আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-৪

আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-৪

ভয় আর আতঙ্কে সারারাত দুচোখের পাতা এক করিনি। না জানি কখন ইরফাত ভাইয়া আবারও চলে আসেন। আবারও এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করেন!!অসভ্য,অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেন!!পুরোটা রাত আমি এই দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটিয়েছি। ভোরের আলো ফুটেছে আরও ঘন্টাখানেক আগে। এখনও আমি রুমের দরজা আটকে বসে আছি । মনে মনে ঠিক করেছি চাচা-চাচী না ফেরা পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবো না। তাই তাদের ফিরে আসার অপেক্ষা করছি ৷ এইভাবে অপেক্ষা করতে করতে অনেকটা বেলা হয়ে গেলো ।

আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। চাচা-চাচী আর ইলাফি বাড়ি ফিরে এসেছে। আমি রুম থেকেই তাদের কথা বলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি । শরীরে জোর নেই,আপাদমস্তক কাপছি। তারপরও মনের সমস্ত শক্তি এক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম । ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে সন্দিহান মনে বাইরে উঁকি দিয়ে আরেকবার নিশ্চিত হলাম। না,সত্যিই চাচা-চাচীরা ফিরেছেন। আমি এগিয়ে গেলাম বসার ঘরের দিকে। চাচী আমাকে দেখেই বলে উঠলেন,"নবাবজাদী,এতোক্ষণে দোর খোলার সময় হয়েছে তোর?একদিন ছিলাম না দেখে খুব ছুট পেয়ে গেছিস না?ছুট পেয়েই জন্মের ঘুম ঘুমিয়ে নিয়েছিস?"

চাচীর এহেন ভৎসনা শুনেও আমি নিরব রইলাম । চাচীর মুখে মুখে তর্ক করার অভ্যাস আমার নেই । টালমাটাল পা ফেলে চলে গেলাম রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরে সব কিছু পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখলাম। সকালের নাস্তা তৈরি করলাম । বাসনকোসনের শেল্ফ থেকে চায়ের সসপেনটা বের করে চা তৈরির জন্য তাতে পানি গরম হওয়ার জন্য চুলায় বসিয়ে দিলাম। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে নিরসভঙ্গিতে চেয়ে রইলাম বাইরের দিকে। যানবাহনের হর্ণ আর মানুষের কোলাহলে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে শহরটা। আমি শুধু দেখে যাচ্ছে ব্যস্ত শহরকে। মনের অলিন্দ-নিলয় জুড়ে কিছু অনাঙ্ক্ষিত অস্থিরতা। হৃদযন্ত্রের কপাটিকা ভেদ করে শুধু একটাই প্রশ্ন বেরিয়ে আসছে,"আর কত দিন?এইসবের কি কোনো সমাপ্তি নেই?"

মনে মনে মৃত বাবা-মা আর দাদীকে দোষ দিতে থাকলাম । তারা কেন আমাকে এইভাবে একা করে চলে গেল?ওরা কেউ যখন পাশেই না থাকবে তখন আমাকেও সাথে নিয়ে যেতো। জন্মের সাথে সাথে গলা টিপে মে*রে ফেলতো আমায়। বাচিয়ে রাখার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। মনের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে দমিয়ে রাখতে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে দাড়িয়ে রইলাম। নইলে আমার বেহায়া চোখ জোড়া যে এখনই অশ্রু ঝড়িয়ে বন্যা করবে। 

হঠাৎই ঘাড়ের কাছে কারো উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করলাম।  তড়াক করে চোখ খুলে পিছনে তাকাতেই দেখলাম পিছনে ইরফাত ভাইয়া দাড়িয়ে আছে । পুরোনো ভয়েরা আবারও জেঁকে ধরলো আমায় । ইরফাত ভাইয়া একদম আমার শরীরের সাথে লেগে দাড়িয়েছেন । আমি ভয়ে দূরে সরে যেতে চাইলে তিনি আমার দুই বাহু শক্ত করে ধরে নিজের সাথে চেপে ধরলেন । আমার কানের কাছে মুখ এনে হিসহিসিয়ে বললেন,"কালকে রাতে এতোবার ডাকলাম,দরজা খোলোনি কেন আলোসোনা। এমন বেয়াদবি কেউ করে বলো তো?আমি কিন্তু খুব রাগ করেছি তোমার উপর। কালকে কত আশা নিয়ে বাসায় ফিরলাম,তোমাকে একটু আদর করবো। তোমার শ্যাম্পু করা চুলে নাক গুজে মাতাল হওয়া সুবাস টেনে নিবো। আর তুমি?দরজা আটকে আমার সব প্ল্যানের ত্যানাব্যানা করে দিয়েছো।"

উনার কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্ত গরম হয়ে উঠলো আমার আমার । রাগে মাথার শিরাগুলো ছিড়ে আসতে চাইলো। দূর্বল শরীর নিয়ে উনাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগলাম। । নিজেকে উনার থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়ে বললাম,"ইরফাত ভাইয়া,ছেড়ে দেন আমাকে । আমি আপনাকে আগেও সাবধান করেছিলাম আজও করছি। দূরে থাকেন আমার থেকে । ছে..ছেড়ে দেন । আ...আমি কিন্তু চিৎকার করবো । মানুষ জড়ো করে সবাইকে সবটা বলে দিবো । চাচা-চাচীকেও জানিয়ে দিবো আপনার কুকর্মগুলো।"

ইরফাত ভাইয়া আমার কথাগুলো শুনে ঠোঁটে একটা ভয়ানক হাসির রেখা টেনে ধরলেন। আমার ঘাড়ের উপর মুখ রেখে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,"চিৎকার করবি?কর...আমিও দেখি তোর গলার কত জোর। মেরে লা*শ বানিয়ে ফেলে রাখবো,কেউ টের পাওয়া তো দূর খোঁজও নিতে আসবে না।"

