হিম শীতল|অনামিকা আহমেদ| পর্ব-২

গল্প: হিম শীতল|অনামিকা আহমেদ| পর্ব-২

স্যার, আপনি এখন আমাকে অপ*মান করছেন। আমি মানছি আমার হাত থেকে কফি পড়ে আপনার শার্টে লেগেছে। কিন্তু এখানে দোষ*টা কি শুধুই আমার? আমি অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাই আপনাকে দেখতে পাইনি। কিন্তু আপনি তো এদিকে সোজা হাঁটছিলেন।

তবে আপনার তো আমাকে দেখার কথা। তাহলে সম্পূর্ণ দোষ*টা আমার ঘাড়ে চাপানো ঠিক হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তবুও আমি আপনার কাছে ক্ষ*মা চেয়েছি ভদ্রতার খাতিরে। কিন্তু আপনি সেই থেকে আমাকে কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন।

শীতলের জোরালো যুক্তির মুখে নতুন প্রফেসরের অভি*যোগগুলো টিকে না। এতগুলো স্টুডেন্টদের সামনে এক হাঁটুর বয়সি মেয়ে কাছে হেরে যাবে সে, না এ কিছুতেই হতে পারে না। হোক সে ভু*ল কিন্তু মানুষকে দমিয়ে রাখার স্বভাব তার শিরা উপশিরায় বহমান। আজ শীতলের সামনে মাথা নত করে মানে সারা জীবনের জন্য তার কাছে ছোট হয়ে হওয়া। ভু*ল তার হলেও সে নিজের ভুল স্বীকার করবে না। 

বেয়াদ*বির একটা সীমা থাকা উচিত। টিচারের সামনে কি করে কথা বলতে হয় জানো না দেখছি। আর জানবেই বা কি করে? গ্রামে তো এসব আদব কায়দা শিখানো হয়না। যত্তসব অশি*ক্ষিত, গেঁয়ো ভূত।

এতক্ষণ শীতল মাথা নিচু করে থাকলেও এবার আর পারে না। মেরুদণ্ড সোজা করে প্রফেসরের চোখে চোখ রেখে তাকায় সে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কতটা নিচু মন মানসি*কতার সেটা বোঝার বাকি নেই তার। ফিটফাট পোশাক পরলেই যে মানুষ সভ্য হয় না সেটা এই চরিত্রকে না দেখলে শীতল জানতে পারত না। 

শীতল বড় একটা শ্বাস ছেড়ে একটা বাকা হাসি দিয়ে বলে,

ঠিক বলেছেন স্যার। গ্রামের মানুষ মূ*র্খ, তাই তারা শহরের মানুষের মতো চাটুকা*রিতা করতে পারে না, মি*থ্যা অভিনয় করতে পারে না। গ্রামে আমাদের শেখানো হয় যেনো আমরা অন্যা*য়কে কখনও প্রশ্র*য় না দেই। তাই হয়তো আপনার কাছে আমার যুক্তিযুক্ত কথাগুলো বেয়া*দপি সদৃশ। আমিও ভেবে পাই না, ঢাকা মেডিকেলের মত প্রতিষ্ঠানে আপনার মত অহং*কারী ও দা*ম্ভিক মানুষ শিক্ষকতা করার সুযোগ পায় কি করে? 

শীতলের বলা প্রতিটা কথা যেনো  নতুন প্রফেসরের গায়ে এসি*ডের মত লাগে। রা*গে যে তার শরীরটা জ্ব*লে যাচ্ছে সেটা তার চোখ মুখ দেখে খানিক আন্দাজ করা যায়। ছেলে মানুষের এমন ভ*য়াল রূপ সাধারণত মেয়েদের ভ*য়ের কারণ হলেও শীতল বিন্দু মাত্র ভ*য় পাচ্ছে না। পূর্বের ন্যায় শক্ত চোখে সে তার স্যারের আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

নতুন স্যার এবার শীতলের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে তার গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডটা হাতে নেয়। তারপর সেটার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভু*ত কিন্তু ভয়ং*কর হাসি দিয়ে আবারও শীতলের দিকে তাকায়।

- নাইস, আমার ডিপার্টমেন্ট। কালকের এনাটমির ক্লাসটা আমার। So be prepared Miss Shitol. আমিও দেখব তুমি কি করে এনাটমির ক্লাসটা শান্তিতে করতে পারো। 

কথাটা শেষ করে স্যার আবারো নিজ গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায়। শীতল কিছুক্ষণ স্যারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর তার আশেপাশের ভিড়ের দিকে চেয়ে সে বলে,

