জীবনের গল্প: নির্বিচার|মারিয়া হাজান মারুফা| পর্ব-৫
একটা হালকা কুয়াশা যেনো ঢেকে রেখেছে পুরো আদালত চত্বরটাকে। হিমশীতল হাওয়া চলাচল করছে করিডোর ধরে। মাঝে মাঝে যেনো খালি দেয়ালে গায়ে হেলানো পুরনো ফাইলের পৃষ্ঠা উড়ে পড়ে যাচ্ছে ফ্লোরে। কোর্টের বিশাল লোহার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাদা গাড়ি। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মেঘ। কালো স্লিক শাড়িতে, হাতে কাগজপত্র আর চোখে ঠাণ্ডা কনফিডেন্স। ওর ঠোঁটের কোণে কোনো আবেগ নেই, কিন্তু চোখের গভীর তলদেশে জমে আছে পাহাড়সম চিন্তা।
শীতের সকালের কুয়াশা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে আজ। বাইজি নগরের আগরতলা কোর্ট চত্বরে পা রাখতেই মেঘ টের পেল, হাড়কাঁপানো ঠান্ডা তার দম ধরে রাখছে। তার কালো স্লিক শাড়ির ওপর কোর্ট ইউনিফর্ম, ভেজা চুল আর ঠোঁটে জমে ওঠা হালকা কুয়াশার ছোঁয়া' সব মিলিয়ে যেন একটা দৃঢ় চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। আজ তার জীবনের প্রথম বড় মামলা। প্রথম বিচার। প্রথম লড়াই। কোর্টের দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে নিঃশ্বাস নিলো মেঘ।
মাথার ভিতরে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে —“বিচার মানে আবেগ নয়, বরং তথ্যের নিখুঁত ব্যাখ্যা।”
কোর্টে প্রবেশ করতেই মেঘ শুনতে পায়! ইমরান হক বললো' —'আচ্ছা আকবর আলী আপনার মেয়ের কি কলেজে কোনো বন্ধু ছিল! ইয়া মানে ছেলে বন্ধু! যাকে এক কথায় প্রেমিক বলা হয়!"
'ওবজেকশন ইয়র ওর্নার! মাফ করবেন দেরিতে আসার জন্য!"
পায়ের শব্দ তুলে মেঘ প্রবেশ করল কোর্টে। ভেতরে ঢুকতেই চারপাশে কড়া নিরবতা। কাঁধে ফাইল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়ন, দণ্ডায়মান বিচারপতি, সচিবরা, দর্শক গ্যালারির সরু কাঁচের ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখ সব ঘুরে এসে ঠেকে মেঘের দিকে।
তার হাই হিলের শব্দ যেন সময়কেও থমকে দেয়। আসামি রোদ দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঠগড়ায়। গাঢ় নীল কোর্ট প্যান্ট, মাথা নিচু। কিন্তু হঠাৎই মেঘের পায়ের শব্দ শুনে সে চোখ তুলে তাকায়। সে মুহূর্তে সময় স্তব্ধ হয়ে যায় রুদ্র রওশন চৌধুরীর জন্য।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে এক অপরূপ নারী, যার চোখে দৃঢ়তা, ঠোঁটে সাহস, আর মুখে এক অচেনা গাম্ভীর্য! মেঘের প্রতিটি চলন যেন ধীর অথচ আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ। ভেজা চুল ঘাড় ছুঁয়ে পড়ছে, ঠাণ্ডায় গাল লাল হয়ে উঠেছে। রোদ কোনোদিন এত শীতল সুন্দর কিছু দেখেনি। সে জানে না এই নারী কে, কিন্তু তার মনের ভেতর একটা ঝড় শুরু হয়ে গেছে।
জর্জ ঘটায় শব্দ তুলে বলেন' —'ওবজেকশন অভাররুল্ড! আপনি আপনার পরিচয় দিয়ে আপনার কেস শুরু করতে পারেন?"
মেঘ কোর্টের নিজের টেবিলে গিয়ে দাঁড়ায়। ব্যাগপত্র রেখে সামনে যায়। মেঘ অর্ধ মাথা নিচু করে আবার উপরে হয়! তারপরে বলে' —'থ্যাংক্স ইউ মাই লড! আমি মিসেস মেঘলা চৌধুরী!"
'কিন্তু আপনার নামে তো মিস মেঘলা রহমান আছে! তাহলে আপনি কি?"
ইমরান হক কথার মাঝে তার প্রশ্ন ছুড়ে! মেঘ একপলক ইমরান হক এর মুখশ্রী দেখে বলে' —'মাই লড! আমি কাল পর্যন্ত মিস মেঘলা রহমান ছিলাম! কিন্তু আজ না! আমি মিসেস মেঘলা চৌধুরী! আমি বিবাহিত!"
ইমরান হক ত্যাজ দেখিয়ে বলেন' —'এখানে কি আপনি আপনার বিবাহিত জীড়বন কাহিনী শুনাতে এসেছেন? আমরা কিন্তু কেউ শুনতে চাইনি?"
