আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| শেষ পর্ব
গোধূলির প্রহর শেষে শুরু হয়েছে রজনীর ঘনঘটা । চাঁদ আর ইতুর গায়ে হলুদের জন্য ছাদেই ছোট করে একটা স্টেজ বানানো হয়েছে । চাঁদের কাজিনরা মিলেই বানিয়েছে স্টেজটা। বাড়ির চারপাশটা আলোকিত হয়েছে ছোট ছোট ঝিলিক বাতির আলোতে । ইতু হলুদ শাড়ি আর কাঁচা ফুলের গয়না পরে স্টেজে বসে আছে। আলো নিচে নানা কাজে ব্যস্ত ছিলো। মিহু একটু আগেই জোড় করে তাকে ছাদে নিয়ে এসেছে । আলো প্রথমে আসতে রাজি হয়নি,তবে চাঁদ ছাদে নেই জানার পর মিহুর জোড়াজুড়িতে আর না করতে পারেনি।
মিহু আলোকে নিয়ে ছাদের এককোণায় দাড়িয়ে আছে। বারংবার করে আলোকে রিকুয়েষ্ট করছে সবাইকে সত্যিটা বলে দেওয়ার জন্য।
"আলো আপু,প্লিজ আর চুপ করে থেকো না। ভাইয়ার বিয়েটা আটকায় তুমি।"
"এটা হয় না মিহু।"
"কেনো হয় না আলো আপু। তুমি কিভাবে চুপ হয়ে সবটা দেখছো বলো তো?"
"এছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই মিহু। উনি আমাকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে চান না বলেই সেদিন রাতে আমাকে ফেলে এসেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে আমি যদি সেদিন মেজো আব্বুর গাড়ির সামনে চলে না আসতাম তাহলে কোনোদিনই আমি এই বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারতাম না,আর না তো উনাকে আমি আবারও খুজে পেতাম।"
"নিয়তিই তোমাদেরকে আবার মিলিয়ে দিয়েছে আলো আপু। তোমাদের এক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। একটাবার ভাইয়াকে বলে দেখো প্লিজ।"
"প্লিজ মিহু,এইসব বিষয়ে আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। কাল বাড়িতে বিয়ে। এখন আমি নতুন করে কোনো ঝামেলা চাই না।"
কথাটা বলেই আলো গটগট পায়ে হেটে ছাদ থেকে নেমে যায়। মিহু অস্থির হয়ে আলোর চলে যাওয়া দেখে। নিজের ভাইয়ার সাথে আলোর বিয়ে হয়েছে জানার পর সে কিছুতেই মানছে তার ভাই এখন অন্য কাউকে বিয়ে করবে। মনে মনে ঠিক করে এই বিয়েটা আটকাতে তাকেই কিছু একটা করতে হবে।
মিহু ছাদ থেকে নেমেই চাঁদের রুমের সামনে এসে দাড়ায়। রুমের দরজা হালকা ভেজানো ছিলো। মিহু তড়িঘড়ি করে ছাদ থেকে নেমেই রুমের দরজায় নক না করে ঢুকে পরে,আর ঢুকেই দেখতে পায় চাঁদ নিজের জামা কাপড় পয়াক করছে । দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে । চাঁদ মিহুকে রুমে ঢুকতে দেখেই এক পলক তার দিকে তাকায় । তারপর আবারও মন দেয় ব্যাগ গুছানোতে।
"হঠাৎ করে এতো রাতে ব্যাগ প্যাক করছো কেন ভাইয়া?"
"দরকার আছে তাই করছি। সবাই ছাদে,আর তুই এখানে কি করছিস?",নিজের কাজ করতে করতেই কথাটা বলে চাঁদ।
"তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে ভাইয়া।"
"এখন আমার কোনো কথা শোনার টাইম নেই মিহু। আমার তাড়া আছে,তুই যা এখান থেকে।"
"তুমি কি কোথাও যাচ্ছো ভাইয়া?"
"হুম।"
"বাড়িতে এতো লোকজন আর তুমি এই রাতের বেলা কোথায় যাবে?"
"এতো কথা বলতে পারবো না মিহু। শুধু জেনে রাখ কালকে বিয়েটা হচ্ছে না। বাড়িতে একটা বড়সড় ঝামেলা হবে আমি জানি। তুই দয়া করে আম্মুকে একটু সামলে নিস।"
চাঁদের কথা শুনে মিহু যেন বাকহারা হয়ে গেল। সে নিজে বিয়ে ভাঙতে এসে শুনছে চাঁদই বিয়েটা করবে না?নিজের কানকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না মিহু।
"এসব তুমি কি বলছো ভাইয়া?বিয়ে হবে না মানে?"
