গল্প: হিম শীতল|অনামিকা আহমেদ| প্রথম পর্ব
আমার পক্ষে আপনার ন*ষ্টা মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব নয় চাচা। আব্বা আম্মা আমার মতামত ছাড়াই এই বিয়ের আয়োজন করেছে। যদি আগে জানতাম এই মেয়ে আমার হবু স্ত্রী তাহলে কখনোই দেশে ফিরতাম না।
জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের আসরে কবুল পড়ানোর ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে বরের মুখে এমন কথা শুনে উপস্থিত সকলে চরম বিস্মিত। কেউ কেউ তো কানাঘুষা শুরু করেছে, ছেলে নিজে থেকে বিয়ে করতে আ*পত্তি জানিয়েছে, নিশ্চই মেয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে। এদিকে কনের বাবা আমদাজ হোসেনের অবস্থা সূচ*নীয়। বারবার হাতে পায়ে ধরেও হবু মেয়ের জামাই কে সে শান্ত করতে পারছে না। নিজের মেয়ে সম্পর্কে এত বড় কথা কোন বাবা স*হ্য করে। আর হিমের জায়গায় অন্য কেও হলে হয়তো এখানেই তিনি তাকে পুঁতে ফেলতেন। কিন্তু এই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামাল দিতে তাকে যতই অপমা*ন সহ্য করতে হয় তিনি করবেন, কিন্তু বেঁচে থাকতে মেয়ের এত বড় ক্ষ*তি হতে দিবেন না।আমজাদ লম্বা চওড়া ফর্সা চামড়ার ছেলেটার সামনে দু হাত জোড় করে বলে,
- বাবা , তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার মেয়ে চরি*ত্রহীনা নয়। ছোট বেলা থেকে একা হাতে ওকে মানুষ করেছি। আর প্রতিটা গতিবিধি আমার জানা। আর যাই করুক, আমার মেয়ে কখনও কোনো পরপু*রুষের দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি।
আমজাদ করুন কন্ঠে বলে কথাগুলো। অন্যা*য়, মিথ্যা*র সামনে মাথা নিচু করে তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। কিন্তু আজকে তাকে সেগুলোই করতে হচ্ছে যা এতদিন তিনি মনে প্রাণে ঘৃ*ণা করতেন।
হিম তাচ্ছি*ল্য ভরে একগাল হেসে বলে,
- শুধু চোখ তুলেই তাকায়নি আপনার মেয়ে, পরপুরুষের সাথে এক বিছানায় শুয়েছে, রাত কাটিয়েছে। তাও একজন নয়, ডজন খানেক লোকের সাথে। আপনার মেয়ে এক বে*শ্যার চেয়ে কম নয়। আর এক বে*শ্যাকে কিনা বিয়ে করবে এই হিম চৌধুরী?
আমজাদ হোসেনের চোখে ক্রো*ধের আগু*ন জ্বলছে। সেই সাথে ক*ষ্টের অশ্রু চোখজোড়া কে ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাবা হয়ে মেয়ের এত বড় ক্ষতি তিনি কিভাবে মেনে নিবেন? পৃথিবীর সবাই যে যাই বলুক, তিনি জানেন তার মেয়ে পুত পবিত্র।
আমজাদ সাহেব হিম কে আর কিছুই বলে না, কোনো অনুনয় ও করে না। তিনি জানেন তাকে বলে কোনো লাভ হবে না। স্টেজের এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন তেহরান চৌধুরী, হিমের বাবা। ছেলের এমন জঘ*ন্য কর্মকাণ্ড আপনাআপনি তার মাথা নিচু করে দিয়েছে, শুধু যে তার মাথাই নিচু হয়েছে তাই নয়। মনস্তা*পের জ্বল*ন্ত অগ্নি*কুণ্ডে জ্বল*ছে তার বিবেক। আজ তার ছোটবেলার বন্ধু আমজাদের সামনে তার কোনো মান সম্মান রইলো না। কত আশা নিয়ে সে তার বন্ধুর কাছে নিজের অপ*দার্থ ছেলের সাথে শীতলের বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। আমজাদ তেহরানের কথা ফেলতে পারেনি। তাই কোনো কিছু না ভেবেই ঠিক করেছিল এই বিয়ে। কিন্তু আজ সবটা ন*ষ্ট করতে হিমের এক মিনিট ও লাগলো না।
