দর্শন ভাই! নিঝুম আপার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আজ,কথাটা কানে যেতেই ফোনটা কেটে দেয় দর্শন। বিছানায় শুয়ে আছে সে, চোখের পাতার নিচে ক্লান্তির ছায়া, শরীর জুড়ে জ্বরের আঁচ। শোয়া অবস্থা থেকে ফট করে উঠে বসে সে। মাথাটা দুলে উঠে, যেন ঝড়ের মুখোমুখি নৌকা। গত দুইদিন ধরে প্রবল জ্বর। আর গত সন্ধ্যা থেকে ১০১-১০২-১০৩ ডিগ্রির নিচে নামছেই না।
শরীর দূর্বল, ভেতরে কাঁপন। কিন্তু, এই মুহুর্তে সব অসুস্থতা, সব ক্লান্তি তুচ্ছ একটা খবরের কাছে, নিঝুমের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
নিঝুম! তার নিঝুম! তার মানে সবাই খুবই গোপনে, খুবই নিঃশব্দে, দর্শনের অজান্তে, নিঝুমকে দুরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যেন এই পৃথিবীতে তার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করছে তার সঙ্গে, তার ভালোবাসার সঙ্গে, তার অনুভুতির সঙ্গে। না! দর্শন বেঁচে থাকতে এইটা কিছুতেই হতে পারে না।
দর্শন কম্বলটা সরিয়ে পা নামিয়ে দেয় ঠান্ডা ফ্লোরে। দাড়াতে গিয়ে শরীর টলে আবার বসে পড়ে। চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে আসে এক মুহুর্তের জন্য। তারপর আবার নিজেকে জোর করে টেনে তোলে সে। তার এখন সময় নেই দূর্বল হওয়ার, সময় নেই আর এক মুহুর্তও বসে থাকার। তাকে যতো দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে হবে নিঝুমের কাছে, আটকাতে হবে এই বিয়ে।
বেডসাইড টেবিল থেকে গাড়ির চাবি তুলে নেয় দর্শন। শরীরে জ্বরের কম্পন। তাও পায়ে পায়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নিচের আলিশান আকৃতির ড্রইং, ডাইনিং ফাঁকা। কেউ নেই। সবাই কোথায়? নিঝুমের বিয়েতে? শুধু তার মা একা বাসায় আর বাকি সবাই কি নিঝুমের বিয়েতে গেছে? আর ভাবে না দর্শন। বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। কেউ জানতেও পারে না দর্শনের বেরিয়ে যাওয়া।
ঢাকার রাস্তা সব সময় কোলাহলে পরিপূর্ণ। ব্যাস্ততা যেন থামে না কখনোই। চারপাশে হর্ন, মানুষের কন্ঠ, হকারের শব্দ, ধোঁয়া, জটলা পাকিয়ে আছে। তার মাঝেই দর্শনের কালো গাড়ি ছুটে চলে। পরিধানে আছে বাসায় পরা কালো ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট। জ্বর কমেনি একটুও। তবুও সে থামে না। চোখে শুধু একটাই লক্ষ্য, নিঝুমকে নিজের কাছে আনা। এই বিয়ে বন্ধ করা। দরকার হলে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিঝুমকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবে। তাও নিঝুমকে তার লাগবে।
হঠাৎ, দর্শনের চোখ যায় উল্টো দিক থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটা গাড়ির দিকে। আচমকা এমন হওয়ায়, সাথে শরীরের জ্বরের প্রকোপ থাকায়, গাড়িকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না দর্শন। এক মুহুর্তে সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যায়।
মুখোমুখি ধাক্কা খায় গাড়ি দুইটি। একটা বিকট শব্দে কেঁপে উঠে চারপাশ। গাড়ির কাচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রাস্তায়। স্টিয়ারিং এর সাথে আঘাত খায় দর্শনের মাথা। মুহুর্তের মাঝেই কপাল ফেটে রক্তে লাল হয়ে যায় সাদা টিশার্ট। হাত, পা ও হয়তো কেটে গেছে, সে আর বোঝার অবস্থায় নেই।
নিঃশ্বাস কাঁপছে দর্শনের, ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে। চোখে অন্ধকার নেমে আসছে, বুকের ভেতর যেন কিছু একটা আঁটকে আছে। আশেপাশে থেকে মানুষের চিৎকার ভেসে আসলেও, দর্শনের মস্তিষ্ক ধারন করতে পারে না সেইসব শব্দ।
কোনরকমে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
–" নিঝুম!"