শেষের কথায় ছিল রসিকতা যার কারণে উপস্থিত সকলেই হেসে উঠে! আবারও সবার মাঝে সোরগোল পাকিয়ে যায়! জর্জ উচ্চস্বরে বলে' —'অডার! অডার! অডার! আপনাদের রসকিতা শেষ হলে কেসে ফিরি সকলে'ই!"
সবার মাঝে নিরবতা! জজ কণ্ঠে ঠাণ্ডা প্রশ্ন' —“আপনি বাদীর উকিল মেঘলা রহমান?"
মেঘ সম্মানসূচক মাথা নোয়ায়' —“জি, আমি। ক্ষমা করবেন। আমার আগমন কিছুটা দেরিতে হয়েছে, তবে আমি প্রস্তুত।”
জজ চোখ তুলে তাকান মেয়েটির দিকে। স্বরস্রোতের মতো গলার স্বচ্ছতা, ভঙ্গিমার দৃঢ়তা এক মুহূর্তে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল।
মেঘ ফাইল খুলে দাঁড়ালো' —“মাননীয় বিচারক মহাশয়! আমার মক্কেল আকবর আলী। একজন দরিদ্র গার্ড, যিনি চৌধুরী বাড়ির গেটে কাজ করেন। তার ১৮ বছর বয়সী মেয়ে রুমানা। অত্যন্ত সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে সবে কলেজে পা রেখেছিল! কিন্তু মাত্র ক'সপ্তাহ আগে, তাকে তার নিজ ঘরে বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার শেষ কথাগুলো ছিল' —‘ছোট সাহেব।’
মেঘ কিছুক্ষণের জন্য থামে। রোদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে! বাতাসে থেমে থাকা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জোরে নিশ্বাস নিয়ে আবারও বলে' —“ছোট সাহেব কে? সেই প্রশ্ন নিয়েই দাঁড়িয়ে আছি আমরা আজ। বিবাদী রুদ্র রওশন চৌধুরী ওরফে রোদ। যার নাম রুমানার মুখে শেষ উচ্চারিত শব্দ ছিল। এক্সালি নাম নয় এটা একটা সাংকেতিক চিহ্ন! সে কি দোষী? নাকি এটা নিছকই ষড়যন্ত্র?”
মেঘ একটু সময় নিলো। ঘড়ির দিকে তাকালো, সময় ১২টা ৪ মিনিট। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো' —'এই কেসটি শুধুই এক ধর্ষিতার বিচার চাওয়ার মামলা নয়, এটি সেই সমাজের মুখোশ উন্মোচনেরও প্রক্রিয়া, যেখানে ক্ষমতা, প্রভাব আর ধনই সবকিছু!"
ইমরান হক বলে ওঠে —'ওবজেকশন ইউর অনার!"
জর্জ সাথে সাথে'ই জবাব দেয়' — 'সাসটেইনড! মিস রহমান, আপনি আবেগ নয়, তথ্য উপস্থাপন করুন।"
মেঘ মাথা নিচু করে বলে' — 'ক্ষমা করবেন, মাই লর্ড।'
এরপর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। আকবর আলীর জবানবন্দি। মেঘের অনুরোধ আর জর্জের অনুমতিতে আকবর আলী কাঠগড়ায় দাড়ায়! মেঘ প্রেশ্ন ছুড়ে' —'আপনার মেয়ে কি কলেজে পড়াশোনা করতো?"
আকবর স্বশব্দে জবাব দেয়' —'হ করতো!"
মেঘ পাল্টা প্রশ্ন করে' —'ঘটনার দিন আপনারা কোথায় ছিলেন?"
আকবর অশ্রুসিক্ত চোঁখে জবাব দেয়' —'আমি আর আমার বউ চৌধুরী বাড়িতে কাজ করতাম। সেদিন খুব কুয়াশা ছিল। হঠাৎ দারোয়ান জানায় ছোট সাহেব আমাদের ঘর থেকে বের হয়েছে। গিয়ে দেখি মেয়ে! আমার মেয়ে!"
কাঁদতে থাকে আকবর আলী! মেঘ রোদের দিকে তাকায়! রোদ এতক্ষণ মেঘের দিকেই তাকিয়ে ছিল! মেঘ তাকাতেই রোদ একটু নড়ে ওঠে মাথা নীচু করে। আবার মাথা তুলে তাকায় মেঘের দিকে। তার কণ্ঠে কোনো আতঙ্ক নেই! আছে ঝলকানো যুক্তির ধার।
মেঘ আবারও প্রশ্ন করে' —'তখন কি সে কিছু বলেছিল?"
আকবর চোখ মুখে বলে' —'হ বলছিল" 'ছোট সাহেব! ছোট সাহেব!' — তারপরই... তারপরই চোখ বন্ধ হয়ে যায়।"
ইমরান হক উঠে দাঁড়িয়ে আকবর আলীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে' —'আচ্ছা আকবর আলী! আপনার মেয়ের কি কলেজে কোনো ছেলে বন্ধু ছিল?'"
