আলোর সংসার| আরোহিতা সুরোভি| পর্ব-৫
ভোরের মৃদু আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙ্গলো আমার। মস্তিষ্ক পুরোপুরি সজাগ হতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম মিহুর রুমে। কাল রাতে পুরোনো ঘটনাগুলো ভাবতে গিয়ে কখন যে চোখ জোড়া লেগে এসেছিল খেয়াল নেই। শোয়া থেকে সোজা হয়ে উঠে বসতেই দেখি মিহুও অন্য দিকে মুখ করে আমার পাশে শুয়ে আছে। হয়তো রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে আমাকে আর জাগায়নি। মুহুর্তেই কিছু একটা মনে পড়তেই ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় ৫টা ৪৬ । এতোক্ষণে মেজো মা উঠে নিশ্চয় মেহমানদের জন্য নাস্তা তৈরির কাজে লেগে পড়েছেন?ইস..কাল রাতে আমার বেখেয়ালে হাত কেটে যাওয়ায় সবটা একা সামলাতে হয়েছে উনাকে। আজও নিশ্চয় হিমশিম খাচ্ছেন উনি?তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে বেরিয়ে গেলান মিহুর রুম থেকে।
নিজের রুমে এসে গোসল সেরে পা বাড়ালাম রান্নাঘরের দিকে। যা ভেবেছিলাম তাই। মেজো মা একা একাই সবার জন্য নাস্তা তৈরি করছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে রুটি বানানোর জন্য ময়দা বের করে নিলাম। মেজো মা আমাকে দেখে বললেন,"হাতের কি অবস্থা তোর?কালকে তো পুরো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি আমাকে।"
আমি মৃদু হেসে বললাম,"শুধু শুধুই চিন্তা করছিলে তুমি। এরকম হুটহাট কেটে যাওয়ার অভ্যাস আমার আছে। মাঝখান থেকে কাল রাতের সবটা রান্না তোমাকে একা হাতে করতে হয়েছে৷"
"একা কেন করতে যাবো?মিহু যথেষ্ট সাহায্য করেছে আমাকে। আর ভয় পাবো না বলছিস?কতটা র*ক্ত বেড়িয়েছে খেয়াল আছে তোর?কখন নিজের দিকে একটু খেয়াল দিতে শিখবি মা?"
"এইভাবেই তো বেশ আছি মেজো মা। তুমি তো আছো আমার খেয়াল রাখার জন্য। আর কি চাই বলো?"
"কথা শোনো মেয়ের। আমি কি সারাজীবন বেঁচে থাকবো রে পাগলি?"
"ওসব কথা এখন বাদ দাও তো মেজো মা। সকাল সকাল এতো ইমোশনাল হয়ে যেও না।"
মেজো মা আমার কথা শুনে ক্ষীণ হাসলেন। বড্ড অমায়িক হাসি উনার। আমি আমার মাকে দেখিনি। কখনো মায়ের ছবি দেখারও সুযোগ হয়নি। তবে এই বাড়িতে আসার পর মেজো মার যত্নে আমি মায়ের ছোঁয়া পেয়েছি । আমার মা বেচে থাকলে উনিও নিশ্চয় মেজো মার মতো কথায় কথায় আমার জন্য উদ্বিগ্ন হতেন। ভেবেই মলিন হাসলাম আমি।
সকালের নাস্তার পর্ব শেষ হলো। এখন বাড়ি ভর্তি মেহমানরা সবাই যে যার মতো গল্পে মশগুল । ঘর জুড়ে বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি আর খিলখিল হাসি । বাইরে লাইটিং আর ডেকোরেশনের কাজ করতে থাকা লোকগুলো একটু পর পর চিৎকার করে করে কথা বলছেন। বাড়ির পিছনের দিকে শামিয়ানা টাঙিয়ে শুরু হয়েছে রান্নার তোড়জোড়। বিয়ের আমেজে যেনো পরিপূর্ণ হয়েছে চারিদিক । শুধু শুষ্ক মরুভূমির মতো খা খা করছে আমার অবাদ্য হৃদয়খানা। কার জন্য এতো হাহাকার?কবুল বলা সেই মানুষটার জন্য?সে তো স্বামী হয়েও হয়নি। কখনো ভুলক্রমেও ধরা দেয়নি আমাকে । তবে?