তারপরই বন্ধ হয়ে যায় চোখ দুটো। চারপাশের কোলাহল, শব্দ, সব মুছে যায় এক নিঃশব্দ ঘোরে।
সোনালি অতীত...
শালবন গ্রাম!
গ্রামটি যেন প্রকৃতির আঁচলে লুকিয়ে থাকা কোনো এক চুপচাপ স্বপ্ন। শান্ত, গাঢ় সবুজে মোড়ানো একটা গ্রাম। তার বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীটা একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস। নদীর পাশ দিয়ে যেন কাশফুলগুলো বাতাসে হেসে উঠে। সাজানো ক্ষেতগুলো একেক ঋতুতে একেক রঙে রাঙিয়ে তোলে গ্রামটিকে। কোথাও হলুদ সরিষা, আবার কোথাও সবুজ ধানের ঢেউ। চারিদিকে ঘিরে রয়েছে বিল, মাঠ, আঁকা-বাকা মেঠোপথ। দুরে থাকা তালগাছ, খেজুর গাছের ঝাড়ের ভেতর দিয়ে যখন হালকা বাতাস বয়, তখন পাতা গুলো হালকা কাপে। সেই শব্দে মনে হয়, যেন কেউ গুনগুন করে গান গাইছে।
এই গ্রামেই বিস্তৃত জায়গা নিয়ে দাড়িয়ে আছে চৌধুরী বাড়ি। এক সময় জমিদারি ছিলো কিন্তু এখন আর সেই রাশভারি ক্ষমতা নেই, কিন্তু সম্মান ঠিকই রয়ে গেছে। গ্রামের লোকেরা এই বাড়িকে সম্মান করে, সমীহ করে চলে। চৌধুরী বাড়ির পুরুষেরা গ্রামের সালিশি সভার মূলে, এদের কথা মানে পুরো গ্রাম। চৌধুরী বাড়ির পুরুষদের কথায় যেন শেষ কথা।
বড় উঠানের তিন পাশে তিনটি বড় আকৃতির বাড়ি তোলা হয়েছে, যার চারিদিকে ইটের গাথুনি আর উপরে টিনের চাল দেওয়া। বাড়ির একটু পেছনেই বড় গোয়াল ঘর, যেখানে সারি সারি গরু বাঁধা, সাথে হাস-মুরগির ঘরও তোলা আছে। তার পেছনেই আছে বিশাল ঘাট বাঁধা একটা বড় পুকুর। এক পাশে রয়েছে কলপাড়, অন্যপাশে বিশাল আকৃতির রান্নার ঘর। বাইরের মানুষ ভেতরের কিছু দেখতে পায় না, কারন চৌধুরী বাড়ির সীমানা জুড়ে রয়েছে বিশাল পাচীল। পাচীল থেকে বের হওয়ার দরজার দিকে মাঝারি আকৃতির একটা ঘর তোলা আছে, যেখানে বিচার সালিশ বসে, চৌধুরী বাড়ির পুরুষেরা বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা করে থাকেন, এক কথায় কাজের ঘর।
চৌধুরী বাড়ির ছোট বউ, আজমিরা বেগম, এই মুহূর্তে এই শান্ত পরিবেশ ভেঙে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। কপালে ঘাম, মুখে রাগ ও দুশ্চিন্তা। তিনি যেন ছায়ার মতো খুঁজে ফিরছেন কাউকে। মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে একটা নাম,
–" নিঝুম! নিঝুম! কই তুই? নিঝুম!"
এ ঘর থেকে ও ঘর, তিন বাড়ির সব গুলো শয়নকক্ষ, বারান্দা, উঠান, এমনকি গোয়ালঘর অব্দি খুঁজে ফেলেছেন। কোথাও নেই মেয়েটি। হতাশায় এবার তিনি দৌড়ে চললেন রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরের এক কোনায় পাটির উপর বসে আছেন তার শাশুড়ি রেবেকা আক্তার। মুখে পান, ঠোঁট রাঙা, চোখে চিরকালীন ধৈর্য, পরনে সাদা শাড়ি, গলায়, হাতে, কানে স্বর্ণ জ্বলজ্বল করছে। পাশে বসা বিউটি ইয়াসমিন, চৌধুরী বাড়ির মেঝো বউ, চাল বাচছেন কুলোয় করে। চুলোর কাছে বসে আছে কাজের মেয়ে মালতি, ভাতের হাড়িতে কাঠের চামচ ঘুরাচ্ছে।
দরজার কাছে দাড়িয়ে আজমিরা বেগম জিজ্ঞেস করে,
–" নিঝুমরে দ্যাখছেন আম্মা?"