চাঁদের ব্যাগ গুছানো শেষ। নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু একটা দেখতে দেখতে বলে,"এই বিয়েটা আমি করতে পারবো না মিহু । আমি আগে থেকেই বিবাহিত ।"
চাঁদের কথাটা শুনে মিহু আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বেডে বসে যায়। চাঁদ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো বলতে শুরু করে,"আজ থেকে তিনবছর আগে অজ্ঞাত এক মেয়ের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমার বিয়ে হয়। সেইরাতে আমি মেডিকেল ক্যাম্পিং শেষে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরছিলাম । আর মাঝরাস্তায় এই ঘটনাটা ঘটে। পর পর অনেকগুলো ঘটনা একসাথে ঘটায় আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না তখন। যার কারণে মেয়েটাকে একা ফেলেই চলে আসি আমি। বাড়ির কাছাকাছি আসার পর আমি রিয়েলাইজ করি এতো রাতে মেয়েটাকে ওভাবে একা ফেলে আসা আমার উচিত হয়নি। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মেয়েটা আমার বউ। আমার অর্ধাঙ্গিনী। তাই আমি তাকে খুজতে আবারও ফিরে যায় সেই জায়গায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি ফিরে গিয়ে মেয়েটাকে আর পায়নি,মেয়েটা তার আগেই ওখান থেকে কোথাও চলে গিয়েছিল।"
"তুমি যদি আগে থেকে বিবাহিত হয় তাহলে ইতু আপুকে বিয়ে করতে রাজি হলে কেন ভাইয়া?"
"আমি ইতুকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। ইতুর রিকোয়েস্টে রাজি হওয়ার অভিনয় করেছি শুধু।"
"মানে?", মিহুর মাথায় যেন আরও একবার বাজ পড়লো৷ ইতু আপু আবার কি রিকুয়েষ্ট করেছে ভাইয়াকে। ভাইয়া এইসব কি বলছে?
" পরে এসে সবটা বলবো তোকে। আমাকে এক্ষুনি মানিকগঞ্জ যেতে হবে। আসি রে মিহু।",বলেই চাঁদ রুম থেকে বের হতে যাবে তার আগেই মিহু তার পথ আটকে দাড়ায়।
"দাড়াও ভাইয়া। তুমি মানিকগঞ্জ কেন যাবে এখন?"
মিহুর পথ আটকানোয় বিরক্ত হয় চাঁদ,তবে সেটার বহিঃপ্রকাশ করে না।
"সেইরাতে যে কাজির বাড়িতে আমাদের বিয়ে হয়েছিল সেখান থেকে অনেক কষ্টে আমি মেয়েটার বাড়ির ঠিকানা পেয়েছি। ও মানিকগঞ্জে থাকে। তাই ওখানেই ওকে খুজতে যাচ্ছি । এখন রাস্তা ছাড় আমার।",কথাটা বলে চাঁদ বেরিয়ে যেতে নিলে মিহু পেছন থেকে বলে উঠে," তোমার বউ এই বাড়িতেই আছে ভাইয়া। মানিকগঞ্জ যেতে হবে না তোমাকে।"
মিহুর কথা কর্ণকুহরে যেতেই চাঁদের থেমে যায়। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মিহুর দিকে ফিরে বলে,"আমি তোর সাথে ফাইজলামি করার মুডে নেই মিহু।"
"আমিও তোমার সাথে মোটেও ফাইজলামি করছি না ভাইয়া। আলো আপু মানে তোমার বিয়ে করা সেই বউ আমাদের বাড়িতেই আছে । গত তিনবছর যাবত তোমার চোখের সামনেই ছিল সে। অথচ তুমি খেয়াল করোনি।"
চাঁদের হাতে থাকা ব্যাগটা পরে যায়। মিহু এগিয়ে গিয়ে চাঁদের সামনে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,"এবার বলো ইতু আপু তোমাকে কি রিকুয়েষ্ট করেছিল যার জন্য তুমি এই বিয়ে করতে রাজি হলে?"
চাঁদ আবার রুমের ভেতরে চলে যায়। ধপ করে বেডে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলে,"ইতু একজনকে ভালোবাসে। ছেলেটা পড়াশোনার জন্য ইতালিতে থাকে । সেটা খালামনি জানার পর ইতুর বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। আমি ইতুকে বিয়ে করতে না চাইলে খালামনি অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিতো ওকে ৷ তাই ইতু আমাকে রিকুয়েষ্ট করেছিলো যাতে আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি হই আর বিয়ের ডেটটা পিছিয়ে দি। তাহলে সেইসময়ের মধ্যে ওর বয়ফ্রেন্ড বাংলাদেশে ফিরে ওকে বিয়ে করার পর্যাপ্ত টাইম পাবে। সব কিছু প্ল্যান মতো ই হয়েছে। আজ বিকেলেই ইতুর বয়ফ্রেন্ড ইতালি থেকে ফিরে এসেছে৷"
কথাগুলো বলে চাঁদ থামলো। হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,"মেয়েটা কোথায় মিহু?"
"কে?তোমার বউ?"
