ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-২১
আরহান গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ তার একেবারে আগুন হয়ে আছে—প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে সে অপেক্ষা করছে ইশার জন্য। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তি যেন গলার কাছ পর্যন্ত উঠে এসেছে।
কিছুক্ষণ পর ইশা বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। তাকে দেখেই আরহানের সব অভিমান যেন এক মুহূর্তে হাওয়ায় মিশে গেলো।
ইশা আঁচল সামলে শাড়ি পরে এসেছে, চুলে খোপা, কপালে ছোট্ট একটা টিপ—ঠিক যেমনটা আরহানের পছন্দ।
ইশা মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। ইশা জানে, আরহান কিসে দুর্বল। আর এই মুহূর্তে সে একেবারে কাবু।
আরহানের অপলক দৃষ্টি ইশার ভিতরে এক অদ্ভুত ঝড় তুলে দিলো। কিন্তু সেই ঝড়ে ভেসে যাওয়ার আগেই, হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে আরহান বলে উঠল,— "এত দেরি করলে কেনো?"
তারপর আর কোনো কথা না বলে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। ইশা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অভিমান আর রাগ মিশে যাচ্ছে তার মুখভঙ্গিতে। অবশেষে সে ফুলতে ফুলতে গাড়িতে উঠে বসল—চুপচাপ।
ইশা ইচ্ছে করে সিটবেল্ট না পরে চুপচাপ বসে রইলো।আরহান গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে চোখ পড়তেই থেমে গেলো। সে ভ্রু কুঁচকে ইশাকে জিজ্ঞেস করল,— "সিটবেল্ট পড়ছো না কেনো?"
ইশা গাল ফুলিয়ে বললো,"ইচ্ছে করছে না, তাই।"
আরহান তপ্ত একটা নিশ্বাস ফেললো। তারপর নিজের সিটবেল্ট খুলে ধীরে ধীরে ইশার দিকে ঝুঁকে গেলো। ঠিক তখনই ইশা রাগে বলে উঠলো,
— "আমি পড়বো না।"
কিন্তু আরহানের চোখে কঠিন এক দৃষ্টি পড়তেই সে চুপ করে গেলো।আরহান কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে ইশার সিটবেল্ট হাতে নিলো। সাবধানে, ধীরে ধীরে সেটা পরিয়ে দিতে লাগলো।
ইশার নিশ্বাস থেমে গেলো যেন।
আরহানের মুখ তার একদম কাছে।
তাদের মাঝে দুরত্ব আসলেই, ইশার মনে হয়—আরহান একটা অভ্যাস, একটা নেশা... যা তার অজান্তেই বুকের গভীরে জমে আছে।
যে কারণে আরহান রাগ করেছে, সে আবদার পূরণ না করার কিছু না। কিন্তু লোকটাকে একটু জ্বালাতে ইশার ভালো লাগছে আজ।
আরহান চুপচাপ সরে গিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। তার চোখ দুটো রাস্তায় স্থির, চোয়ালে টান — স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সে এখন বিরক্ত।
ইশাদের বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই আরহানের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বাড়ির ভেতরে ভীষণ ভিড়। সবকিছু যেন একটা উৎসবের আমেজ নিয়ে আছে।
গাড়ি থামিয়ে আরহান ধৈর্য ধরে জিজ্ঞেস করলো,
“ভিতরে এত মানুষ কেন? কী হচ্ছে?”
ইশা হেসে উঠে বললো,“ জামাই দেখতে এসেছে সবাই!”
“What nonsense!” — আরহান অবাক হয়ে তাকালো ইশার দিকে।
ইশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে মিষ্টি গলায় বললো,
“এইসব ডায়লগ দিয়ে লাভ নেই। আমাকে তো আপনার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুরো জমায়েত করে দেখা হয়েছিলো। এবার আপনার পালা।”
আরহান মাথা নাড়তে নাড়তে বললো,
“আচ্ছা… আমাদের বাসর রাতের দিন সকালে যে অনুষ্ঠান হয়েছিলো না? আজ তাহলে ‘দ্বিতীয় বাসর’ হবে?”