রেবেকা আক্তার মাথা নাড়িয়ে বলে ওঠে,
–" কই নাতো। হেরে তো আজ সক্কাল থেইকাই আমি দেহি নাই। গ্যাছে কই হেই মাইয়া?"
আজমিরা বেগম ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–" আমি তো হ্যার জন্য গোটা বাড়িখান ছান মারলাম।নাই, একদম নাই।"
বিউটি ইয়াসমিন পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে,
–" শশী কই?"
আজমিরা বেগম তার দিকে তাকিয়ে বলে,
–" শশী আর নয়নরে পাঠাইছি গোয়ালিগে বাড়ি। আজ বেশি কইরা দুধ দেওনের লাইগা।"
রেবেকা আক্তার বাটিতে পানের রস ফেলে বলে,
–" যাইয়া দ্যাহো কার আম গাছ, জাম গাছে উইঠা বইয়া আছে। হের তো আবার কোনো কিছু কইলজায় আটকাই না। পড়াল্যাখা শিখাইয়া মাইয়াডারে এক্কেবারে মাথার মউর বানাইছো তুমরা। কি হইলো তাতে? উল্টো বেয়াদপি কাজ কারবার বাড়ছে।"
আজমিরা বেগমের মুখ রক্ত বর্ন ধারন করে রাগে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
–" আজ যদি হেরে সত্যি সত্যি গাছে পাই, ওর পিঠের ছাল তুইলা নিমু আমি।"
কথাটা শেষ করেই তীব্র রাগে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় আজমিরা বেগম। পেছন থেকে বিউটি ইয়াসমিন চেচিয়ে বলে,
–" ছোটু! কিছু কইস না মাইয়াডারে। আমি পরে বুঝাইয়া কমুনি।"
আজমিরা বেগম শুনলো না কথাটা। দ্রুত পায়ে চলে গেলো উঠোনের দিকে। রেবেকা আক্তার গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
–" মাইয়াডার ধিরিঙ্গিপনা দিন দিন বাড়তাছে। একেবারে অসহ্য লাগে আমার।"
বিউটি ইয়াসমিন চোখের কোণে একটুখানি উদ্বেগ নিয়ে শাশুড়ির দিকে তাকায়। তারপর আবার চিন্তিত দৃষ্টিতে চোখ ফেরায় আজমিরা বেগমের বেরিয়ে যাওয়া পথের দিকে।
আজমিরা বেগম বাড়ির গেটের দিকে যাচ্ছে। তার মুখে তীব্র রাগ, চোখে অস্থিরতা। এমন সময় এক দৃশ্য দেখে থেমে যায় আজমিরা বেগম, তার মেঝো যা অর্থাৎ বিউটি ইয়াসমিনের ছোট কন্যা শশী চুপচাপ পা টিপে টিপে উঠোন পেরিয়ে যাচ্ছে। তার হাতে একটা বড়সড় বেতের তৈরি ঝাকা।
আজমিরা বেগম ভ্রু কুচকিয়ে তাকিয়ে রইলো শশীর দিকে। চোখ সরু করে নজর রাখছে শশীর গতিবিধির উপর। শশী যখনি পাচিলের দরজা দিয়ে বের হতে যাবে তখনি পেছনে বাজ ভাঙা কন্ঠে ধ্বনিত হয়,
–" শশী!
শব্দটা বজ্রপাতের মতো এসে পড়ে শশীর ঘাড়ের উপর। চমকে উঠে সে। পা থেমে গেছে। ঝাকা আকরে ধরে ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায়। তার সামনে দাড়িয়ে আছে তার ছোট চাচী আজমিরা বেগম। মুখে এমন গাম্ভীর্য যেন এখনো কিছু জানেন না, কিন্তু সব জেনে গেছেন।
শশী ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে। হঠাৎ যেন এই উঠানটা আদালতের কাঠগড়ায় পরিনত হয়েছে, আর সে অভিযুক্ত। শশীর মুখ শুকিয়ে গেছে, হাঁটু কাঁপছে হালকা। গলায় কৃত্রিম স্বাভাবিকতা এনে জিজ্ঞেস করে,
–" ডাকছো, ছোট চাচী?"