চাঁদের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়না। সে শুধু উত্তরের আসায় মিহুর দিকে চেয়ে থাকে। মিহু মুখ বাকিয়ে বলে,"হুউম...তিন বছরে কোনো খোঁজ খবর নেয় নাই,আর এখন আসছে বউ খুজতে।"
মিহুর কথা শুনে চাঁদ ক্ষীণ হাসে। মেঝের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে,"গত তিনবছরে কম খুজিনি ওকে । মেয়েটার নামও আমি ঠিক মতো জানি না। রাতের অন্ধকারে কোনদিক দিয়ে কাজীর আমাদের কাজীর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাও আমার মনে নেই। তাও কম করে হলেও কয়েকশ বারের উপরে গেছি সেই জায়গায়। উদ্দেশ্য একটাই মেয়েটার দেখা পাওয়া,অথবা সেই কাজীর বাড়ি চিনা। ওইগ্রামে কম করে হলেও বারো থেকে পনেরোটা কাজীর বাড়ি আছে। আমি যখনই ছুটি পেতাম তখনই ছুটে যেতাম ওই আসল বাড়িটা খুজতে। গতকালও গিয়েছিলাম। আর ফর্চুনেটলি গতকালই আমি সেই আসল কাজীর বাড়িটা খুজে পাই,আর সেখান থেকে মেয়েটার নাম আর ঠিকানা জানতে পারি।"
চাঁদ নিজের কথাগুলো শেষ করে এবার মিহুর দিকে মুখ তুলে তাকায়। কাতর স্বরে বলে,"এবার তো বল ও কোথায়?"
"নিচে সিঁড়ির পাশের ঘরটাতে আছে।"
মিহুর কথাটা বলতে দেরি চাঁদের আলোর কাছে যেতে দেরি হয়নি। সে উঠেই পা বাড়ায় আলোর রুমের দিকে।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে আজ। আলো জানালার গ্রিল ধরে তাকিয়ে সেই চাঁদের দিকে। মাঝে মাঝে নিরবে এক দুই ফোটা করে অশ্রু গড়িয়ে পরছে তার নরম কপোল বেয়ে। আচমকা কেউ একজন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আলোকে । আলো কে সেটা দেখার জন্য পেছনে ঘুরতে চাইলে চাঁদ তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,"উহুম...একদম পেছনে ঘুরবে না। এইভাবেই দাড়িয়ে থাকো প্লিজ।"
আলো বুঝতে পারলো তাকে বাহু বন্ধনীতে আবদ্ধ করা ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং চাঁদ,সাথে বেশ অবাকই হলো সে। হঠাৎ চাঁদের এতোটা সান্নিধ্যে চলে আসায় হাত পা কাপছে তার। আলো কাপা কাপা গলায় বলে,"আ..আপনি এখানে?"
"সেই প্রশ্নটা তো আমার তোমাকে করা উচিত। গত তিনবছরে আমি তোমাকে কিভাবে খুজেছি কোনো আইডিয়া আছে তোমার৷ অথচ তুমি আমার বাড়িতেই ছিলে। একটাবারের জন্য আমার সামনে গেলে না কেন?কেন আমার কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখলে?"
আলো নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে। চাঁদ এবার আলোকে ঘুড়িয়ে নিজের দিকে ফেরায়। আগের থেকেও আরও বেশি শক্ত করে জডিয়ে ধরে তাকে। আলোর কপালের সাথে নিজের গাল লাগিয়ে ব্যাথাতুর স্বরে প্রশ্ন করে,"একটা কথা কি জানো আলো?"
চাঁদের বুকে লেপ্টে থাকা আলো আনমনেই জিজ্ঞেস করলো,"হুম?"
চাঁদ আলোর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে বলল,"চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। সূর্যের আলোতেই চাঁদ আলোকিত হয়। তেমনই তুমি ছাড়া আমার জীবনটা অন্ধ তমিস্রা। সেদিন রাতে তোমাকে মৌখিকভাবে কবুল করলেও মানসিকভাবে কবুল করতে না পারাটা ছিল এই শুভ্রনীল চৌধুরী চাঁদের ব্যর্থতা। যার অনুতপ্ততা আমাকে আজও গ্রাস করে। একটাবারের জন্য যদি তুমি আমার কাছে এসে নিজের অধিকার চাইতে,তাহলে বিশ্বাস করো নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসতাম তোমায়।"
চাঁদের বলা প্রতিটা শব্দ আলোর মনে গিয়ে লেগেছে । তীরের মতো গেঁথে গেছে একদম। উহুম...তীরের আঘাতে হৃদয় একটুও রক্তাক্ত হয়নি। এই তীর যে ভালোবাসার তীর। হৃদয়ে গাঁথে ঠিকই,তবে জখম করে না। উল্টো হৃদয়ের অলিন্দ আর নিলয় জুড়ে উষ্ণতা ছড়ায়। কপাটিকার বেড়ায় আটকে দেয় সব অভিযোগ,অভিমান। আলোকরশ্মির মতো ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসার দীপ্তি । আর জন্মজন্মান্তরে জন্য সেই ভালোবাসার উপমা হয়ে থাকে চাঁদের আলো।
0 Comments