়ানোর শব্দে ইয়াদ তাকিয়ে দেখলো টয়া লিফটের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। ইয়াদ  কিছুই বুঝতে পারছেনা মেয়েটা কেনো যে তাকে দেখলেই পালাই পালাই করে আগেই ভালো ছিলো খোঁজার আগেই হাজির হয়ে যেতো। 

ইয়াদ কিছুক্ষণ লিফটের জন্যে দাড়িয়ে অপেক্ষা করলো। কিন্তু অনেক্ষন হয়েগেছে লিফট উপরে আসছে না। বাটন টাও ঠিক মতন কাজ করছে না। ইয়াদ পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলো আজ বোধয় তার এই সিড়ি বেয়েই নিচে যেতে হবে। লিফটা কি নষ্ট হয়ে গেলো? এগারো তলা থেকে হেটে নিচে নামবে? কি অসহ্য ব্যাপার! ইয়াদ অবশেষে নীচে নামলো।ইয়াদের মাথা ভীষণ গরম হয়ে গেলো। লিফটে প্রবলেম থাকলে আগে থেকে ঠিক করে রাখা উচিৎ ছিলো তো নাকি?

ইয়াদ রেগে গার্ডকে বলতে গেলো," আপনাদের লিফট কেনো কাজ করছেনা? আমাদের জন্য না হয় ঠিক আছে যারা একটু মধ্যবয়সী তাদের জন্য তো বিশাল সমস্যা।"

"স্যার লিফটের দায়িত্বে তো আমি নেই। দাড়ান আমি এক্ষুনি পাশের রূমে জিজ্ঞেস করছি। তাই তো বলি কিছুক্ষণ আগে মনে হলো কেউ লিফটে নীচে নামছে কিন্তু এখনো আসেনি। দাড়ান আমি এক্ষুনি দেখছি।" লোকটার কথা শুনে ইয়াদের কেনো জানি খারাপ কিছু মনে হলো। টয়া  ঠিক আছে তো? ঠিক মতো নীচে পৌঁছাতে পেরেছে কি? লোকটা পাশের রুমে যেতেই ইয়াদ লোকটাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলো," আচ্ছা, টয়াকে দেখেছেন! একটু আগে নিচে নামলো? একটা মেয়ে সাদা ড্রেস গলায় নেভিব্লু স্কার্ফ?"

গার্ড কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাকলো তারপর বললো," ও আচ্ছা বুঝেছি, ভার্সিটিতে যায় তো উনি প্রতিদিন। কিন্তু কই আজ তো দেখলাম না।"

গার্ডের কথায় ইয়াদের চোখ মুখ অস্থিরতায় ভরে গেলো। টয়া লিফটে আটকা পড়েনি তো? দশ মিনিটের মতো তো হয়েছে টয়া বেরিয়েছে। ইয়াদ গার্ডের সাথে পাশের লিফট কন্ট্রোল রূমে গেলো। সেখানে যে দায়িত্বে আছে সে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে দেখেই ইয়াদের মাথায় রক্ত ওঠে গেলো। গার্ড তাড়াহুড়ো করে সেই ছেলেকে ডেকে তুললো। ছেলেটা উঠার সাথে সাথে ইয়াদ কড়া গলায় বললো," লিফটে কি হয়েছে?তোমাকে দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে আর তুমি পরে পরে ঘুমাচ্ছো।"

ইয়াদের কথায় ছেলেটা ভয় পেয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো তারপর বললো,"  একটু সমস্যা হয়েছে কিছুক্ষনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।"

ইয়াদের ভিতরটা চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। ইয়াদ রেগে গিয়ে বললো," কিছুক্ষণ মানে? এক্ষুণি আমাকে লিফটের সিসিটিভি ফুটেজ দেখাও।" বলেই ইয়াদ কম্পিউটারের সামনে এসে দেখে সেটা বন্ধ হয়ে আছে। 

"What the hell! তোমার কম্পিউটার বন্ধ কেনো?" বলে ইয়াদ জোরে টাবিলে একটা বাড়ি দিলো। ছেলেটা ভয় পেয়ে জলদি সিসিটিভি ফুটেজ অন করলো। ইয়াদ সিসিটিভি ফুটেজে স্পট টয়াকে দেখতে পাচ্ছে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। 

ইয়াদের মেজাজ হারিয়ে ছেলেটার কলার চেপে ধরে বলে,

you bustard, তোমাকে এখানে রাখা হয়েছে পরে পরে ঘুমানোর জন্য? দুই মিনিটের মধ্যে লিফট খোলার ব্যবস্থা করো টয়ার যদি কিছু হয় না I swear আমি তোমাকে দেখে নিবো। তোমার চাকরি তো এমনেতেই শেষ।"

ইয়াদের ধমকে গার্ড আর ছেলেটা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব লিফট খোলার ব্যবস্থা করে। ইয়াদ টয়াকে কোলে করে  নিজের বাসায় নিয়ে আসে।

টয়ার জ্ঞান ফিরল অনেক পরে কিন্তু সে বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কারণে ওকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়। টয়ার এমন অবস্থায় মিলি আক্তার চিন্তায় পড়ে যায়। এদিকে ইয়াদ নিজের পরিচিত একজন ডক্টরকে বাসায় আনে। তিনি বলেছেন মেয়েটা প্রচন্ড ভয় পেয়েছে । মণে হয় ছোট বেলার কোনো ভয় ভিতরে ঢুকে গেছে দেখে রাখতে হবে আর কাছাকাছি একজনকে সবসময় থাকতে বলেছেন। ইয়াদ নিজেও এটাই ধারণা করেছিলো তবে ছোটো বেলার কি এমন ভয় থাকতে পারে টয়ার ?

