ভালোবাসি কও| নুজাইফা নূন| পর্ব-১
আমার বর তথা পরাগ ভাইয়ের দ্বিতীয় বিয়ের কার্ড আমি নিজেই হাতে পেলাম।লাল রঙের খামে মোড়ানো সোনালী অক্ষরে লেখা নাম -
পরাগ ইহতেশাম ইলাহী & সুনেরা সেহরিন চৌধুরী।
পরাগ ভাইয়ের পাশে অন্য নারীর নাম দেখে আমার ঠোঁট কাঁপলো না , চোখও ভিজলো না। শুধু বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। কেন উঠলো আমি নিজেও জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম পরাগ ভাইয়ের জন্য আমার মন পুড়ছে।
পরাগ আমার মামাতো ভাই।বয়সে আমার অনেক বড়।প্রায় বারো বছরের ফারাক ।আমাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। ইনফ্যাক্ট এখনো করেন না।শুধু মাত্র পরাগ ভাইয়ের জন্য আমি নানুবাড়ি যেতাম না।তাকে প্রচন্ড ভয় পেতাম।তার চোখের এক ঝলকেই আমি ছোট্ট পাখির মতো কেঁপে উঠতাম।
অন্য মেয়েরা যেখানে নানু বাড়ি যাওয়ার জন্য তাদের মায়ের কাছে বায়না করতো, আমি সেখানে নানু বাড়ি না যাওয়ার জন্য অযুহাত খুঁজতাম। আম্মু নানু বাড়ি যাবার সময় পাতলা পায়খানা হয়েছে বলে বাড়ি থেকে যেতাম। কিন্তু সেবারের বসন্ত আমার জীবন টা ওলোটপালোট করে দিল।মামা জরুরী তলব পাঠালেন।পরাগ ভাই যশোর এম এম কলেজের লেকচারার হয়েছেন।সেই খুশিতে বড় মামা মস্ত বড় খাসি জবাই দিয়েছেন। কাছের সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।মামা নিজ হাতে রান্না করে সবাইকে খাওয়াবেন।
সেই খুশির ভোজে নাকি না গিয়ে কোনো উপায় নেই।মামা কড়া গলায় বলে দিয়েছেন,
“ ছুটকি যদি না আসে, আমি তাকে ত্যাজ্যভাগ্নি করবো।”
আমার বড় মামা পলাশ ইশতেহাম ইলাহী এক কথার মানুষ। ফাঁকা বুলি ছাড়ার মানুষ নন তিনি।গাছের পাতার নড়চড় হলেও তার কথার নড়চড় হয় না।
অগত্যা আম্মুকে নিয়ে সকাল সকাল রওনা হলাম নানু বাড়ির উদ্দেশ্যে।আমার নানু বাড়ি যশোরের পালবাড়ি মোড়ে। মাগুরা থেকে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু রাস্তায় জ্যাম থাকার দরুন প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যায়। রিকশা এসে একদম নানু বাড়ির গেটের সামনে থামে। রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি বাড়ির উঠোনে বেশ সরগরম।আত্মীয়রা এসেছে,গল্প গুজব করছে,ছোট ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে,হাসি-ঠাট্টার মাঝে অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে নিচ্ছে কেউ কেউ। সবমিলিয়ে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
আমাকে দেখেই এগিয়ে আসলেন বড় মামী। আদর করে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলেন।সাথে একগাদা কথা শোনালেন আমি কেন আসি না সেজন্য।বড় মামীর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম পরাগ ভাই বাড়িতে নেই।কী এক কাজে বেড়িয়েছেন।ফিরতে রাত হবে।আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।মামী হিম কণ্ঠে বলনেন,
“ অনেক দূর থেকে জার্নি করে এসেছিস । নিশ্চয় ক্ষুধা লেগেছে? চটজলদি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।আমি জলখাবারের ব্যবস্থা করছি।”
“ কোন রুমে থাকব মামী?”