আমজাদ তেহরানের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ায়। মাথা না তুলেই শক্তপোক্ত কন্ঠে বলে,
- তেহরান, আমি তোর কাছে আমার মেয়ের সম্মান ভি*ক্ষা চাচ্ছি। তোর ছেলেকে বল এই বিয়েটা করে সে যেনো আমার মেয়ের জীবনটা রক্ষা করে। নাহলে সারাজীবনের জন্য আমার মেয়ের গায়ে কল*ঙ্কের দাগ লেগে যাবে। যেটা বাবা হয়ে আমি হাজার চেষ্টার পরও সরাতে পারব না।
তেহরান চৌধুরী কিছু বলেন না, পূর্বের মত নিশ্চল অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। নিজের জীবনের প্রতি চরম হতা*শা কাজ করছে তার, একটামাত্র ছেলেকেও তিনি ঠিকমতো মানুষ করতে পারলেন না। শীতল গুণী মেয়ে। ভেবেছিলেন এমন একটা নম্র ভদ্র মেয়ের সংস্পর্শে থাকলে তার উচ্ছ*ন্নে
যাওয়া ছেলেটা ঠিক হবে। কিন্তু তা আর হলো কই?
চলে যাওয়ার আগে তেহরান মাথা নিচু করে আমজাদের উদ্দেশে বলে,
- আমি শীতল আর তোর কাছে আন্তরিক ভাবে ক্ষ*মা চাইছি। আমার পুরো জীবনই বৃ*থা।
তেহরান আমজাদের চোখের দিকে তাকায় না। কারণ আজ সে অপ*রাধী, ভুক্তভো*গীর চোখে চোখ রেখে তাকানোর সাহস তার নেই। নিজের বাবাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির দিকে যেতে দেখে হিম ভীষণ ই খুশি হয়। তাকে আর এই বিয়ে করতে হবে না, বিয়ে নামক এক আজ*ব বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে না। তার জীবনের স্বাধীনতা কেও কেড়ে নিতে পারবে না।
নিজের জীবনের ধরন না বদলানোর আশায় সে যে জেনেশুনে এক মেয়ের কত বড় ক্ষতি করেছে সেই ধারণা নেই হিমের। খুশিতে গদগদ করতে করতে সে পা বাড়ায় নিজের গাড়ির দিকে। একবারের জন্য আমজাদ হোসেনের দিকে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করে না, কিংবা তার মনে পড়ে না সেই রমণীর কথা যে কিনা তার জন্য সেজে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
গাড়ির দরজা খুলে হিম ভিতরে ঢুকে যায়। তারপর গাড়ি স্টার্ট করেই কাউকে ফোন করে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে হিম উচ্চস্বরে বলে উঠে,
- ভাই মিশন সাকসেসফুল। টিকিট বুক করে রাখ। আজকেই পারি জমাবো লন্ডনে।
এদিকে আমন্ত্রিত সকল অতিথি আমজাদ হোসেনকে অপমা*নজনক কথা বলছে। শুধু তাকে নয় শীতল কে জড়িয়ে ও খারাপ ম*ন্তব্য করতে তাকে মুখে আটকাচ্ছে না। এত এত ক*টু বাক্যের ভিড়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে আমজাদ এর তিলে তিলে গড়ে প্রতিপত্তি।