অনেক্ষন পর টয়ার ঘুম ভাঙ্গলো ছোটবেলার সেই দুঃস্বপ্নে সে ঘুমের মাঝে ছোটফটিয়ে হালকা চোখ খুললো। সাড়া শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে, চোখ খুলেই সামনে কাউকে না দেখে ভয়ে তটস্থ টয়া। এ জায়গায় সে আগে কখনো আসেনি। এটা কোথায়? টয়া উঠে বসতে বসতে মা মা করে চিৎকার করতে লাগলো। 

ছোটোবেলায় ফুফুর বিয়েতে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে এক অন্ধকার স্টোর রুমে লুকিয়েছিলো টয়া। যাতে তাকে কেউ  খুজে না পায়। কে জানি সেদিন দরজাটা বাহির দিয়ে আটকে দিয়েছিলো।

ভয় আর আতঙ্কের সেদিনের চিৎকার আর কান্না কেউ শুনেনি। যখন খুজতে খুজতে সবাই স্টোর রুমে আসে তখন নিস্তেজ হয়ে এসেছিলো সেই ছোট্ট শিশুটির দেহ। 

আজ সেই জায়গায় আবার ফিরে গিয়েছিল  টয়া। আজও তার কান্না কেউ শুনেনি। টয়া কাদতেঁ লাগলো, টয়ার ডাকে মিলি আক্তার রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। ইয়াদ পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

মিলি আক্তার টয়াকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেস্টা করলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। টয়া থর থর করে কাঁপতে লাগলো। কিছুক্ষন পর টয়া কিছুটা স্বাভাবিক হলো। তবে তার ভয় কমে নি। ইয়াদ শান্ত ভঙ্গিতে একপাশে দাড়িয়ে ছিলো। 

মিলি আক্তার ছেলেকে বললো," একটু মেয়েটার পাশে এসে বস। আমি ওর জন্য সুপটা গরম করে আনি।"

ইয়াদ টয়ার পাশে এসে বসলো কিন্তু টয়া মিলি আক্তারের কাপড়ের এক অংশ ছোটো বাচ্চাদের মতো হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আছে। মিলি আক্তার বুঝিয়ে সুজিয়ে টয়াকে ইয়াদের কাছে রেখে গেলো। টয়ার ইচ্ছে করছে কিছু একটা শক্ত করে ধরে রাখতে। ইয়াদ শান্ত চোখে টয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। টয়া হাতের কাছে কিছু না পেয়ে বিছানার চাদর ধরে আছে কিছুক্ষণ পর পর টয়ার সেই অন্ধকার ঘরের কথা মনে পড়তেই কেপে উঠে। 

ইয়াদ টয়কে কীভাবে সামলাবে বুঝতে পারছেনা। ইয়াদ টয়ার হাত ধরতে নিয়েছিলো টয়া হাত সরিয়ে নিয়েছে। ইয়াদ টয়াকে এই মূহুর্তে জোর করতে চাচ্ছে না। মেয়েটা যে বড্ডো জেদি সেটা ধীরে ধীরে ইয়াদ টের পাচ্ছে।

ইয়াদ নিজের শার্টের হাত ভাঁজ থেকে নামিয়ে সেই হাতটা টয়ার সামনে বাড়ালো। টয়া ক্লান্ত চোঁখে ইয়াদের দিকে তাকালো। ইয়াদ চোখে হাতের দিকে  ইশারা করলো। টয়া কিছুক্ষণ ইয়াদের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে ইয়াদের শার্টের হাতার কিছু অংশ মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো।

 ইয়াদ টয়ার কান্ড দেখে হাসলো, ভয়ে আছে তাও নিজের জেদ বজায় রাখবে। হাতটা ধরলে কি অসুবিধা হতো তার।

কিছুক্ষন পরেই ইয়াদের মা গরম সুপ এনে টয়াকে খাইয়ে দিলেন। ইয়াদ পাশেই বসে ছিলো। টয়া এখন অনেকটাই স্বাভাবিক তবে সে যে ইয়াদের বসায় ইয়াদের রূমে বসে আছে ব্যাপারটা টয়া এই মাত্র খেয়াল করলো। রুমটা অচেনা লাগছিলো তবে এটা যে ইয়াদের ফ্ল্যাট এটা এবার স্পষ্ট। 

টয়া চোখ টিপ টিপ করে একবার ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো। এবার টয়ার নজর গেলো নিজের হাতের দিকে এতক্ষন ধরে ইয়াদের শার্টের হাতা ধরে বসে ছিল কেনো? এখন ইয়াদের মা সামনে আছে। উনি দেখেছেন নাকি? কালকে রাতে একবার! 