আজমিরা বেগম এক ধাপ এগিয়ে আসে। চোখ দিয়ে যেন একেবারে ভেতরটা ঝলসে ফেলছেন। গলায় সন্দেহ মেশানো রুক্ষ সুরে বললেন,
–" এইরাম চোরের মতো হেঁটে কই যাইতাছোস? তোরে আর নয়নরে তো আমি গোয়ালিনির বাড়ি পাঠাইছিলাম, দুধ আনবার লাইগা। তুই এইহানে কি করোস?"
শশী একটা ঢোক গিলে আস্তে করে। তারপর একটু ইতস্তত করে বললো,
–" আসলে, ছোট চাচী! আমরা গেছিলাম গোয়ালিনির বাড়ি। কাকু বললো, উনি নিজে নিয়ে আসবেন। দুধ বিকালের আগেই দিয়ে যাবেন। তাই, আমরা চলে আসছি।"
–" তা বুঝবার পারলাম! কিন্তু, এইযে এতো বড় ঝাকা কিসের জন্যি?"
শশী এক পলক হাতে থাকা ঝাকার দিকে তাকায়। তারপর আজমিরা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–" নদীর কূলে অনেক প্রকার শাক হয়েছে দেখলাম। ভাবলাম, তুলে নিয়ে আসি।"
–" শাঁক তুইলা আনতে এতো বড় ঝাকা লাগে?"
শশীর গলা শুকিয়ে আসছে। আজমিরা বেগমের মুখের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছে না তার। শক্ত করে ঝাকাটা চেপে দাড়িয়ে আছে।
আজমিরা বেগম চোখ ছোট ছোট করে রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,
–" শশী! নাটক করবি না আমার লগে। নিঝুম কই?"
শশীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। চোখ বড় করে তাকায় ছোট চাচীর পানে। কিছু বলবে, আবার থেমে গেলো। আজমিরা বেগম শক্ত গলায় আবার বলে ওঠে,
–" নিঝুম কোথায়? সত্যি কইরা ক, নাইলে সব কয়ডারে এক লগে পিটামু।"
শশী বুঝতে পারলো, আর মিথ্যা বলা সম্ভব না। কম্পিত কন্ঠে বললো,
–" নিঝুম! নিঝুম বড় আম বাগানে আছে।"
আজমিরা বেগম যেন চোখ দিয়ে আগুন ছুড়ে দিলো।
–" আবার গাছে উঠছে ও। এতোবার নিষেধ করা সত্বেও আবার গাছে উইঠা গ্যাছে। আইজ ওরে আমি মাইরাই ফালামু।
চুলা থেকে সদ্য উঠা ধোয়ার মতো হনহন করে বেরিয়ে গেলো আজমিরা বেগম। মুখে তীব্র ক্রোধ আর মনে প্রবল হতাশা। এই মেয়ে তার মাথার উপর চড়ে বসেছে। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না মেয়েকে।
শশী হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো। তার মুখে দুঃশ্চিতা আর চোখে ভয়। তারপর মনে মনে বলে ওঠে,
–" গেলিরে নিঝুম! এইবার তো তুই ঠিকই গেলি। ছোট চাচীর রাগ কে থামাবে আজ? তোকে তো আর আস্ত রাখবে না।"
শশী আর দাড়িয়ে থাকতে পারলো না। উঠানে ঝাকা ফেলে রেখে দৌড়ে চললো চাচীর পেছনে। উদ্দেশ্য, নিঝুমকে আজ মার খাওয়ার হাত থেকে যদি বাঁচানো যায়।
