ভালোবাসি কও| নুজাইফা নূন| পর্ব-২
পরাগ ভাইয়ের মতো ঊনত্রিশ বছর বয়সী, শক্তপোক্ত, গুরুগম্ভীর লোকটা এমন বোকার মত কাজ করবেন, এটা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি।তিনি আমাকে নিয়ে কাজী অফিসে এসেছেন। সাইনবোর্ড কাজী অফিস লেখাটা দেখেই আমার কালঘাম ছুটে যায়।আমি দৌড়ে সেখান থেকে পালাতে গিয়েও পালাতে পারি না।আমার পায়ে যেন শিকল পড়ে যায়।পরাগ ভাই রক্ত চোখ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেন।আমার হাত ধরে গরুর মতো টানতে টানতে কাজী অফিসের ভেতর নিয়ে আসেন।
কাজী অফিসের ভেতরে ঢুকতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার। ঘরটা ছোট, চারপাশে কাগজপত্রের গন্ধ, একপাশে টেবিলের ওপর খাতাপত্র সাজানো। কাঠের চেয়ারে বসে এক গম্ভীর চেহারার কাজী সাহেব কিছু লিখছেন। সেখানে একজন লইয়ারসহ আরো চার জন পুরুষ উপস্থিত ছিলেন।তারা চার জন’ই পরাগ ভাইয়ের বয়সী।হয়তো পরাগ ভাইয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড।
আমাদের দেখে কাজী সাহেব নিজের কলম থামিয়ে খাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে তাকান। নিজের চশমা টা ঠিক করে শান্ত গলায় বলেন,
“ তোমরাই তাহলে বর কনে? দাঁড়িয়ে থেকে কোমর ব্যাথা না করে চেয়ারে বসে পড়ো।”
পরাগ ভাই নির্দ্বিধায় চেয়ারে বসে পড়লেন। কাজী সাহেব আমার দিকে তাকাতেই আমি কাঁপা গলায় বললাম,
“আমার এই বিয়েতে মত নেই।আমি এই বিয়েটা করতে চাই না।”
কাজী সাহেব কপালে চোখ তুলে শান্ত গলায় বলেন,
"বিয়েতে দু’পক্ষের সম্মতি লাগবে ভাই। মেয়েটা যদি না চায়, তাহলে—"
পরাগ ভাই হঠাৎ টেবিলে জোরে একটা হাত রাখলেন।
তার হাতের জোরে টেবিল কেঁপে উঠে।।কাজী সাহেব কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে থেমে যান।বাক্য অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার।আমি শুকনো ঢোঁক গিলে কিছু বলার আগেই পরাগ ভাই আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কাজী অফিসের বাইরে নিয়ে আসেন।আমার চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু মুখে কোনো শব্দ বের হয় না। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে আমার।পরাগ ভাই আমার হাতটা ছেড়ে দেন। বিদ্রুপ কন্ঠে বলেন,
“ তুই খুব ভালো অভিনয় করতে পারিস পাপড়ি। অভিনয়ের জন্য পাপড়ি তুই সেরা রে। কিন্তু তোর অভিনয় দেখার মত সময় বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট চাইছি না আমি।যা বলা হবে তাই করবি।”
আমার অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু ঠোঁট ফুঁড়ে একটা শব্দও বের হয় না।আমি ঠাঁই সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি।পরাগ ভাই কাজী অফিসের ভেতর ঢুকতে গিয়েও ফিরে আসেন।কণ্ঠ হালকা নরম করে বলেন,
“ আমার জন্মের সময় মা খুবই অসুস্থ ছিলেন।মা কে এক হসপিটালে আর আমাকে অন্য হসপিটালে রাখা হয়েছিল।তখন ফুপি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। অবিবাহিত হয়েও একজন মা হয়ে উঠেছিলেন।ফুপি আমার দ্বিতীয় মা।আজ যদি তুই মারা যাস ,হয়তো আমার কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু ফুপির কোল খালি হয়ে যাবে।তার কলিজার টুকরা হারিয়ে যাবে।
আমি চাই না তোর জন্য ফুপি কষ্ট পাক।”
আমি কোনো কথা বাড়িয়ে পরাগ ভাইয়ের পিছুপিছু কাজী অফিসের ভেতর প্রবেশ করি। অনিচ্ছার স্বত্ত্বেও পরাগ ইহতেশাম ইলাহী নামটা আমার নামের সাথে জুড়ে যায়।তবে আমাদের বিয়ের ব্যাপার টা কাজী অফিসে উপস্থিত কয়েকজন লোক ছাড়া একটা কাক পক্ষীও জানতে পারে না।
“সেই রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে আমার।হয়তো ভয়ের চোটে জ্বর এসেছে।বাড়ি শুদ্ধ লোক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।আমার নানু পরাগ ভাই’কে দোষারোপ করেন।বাড়ি ফেরার পর আমাকে আর পরাগ ভাই কে একসাথে দেখে সবাই এমন রিয়্যাক্ট করেছিলেন, যেন তারা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছেন।সবার একটাই প্রশ্ন আমরা দুজনে কোথায় গিয়েছিলাম?
