ভালোবাসি কও| নুজাইফা নূন| পর্ব-৩
পরাগ ভাই আমাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছেন।আমার মাথাটা পরাগ ভাইয়ের ঠিক বুকের বাঁ পাশে গিয়ে ঠেকেছে।তার বুকের ধুকপুক শব্দ ছন্দের মতো আমার কানে বাজতে থাকে।নাকে আসে তার ঘামে ভেজা শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ।তার বুকের উষ্ণতায় আমার সমস্ত ভয়, সমস্ত সংশয় গলে পড়ে।একটা মুহূর্তের জন্য মনে হয়, আমি যদি চিরকাল এভাবেই তার বুকে লুকিয়ে থাকতে পারতাম।তার বাহুর বাঁধনে বন্দি থেকে তার গায়ের ঘ্রাণ নিয়ে পারতাম। তাহলে হয়তো এই জীবনটাই স্বর্গ হয়ে যেত। কিন্তু পরমূহুর্তে নিজেকে নির্লজ্জ, বেহায়া বলে ধিক্কার জানালাম।
আমি তার বুক থেকে সরে আসার আগেই পরাগ ভাই এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে দিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“দেখে চলতে পারিস না?চোখ কি হাঁটুতে নিয়ে হাটিস? এক্ষুনি তো গাড়ির নিয়ে চাপা পড়ে মরতি।”
আমি কখনোই পরাগ ভাইয়ের মুখের উপর কোনো কথা বলি না। কিন্তু আজ কেন জানি চুপ থাকতে ইচ্ছে করলো না।আমি প্রথমবারের মতো তার চোখে চোখ রাখলাম। কণ্ঠ কাঁপছিল, তবুও রুক্ষ স্বরে বললাম,
“ আমি না হয় হাঁটুতে চোখ নিয়ে হাঁটি। কিন্তু আপনার চোখ তো ঠিক জায়গায় রয়েছে।তাহলে আপনি কেন দেখতে পারছেন না , আমি কতটা কষ্টে আছি? গতরাত থেকে জ্বর , মাথাব্যথায় …
বাকি কথাটা শেষ করতে পারি না আমি।তার আগেই কেউ পেছন থেকে আমার পিঠে দড়াম করে কিল বসিয়ে দেয়।আমি পেছন ফিরে দেখি আম্মু কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন । নিজের আদরের ভাইপো কে দুটো কথা শুনিয়েছি, আঁতে ঘা লেগেছে তার।।তিনি রেগে গিয়ে গর্জে ওঠেন,
“ বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না? এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে?আব্বাজান তোকে ভালো কথা বলল, আর তুই তাকে যা নয় তাই বলে অপমান করলি? “
“ যা নয় তাই কোথায় বললাম মা? “
“ জ্বর হওয়াতে যেন সাপের পাঁচ পা দেখে এসেছে। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করছে।যা গিয়ে আব্বাজান কে সরি বল।”
পরাগ ভাই এগিয়ে আসলেন।শান্ত স্বরে বললেন,
“ ফুপি এটা পাবলিক প্লেস।এখানে প্লিজ কোনো সিনক্রিয়েট করো না।পাপড়ি ছোট মানুষ। ঠিক, ভুল বিচার করার বয়স এখনো হয় নি। তুমি চলো তো। এই ব্যাপারে বসে কথা বলব আমরা।”
অটোর পেছনের সিটে আমি আর আম্মু বসেছি। সামনের সিটে পরাগ ভাই বসেছেন।একদম আমার মুখোমুখি। যার দরুন বারবার চোখাচোখি হচ্ছে আমাদের। প্রতিবারই আমি কেঁপে উঠছি।
জ্বরটাও চড়াও হয়েছে আবার।আমি চোখ বন্ধ করে আম্মুর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিই। আম্মু পরম যত্নে আমার মাথায় বিলি কেটে দেন।পরাগ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
“আব্বাজান, তোর পরিচিত কোনো রিক্সাওয়ালা, ফুচকাওয়ালা , ওয়াইফাইওয়ালা আছে কি?”
পরাগ ভাই ফোন টিপছিলেন।আম্মুর কথা শুনে ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে তাকালেন। শান্ত স্বরে বললেন,
“ রিক্সাওয়ালা, ফুচকাওয়ালা ,ওয়াইফাইওয়ালাদের দিয়ে তোমার কাজ কী ফুপি?”