শালবন গ্রামের এক প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিশাল এক আমবাগান। যেন সবুজের রাজ্য জুড়ে ছায়া ঘেরা শান্তির নীড়। সারি সারি আম গাছ দাড়িয়ে আছে ঘন হয়ে, ডালে ডালে ঝুলছে কাঁচা পাকা মিশ্র আমের গুচ্ছ। রোদ আর ছায়া মিলে মিশে এক স্নিগ্ধ আবহ সৃষ্টি করেছে। আম বাগানটা আসলে চৌধুরী বাড়ির। কিন্তু, গ্রামের মানুষের সেখানে অবাধ যাতায়াত রেখেছে চৌধুরী বাড়ি। যে যা পারে আম পেড়ে খেয়ে যায়। গ্রামের সরল সহজ মানুষ গুলো অবশ্য খাওয়া ব্যতিত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে আম পাড়েও না।
বাগানের মাঝামাঝি এক বিশাল পুরোনো আম গাছ। ছড়ানো ডালপালা, শক্ত কান্ড, কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে অনেক বছর। এই গাছের উপর এক তরুনী বসে আছে গাছের ডাল আকড়ে ধরে। পরনে লাল ধুতি সালোয়ার, আকাশি রঙের কামিজ, শরীরে আড়াআড়ি করে বাধা লাল উড়না। মাথার পেছনে একটা লম্বা বেনুনি, প্রায় হাটু ছুঁতে যাচ্ছে। রোদের তাপে ধবধবে ফর্সা রং রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। গাঢ় চোখ জোড়া হাসছে, মুখে দুষ্টুমির ছাপ। আলো-ছায়ার ফাকে তাকে দেখে মনে হয়, গাছের পাতার ফাঁকে কেউ গল্পের পাখির মতো বসে আছে।
মেয়েটি নিঝুম! গাছের নিচে ছায়ায় দাড়িয়ে আছে আরও কয়েকজন। নয়ন, রিমি, প্রেমা, মারুফ, অন্তু ও গৌরি। নয়ন নিঝুমের আপন ছোট ভাই, রিমি নিঝুমের ফুপাতো বোন, আর মারুফ, অন্তু, প্রেমা গ্রামের ছেলে মেয়ে, ছোট বেলা থেকে নিঝুমের সাথে চলাচল তাদের। গৌরি নিঝুমদের বাড়িতে কাজ করে। প্রতিদিন তাদের নানান কার্যকলাপে গ্রাম ভরে থাকে। তাদের দলের নেত্রী নিঝুম।
নয়ন মাথা উচু করে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
–" নিঝুম আপা! তোমার মাথার উপরের ডালে ঝুলে থাকা আমটা আমাকে পেড়ে দাও না।"
নিঝুম আমের দিকে তাকিয়ে বললো,
–" কোনডারে? এইডা? নাকি ঐ পাশেরডা? দ্যাখতাছি তো পাচডা একলগে ঝুলতাছে। বল, কোনডা পাড়ুম?"
নয়ন ব্যস্ত হয়ে নির্দেশনা দেয়,
–" ঐটা আপা! যেটার পাশে পাখির বাসা আছে।"
গৌরি ভ্রু কুচকিয়ে বলে ওঠে,
–" নিঝুম আপা! ছুডো চাচী না কইছে, আপনারে শুদ্ধ ভাষায় কথা কইতে। আপনে আবার আমাগো মতো এইরাম ভাষায় কথা কইতাছেন? ছুডো চাচী শুইনলে একখান ভালোই ঝাড়বে আপনারে।"
নিঝুম খানিকটা গম্ভীর মুখে বললো,
–" এই থাম তো গৌরি! বেশি কথা কইবি না একদম। তোর ছোট চাচী কি এইহানে আইয়া আমার কথা হুনতে আইতেছে?"