কথাগুলো বলে উনি বিচ্ছিরিভাবে হাসতে শুরু করলেন। ঘৃণায় আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল । আমি উনাকে ধাক্কা মেরে ছিটকে দূরে সরে আসলাম । কোনো কিছুর বাচবিচার না করে জ্বলন্ত চুলার উপর থাকা গরম পানির সসপেনটা নিয়ে ফুটন্ত গরম পানি ছুড়ে মারলাম উনার উদর আর উরুর মাঝ বরাবর। মুহুর্তেই তিনি কাতরাতে কাতরাতে মাটিতে লুটিয়ে পরলেন। বিকট চিৎকার ছুড়ে যন্ত্রণায় কুকড়ে উঠলেন। আমি রান্নাঘরের এক কোণে দাড়িয়ে রাগে ফুসতে লাগলাম। 

ইরফাত ভাইয়ার চিৎকার শুনে চাচী আর ইলাফি রান্নাঘরে ছুটে এলো। চাচী এসেই মাটিতে লুটিয়ে থাকা ইরফাত ভাইয়াকে দুই হাতে আগলে ধরলেন। কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,"কি হয়েছে বাবু?কোথায় যন্ত্রণা হচ্ছে তোর?মাকে বল বাবু?"

ইরফাত ভাইয়া যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন । যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললেন,"ভীষণ মাথা ধরেছিল আম্মু। তাই আমি রান্না ঘরে একটু চা চাইতে এসেছিলাম। আমি আসতেই আলো আমার কাছে আসার চেষ্টা করলো,আমার সাথে নোংরামি করতে চাইলো । আমি বাধা দেওয়াতে আমার উপর গরম পানি ছুড়ে মারলো।"

ইরফাত ভাইয়ার কথাগুলো শুনে চাচী রাগে কটমট করে ছুটে এসে পর পর তিনটা থাপ্পড় বসালেন আমার গালে।  আমি হতভম্বের মতো গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছি। চোখের কোণ ছলছল করছে আমার। কি মসৃণ ভাবে ইরফাত ভাইয়া আমাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করে দিলেন। কলংকের দাগ লাগিয়ে দিলেন আমার উপর । আমি নিজেকে সামলে চাচীকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই চাচী হুংকার দিয়ে উঠলেন,"এই বাইশ্যার ঘরের বাইশ্যা,কেনো আমার সংসারটাকে শকুনের মতো খুবলে খেতে উঠে পরে লেগেছিস?আমার এক ছেলেকে আমার থেকে দূরে পাঠিয়ে দিয়ে শান্তি হয়নি তোর?আমার আরেক ছেলেকে মেরে ফেলার পায়তারা করছিস।"

কথাগুলো বলে চাচী আবারও ইরফাত ভাইয়ার কাছে ফিরে গেলেন । রাগে ফুসতে ফুসতে উনাকে আগলে ধরে টেনে তুলতে নিয়ে বললেন,"তোর বাপকে আমি আগেই বলেছিলাম এই অপয়া শকুনের বাচ্চাকে বাড়িতে না রাখতে। সেদিন তোর বাবা আমার কথা শুনলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না। আজই এর একটা বিহিত করবো আমি। তার আগে তোকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া প্রয়োজন। চল বাবু,ডাক্তারের কাচে চল। এখুনি ওষুধ দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷"

কথা গুলো বলে চাচী ইরফাত ভাইয়াকে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমার শ্বাসের পাল্লা ভারি। মনে মনে ঠিক করলাম এই মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে আমি এই বাড়িতে আর এক মুহুর্তও থাকবো না। দরকার পড়লে গাড়ির তলে পরে জান দিবো। তারপরও এই নরকের মধ্যে থেকে চরিত্রে দাগ লাগিয়ে নিজের আত্মসম্মান খোয়াবো না। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভেজা গাল দুটো মুছে নিলাম। ইলাফি এতোক্ষণ রান্নাঘরের দরজায় দাড়িয়ে থেকে সবটা দেখছিল। ও আমার কাছে এগিয়ে আসতে নেওয়ার আগেই আমি ওকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। ভীষণ রকম শ্বাস ফুলছিল আমার । কোনো রকমে গায়ে বোরখাটা জড়িয়ে মুখে হিজাব আর নেকাবটা বেধে নিলাম। রাগে,দুঃখে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে যাবো ঠিক তখনই ইলাফি আমার পথ আটকে দাড়ালো। আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,"আমি জানি আপু,ভাইয়ায় তোমার সাথে উল্টা পাল্টা কিছু করেছে,তাই তুমি এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছো। ভাইয়ার কথায় আম্মু তোমাকে ভুল বুঝেছে । আঘাত করেছে। আমি তোমাকে আটকাবো না আপু। এই বাসাতে থাকলে প্রতিনিয়ত তোমাকে এইভাবে হেয় করবে ওরা। তুমি দূরে চলে যাও,বহুদূরে। নিজের মতো করে গুছিয়ে নাও নিজেকে।"

ইলাফি আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো। আমার হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বলল,"এইগুলো রাখো আপু৷ জানি খুবই সামান্য,তবে এইটুকুতে তোমার কিছুটা হলেও সাহায্য  হবে।"

আমি ইলাফির কাছ থেকে টাকা নিতে বারণ করে দিলাম । ও কান্না করতে করতে আমাকে নিজের কসম দিয়ে বসল। আমি না চাইতেও ওর কাছ থেকে টাকাগুলো নিলাম। তারপর শেষবারের মতো ইলাফিকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পরলাম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুন: আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-৫

Post a Comment

0 Comments