কি শুরু হয়েছে এগুলো তার সাথে? ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে ইয়াদের শার্টের হাতা ছেরে দিয়ে হাতটা নিজের কম্বলের ভিতরে নিয়ে গেলো।

টয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ইয়াদ টয়াকে আরেকটা ওষুধ খাইয়ে দিলো এরপর অনেকটাই ভালো হয়ে উঠবে টয়া। টয়ার শরীর ক্লান্ত হওয়ায় সে শুয়ে পড়তেই চোখ দুটো ঘুমে ঘিরে ধরে।

ইয়াদ একটা চেয়ার এনে টয়ার খাটের পাশে বসে টয়ার ব্যাগে থাকা কিছু ডিজাইন দেখছিলো। এমন সময়ে মিলি আক্তার এসে টয়ার মাথার কাছে বসলো। তিনি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলো," আচ্ছা ইয়াদ?" 

মায়ের ডাকে ইয়াদ মায়ের দিকে ফিরলো। "এই টয়া কি সে মেয়ে যার ঘড়িটা তুই এতো বছর আগলে রেখেছিস?"  

মায়ের কথায় ইয়াদ হেসে বলল,"  হটাৎ তোমার এমন মনে হলো কেনো, মা?"

আমিতো মা, আমি বুঝি। তোর চেহারায় এতো টেনশন কেনো বলতো? আমাকে বল কি হয়েছে?"  মায়ের প্রশ্নে ইয়াদ শব্দ করে একটা নিশ্বাস ফেললো। 

তারপর টয়ার দিকে তাকিয়ে বললো," একটা ভুল করেছিলাম।"

অনেক শুনেছি তোর এসব কথা। এই টয়া কি সেই মেয়ে? আমাকে শুধু এই প্রশ্নের উত্তর দে।", ইয়াদ নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আর মিথ্যে বলতে পারলো না স্বীকার করে নিলো সবটা।

আচ্ছা ঠিক আছে, বাকিটা  আমি দেখে নিচ্ছি।", মায়ের এমন কথা শুনে ইয়াদ অবাক হয়ে বললো," দেখে নিচ্ছ মানে কি?

টয়া আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। এই সহজ কথাটা তুমি কেনো বুঝতে পারছো না মা?"

ছেলের এমন কথায় মিলি আক্তার বললেন," চেস্টা না করে হাল ছাড়লে হবে?"

ইয়াদ কোমরে হাত দিতে দাড়িয়ে পড়ল," মা তুমি আমার বিয়ে নিয়ে কেনো পড়েছ বলতো? আর তুমিই টয়ার বাবা মাকে ডেকেছো তাই না?" 

"ধুর, আমি কেনো ডাকবো? মেয়ের এমন ঘটনা শুনে ওনারা চলে এসেছেন। আমি কি নিজে ফোন দিয়ে ডেকে এনেছি? টয়ার ফোন বাজছিল বেচারির ঘুম ভেঙে যেতো তাই কথা বলেছি একটু।" বলেই ইয়াদের দিকে তাকালেন।

আচ্ছা, তাই? তাহলে বাবা কি করে একরাতের মধ্যে ঢাকায় চলে এলো? বলো আমাকে।", বলে সন্দেহের চোখে তাকালো ইয়াদ।

মিলি আক্তার হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো," তোর বাবার ফোন ধরিনি যে কয়দিন তাই কালকে এসেছে। বুড়োটাকে  শিক্ষা দিতে হবে বুঝলি?"

ইয়াদ বললো," তুমি বাবাকে বুড়ো বলছো!"

এই শোন বেশী বাবা বাবা করিস না। বাবার উকিল হয়েছেন উনি। সর সামনে থেকে,আমি যাই ওনাদের নিয়ে আসি।"

মায়ের কথায় ইয়াদ চমকে উঠে বলে," ওনাদের মানে কাদের?"

মিলি আক্তার যেতে যেতে বললো," টয়া আর টয়ার বাবা- মা। আজকে ওনাদের রাতের দাওয়াত দিয়েছি তো।"

ইয়াদ নিজের মায়ের কাজকর্মে হতবাক হয়ে গেলো। ইয়াদের বাবা টিভিতে নেশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল এ ম্যান vs ওয়াইল্ড দেখছে। ইয়াদের বাবা একজন শান্তি প্রিয় মানুষ আর এদিকে তার মা অশান্তি প্রিয়।

তার মা যে হুটহাট কি করে বসে। টয়ার সাথে তার বিয়ে দিতে উঠে পড়েছে সে। কিন্তু এইসবের কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হবে না সেটা সে জানে। যতদিন না টয়া তাকে মন থেকে ক্ষমা করবে ততদিন সে নিজেও শান্তিতে থাকতে পারবে না।

ইয়াদের মা সবাইকে নিয়ে ফ্লাটে ঢুকলেন। ইয়াদ নিজের রুমে ছিলো সে অনেক্ষন পর রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে সে আরো অবাক।

টয়ার বাবা তার বাবার সাথে কি বিষয়ে খুবই জোরালো এক আলোচনায় বসেছে। টয়ার বাবা একের পর এক কথা বলছে ইয়াদের বাবা চুপ করে শুনছেন এবং মাঝে মাঝে নিজের কিছু মন্তব্য জানাচ্ছেন।

এদিকে আরেক অবস্থা, ইয়াদের মা বক বক করছে আর টয়ার মা মনোযোগ দিয়ে তাশুনছে। ইয়াদের মা এমনভাবে কথা বলে যে সবাই আগ্রহ সহকারে শুনতে বাধ্য।