ইশা মুখ হা করে চেয়ে রইলো।
দ্বিতীয় বাসর! উনি কী বলছেন এসব!
ইশা মুখ বাঁকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো,
“ওসব বাসর-টাসর কিছু হবে না, বুঝলেন?”
আরহান ঠোঁট উল্টে বললো,“তাহলে এইসব অনুষ্ঠানে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”
ইশা কিছু বলার আগেই তার বড় ভাই এসে হাজির। তাকে দেখে আরহান গাড়িতে থেকে নামলো। দুজনে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভিতরে গেলো।
কায়ান নিজের অফিসে একা বসে ছিল। জানালার ধারে পড়ন্ত রোদের আলো পড়েছে তার মুখে। সামনে টেবিলে খোলা কিছু ফাইল, কিন্তু চোখ সেগুলোর দিকে নেই। ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
রুবান ভেতরে ঢুকে বললো,
“স্যার, একটা খবর আছে। ম্যাসেজ পাঠিয়েছে আরহান। সে সামনাসামনি দেখা করতে চায়… তবে শর্ত দিয়েছে— আগে রাহিকে ছেড়ে দিতে হবে।”
কায়ানের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের একটুখানি হাসি ফুটে উঠলো।
সে ধীর গলায় বললো,
“আরহানকে জানিয়ে দাও...
সে যদি আসে তবেই রাহিকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তার আগে নয়।”
রুবান মাথা নুইয়ে সম্মতি জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে।
কায়ান তখন পেছনে হেলে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। তার চোখে ধরা পড়ে— একরাশ ভাবনা আর একটুকরো অনিবার্যতা।
নিচু স্বরে, যেন নিজেকেই বললো,
“সুইটহার্ট... তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে।”
আরহান পড়েছে এক মহা বিপদে।
গ্রামের বাড়ি থেকে ইশার নানি, বড় নানি, খালা-ফুপু সবাই এসে হাজির হয়েছে আজ। একটাই উদ্দেশ্য— জামাইকে চোখে দেখা, যাচাই-বাছাই করা।
ড্রয়িংরুম এখন যেন মহিলা সমিতির আড্ডা কেন্দ্র। একেকজন পায়ের ওপর পা তুলে, পান চিবিয়ে গল্পে মগ্ন। মাঝখানে পড়ে আছে আরহান— বোঝাই যাচ্ছে, তার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ইশার বড় নানি, চোখে মোটা চশমা— ঠিকমতো দেখতেও পান না, কিন্তু কথা বলেন ঢাক বাজিয়ে। গলার আওয়াজে পাশের বাড়িও কেঁপে ওঠে।
তিনি হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তো বাবা, তোমার পড়াশোনা কতদূর?”
আরহান থমকে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার। পাশেই ইশা আর তার মা। এমন প্রশ্নে খানিক বিব্রত হয়ে ইশার মা উত্তর দিল,
“অনেক দূর, মানে...বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়েছে। আপনি বুঝবেন না।”
তার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে আরেকজন পান মুখে মাথা নেড়ে বললো,
“হেহ, না চেনার কী আছে! আমাদের গ্রামেও তো ডিগ্রি কলেজ আছে। বড় বড় লেখা লেখা দেখে তাবেদারি করার কিছু নাই!”
ইশা ঠোঁট কামড়ে কোনোভাবে হাসি চেপে বসে রইলো। কিন্তু আরহানের চোয়ালে টান পড়ে গেছে— সে এখন বিস্ফোরণের আগের মুহূর্তে।
ইশার মা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এত মানুষ, কারো মুখ বন্ধ করাও যাচ্ছে না।
শেষমেশ ইশা একটু কাশে নিয়ে নরম গলায় বললো,“নানি, তোমার ওই ডিগ্রি কলেজ আর লন্ডনের ডিগ্রি এক না, বুঝলে?”