আমি আরেকপ্রস্ত চায়ের ট্রে হাতে বসার ঘরের দিকে গেলাম। বাড়ির গুরুজনেরা সবাই নিজেদের আড্ডা জমিয়েছেন সেখানে। আমি গিয়েই সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে লাগলাম। তখনই কিছু কথা ভেসে এলো আমার কানে।
"চাঁদ যে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করতে রাজি হয়েছে এতেই আমি খুশি।",চায়ের কাপে এক চুমুক বসিয়ে কথাটা বললেন বড়মা,অন্যভাবে বললে আমার শ্বাশুড়ি মা।
"রাজি না হওয়ার কি আছে?আমার মেয়ে কি কোনো দিকে থেকে ফেলে দেওয়ার মতো?তাছাড়া দুজন দুজনকে ছোটবেলা থেকে চিনে,দেখেছে। একই মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেছে ৷ কতকালের পরিচিতি দুজনের।",কপট রাগ দেখিয়ে কথাটা বললেন খালামনি। অর্থাৎ বড় মার ছোট বোন শিমা বেগম। আগামীকাল উনার মেয়ে ইতুর সাথেই আমার স্বামী নামক ব্যাক্তিটির বিয়ে। পারিবারিকভাবেই ঠিক হয়েছে সবটা। খালামনি নিজে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বড়মাকে। বড় মাও বোনের মেয়ে,চেনা জানা বলে কোনো আপত্তি রাখেননি। অতঃপর ছেলেকেও রাজি করিয়েছেন বিয়ের জন্য।
বড়মা বোনের রাগ বুঝলেন। খালামনিকে শান্ত করতে নরম কন্ঠে বললেন," আমি কথাটা সেভাবে বলিনি শিমু। নিঃসন্দেহে আমাদের চাঁদের জন্য ইতুর চেয়ে যোগ্য পাত্রী আর দুটো নেই। তবে চাঁদকে এই বিয়ের জন্য রাজি করানোটা আমার কাছে কোনো যুদ্ধের চেয়ে কম ছিলো না। সেসব তুই বুঝবি না।"
খালামনির রাগ শান্ত হলো কিনা বুঝা গেলো না। তবে গলার স্বরে কিছুটা পরিবর্তন এলো। উনি আগের চেয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,"সে তুমি যাই বলো দিদি। চাঁদ বাবাকে আমি প্রথম থেকেই নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে ভেবে রেখেছিলাম। শুধু অপেক্ষা করেছিলাম চাঁদের ডাক্তারি পাশ করার। তোমাদের জামাইরও এবিষয়ে সায় ছিলো। উনি আবার প্রেম পিরিতির বিয়ে পছন্দ করেন না। ঘরের মধ্যে সবটা ঠিক হওয়ায় সহজে রাজি হয়েছেন।"
বড়মা আর কিছু বললেন না। উনার মনে কি চলছে তা বোঝা মুশকিল। তবে দেখে মনে হচ্ছে কোনো ভাবে বিয়েটা হলেই তিনি বাঁচেন। আমি আর দাড়ালাম না সেখানে। খালি ট্রে হাতেই বসার ঘরে থেকে বেড়িয়ে এলাম। মনের ভেতরের অস্থিরতা গুলো কেমন কমার পরিবর্তে ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে যাচ্ছে। যেদিকে যাচ্ছি সেদিকেই শুধু বিয়ের আলোচনা। ভালো লাগছে না কিছু । শরীরটা কেমন নেতিয়ে পড়ছে । জ্বর টর আসবে নাকি আবার?আনমনে হাটতে হাটতে আচমকা ধাক্কা খেলাম কারো সাথে। সঙ্গে সঙ্গে পরে যেতে গিয়ে পড়লাম না। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম । অনুভব করলাম আমি কারো বাহু বন্ধনীতে আটকে গেছি। খানিক সময় পর চোখ চোখ পিটপিট করে খুলেই আতকে উঠলাম। গত তিন বছরে যেটা ঘটেনি সেটাই ঘটেছে আজ । আমি উনার মুখোমুখি। উনি ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি তড়িৎ সোজা হয়ে দাড়িয়ে মাথায় থাকা ওড়নাটা আরেকটু টেনে নিয়ে মুখ ঢাকলাম। আমার এহেন আচরণে উনি কিছুটা অবাক হলেন বোধহয়। তবে কন্ঠে তা প্রকাশ পেল না। গম্ভীর স্বরে তিনি বললেন,"সরি,আমি খেয়াল করিনি। ঠিক আছেন আপনি?"