টয়া ডাইনিং টেবিলে বসে  ম্যাঙ্গো জুস হাতে ফোন নিয়ে ব্যাস্ত। সবটা দেখে ইয়াদ টয়ার পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো। টয়া একবার আড় চোখে তাকিয়ে আবার ফোনে দৃষ্টি স্থির করলো। ইয়াদ অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য একটু কেশে নিলো। আজকাল টয়া ইয়াদ নামক বিষয়টাকে ইগনোর করছে। তেজ দেখো মেয়ের ইয়াদের মেজাজ একটু বিগড়ে গেলো তার বাসায় এসে তাকেই ইগনোর করছে।

ইয়াদ টয়ার হাত থেকে হটাৎ করে জুসের গ্লাসটা নিয়ে নিলো। টয়া এবার বিরক্তি চোখে ইয়াদের দিকে তাকালো তরপর বললো," দেখুন ওটা আণ্টি আমার জন্য বানিয়েছে। আমাকে ফেরত দিন।"

ইয়াদ গ্লাসটা নাড়িয়ে চারিয়ে দেখে বললো," আচ্ছা " বলেই ইয়াদ গ্লাসটা একটা চুমুক দিতেই টয়া চোখ বড় বড় করে ইয়াদের দিকে তাকালো। 

ইয়াদ এমন কিছু করবে টয়া ভাবেনি। এক চুমুক দিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে গ্লাসটা টয়ার দিকে এগিয়ে দিলো। টয়া ভ্রু কুচকে ফেললো। ইয়াদ জুসের গ্লাসটা টয়ার সামনে রাখতে গিয়ে বললো," তুমি যে অনেক অকৃতজ্ঞ সেটা কি তুমি জানো?"

টয়া চোখগুলো রসগোল্লার মতোন করে তাকালো। তারপর বলল," আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?" 

কালকে এতো কষ্ট করে তোমাকে বাঁচলাম তুমি একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলে না।" ইয়াদের কথায় টয়া এমন ভাবে তাকালো যেনো তার কাছ থেকে ইয়াদ তার একটা কিডনি চেয়েছে।

আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন?" বলেই হা করে তাকিয়ে রইল।

 টয়ার কথায় ইয়াদ বললো," নাহ্ ভূত তোমাকে কোলে করে ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে।" 

টয়া আরো বিস্ময় চোখ বড় বড় করে বললো," কি! আপনি আমাকে কোলে করে এনেছে! আপনি! আপনি কোলে নিয়েছেন আমাকে? কেনো!" 

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো," আসলে ভুল করেছি, তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় হাটিয়ে হাটিয়ে নিয়ে আসা উচিৎ ছিলো। তাই না?"

তাই বলে আপনি এভাবে অনুমতি ছাড়াই যে কাউকে কোলে নিয়ে কোলে নিবেন?" উত্তেজিত হয়ে বললো টয়া।

ইয়াদ একটা ভ্রু তুলে বলল," ও আচ্ছা তোমার অনুমতি নিতে হতো। তাহলে সেখানে অজ্ঞান অবস্থায় আগে তোমাকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিলো এক্সকিউজ মি! ম্যাডাম আমি আপনাকে কোলে করে বাসায় পৌছে দিবো? আপনি তো এখন অচেতন। তারপর অপেক্ষা করতাম কখন তোমার জ্ঞান ফিরবে তুমি অনুমতি দিবে। তারপর কোলে নিতাম, তাই না? হুম,বুঝতে পেরেছি।"

ইয়াদের উপহাসে টয়ার রাগ হলো। রাগের মাথায় সে কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পরলো না। লোকটা এমন ভাবে কথা বলে যে আর কিছু বলাই যায় না। এইসব ভাবতে ভাবতেই সে সামনে থাকা জুসের গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোক পুরোটা শেষ করে ফেললো।

ইয়াদ সেটা দেখে হেসে ফেললো, রাগের মাথায় টয়া কি করেছে সে সেটা নিজেও বুঝতে পারছেনা। টয়া অবাক হয়ে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার মনে পড়লো ইয়াদ এই গ্লাসটায় চুমুক দিয়েছিলো। 

এটা কি করে ফেলল সে? টয়া অনেক অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। টয়া আর ইয়াদের চেয়ারের মাঝে অনেকটাই দূরত্ব ছিলো। ইয়াদ টয়ার চেয়ারের মাথা ধরে নিজের দিকে টেনে আনতেই টয়া হকচকিয়ে উঠলো। সে বিচলিত হয়ে আশেপাশে দেখলো কেউ দেখেছে কিনা? এমন সময়ে ইয়াদ টয়ার মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললো," কি দেখছো? কেউ দেখেনি। "

ইয়াদের কাছাকাছি থাকলেই টয়ার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। টয়া অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো," আপনি কি শুরু করেছেন? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।" বলে টয়া উঠে যেতেই ইয়াদ টয়ার হাত ধরে ফেললো। টয়া দাড়ানোর আগেই বসে পড়লো। টয়া হাত ছড়ানোর জন্য নানা চেস্টা করছে আর এইদিকে ভয়ও লাগছে কেউ না জানি দেখে ফেলে। 