সবাই এক মুহূর্তের জন্য চুপ। আর ঠিক তখনই ইশার মাথায় যেন বাজ পড়লো।
লন্ডনের ডিগ্রি...
এই তো, বিয়ের আগে রাহি বলেছিলো— আরহানের লন্ডনে একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো।
মানে?!
লন্ডনের ডিগ্রি মানেই তো সে সময় তারা একসাথে ছিলো!
ইশা থমকে গেলো। মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে এলো। ঠোঁট শক্ত করে বসে রইলো চুপচাপ।
আর পাশের সোফায় বসে থাকা আরহান তখনো ধৈর্য ধরে মহিলা সমিতির প্রশ্নবাণ সহ্য করে যাচ্ছে— জানেই না, সামনে আরেকটা ঘূর্ণিঝড় আসতে চলেছে।
হঠাৎ এক বয়স্ক খালা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
“জামাই কি কথা বলতে পারে না নাকি? এমন চুপচাপ হইলে তো সমস্যা রে মা!”
আরহান একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। চারপাশে নারী সমাবেশ, অদ্ভুত সব প্রশ্ন, তার ধৈর্যর পরীক্ষা চলছেই।
ধীরে বলে উঠলো,“না না, কোনো সমস্যা নেই। আপনারা বলুন, আমি শুনছি।”
বয়স্ক মহিলারা একে একে মাথা নাড়লেন। তারপর এক খালা সোজা বলে ফেললেন,
“আর কি বলবো বাবা। আমাগো মেয়েটার খেয়াল রাখবা। তাহলেই হইবো।”
এই বলে তিনি সস্নেহে ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
ইশা কেবল একটুখানি হাসার চেষ্টা করলো, কিন্তু মুখটা তখনো মেঘে ঢাকা।
রাতে খাবার শেষ হতে না হতেই আরেক দফা আলোচনা জমে উঠলো। এবার বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ঘিরে ধরলো আরহানকে— চাকরি, ব্যবসা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, গৃহস্থালি নিয়ম— একেকজন একেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে।
ইশা এক মুহূর্তও সেখানে থাকলো না। চুপচাপ সরে গিয়ে নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। আলো না জ্বালিয়ে বারান্দায় চলে গিয়ে দোলনায় বসে পড়লো। নিজেকে গুটিয়ে নিলো— দুই হাঁটু বুকে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। তার মনটা ভারী।
নিচের আলো, দূরের কোলাহল— কিছুই আর স্পর্শ করছে না তাকে।
কিছুক্ষণ পর আরহান রুমে এল। ঘরে ঢুকেই অন্ধকার দেখে একটু থমকে গেলো।
— ইশা কোথায়?
চোখ সয়ে যেতে না যেতেই কান ঝাঁপটালো দোলনার হালকা আওয়াজে।
চুপচাপ এগিয়ে এসে বারান্দায় উঁকি দিলো। চাঁদের আলোয় ধরা পড়লো ইশার গুটিয়ে বসে থাকা অবয়ব।
কোনো কথা না বলে আরহান ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ইশার পাশে বসল। তারপর খুব সহজ এক ভঙ্গিতে ইশার পা দুটো আলতো করে নিজের কোলের উপর তুলে নিলো। ইশা কোনো কথা বললো না।
বারান্দার নরম আলোয় বসে থাকা ইশার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই আরহানের চোখ পড়লো তার হাতে। চুড়িগুলো। যা একদিন চুপিচুপি ইশার ব্যাগে রেখে দিয়েছিল সে।
চোখে পড়তেই ঠোঁটে একটুকরো নরম হাসি ফুটে উঠলো আরহানের।
ইশা তখন আনমনে দোলনায় দুলছে। হঠাৎ বললো,“আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”
আরহান তার দিকে নরম চোখে তাকিয়ে ধীরে মাথা নাড়লো।
ইশা এবার সরাসরি তাকালো তার চোখে। গলায় দ্বিধা মিশ্রিত এক কৌতূহল নিয়ে বললো “লন্ডনে… আপনার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো?”