আমি মুখে কিছু বললাম না। মাথা দুলিয়ে শুধু জানালাম। অর্থাৎ আমি ঠিক আছি। তারপর দ্রুত সেখান থেকে চলে এলাম। উনি এরপর কোথায় গেলেন জানি না। আমি রান্নাঘরে এসে হাতের ট্রে টা রেখে ধপ করে একটা টুলে বসে পরলাম। দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে বসে রইলাম থম মেরে।
গত তিনবছরে অনেক সাবধানে চলাফেরা করেছি। কখনো উনার সামনে পড়িনি। সকালে উনি হসপিটালের জন্য বেরোনোর আগেই নিজের কাজ শেষ করে রুমে চলে গিয়েছি। রাতেও উনি বাসায় ফিরলে হয় রান্না ঘরে থেকেছি আর নয়তো নিজের রুমে। তিনটা বছর ধরে দূর থেকেই দেখে গেছি মানুষটাকে । তবে আজ?শেষ সময়ে এসে কেনো সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে?এতোগুলো দিন পর হঠাৎ আজই কেন আমি উনার সামনে পরলাম?উনাকে এতোটা কাছাকাছি দেখে আমি যে আরও দূর্বল হয়ে পড়ছি। নিজের কাছে নিজে মিথ্যা বলার মতো বিরাট সাহস আমার নেই। সেদিন রাতে আমাদের অনাঙ্ক্ষিত বিয়ের পর যখন উনি আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন তখন খুব রাগ হয়েছিলি উনার উপর । তবে এই তিনবছরে উনাকে যতোবার দেখেছি ততবার মুগ্ধ হয়েছি আমি। প্রেমে পড়েছি আরও হাজারবার। উনি চোখের সামনে আসলেই কেমন রাগগুলো সব উবে যায়। ভুলে যায় সেদিনের সব ঘটনা।
(অতীত)
সেদিন রাগে চাচার বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি। ইরফাত ভাইয়ার সাথে যা করেছিলাম তা নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছিলনা আমার মনে। কারণ শাস্তিটা ইরফাত ভাইয়ার প্রাপ্য ছিল। গোধূলীর জনবহুল রাস্তায় হেটে চাচার বাসা থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছিলাম। সম্ভল হিসেবে সাথে ছিল শুধু ইলাফির দেওয়া সেই টাকা গুলো। আসার সময় ফোনটাও ফেলে এসেছিলাম । সাথে করে নিয়ে এলেও লাভ হতো না যদিও। কাকেই বা কল করতাম আমি?কার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতাম?দীর্ঘক্ষণ হাটার পর আমি এসে পৌছোলাম একটা বাসস্ট্যান্ডের সামনে।
কোনো কিছু না ভেবেই সবটা ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিয়ে একটা টিকিট কেটে উঠে পড়লাম বাসে। বাসটা কোথায় যাবে,কোথায় এর শেষ গন্তব্য কিছুই জানি না। শুধু জানি বহুদূরে কোথাও চলে যেতে হবে।
খানিকসময় পর পাশের সিটে এক যবুক এসে বসলেন। আমি সন্দিহান মনে একবার তাকালাম উনার দিকে । লোকটির পড়নে সাদা এপ্রোন,মুখে মাস্ক । হাতে একটা মাঝারি আকারের কাধ ব্যাগ। আমি লোকটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। মাথার মধ্যে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে রইলাম। এরমধ্যে বাসটাও চলতে শুরু করেছে । পাশে বসা লোকটির দিকে কোনো খেয়াল নেই আমার। উনিও ব্যস্ত হয়ে আছেন ফোনে। বাসটি চলছিল তার নিজের গতিতে,নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। হাজারো অনিশ্চয়তার মাঝেও একটা বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম আমি। আর সেটা হলো বাসের শেষ স্টপেজই আমার গন্তব্য।