টয়া আওয়াজ নিচু করে বললো," আমার হাতটা ছাড়ুন।"

ইয়াদ টয়ার হাতটা নিজের কাছে টেনে নিতেই টয়া হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। 

ইয়াদ টেবিলের নিচে হাতটা আবার শক্ত করে ধরে বললো,

তুমি যদি এই চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্য  চেয়ারে বসো তাহলে কি হবে জানো? তারপর  আমিও পিছু পিছু গিয়ে তোমার পাশের চেয়ারে বসে পরবো। তখন কেমন হবে ব্যাপারটা? যদি সেটা না চাও চুপ চাপ আমার পাশে বসে থাকো।"

ইয়াদের উপর টয়ার বিশ্বাস নেই এই ছেলে সব পারে। উপায় না পেয়ে টয়া বসেই রইলো। এই ছেলেটা এতো কথা শিখেছে কবে কে জানে? টয়া মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে বসে আছে আর নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। টয়ার এবার রাগ লাগছে, হাতটা এভাবে ধরে বসে আছে কেনো? সে কি তার প্রেমিকা নাকি? আশ্চর্য!

টয়া বির বির করে বললো," হাত ধরে আছেন কেনো? ছাড়ুন।"

"ভালো লাগছে, তাই।" বলে ইয়াদ অন্য হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলে রাখলো। 

টয়া তেজী গলায় বললো," আমার ভালো লাগছে না।" ইয়াদ ফোনর স্ক্রীন স্ক্রোল করতে করতে বলল," সে তোমার কিছুই ভালো লাগে না। তাই বলে কি সব কিছু তোমার ইচ্ছে মতো হবে?"

মানে? আপনি আমার হাত ধরে আছেন কেনো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি কি আপনার প্রেমিকা লাগি? হাত ছাড়ুন।" জোর দিয়ে বললো টয়া।বলে সে বিরক্তি নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।

ইয়াদ ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো," You're my wishing Star।" 

ইয়াদ কথাটা নিজের মনে মনে বলে হাসলো। টয়া কিছু না বুঝে আড় চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,"  আরেহ আপনি হাসছেন কেনো?

তুমি এতো ঝগড়ুটে হয়েছে কেনো, বলতো?"ইয়াদের কথায় টয়া রাগে গজগজ করতে লাগলো। তাকে ঝগড়ুটে বলা কতো বড় সাহস! সব সময় ঝগড়া করে কে? লোকটা নিজেই ঝগড়া শুরু করে আবার তাকে ঝগড়ুটে বলা।

টয়া রেগে গিয়ে টেবিল থেকে অন্য হাত দিয়ে একটা কাটা চামচ তুলে ইয়াদের মুখের সামনে হুমকি স্বরূপ দেখাতেই ইয়াদ হেসে উঠে বললো," সিরিয়াসলি টয়া!" 

টয়া কিছু বলতে যাবে এমন সময় মিলি আক্তারের কণ্ঠ," কি ব্যাপার কাটা চামচ হাতে কি করছো তোমরা?" শুনেই টয়া সাথে সাথে চামচটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।

ইয়াদের মা ট্রেতে খাবার এনে টেবিল সাজালেন। ইয়াদ এখনো হাতটা ধরে আছে। টয়া ভীষণ অসস্থিতে পরেছে কেউ দেখে ফেললে কি যে ভাববে। টয়া আড় চোখে ইয়াদের দিকে তাকালো ইয়াদ এমন ভাব করছে যেনো কিছু হয়নি।

টয়া একটু চালাকি করে নিচু স্বরে বললো," হাতটা ব্যাথা করছে ছাড়ুন।" ইয়াদ যদিও টয়ার কথা বিশ্বাস করেনি তাও সে ছেড়ে দিলো হাতটা। একটু পর এমনেই ছেড়ে দিতে হতো।  

অন্য হাতে ধরে রাখা যেত কিন্তু একটু আগে কাটা চামচ হাতে নিয়েছে কিছুক্ষণ পর হয়তো ছুরি দেখিয়ে শাসিয়ে যেতো। 

টয়া যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো ছাড়া পেয়ে,হাতটা গুটিয়ে রাখলো। খাবার টেবিলে সবাই গল্প করছিল টয়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়ে নিয়ে উঠে পড়ল। কখন আবার হুট করে হাত ধরে বসে এই চিন্তায় সে তাড়াতাড়ি খেয়ে একপাশের সোফায় বসে রইলো।

এখন হুট করে বাসায় যাবার কথা বলতেও পারছেনা, সবাই খাবার টেবিলে আড্ডা দিচ্ছে। কখন যে শেষ হবে এদের আড্ডা বাসায় গেলেই টয়া বাঁচে। টয়ার বাবা ইয়াদের সাথে তখন থেকে কি যে গল্প শুরু করেছে থামার নাম নেই। এই ছেলের সাথে এতো কথা বলার দরকার কি তার বাবার। খাওয়া শেষ উঠে পড়লেই তো হয়। 

ইয়াদের হটাৎ মা কি যেনো একটা বললেন সেটা কানে আসতেই টয়া চমকে উঠলো।

আপনার মেয়েটাকে আমার ভীষন পছন্দ হয়েছে ভাবি। ওদের দুজনকে মানবে ভালো।" এতটুকু শুনেই টয়া হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে গেলো।