আম্মুর মজার ছলে বললেন,
“ কিছুদিন বাদেই তো পাপড়ির এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে।যদি খারাপ রেজাল্ট করে তো কোনো রিক্সাওয়ালা ,ফুচকাওয়ালা বা ওয়াইফাইওয়ালা দেখে বিয়ে দিয়ে দিব।তাই আগে থেকেই খোঁজ খবর নিয়ে রাখা ভালো। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।"
আম্মুর কথা শুনে চট করেই আমি চোখ মেলে তাকালাম।আম্মু মিটিমিটি হাসছে।তাকে কিছু বলার আগেই পরাগ ভাই বলে উঠলেন,
“ তোমার মেয়ের যা রুপ, গুন, তাতে সে রিক্সাওয়ালা ,ফুচকাওয়ালা’ই বউ হবার যোগ্য।
রিক্সাওয়ালার বউ হলে তোমার মেয়ে ফ্রিতে ৬৪ জেলা ঘুরে দেখতে পারবে।ফুচকাওয়ালার বউ হলে ফ্রিতে যতো খুশি ফুচকা গিলতে পারবে।আর ওয়াইফাইওয়ালার বউ হলে তো কথাই নেই।ফ্রিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে। ব্যাপার টা দারুন হবে ফুপি।”
পরাগ ভাইয়ের বলা ছোট্ট কথাটা প্রচন্ড হার্ট করলো আমাকে। চোখের কোণে পানি জমলো।
পরাগ ভাইয়ের আড়ালে আমি চোখের পানি মুছে নিলাম। রাস্তায় আর একটা কথাও বলি নি আমি।
রাস্তাটা যেন হঠাৎ দীর্ঘ হলো।আম্মু, পরাগ ভাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আমি চুপচাপ এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিচ্ছিলাম।
প্রায় দশ মিনিট পর অটো এসে আমাদের গেটের সামনে থামে।আমরা অটো থেকে নামতেই আমাদেরকে দেখে আশেপাশের মানুষ কেমন যেন কানাঘুষা শুরু করে দিলো।কেন করলো বুঝে উঠতে পারি নি।
মা গেট খোলার জন্য ব্যাগ হাতড়ে চাবি বের করতেই দেখে গেট অলরেডি খোলাই রয়েছে।
মায়ের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।সেই সাথে আমার কপালেও ভাঁজ পড়ে। আমাদের দোতলা বাড়ি।দোতলা এই বাড়িটা একসময় যৌথ পরিবারের জন্য বানানো হয়েছিল। এখন অবশ্য আমরা ছাড়া আর কেউ থাকে না।
আমাদের বাড়ির মুল ফটকে মাঝারি সাইজের লোহার গেট, যার পাশে একটা মেহগনি গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।গেট পেরোলেই পাথর বিছানো পথ ধরে বাড়ির মূল অংশ।বাঁ দিকে ছোট একটা বাগান।সেখানে দাদুর লাগানো গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা আর ক'টা রঙ্গন গাছ এখনো রয়ে গেছে।ডান দিকে গ্যারেজ, বাবার পুরোনো ভাঙ্গা গাড়িটা অনেকদিন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, ধুলোমাখা ছাউনির নিচে।
নিচতলায় আমরা থাকি।আমি আর মা।
দু’টো শোবার ঘর, একটা বারান্দা, মাঝারি আকারের ড্রয়িংরুম আর রান্নাঘর।ড্রয়িংরুমে কাঠের পালিশ করা সোফা, একপাশে বইয়ের তাক ।
উপরতলা একসময় ছিল বড় চাচাদের। বছর দুয়েক আগে তারা সপরিবারে দেশের বাইরে চলে গিয়েছেন।তাঁরা চলে যাওয়ার পর পুরো বাড়িটাই আমাদের।ওপরেও দু’টো ঘর, একটিতে ফার্নিচার রাখা, অন্যটাতে বাবার জিনিসপত্র।
একটা বড় বারান্দা আছে ওপরে, যেখান থেকে পুরো পাড়ার ছাদ দেখা যায়। মাঝেমধ্যে বাবা রাতে সেখানে বসে থাকতেন, চুপচাপ।মাঝে মাঝে আমি দেখতাম, উনি চুপচাপ বসে সিগারেট খাচ্ছেন। আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার। বরিশাল পোস্টিং। মাগুরা আসেন ছয় মাসে বা বছরে একবার।বাবা বাদে আর কারো কাছে চাবি থাকার কথা নয়।তাহলে কি বাবা এসেছে? আর আসলেও বাবা আমাদের জানালো না কেন? প্রশ্নগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
সেই সাথে অজানা শঙ্কায় আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।মনে হচ্ছিল, আমার বুকের ভেতরের ধুকপুকানিও বুঝি বাড়ির দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে।
মা কিছু না বলে সামনে এগিয়ে গেলেন।
আমি তাঁকে অনুসরণ করলাম। কিন্তু প্রতিটা পা ফেলতেই মনে হচ্ছিল মেঝেটা যেন একটু একটু করে সরে যাচ্ছে পায়ের নিচ থেকে। আমাদের পেছন পেছন পাড়াপড়শিরাও ঢুকলেন।তারা জানেন , কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে বলছেন না।তাদের
গজগজ আওয়াজ , ফিসফাস, চাপা হাসি সবটাই আমার কানে বাজলো। কিন্তু আমি পাত্তা দিলাম না।মায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে লাগলাম।
বারান্দা পেরিয়ে যখন ঘরের দরজার সামনে পৌঁছালাম, দেখি দরজাটা হালকা খোলা। আরেক দফা চমকে উঠলাম।মা একবার আমার দিকে তাকালেন।তার চোখে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
কিন্তু মা কিছুই বললেন না। ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। মায়ের পিছু পিছু আমি , পরাগ ভাই ভেতর ঢুকলাম।আমার পা যেন জমে বরফ হয়ে গেল।আমি ,মা যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, ঠিক সেটাই হয়েছে।ড্রয়িংরুমে বাবা বসে রয়েছেন।
কিন্তু তিনি একা নন।
সামনের সোফায় বসে আছেন এক অচেনা নারী। তার পরণে চকমকে শাড়ি, হাতে সোনার চুড়ি,কানে দুল, সাজানো চুল, ঠোঁটে লিপস্টিকের আভা।
নিঃশব্দে পুরো ঘরটা যেন জমে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। শুধু টিকটিকির টিকটিক শব্দ, আর মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। আমি পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছি।বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার।বুক ফুঁড়ে হৃদপিন্ড টা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
পরাগ ভাই হয়তো বুঝতে পারলো ,এই মুহূর্তে তার কাঁধটাই সবচেয়ে বেশি দরকার আমার।
সে আস্তে করে এগিয়ে আসলো। পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলো।আমি ধীরে ধীরে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম।
আমার চোখদুটো লাল হয়ে উঠেছে কান্নায়। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোন শব্দ বের হচ্ছে না।আমার কী থেকে কী হয়ে গেল ,আমি নিজেও জানি না।আমি সমস্ত ভয়, লাজ লজ্জা ভুলে পরাগ ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
0 Comments