গৌরি স্লান মুখে চুপ মেরে যায়। এই মেয়েকে কিছু বলেও লাভ নেই, সেইটা সে খুব ভালো করেই জানে। প্রেমা পাশ থেকে বিরক্ত সুরে বলে উঠলো,
–" এই শশী কহন গ্যাছে ঝাকা আনতে, অহনও কোনো খোজ নাই। আমরা তো বুড়া হইয়া যামু, এইহানে খাড়াইয়া থাকতে থাকতে।"
নিঝুম গাছের ডালটা একটু সামলে নিয়ে বললো,
–" ওরে দিয়ে একটা কামও ঠিক ভাবে করবার পারি না আমি। বছর লাইগা যায় ওর কাম করতে।"
নয়ন আবার ধৈর্য্য হারা হয়ে বলে ওঠে,
–" আপাততো কথা কম বলে, আগে আমটা দাও তো।"
–" খাড়া দিতাছি।
কথাটা বলে নিঝুম ডাল ধরে ঘুরে দাড়ায় অন্যদিকে, আম পাড়ার জন্য হাত বাড়ায়। ঠিক সেই মুহুর্তে যেন বজ্রপাত হলো। সবাই একসাথে জমে যায়। গাছতলায় এসে দাড়িয়েছে আজমিরা বেগম। সবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। নয়ন মাকে দেখে হকচকিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি মারুফের পেছনে গিয়ে লুকায়।
আজমিরা বেগমের পেছন পেছন শশীও এসে দাড়িয়েছে। প্রেমা চোখ রাঙিয়ে শশীর দিকে তাকায়, শশী কান্না কান্না মুখে করে নিচের দিকে চেয়ে থাকে। তার মুখে ভয় ও অনুশোচনার ছাপ।
নিঝুম তখনো ব্যস্ত আম পাড়ায়, মায়ের আগমন সে টের পায়নি। সে ডাল ধরে নির্দিষ্ট আম ছিঁড়ে নিচে তাকাতেই, চোখ গিয়ে পড়ে মায়ের মুখের উপর। মুহুর্তেই দম বন্ধ হয়ে আসে নিঝুমের। সে তাকায় শশীর দিকে। শশী ভীত চোখ দেখে নিঝুম সব বুঝে যায়। তার মনে হচ্ছে, এখনি গাছ থেকে একটা আম ছুড়ে শশীর মাথা ফাটিয়ে দিতে।
আজমিরা বেগম রাগে আগুন হয়ে দাড়িয়ে আছে গাছের নিচে। মুখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু চোখে বজ্র। নিঝুমের যেন মাথা ঘুরছে। মায়ের তীব্র চোখ যেন তাকে চুরমার করে দিচ্ছে।
–" নিচে নাইমা আয় নিঝুম!"
মায়ের এই গম্ভীর ডাক যেন গাছও কাঁপিয়ে দেয়। নিঝুমের শরীর কেঁপে উঠে। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, আজ আর কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। হাতের আমটি নিচে পড়ে যায়, কারোর অবশ্য সেইদিকে খেয়াল নেই। একটা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে নিঝুম নিচে নামতে শুরু করে। মাটিতে পা পড়তেই আজমিরা বেগম পাশের থেকে একটা মোটা ডাল তুলে নেয়। চারপাশে সবাই একসাথে বলে উঠলো,
–" ওরে বাবা!"
রিমি, প্রেমা, নয়ন, শশী, মারুফ, অন্তু, গৌরি, সবাই দৌড় দেয় যে যেদিকে পারে, যেন ভুতের ভয় পেয়েছে। নিঝুমও পালাতে যায়, তখনি আজমিরা বেগম বলে ওঠে,
–" খবরদার নিঝুম! পালাবি না এইহানতে।"
থেমে যায় নিঝুম। পালায় না, বুঝলো, এখন পালালে মায়ের রাগ সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তাই মাথা নিচু করে দাড়িয়ে যায় নিঝুম। আজমিরা বেগম এগিয়ে এসে নিঝুমের কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
–" চল বাড়ি। আজ তোর হইতাছে।"
–" মা! লাগছে আমার।"
–" চুপ! এইভাবেই যাওন লাগবে তোর। চল।"
সেইভাবেই কান ধরে টেনে হাঁটা শুরু করে আজমিরা বেগম। নিঝুমও নাক মুখ কুচকিয়ে মায়ের সাথে হাঁটতে থাকে।
আমবাগান থেকে ফিরে আসার পথে আজমিরা বেগমের মুখে জলন্ত রাগ। এক হাতে শক্ত করে ধরে আছেন নিঝুমের কান, টেনে নিয়ে যাচ্ছে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে থাকা মেয়েটিকে। নিঝুম মুখে কিছু না বললেও, ব্যাথায় পুড়ছে সে। কানে লালচে ছোপের ব্যাথার ছোঁয়া, আর চোখে জমে থাকা জল চকচক করছে।
ঠিক তখনি রাস্তার মোড়ে এসে দেখা হয়ে গেলো শুভর সাথে। শুভ হলো বিউটি ইয়াসমিনের বড় ছেলে, শশীর বড় ভাই। শুভ হঠাৎ থমকে দাড়ালো। চোখ বড় হয়ে গেলো এমন দৃশ্য দেখে, নিঝুমের কান ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ছোট চাচী।
শুভ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ব্যাগ্র বলে ওঠে,
–" ছোট চাচী! নিঝুমকে এইভাবে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? কি হয়েছে?"
আজমিরা বেগমের রাগ যেন একটুও কমেনি। শুভর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
–" কি হইছে আর জিগাস না বাপ। এই মাইয়া লইয়া আমার আর শান্তি নাই। হেয় আবারও গাছে উঠছে।"
–" কি?"