আজ বিয়ে কথাটা শুনেই টয়ার পিলে চমকে উঠলো। মানে কি বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই বিয়ে? সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কিচেনে গিয়ে ইয়াদের মায়ের সাথে তার মায়ের আলাপ কানে আসতেই টয়া যেনো আকাশ থেকে পড়লো। কাল রাতে যা শুনেছিল সব তাহলে সত্যি। কেউ কাল এই ব্যাপারে কোনো কথা বলে নি তাই টয়া ভেবেছিলো তার হয়তো বোঝার ভুল কিন্তু এবার তো স্পষ্ট শুনেছে সে।

টয়া স্ট্যাচুর মত সেখানে দাড়িয়ে রইলো। মিলি আক্তার আর টয়ার মা এই নিয়ে টয়ার সাথেই কথা বলবেন বলে যাচ্ছিল টয়াকে এখানে পেয়ে তাদের ভালোই হলো।

টয়া যা শুনেছে সেটা নিয়ে সে কল্পনাও করতে পারছেনা। টয়াকে এনে দুজনে সামনে বসালেন। টয়ার সামনে মিলি আক্তার আর তার মা। ।

টয়ার মা আর দেরী না করে বললেন," শোন ইয়াদ ছেলেটাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।"

আরো বললেন যে ইয়াদের বাবার সাথের টয়ার বাবার পরিচয় অনেক আগের। এছাড়া একা একা এইভাবে তাকে রেখে যেতেও ভীষণ ভয় লাগছে তাদের। বিয়েটা হয়ে গেলে তারা চিন্তা মুক্ত হয়ে ফিরতে পারবেন। 

আর আমার ইচ্ছে? তার বুঝি কোনো মূল্য নেই? আমি এখণ এসবের মধ্যে জড়াতে চাই না।" জোর গলায় বললো টয়া।

"তোমাকে এসবের মধ্যে এখন জড়াতে কেউ  বলছেনা। আমাদের এখন বয়স হয়েছে এভাবে শহরে এসে থাকতে পারিনা। তোমরা একা একা থাকো কখন কার কি বিপদ হয়ে যায়। সে চিন্তায় চিন্তায় সারাদিন কাটাতে হয়। আমরা চাই শুধু তোমরা একে অপরের খেয়াল রাখো। তাহলে আমরা একটু চিন্তামুক্ত হই। এক্ষুণি সংসার করতে কেউ বলছেন না তোমায়। শুধু হাতে কলমে রেজিস্ট্রি করা হবে। তোমার ভাইয়েরা আছে তারা আসবে আমদের আত্মীয় স্বজন তারা আসবে ধুমধাম করে তখন বিয়ে হবে। এখন এ বিয়ের কথা কাউকে জানাবারও প্রয়োজন নেই।"মিলি আক্তারের কথাগুলোয় টয়া চুপ করে ছিলো। তার মাথায় একটাই কথা ইয়াদকে সে বিয়ে করবে না। হুট করেই কিভাবে এক রাতের মধ্যে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা?

টয়ার মা উপায় না পেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো," তোর কি পছন্দের কেউ আছে?" 

এই প্রশ্নের উত্তরের ইয়াদের মা আগ্রহ নিয়ে টয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। টয়া মাথা নিচু করে না সূচক মাথা নাড়ল। মিলি আক্তার যেনো শান্তি পেলেন।

কাউকে পছন্দ না করলে এই বিয়েতে সমস্যা কি তোর?" মায়ের প্রশ্নে টয়া চুপ করে আছে। 

যে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে সে ছেলেই আসল সমস্যা। সেই কথা এদের সে কিভাবে বুঝাবে?

টয়ার নিরবতা দেখে ইয়াদের মা বললো," আমাদের বুঝি ভালো লাগেনি তোমার?"

টয়া ইয়াদের মাকে কষ্ট দিতে চায় না। উনি অনেক আলাদা একজন মানুষ যাকে বন্ধুর মতো সব বলা যায়। টয়া মাথা তুলে নিচু স্বরে বললো," আণ্টি আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না আমি সেটা বলিনি।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টয়া আরো বললো," ঠিক আছে তোমরা যা আমার জন্য ভালো মনে করেছো আমি সেটা মেনে নিচ্ছি তবে ওই ছেলের সাথে আমি একঘরে থাকবো না। আমাকে কোনো ব্যাপারে কেউ জোর করতে পারবে না। আর আমি যদি আলাদা হয়ে যেতে চাই তাতেও কেউ আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না।"

টয়ার এমন আযুক্তিক কথা শুনে টয়ার মা ধমক দিতে যাবেন এমন সময় মিলি আক্তার তাকে থামিয়ে বললেন," টয়া তো ঠিকই বলেছে এখন একসাথে থাকতে যাবে কেনো? সবে তো মাত্র রেজিস্ট্রি হবে। তোমরা আলাদা থেকো সমস্যা নেই।"

যাক একটা বিপদ থেকে বাঁচার অনুমতি পেয়েছে সে। ভেবেই বিয়ের ভয়টা একটু কমেছে টয়ার। তবে ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না। 

এদিকে ইয়াদ এ ব্যাপারে কিছুই জানে না হঠাৎ তার মা এসে বললো," তোর টয়া বিয়েতে রাজি হয়েছে। দেখছিস আমি বলেছিলাম না?"