ক্লান্তিতে চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়েছিলাম। গোধূলির প্রহর শেষে আকাশে নেমে এসেছিল রাতের অন্ধকার। হঠাৎ চলন্ত বাসটি থেমে গেলো। আমি গাড়ির থেমে যাওয়া অনুভব করে আধো আধো চোখ খুলে বাইরে তাকালাম। দেখলাম অনেকগুলো পুলিশের পোশাকধারী লোক বাসটিকে ঘিরে ধরেছে। আচমকা পুলিশগুলোর মধ্যে কয়েকজন বাসে উঠে তল্লাশি চালাতে শুরু করল । আমাদের সবাইকে বাস থেকে নামিয়ে জড়োসড়ো করে দাড় করালো এক জায়গায়। ঘটনা কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি।
একটু পর দেখলাম আমার পাশে বসা লোকটি কানে ফোন চেপে ধরে কাউকে রেগে গিয়ে বলছেন,"তুই আমাকে এটা কোন বাসে উঠিয়ে দিয়ে গেলি?মাঝ রাস্তায় পুলিশে ঘেরাও করেছে বাসটাকে । এই বাসে করে নাকি ম*দ আর নারী পাচার করা হচ্ছিল । আমাদের সবাইকেই এখন থানায় নিয়ে যাবে। তোর কথা ধরে দেখছি অনেক বড় ফ্যাসাদে আটকে গেছি আমি।"
ফোনের ওপাশ থেকে কে কি বলল বোঝা গেল না। তবে লোকটার কথা শুনে আমার মাথা চক্কর দিতে শুরু করল। এক বিপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে শেষে কীনা আরেক বিপদের ফাদে পা দিলাম আমি?তখন অধিক দুশ্চিন্তার চোটে কোনো কিছু না বুজে শুনেই বাসে উঠে পরেছিলাম । লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছে উনিও আমার মতো একই ভুল করেছেন। ভুল করারই কথা। বাইরে থেকে দেখে কোনোভাবেই আন্দাজ করার উপায় নেই বাসটিতে ম*দ আর নারী পা*চার করা হচ্ছিল। অতঃপর পুলিশ লোকগুলো তাদের গাড়িতে উঠার জন্য আমাদের তাড়া দিতে লাগলেন। সবাইকে এখন থানায় নেওয়া হবে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। জীবনে প্রথম এরকম কোনো ঘটনার সম্মুখীন হওয়ায় ভিশন রকম ঘাবড়ে গেলাম আমি । পুলিশগুলো আবারও তাড়া দিতে শুরু করলো । এরমাঝে আমার পাশে বসা লোকটা হালকা পিছিয়ে এসে আমার কানের কাছে 'পালান' বলে হঠাৎই দৌড় দিলেন । উনাকে দৌড়াতে দেখে আমিও কিছু না ভেবে উনার পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলাম । পিছনে কয়েকজন পুলিশ সাথে সাথে দৌড়ে তাড়া করতে লাগলো আমাদের। আমরা দুজনই পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকটা দূরে চলে আসলাম । একটা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দুজনেই পিছন দিকে তাকিয়ে হাপাতে শুরু করলাম। না,পুলিশগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। এরই মাঝে কোত্থেকে দুজন লোক চলে আসল সেখানে৷ আমাদের এইভাবে একসাথে হাপাতে দেখে কি ভাবলো জানি না,তবে তারা মুহুর্তেই চিৎকার চেচামেচি করে লোক জড়ো করে ফেলল । তাদের মধ্যে একজন সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো,"দেখো দেখো সবাই। রাত বেরাতে পোলা মাইয়া দুইটা কেমন নষ্টামি করে বেড়াইতেছে। আমরা একদম হাতে নাতে পাকড়াও করছি এদের। এদের কারণেই সমাজটা একদম উচ্ছনে যাইতেছে।"