পরাগ ভাই কোন প্রকার ভনিতা ছাড়াই বলেছিলেন তিনি আমাকে মল্লিকপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ দেখানোর জন্য।
নানুর ধারণা সেখান থেকেই আমার উপর বদ জ্বিনের নজর পড়েছে।নানু ছোট মামাকে নির্দেশ দেন হুজুর ডেকে আনার জন্য। কিন্তু বাঁধ সাধি আমি। ভাঙ্গা গলায় বলি,
“ হুজুর, ডাক্তার, কবিরাজ কিছুই লাগবে না আমার।আমি বাড়ি যাব।বাড়ি গেলেই আমি সুস্থ্য হয়ে যাবো।”
আমার কথা কেউ আমলে নিল না।বড় মামা ডক্টর নিয়ে আসলেন, ছোট মামা হুজুর নিয়ে আসলেন।বড় মামী ,ছোট মামী আমার হাত পায়ে তেল মালিশ করে দিতে লাগলেন।
আমার অসুস্থতার কথা পরাগ ভাইয়ের কানে পৌঁছাল। কিন্তু তিনি একবারও আমাকে দেখতে আসার প্রয়োজন মনে করলেন না।কেন জানি ব্যাপার টা আমাকে প্রচন্ড হার্ট করলো। সারারাত ঘুমতে পারলাম না। বিছানায় গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলাম।আমার এই অবস্থা দেখে মা কেঁদে বুক ভাসালেন। তবুও মাগুরা ফিরে যেতে রাজি হলো না।তার কথা অসুস্থ শরীর নিয়ে জার্নি করলে আমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বো।
কিন্তু আমি মায়ের কথা শুনলাম না।সকাল সকাল ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মা'কে ভাঙ্গা গলায় বললাম,
তোমার বাপের বাড়ি তুমি থাকো।আমি আমার বাপের বাড়ি চলে গেলাম।”
আমাকে সবাই আটকানোর চেষ্টা করলো।আমি কারো শাসন, বারণ না শুনে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।একটা রিকশায় চড়ে যশোর বাস টার্মিনাল এসে পৌঁছালাম।আমি রিকশা থেকে নামতেই দেখি মা এসেছে।তবে একা আসে নি। মায়ের সাথে পরাগ ভাইও এসেছেন।তাকে দেখেই আমার মন , মেজাজ দুটোই খারাপ হলো। কিন্তু আম্মুর সামনে সেটা অপ্রকাশিত রইল।
ভেবেছিলাম পরাগ ভাই আম্মু’কে এগিয়ে দিতে এসেছেন।আমরা বাসে উঠলেই তিনি চলে যাবেন।
কিন্তু তিনি আমার ভাবনায় বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমার পাশের সিটে বসলেন।আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।সেখানে বিস্কুট,কেক, জুস,
পানিসহ আরো অনেক কিছু ছিল।
জ্বরের কারণে এমনিতেই মেজাজ খিটখিটে ছিল।
এরপর আবার পরাগ ভাইয়ের জুতা মেরে গরু দান করার ব্যাপার টা মানতে পারলাম না।তার দেওয়া প্যাকেট টা নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
পরাগ ভাই কিছু বললেন না। শুধু রক্ত চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকালেন।আমি সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম।বড্ড মাথা ব্যাথা করছে।ব্রাউনির কথা খুব মনে পড়ছে।ব্রাউনি আমার বিড়ালের নাম।সে বিড়াল হলেও আমার কাছে নিজের সন্তানের মতো।আমি অসুস্থ হলে সে কীভাবে জানি বুঝতে পারে।আমি শুয়ে থাকলে আমার মাথার কাছে এসে বসে থাকে।আমাকে আদর করে, চুমু খায়।তার আদুরে স্পর্শ পেয়ে আমার খারাপ লাগা ফানুস হয়ে উড়ে যায়। কিন্তু আজকে আমার কাছে ব্রাউনি নেই।
পরাগ ভাই বিড়ালের ছায়া মাড়াতেও পছন্দ করেন না। বিড়াল দেখলেই মেরে ধরে তাড়িয়ে দেন।ব্রাউনি কে যদি মেরে ফেলেন এই ভয়ে নানু বাড়ি যাওয়ার সময় ব্রাউনি কে আমার বান্ধবী রুশুর কাছে রেখে গিয়েছিলাম।রুশু আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে থাকে। তাছাড়া রুশু নিজেও বিড়াল পছন্দ করে।ঘন্টায় ঘন্টায় আমাকে আপডেট দিয়েছে।আমি চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম।
মিনিট দশেক পর মনে হলো কেউ আমার মাথা টিপে দিচ্ছে, চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।বড্ড ভালো লাগছিল আমার।সেই মুহূর্তে চোখ খুলতে ইচ্ছে করল না।কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না।
ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ খুলে দেখি আমার মাথাটা পরাগ ভাইয়ের কাঁধে রয়েছে।তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।হয়তো মানবতার খাতিরে তিনি বিরক্তবোধ করলেও মুখে কিছু বলেন নি। কিন্তু তার ভাটার ন্যায় জ্বলতে থাকা চক্ষু দেখে আমি বিনা বাক্যে সরে আসি। মা'কে বলে সিট এক্সচেঞ্জ করে নিই।
ঘন্টা দেড়েক পর বাস এসে ভাইনার মোড়ে থামে।
বাস থেকে নামতেই আমার মাথাটা পুনরায় চক্বর দিয়ে উঠে। চোখের সামনে সবটা যেন ব্লার হয়ে আসে।আমি কয়েক কদম সামনে পা বাড়াতেই হুট করে একটা গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা হাত এসে এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে নিয়ে এসে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।”
0 Comments