সকলে যখন নিজেকের মন্তব্য প্রকাশ করে যে যার মতো চলে যায়, তখন বধূবেশে শীতল তার নিস্তব্ধ বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি আর ভারী গয়না, হয়তো বংশের গৌরব ধরে রাখতেই তার এই আভিজাত্যের সাজ। শীতলের আলতা রাঙা হাত পা যেনো শুভ্র চামড়ার জ্যোতি ভেদ করে ফুটে উঠছে। টানা টানা চোখ, গোলাপী ঠোঁট, খাড়া নাক বলতে গেলে অপরূপ সুন্দরী শীতল। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে খুঁত না থাকায় হয়তো আল্লাহ তার ভাগ্যকে সংকীর্ণ করে দিয়েছে।
এত এত ঘটনা রট*নার মাঝে যেনো সকলে তাকে ভুলেই গিয়েছে, ভুলে গিয়েছে তার অস্তিত্ব। বাবার অপ*মানিত হওয়ার কথা তারও কানে এসেছে।
শীতল তার বাবার কাঁধে হাত রেখে একটু দোলা দেয়। কাপা কাপা কন্ঠে বলে,
- বাবা।
মেয়ের কন্ঠ কানে এলে আমজাদ হোসেনের হুশ ফিরে আসে। অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
- ক্ষ*মা কর মা আমায়, আমি বাবার দায়িত্ব পূরণ করতে পারি নি।
- কে বলেছে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো নী? মা মা*রা যাওয়ার পর তুমিই আমাকে মানুষ করেছ, একা হাতে বড় করেছ। ঘরে সৎ মা আনো নি এই ভেবে যেনো আমার ক*ষ্ট না হয়। কোনো দিন মুখ ফুটে কিছু চাইতে হয়নি তোমার কাছে, তুমি আমার মন পড়ে সেগুলো আগেই আমার সামনে হাজির করেছ। আর কি দায়িত্ব পালন করা বাকি আছে তোমার?
- মা রে ওরা তো চলে গেলো। আমি আটকাতে পারলাম না।
- অমন অ*মানুষ ছেলেকে তোমার মেয়ে বিয়ে করলে কি আদেও সুখী হতো বাবা? যে কিনা এক অচেনা মানুষকে কাট*গোড়ায় দাড়া করায় সে কেমন নিষ্ঠাবান? বাবা, তুমি কি বিশ্বাস করো আমায় ? বিশ্বাস করো যে তোমার মেয়ে কোনো খারা*প কাজ করতে পারে না?
- সারা দুনিয়া বললেও আমি বিশ্বাস করব না যে আমার মেয়ে খা*রাপ।
- তাহলে কেঁদো না, যা হয়েছে ভালো হয়েছে। কিন্তু আজকের অপমা*নের দাম হিম চৌধুরী কে চোকাতে হবে। আমি এই অপমা*নের পাই পাই হিসাব তুলবো উনার কাছ থেকে।
তিন বছর পর......
কলেজের নতুন প্রফেসরের ওপর গরম কফি পড়ায় ভিজে গেছে শার্টের বেশ খানিকটা, সেই সাথে সাদা রঙের শার্ট বাদামি বর্ণ ধারণ করেছে। ঘটনাটা আকস্মিক তবুও শীতলের হাতে ঘটায় মাথা নিচু করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা অগ্নি*মূর্তি ধারণ করেছে। সে আর কেও না কলেজের নতুন প্রফেসর। শীতল লোকটার নামও ঠিক মত জানে না, তাই ইচ্ছে করে তার ওপর কফি ফেলার দোষা*রোপ করাটা অযৌ*ক্তিক।
তবুও লোকটার রাগে*র শেষ নেই। ফর্সা চোখ মুখ মুহুর্তের মাঝেই লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঘাড়ের রোগ গুলোও ভেসে উঠেছে। এমন এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছড়াতে বেশি সময় লাগে নি। ছাত্র ছাত্রীদের ভিড় জমে গেছে তাদের ঘিরে।
অসম নিস্তব্ধতা কাটিয়ে শীতল নিজেই বলে উঠে,
- স্যার, I am really very sorry. আমি আসলেই আপনাকে দেখতে পাইনি। তাই হাত ফসকে -
- Just sh*ut up. তোমাদের মত গাই*য়া মেয়েরা কিভাবে এই কলেজে ভর্তি হয় আমি সত্যিই জানি না। আমিও দেখব এই কলেজে তুমি কতদিন টিকতে পারো মিস।
আরও পড়ুন: হিম শীতল|অনামিকা আহমেদ| পর্ব-২
0 Comments