লোকটার কথা শুনে এগিয়ে আসা লোকগুলোর মধ্যে কানাঘুষা শুরু হলো। আমাদের বিপদের উপর বিপদ বাড়লো। আমি আর থাকতে না পেরে এবার কান্না শুরু করে দিলাম। আমাদেরকে টু শব্দও বলার সুযোগ দিলো না তারা। অনেকক্ষণ যাবত কানাঘুষা করার পর আমাদের টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো ওখানকারই এক স্থানীয় কাজীর বাড়িতে। বিয়ে করতে বাদ্য করা হলো আমাদের। আমার সাথে থাকা লোকটি ওদের রাগের তোপে পড়ে কবুল বলতে বাদ্য হলেন। অতঃপর আমাদের অনাঙ্ক্ষিত বিয়েটা সম্পন্ন হলো।
কাবিন নামা লেখার সময় লোকটার নাম শুনেছিলাম। পুরোপুরি না শুনলেও শেষের শব্দটা শুনেছিলাম শুধু। চাঁদ।সেদিন রাতে বিয়ের পর আমরা দুজনই কাজীর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শহরে যাওয়ার রাস্তায় চলে আসলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"দেখুন,যা হয়েছে তাতে আমাদের দুজনের কারো কোনো হাত ছিল না। আমি জানি আপনিও হয়তো আমার মতো ভুল করে ওই বাসে উঠে পড়েছিলেন। টিকিট কাউন্টারে অপেক্ষা করা কালীন আপনি আমাকে না দেখলেও আমি আপনাকে খেয়াল করেছিলাম। বাসে পুলিশ উঠার পর বুঝতে পারলাম আমি আর আপনি ছাড়া বাকিরা আগে থেকেই ওই বাসে ছিলো। এমনভাবে ওরা যাত্রীর বেশ ধরেছিল যে বোঝার উপায় নেই তারা কোনো বেআইনি কাজ করছে। মাঝখান থেকে আমি আর আপনিই না বুঝে ফেসে গেছি এইসবে। আপনাকে দেখে ভদ্র ঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। তখন পুলিশের সাথে থানায় গেলে শুধু শুধু একটা মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে দিতো ওরা। আমি আর আপনি একসাথে বসায় ওরা ভাবতো আমিও আপনাকে কোথাও পাচার করবো বলে নিয়ে যাচ্ছি। হাজার সত্যি বলেও ওদের আমি বিশ্বাস করাতে পারতাম না বাসের নারী পা*চারকারীদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই । নির্দোশ হয়েও নারী পাচারকারীর ট্যাগ লাগিয়ে দিতো ওরা। তার উপর আপনিও ওদের সাথে থানায় গেলে শুধু শুধু হেনস্তার শিকার হতেন। তাই নিজেকে আর আপনাকে বাচাতে ওখান থেকে পালাতে বাদ্য হলাম আমি । কিন্তু এইরকম একটা ঘটনা ঘটবে...আচ্ছা,সেইসব বাদ দিন। সবটা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবেন।"
কথাগুলো বলেই লোকটা চলে গেলেন নিজের মতো। আমাকে কিছু বলার সুযোগটা পর্যন্ত দিলেন না। নির্জন এক রাস্তায় আমাকে একা ফেলে চলে গেলেন তিনি।
(বর্তমান)
মেজো মার ডাকে হুশ ফিরলো আমার। মেজো মা তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে এসেই আমাকে বললেন,"এইভাবে মাথায় হাত দিয়ে রান্নাঘরে বসে আছিস কেন আলো?খাবি না?সবার তো খাওয়া শেষ,তুই গিয়ে খেয়ে নে । বসে থাকিস না আর। সন্ধ্যায় আবার গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হবে।"
আমি মেজো মার কথার প্রতিউত্তরে "যাচ্ছি" বলে উঠে দাড়ালাম। অতীতের ঘটনাগুলোকে হদস্পন্দনে দমিয়ে রাখলাম আবারও।
0 Comments