“দোতলার বামদিকে কোণার রুম টা তোর জন্য গুছিয়ে রেখেছি। তুই নিশ্চিতে থাকতে পারবি। কেউ বিরক্ত করবে না।”
আমার দুই মামা একই সাথে বসবাস করেন। জয়েন্ট ফ্যামিলি তাদের।যেটা সচরাচর এখন দেখা যায় না। বাড়িটা তিনতলা ফ্ল্যাট স্টাইল হলেও একান্ত পারিবারিক ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা। নিচতলায় পারিবারিক ডাইনিং ও বসার ঘর,গেস্ট রুম, তার পাশেই নানুর রুম। নানুর বয়স হয়েছে। হাঁটা চলা করতে পারেন না।তাই তাকে নিচ তলায় রাখা হয়েছে।
দোতলায় বড় মামা, মামী , পরাগ ভাই, পুষ্প আপু থাকেন।আর তিন তলায় ছোট মামা, মামী আর শ্রবণ ভাই থাকেন।
আমি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেছি ঠিকই , কিন্তু বাম , ডানের হিসাব মিলাতে পারছি না। মিনিট পাঁচেক চিন্তা ভাবনা করে আল্লাহর নাম নিয়ে ঢুকে গেলাম বাম দিকের কোণার রুমে।
রুমে ঢুকতেই একটা সুবাস এসে আমার নাসিকায় বারি খেল।রুম টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ মিললো না। দৌড়ে ছুটে গেলাম ওয়াশরুমে।ফ্রেশ হতে গিয়ে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই স্মরণ হলো তাড়াহুড়ো করে আমি কোন কাপড় আনি নি। এদিকে ভেজা কাপড়ে থাকায় আমার শরীর চুলকাতে শুরু করে।।
অগত্যা আমি ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে বুকে একটা টাওয়াল গিঁট দিয়ে জরিয়ে নিই।এ বাড়িতে বড় মামার তৈরি করা কড়া নিয়ম রয়েছে।কেউ কারো রুমে নক করা ছাড়া ঢুকতে পারবে না।তাই আমি নির্দ্বিধায় টাওয়াল হাতে ধরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। কিন্তু বাইরে বের হতেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।আমার সামনে স্বয়ং পরাগ ভাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন।তাকে দেখেই হাত আলগা হয়ে যায় আমার।বুক থেকে টাওয়াল সরে নিচে পড়ে যায়।শরীরে সুতোটিও অবশিষ্ট রয় না।পরাগ ভাই রক্ত চোখ নিয়ে আমার দিকে বেডশিট ছুঁড়ে দেন।
লজ্জা ঘৃণায় আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।পরাগ ভাই ত্বরিত বেরিয়ে যান। বুঝতে পারি ভুলটা আমারই হয়েছে।আমি নিজের রুমে না পরাগ ভাইয়ের রুমে ঢুকে পড়েছি।আমার শরীর অসাড় হয়ে আসে। হাঁটতে কষ্ট হয়। তবুও অনেক কষ্টে হেঁটে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিই।
আমার মস্তিষ্ক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নিজের মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারি না। লজ্জায়, ঘৃণায় শরীর কেঁপে উঠে বারবার।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে শক্ত করে নিজের চুল খামচে ধরি,নিজেকে নিজে আঘাত করে, কামড়িয়ে রক্তাক্ত করে ফেলি। তবুও নিজেকে শান্ত করতে পারি না।
অনেক ভেবে চিন্তে সু'ই'সাইড করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু গালায় ফাঁ'স দেওয়ার আগেই পরাগ ভাই আমার রুমে চলে আসেন। কীভাবে আসেন সেই মুহূর্তে ঠাহর করতে পারি নি।
তিনি আমাকে টেনেহিঁচড়ে টুলের উপর থেকে নামান। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার গালে ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দেন।আমি তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যাই।
পরাগ ভাই পকেট থেকে ফোন বের করে কোথাও একটা ফোন দেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
“ পেপার রেড়ি কর ।আমি এক্ষুনি আসছি।”
আমি তখনো নিচে পড়ে রয়েছি।গাল দুটো ব্যাথায় টনটন করছে।সেই সাথে কানেও ধাপা লেগে বোধহয়।মনে হচ্ছে যেন কোন হাতির থাবা খেয়েছি।পরাগ ভাই কথা বলা শেষ করে আমাকে নিচ থেকে তোলেন।রুঢ় কণ্ঠে বলেন,
“ চোখ মুখ ধুয়ে ফকিন্নির বেশ পাল্টে নিচে আয়।আমরা বেরবো।”
কোথায় যাব এই সামান্য কথাটা জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না আমার।আমি রেডি হয়ে নিচে এসে দেখি পরাগ ভাই সোফায় বসে ফোন টিপছেন। আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।সবাই বাগানের দিকটায় রয়েছে।সেখানেই রান্নার আয়োজন চলছে।
আমকে দেখেই পরাগ ভাই চোখ তুলে তাকালেন। তার চোখে চোখ পড়তেই আমি চোখ নামিয়ে নিই।তিনি কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে আসেন। আমিও তার পিছু নিই।
আমরা দুজনেই নানুবাড়ির গেট পেরিয়ে হেঁটে রাস্তায় আসলাম। পরাগ ভাই চুপচাপ একটা সিএনজিতে উঠে বসলেন। আমি কিছু না বুঝেই তার পাশে বসে পড়লাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। কিন্তু গন্তব্য কোথায় তা নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই।
চুপচাপ দুজন বসে আছি। শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। মাঝে মাঝে পরাগ ভাই তাকাচ্ছেন ফোনের স্ক্রিনে, আবার কখনো জানালার বাইরে। আমি তার পাশে বসে আছি কাঁপতে থাকা একটা কাঁচের মতো। মনে হচ্ছে, এখনই কেউ ছুঁয়ে দিলে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবো।
কিছুক্ষণ পরে সিএনজি থামলো একটা সাদা বিল্ডিং এর সামনে।সিএনজি থেকে নামতেই সাদা সাইনবোর্ডে গাঢ় কালিতে বড় বড় অক্ষরে কিছু লেখা চোখে পড়তেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় আমার।মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে গেলেই পেছন থেকে পুরুষালি শক্ত হাত এসে আমার কোমর আঁকড়ে ধরে।”
চলবে ইনশাআল্লাহ।
আরও পড়ুন: ভালোবাসি কও| নুজাইফা নূন| পর্ব-২
0 Comments