"টয়া বিয়েতে রাজি হয়েছে! হতেই পারে না", ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ইয়াদ।

" রাজি হয়েছে তবে বলেছে তোর সাথে একঘরে থাকবে না। যাক সেটা বিয়ের পর তোদের পার্সোনাল ব্যাপার। সেটা দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই। তোর বউ তুই বুঝে নিস।"

ইয়াদ বিস্ময় নিয়ে বললো," আসলেই রাজি হয়েছে? কীভাবে সম্ভব?" 

তোর মা থাকতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। এবার তোরা বিয়ের পর মারামারি কর কিংবা চুলোচুলি কর তোদের ব্যাপার কিন্তু একে অপরের হয়ে থাক। " 

ইয়াদের যেনো কোনো মতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। সে হা করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

রেজিস্ট্রি কাগজে ওরা সহজেই সাইন করে ফেললো। বিয়ে বিয়ে কোনো অনুভুতি কেউ পেলো না। টয়া সন্ধ্যে বেলা নিজের রুমে বসে টিভি দেখছিল এমন সময় তার মা হাতে একটা শাড়ি হাতে ঘরে এলো। যা চেয়েছিল সব তো করেই দিয়েছে আবার এ কোন আপদ সঙ্গে করে নিয়ে আসছে তার মা। এবার কি শাড়ি পড়তে হবে? মায়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে টয়া। 

টয়ার মা শাড়ি ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বললো,"এভাবে তাকিয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। শাড়ি পড়ে বাহিরে এসো।"

টয়া নানা অজুহাত দেখিয়ে বাঁচার চেস্টা করলো কিন্তু তাকে আজ শাড়ি পড়তেই হবে। সবার সামনে শাড়ি পড়ে যেতে হবে কতটা বিভ্রান্তিকর একটা কাজ। টয়া কোনো মতে শাড়িটা পরে বের হয়ে এলো।

বাহিরে এসেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো ইয়াদ, ইয়াদের মা বাবা সবাই বসে আছে। টয়া এদের দেখে আবার রূমে চলে যেতে চাইলো টয়ার মা টয়াকে জোর করে এনে ইয়াদের পাশে বসিয়ে দিলো। ইয়াদ টয়ার থেকে চোখ সরাতে পারছে না। বেগুনি রঙের শাড়িটাতে টয়াকে অপরূপা লাগছে। চুল গুলো খোলা রাখার  কারণে তাকে যেনো আরো সুন্দর লাগছে। ইয়াদ সোফার এক পাশের উপরিভাগে এক হাত মেলে  বসে ছিলো।নেভিব্লু রঙের শার্ট আর জিন্স প্যান্ট তাকেও মানিয়েছে।

টয়ার মা টয়ার মাথায় শাড়ির আঁচলটা তুলে দিলেন। টয়া নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভীষণ বিরক্ত লাগছে এইসব। সবাই কথা বলছে। এইখানে তাকে বসিয়ে রাখার মানে কি?

হটাৎ তাদের একসাথে কিছুক্ষণ থাকার জন্য বড়রা  ছাদে পাঠিয়ে দিল। টয়া আসতেই চাইছিলো না ইয়াদের সাথে টয়ার মা ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দিলেন। টয়া ইয়াদের থেকে দশ হাত দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ইয়াদের এখনো টয়ার বিয়েতে রাজি হওয়াটা অস্বাভাবিক লাগছে। ইয়াদ এক দৃষ্টিতে টয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। টয়া সেটা ভালোই বুঝতে পারছে কিন্তু সে তাকাচ্ছে না। কতক্ষণ এইখানে থাকতে হবে কে জানে? এই ছেলের সাথে আবার নাকি বিয়েও হয়ে গেছে। ইয়াদ টয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললো," গাল ফুলিয়ে রেখেছো কেনো?" 

টয়া আড় চোখে তাকালো কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। কারণ কথা বললেই কথা বাড়ে। কথা বাড়ানোর মন মানসিকতা তার এখন নেই।

" বিয়ের শোকে কি কথা বন্ধ হয়েগেছে?", ইয়াদ কাটা ঘায়ে একটু নুনের ছিটে দিয়ে দিলো আর কি!

" আপনার সমস্যা কি বলুন তো? আপনিই এইসব করেছেন তাই না। সব আপনার প্ল্যান, এবার আমি সব বুঝতে পারছি।", কড়া গলায় বলল টয়া।

ইয়াদ তাচ্ছিল্য করে বললো," তুমি  নিজেকে কি ভাবো বলোতো ? তোমাকে বিয়ে করতে হলে এতো ঝামেলায় কেনো পড়তে যাবো আমি?"

" তাহলে এ বিয়েতে রাজি হলেন কীভাবে? আপনার যাকে পছন্দ আমার থেকে ভালো তাকেই বিয়ে করতেন।" তেজ দেখিয়ে বললো টয়া।

" হুম, ইচ্ছে তো এমনটাই ছিলো। কিন্তু কি করার বলো মা বাবার কথা তো ফেলতে পারি না।", বলে ইয়াদ টয়ার দিকে তাকালো। টয়ার রাগী মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কথাটা তার ভালো লাগেনি বোঝাই যাচ্ছে, মুখে তো এতো কথা বলে তাহলে এখন অন্য মেয়ের কথা শুনে মুখ ফ্যাকাশে করেছে কেনো?