প্রশ্নটা নিঃশব্দে এসে যেন কাঁপিয়ে দিলো মুহূর্তটা।
আরহান থেমে গেল এক মুহূর্ত, তারপর ধীরে মাথা নাড়লো— হ্যাঁ।
ইশার মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে গেল। চোখে-মুখে স্পষ্ট হতাশা। ভেতরটা যেন হু হু করে ভেঙে পড়ছে। অল্পেই চোখ ভিজে উঠলো।
আরহান সঙ্গে সঙ্গে ইশার পা থেকে হাত সরিয়ে এগিয়ে এল। তার দুই গাল আলতো করে ধরলো, চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বললো,
“ওটা সিরিয়াস কিছু ছিলো না, ইশা। আমি দেশে ফেরার কয়েকমাস পরেই… আমরা মিউচুয়ালি আলাদা হয়ে গেছিলাম।”
এই বলে সে ইশার কপালে নিজের কপাল ছুঁইয়ে রাখলো।
ইশা যেনো একটু দম ফিরে পেলো। তবুও ভেতরের কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি… আপনি এখনো ও মেয়েটাকে ভালোবাসেন না তো?”
আরহান গভীরভাবে তার চোখে তাকিয়ে বললো,
“তুমি থাকতে অন্য কাউকে ভালোবাসার প্রশ্নই উঠে না। তুমি আমার সব, ইশা।”
এই কথাগুলো যেন ইশার ভিতরের সমস্ত ভাঙচুরকে এক নিমিষে জোড়া লাগিয়ে দিলো।
ইশা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে হঠাৎ করেই নিজের ঠোঁট রেখে দিলো আরহানের ঠোঁটে।
তীব্র, গভীর, নিঃশর্ত সেই চুম্বনে আরহানও সাড়া দিলো।তার বাহু জড়িয়ে ধরলো ইশার কোমর, ভালোবাসায় তাকে নিজের কোলে তুলে নিলো।
দু’জনের নিঃশ্বাস এক হয়ে গেলো— আবেগ, আকাঙ্ক্ষা আর গভীর অনুভবের অনুরণনে তারা হারিয়ে গেলো নিজেদের মাঝে।
সময় থমকে দাঁড়ালো কিছুক্ষণের জন্য।
শেষমেশ, একটু দম নিতে ইশা নিজেকে সামান্য সরে আনলো। চোখে লজ্জা, ঠোঁটে কাঁপুনি। কিন্তু আরহান তার ঠোঁট উল্টে মুচকি হেসে বললো,
“এতটুকুতে তো —-আমার মন ভরে না, বেবি।”
ইশা অন্যদিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললো,
“আপনার আবদার রেখেছি… আর পারবো না।”
আরহান চুপ থাকলো না। আরও একটু এগিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে বললো,“ উহু….এখনো তো আমাদের দ্বিতীয় বাসর বাকি আছে…”
ইশার গাল তখন লাল টকটকে। লজ্জায় সে চোখ নামিয়ে নিলো, কিন্তু হাসিটা চাপতে পারলো না।
আর সেই লাজুক হাসিতেই যেন আরহানের সমস্ত ভালোবাসা মিশে গেলো।
সেই রাতের বারান্দায়— নীরব বাতাস, চাঁদের ম্লান আলো আর ভালোবাসার নিঃশব্দ উন্মাদনা এক অদ্ভুত আবেশে জড়িয়ে রাখলো দু’জনকে।
বড় পর্ব দিয়েছি।
কমেন্টে কিন্তু ঠিকই লেজেন্ডরা নেক্সট লিখে দৌড় দিবে।
0 Comments