- রঙ্গ দেখা শেষ হলে যে যার কাজে যাও।

শীতলের কন্ঠটা ঠান্ডা কিন্তু জোরালো। তাই হয়তো কেও তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার কিন্তু কথা শোনানোর ফুরসৎ পায় না। নিজেদের মত আজেবা*জে কথা বলাবলি করতে করতে তারা সরে যায় সেখান থেকে। 

ভিড় কমলে একটু দূরে দাঁড়ানো সাদা সালোয়ার পরা একটা মেয়ে শীতলের কাছে আসে। মেয়েটার নাম কুহু। শ্যামলা, ছিমছাম শরীর,মুখের গড়ন মন্দ নয়। তার ঘনও কালো চুল গুলো দুর থেকে সকলের দৃষ্টি কাড়ে। 

কয়েকদিন হলো ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিনেই শীতলের সাথে কুহুর দেখা হয়েছে, কথাও হয় মাঝে মাঝে। কুহু মেয়েটা একটু চুপচাপ, বই পড়েই কাটিয়ে দেয় তার সারা দিন। তবুও বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে শীতলের সাথে হালকা আলাপচারিতা তার ম*ন্দ লাগে না। 

শীতল, এই স্যার টা মনে হয় অনেক রা*গী। তোমার বোধয় ওনার সাথে তর্ক করাটা ঠিক হয়নি। ছেলে মানুষ , রে*গে গেছেন অনেক। এখন যদি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে বিচার দেন তাহলে?

কুহুর ভয়া*র্ত কন্ঠ শুনে শীতলের চুখ ছোট ছোট হয়ে যায়। নাকটা একবার টেনে সে বলে,

ওনার দিতে মন চাইলে দিবেন। আমি এসব ভ*য় পাই না। 

তুমি ভয় পাচ্ছো না? যদি তোমায় রাষ্ট্রিগেট করে দেয়, তখন?

আর মেয়ে তুমি এত ভী*তু কেনো? যা হবার হবে। তুমি তোমার কফি শেষ করে, ঠান্ডা হয়ে গেছে মনে হয়। আমায় তো আবার নতুন আরেক কাপ কফি কিনতে হবে। আগেরটা তো জলে গেলো।

বিশালাকায় অন্ধকার রুমটা আসবাবশূন্য। চারিদিকে তাকালে অন্ধকারের মাঝে শুধু একটা বক্সিং পিলো দেখা যায়। তার পাশে মেঝেতে পড়ে আছে এক জোড়া বক্সিং গ্লাভস। রুমটায় আলোর এতটাই অভাব যে এখানে দাঁড়িয়ে কেও আন্দাজ করতে পারবে না যে এখন কি দিন নাকি রাত, অনেকটা আয়না ঘরের মতো। কেবল একটা অনুজ্জ্বল আলোর বাল্ব জ্বলছে ঠিক বক্সিং পিলোর কাছে।

নিস্তব্ধতার ভিড় থেকে দরজা খোলার আওয়াজ শোনা যায়। এমনিতে এই আওয়াজ তেমন কিছু না, তবে অতিরিক্ত শব্দহীনতায় তা বিকট আকার লাভ করে। দরজা খুলে এক মানুষরুপী অবয়ব সাউন্ডপ্রুফ রুমে ঢুকে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে এগোয় বক্সিং রিং এর দিকে। মেঝেতে থাকা গ্লাভস গুলো পড়ে সজোরে এক ঘু*ষি বসায় পিলোর গায়ে। তারপর একের পর এক পা*ঞ্চ, যেনো তার গায়ের সব রা*গ ঝাড়ছে পিলোর ওপর। প্রায় আধঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন বক্সিং প্রেকটিস শেষে ঘর্মা*ক্ত শরীরে সে মেঝেতে বসে পড়ে। খালি গায়ে বিন্দু বিন্দু জমা ঘামগুলো হালকা আলোয় চকচক করছে।

ডান হাতটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সে চিত হয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। তারপর আধখোলা চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে সে অদ্ভুতভাবে হাসতে থাকে।

শীতল হোসেন ইন্টারেস্টিং। মিস শীতল, আমিও দেখব হার জিতের এই খেলায় কে বিজয়ী হয়। তুমি নাকি আমি?

আরও পড়ুন: হিম শীতল|অনামিকা আহমেদ| পর্ব-৩

Post a Comment

0 Comments