" ও আচ্ছা, বাবা মার চাপে বিয়েটা করেছেন!", শান্ত গলায় বলল টয়া। টয়ার ভিতরটা কেমন জানি করে উঠলো ইয়াদের কথায়। তাহলে কি তার অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ ইয়াদের।

" হুম , কেনো তুমি কি ভেবেছিলে?", বলেই ইয়াদ টয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই টয়া মুখ সরিয়ে সামনের রেলিং ধরে দাড়িয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললো," কিছু ভাবিনি"।

" তা তুমি কেনো রাজি হয়েছো? তুমিও কি বাবা মার চাপে?" ইয়াদের এমন প্রশ্নে টয়া শুধু হা সূচক মাথা নাড়ল কিন্তু তার দৃষ্টি সামনে স্থির।

বাতাসে টয়ার চুলগুলো উড়ছে ইয়াদ টয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা ঘোরের মধ্যে চলেগেছে। ইয়াদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বললো," তোমার পছন্দের কেউ নেই?"

নিজের পছন্দের উপর থেকে আস্থা অনেক আগেই উঠে গেছে আমার।", ইয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো টয়া।

কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে টয়া। ইয়াদ নিজেকে সামলে নিলো।টয়ার আর থাকতে ভালো লাগছে না। টয়া চলে যেতেই ইয়াদ টয়ার হাত ধরে ফেললো। টয়া জোর গলায় বললো," আমার হাত ছাড়ুন। আপনাকে আমি বারণ করেছি না আমার হাত ধরবেন না।"

টয়ার কথায় ইয়াদ টয়ার কোমড় জড়িয়ে কাছে নিয়ে এলো। টয়া ইয়াদের এভাবে তাকে কাছে নিয়ে আসায় চমকে গেলো। 

টয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ইয়াদ টয়াকে আরো কাছে এনে বললো," আমাকে কি জানি বলছিলে একটু আগে? যেনো তোমার হাত না ধরি? যদি না শুনি তোমার কথা। কি করবে তুমি ?"

ইয়াদের হটাৎ এমন আচরণে ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। কি বলছে এইসব! টয়া নিজেকে সামলে বললো," আমি চিৎকার করবো। "

বাতাসে টয়ার সামনের চুল গুলো চোখে এসে পড়ছে। ইয়াদ চুল গুলো টয়ার কানের কাছে গুঁজে দিয়ে ঠোঁটে বাকা হাসি রেখে বললো," তাই বুঝি। সব কিছুর সলিউশন আমার কাছে আছে।" 

টয়া ভ্রু কুঁচকে বললো," মানে?" 

ইয়াদ টয়ার কথায় ঝুকে এসে টয়ার ঠোটের দিকে তাকাতেই টয়ার কাছে কথাটা পরিষ্কার হয়ে গেলো।

টয়া সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রাগে বলে উঠলো," আপনি..." বলেই থেমে গেলো।

কি হলো থেমে গেলে যে? কি বলবে? আপনি আমার বর?", টয়ার কানের কাছে মুখ এনে বললো ইয়াদ।

টয়া তেজ দেখিয়ে বললো," বলবো না। ছাড়ুন আমাকে।"

ইয়াদ টয়াকে আরো কাছে এনে বললো," তাহলে আমিও ছাড়ছি না।"

টয়া ইয়াদকে সরানোর চেষ্টা করলো কিন্ত কোনো লাভ হলো না। ইয়াদ বললো," আচ্ছা তুমি যদি তিনবার জোরে জোরে বলো ইয়াদ আরফিন আমার বর তাহলে ছেড়ে দিবো।"

" জীবনেও বলবো না।", কড়া গলায় বলল টয়া।

" আমিও  ছাড়বো না।", কথার পিঠে কথা বললো ইয়াদ। 

এ কেমন বিপদে পড়লো সে। আগে জানলে কখনই এই বিয়েতে সে রাজি হতো না। কেনো যে রাজি হতে গেলো। 

ইয়াদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে টয়া। এতে তার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করছে। এভাবে আর থাকা যাবে না, কোনো না কোনো বুদ্ধি বের করতেই হবে টয়াকে। 

টয়া ভ্রু কুঁচকে বললো," একটু এদিকে আসুন একটা কথা বলবো।"

ইয়াদ একটু ঝুকে এলো তারপর বলল," বলো শুনছি।"

টয়া বললো," একটু কাছে আসুন।কানে কানে বলি।"

টয়ার কথা শুনে ইয়াদের মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাবার উপক্রম হলো। টয়া ইয়াদের বুকে হাত রেখে কানের কাছে গিয়ে বলল," ইয়াদ আরফিন " খুব সুন্দর করে এতটুকু তো বললো তারপরে যা হলো সেটার জন্য ইয়াদ প্রস্তুত ছিলো না,

টয়া সজোরে ইয়াদের কানের কাছে হিটলার বলে চিৎকার করেই ইয়াদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সফল ভাবে পালিয়ে যাবে। এমন সময় ইয়াদ টয়ার শাড়ির আঁচলটা ধরে ফেলে।

আরও পড়ুন: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-৫

Post a Comment

0 Comments