শুভ বিস্ময়ে তাকায় নিঝুমের দিকে। ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে, কানের লালচে রঙে স্পষ্ট ব্যাথার ছাপ। নিঝুম মাথা নিচু করা, ঠোঁট কামড়ে ধরা, চোখের কোণে পানি দেখা যাচ্ছে। নিঝুমকে দেখে শুভর বুকের ভেতর কেমন খচখচ করে উঠে।
শুভ গলা নামিয়ে আস্তে করে বললো,
–" চাচী! আজকের মতো ছেড়ে দাও। ও আর এমন করবে না। আমি বলছি, বিশ্বাস করো।"
–" এই মাইয়া জীবনও কথা শুনবো না। আইজ ওর পিঠের ছাল উঠাইয়া ফালামু আমি।"
–" একবার, শুধু আজকের মতো মাফ করে দাও, চাচী! আমি অনুরোধ করছি তোমাকে।"
শুভর কন্ঠে কাতরতা ভেসে উঠে। তার কথার জন্য আজমিরা বেগম নিজের রাগকে দমিয়ে নেয়। আর যাই হোক বাড়ির ছেলের কথা উপেক্ষা করা উচিত না। আজমিরা বেগম নিঝুমের কান ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
–" আইজ শুভর লাইগা তুই বাঁইচা গেলি। আর যদি দেহি তুই গাছে উঠছোস, তোর একদিন কি আমার যে কয়দিন লাগে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়।"
কথাগুলো বলেই আজমিরা বেগম দ্রতু বেগে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। নিঝুম চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাসে, চোখে পানি টলমল করছে। এতো সময় কান চেপে ধরে রাখায়, কান যেন অবশ হয়ে আছে তার। তারপর চলে যেতে নিলেই শুভ মোলায়েম করে বলে ওঠে,
–" নিঝুম!''
দাড়িয়ে পড়ে নিঝুম। শুভ নিঝুমের মুখোমুখি দাড়িয়ে আস্তে করে বললো,
–" চাচী তোকে কতোবার নিষেধ করেছে, তোকে গাছে না উঠতে। তুই তাও কেন উঠিস বলতো? নিষেধ করা কথা শুনিস না কেন?"
নিঝুম চোখ তুলে তাকায়। তার মুখে অভিমান, কন্ঠে বিদ্রোহ বলে,
–" সবাই শুধু আমাকে শাসন করতেই জানে। আর কিছুই যেন পারে না। এই সময়ে গাছে হালকা কাঁচা পাকা আম থাকে। যেইটা খেতে আমার খুব ভালো লাগে। কয়েকদিন পর সব আম পেকে যাবে, সেইসব আমি খাই না। তাই একটু খাওয়ার জন্য উঠেছিলাম, তাতেই সবাই অস্থির। মাঝে মাঝে মন চাই, যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাই।"
কথাগুলো বলে হনহন করে বাড়ির দিকে চলে যায় নিঝুম। শুভ দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তাকিয়ে থাকে নিঝুমের যাওয়া দিকে। নিঝুম দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেলে সামনে হাঁটতে থাকে শুভ। কিছুদুর গিয়ে একটা ছেলেকে চোখে পড়তেই শুভ ডেকে ওঠে,
–" ঐ রহিম! এইদিকে আয় তো।"
রহিম দৌড়ে আসে।
–" কউ শুভ ভাই!"
শুভ পরনের লুঙ্গি কাছা দিতে দিতে বললো,
–" আমাদের বাড়ি গিয়ে একটা বড় ঝাকা নিয়ে সোজা বড় আমবাগানে আসবি। আজ ঝাকা ভরে আম পাড়তে হবে।"
রহিম ভ্রু কুচকিয়ে বলে,
" এতো আম ক্যান, ভাই?"
শুভ মুচকি হাসে। তারপর আমবাগানের দিকে যেতে যেতে বলে ওঠে,
" মহরানির মন খারাপ হয়ে আছে। ঝাকা ভরা আম নিয়ে তার মনোকষ্ট সরাতে হবে।"
পেছনে রহিম অবাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে। পরে আর বেশি কিছু না ভেবে শুভর আদেশ মতো দৌড় দেয় চৌধুরী বাড়ির দিকে ঝাকা আনার উদ্দেশ্যে।
0 Comments