মেঘ চিৎকার করে ওঠে' —'ওবজেকশন ইউর ওর্নার!'
বিচারক মাথা নাড়েন' —'ওভাররুলড!'
মেঘ বসে পড়ে! ইমরান হক দাড়িয়ে প্রশ্ন করেন' —'তাহলে কি আপনার মনে হয়, এই ঘটনায় আপনার মেয়ের কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রভাব থাকতে পারে?"
আকবর চোখ মুছে বলে' —'না স্যার। ও কারও সাথে মিশতো না!"
ঘরে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আদালতের ভেতর যেন উত্তপ্ত আগুন! মেঘের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পেছনের বেঞ্চিতে বসে থাকা জনসাধারণ হঠাৎ কানা-ঘুষায় ফেটে পড়ে। জজ বললেন — 'অডার! আদালতে শৃঙ্খলা বজায় রাখুন!'
তবে সেদিন আর শেষ করা গেল না। মামলার বিবাদী পক্ষ আরও কিছু নথি উপস্থাপন করতে চায়, সেই বিষয়ে প্রস্তুতি প্রয়োজন। বিচারক বললেন' —'এই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করা হলো ২৮ ডিসেম্বর, দুপুর ১টা। সকল পক্ষ প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন। কোর্ট ইজ অ্যাডজার্নড!''
সকলের মাঝে তাড়াহুড়ো শুরু হয়! একে একে সকলেই কোর্ট থেকে! মেঘ ক্লান্ত পায়ে কোর্ট বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসে। মাথা নিচু করে সোজা চলে যায় বাইজি নগরের কোর্ট ক্যান্টিনে। ওর কাঁধে একগাদা ফাইল, চোখে একরাশ ক্লান্তি। একটা টেবিলের একপাশে বসে, অর্ডার করে এক কাপ লেবু চা আর সিঙ্গারা। সেই মুহূর্তে সেখানে প্রবেশ করে রোদ। চুলে হালকা জেল, ধূসর প্যান্টস্যুট, চোখে একটু থেমে থাকা আগুন। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে মেঘকে। তারপর ধীরে পায়ে এগিয়ে আসে রোদ! মেঘের পানে প্রশ্ন ছুড়ে' —'আপনি মেঘলা রহমান?''
মেঘ তাকায়। একটু অবাক হয়। তারপর বলে' —'জ্বি!"
মেঘের কোনো প্রতিত্তোরে না পেয়ে রোদ আবার প্রশ্ন করে' — 'আপনি বিশ্বাস করেন আমি দোষী?''০
মেঘ নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে জবাব দেয়' —'আমি কোর্টরুমে সত্য খুঁজি। বিশ্বাস রাখি প্রমাণে।''
রোদ একটু হেসে বসে পড়ে তারপর বললো' —'তাহলে প্রমাণ দেখুন। আমাকে একটু সময় দিন আপনার সাথে কথা বলতে চাই। আমি শুধু নিজেকে নয়, সত্যকে রক্ষা করতে চাই।''
মেঘ কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে আছে একধরনের কৌতূহল! কিন্তু হঠাৎ কেউ হ্যাঁচকা টানে নেয়ে মেঘ কে! পরপর'ই গালে চড় পরে মেঘের!
—টাসসসসসসসসসস
একটা চড়ের শব্দে পুরো ক্যান্টিন চুপচাপ হয়ে যায়! মেঘের মুখটা কাঁচের মতো ফেটে পড়ে। মাথাটা একপাশে ঘুরে গেছে চড়ের ধাক্কায়। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অভি! চোখে আগুন, ঠোঁট কাঁপছে। হাতে মুঠো চেপে ধরেছে' — 'এখানে বসে পরপুরুষের সাথে আলাপ করছো লজ্জা করে না তোমার? তুমি বিবাহিত মেঘ! কথাটা যত তাড়াতাড়ি মাথায় ঢুকাতে পারতে তত'ই তোমার ভালো!''
রোদ উঠে দাঁড়ায় — 'হেই! ইউ ক্যান্ট টাচ হার লাইক দ্যাট!'
অভি কিছু বললো না! মেঘ স্তব্ধ! কান্না আসছে না, রাগও নেই। শুধু একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বুকের মাঝখানে শূন্যতা তৈরি করেছে। ক্যান্টিনের লোকজন তখন হেঁটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কেউ চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, কেউ রোদকে দেখছে, কেউ অভির মুখের আগুন দেখে চুপ।
অভি কিছু বলার আগেই মেঘ তার ফাইলটা কাঁধে তুলে বেরিয়ে যায়। রোদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। পেছনে অভি দাঁড়িয়ে থাকে, বোবা পাথরের মতো। বাইরে তখন আবারও হিমেল বাতাস। শীতল, তীক্ষ্ণ, মেঘের চোখের কোল ভিজে যাচ্ছে...
0 Comments