এ দহন ভালবাসার| জান্নাতুল ফেরদৌস মমি| পর্ব-২

ভালবাসার গল্প: এ দহন ভালবাসার| জান্নাতুল ফেরদৌস মমি| পর্ব-২

বাবা দেখো লাগছে না আমায় বউ বউ?

গানেম সাহেব মেয়ের কথায় জলভর্তি চোখ নিয়ে হাসলেন।তার মেয়েটার আজ বিয়ে।এইতো সেদিন এতটুকুন ছিল আর আজ তার নিজ বাড়ি থেকে বিদায়ের পালা।যে মেয়েটা সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াতো, এটা ওটা করতো সে আজ অন্যের বাড়ি যাচ্ছে।

পর ঘর,পর ভালোবাসা।এইতো ১৮তে পা দিল।কত বড় কেক কত লোকজন বাড়ি পুরো জমজমাট।আর এখন সে মেয়েই ঘর আঁধার করে চলে যাবে পর বাড়িতে।

- বাবা কাদঁছ তুমি? গানেম সাহেব চোখ মুছে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন।


- আমার মাকে একদম নতুন বউ বউ লাগছে

সন্ধ্যার সময় রোশানের নানা বাড়ির লোকজন এসে গেল। রোশানের দুই মামা আর এক খালা।নানি বেঁচে থাকলেও নানা গত হয়েছে অনেক আগেই।তার মামাতো ভাইবোন তিনটা।বড় মামার বড় মেয়ে তরী তার এক বছরের ছোট।সে হিসেবে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বসুলভ। তরীর ছোট বোন টিনা।ছোট মামার এক ছেলে নীল।খালুর ব্যস্ততার জন্য ওই বাড়ির কেউ আসতে পারে নি।তবে রাহেলা বেগমকে কথা দিয়েছেন সময় করে ঠিক নতুন বউ আর রোশানকে দেখতে আসবে। ওনারা আসতেই মেহমানদারী শুরু করল সবাই।উপরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল রোশান।

না আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।মায়ের সাথে আরেক বার কথা বলা দরকার।তখন তো সে ভাবে কিছুই বলা হয় নি।এবার এইটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে।মায়ের ভুল কোনো সিদ্ধান্তে সে সারাজীবন কাটাতে পারবে না। রোশানের নানী খয়রুন বেগম বুড়ো হলেও এখনও বেশ সুন্দর।যে কেউ দেখলে বলতে পারবে এই বুড়ি যৌবনকালে কারো শখ করে করা জলাধারের পদ্ম ফুল ছিল।না জানি কত জনেরই মাথা ঘুরিয়েছে সে সময়।সে একই রূপ পেয়েছে রাহেলা বেগম।মায়ের মত সেও যেন জলে ভাসা কোনো জলজ ফুল।তাই তো বাহজাত চৌধুরী ট্যুরে গিয়ে তাকে দেখে একেবারে বিয়ে করে বাড়ি ফিরেছে।

মায়ের লাবণ্যতা রোশানের মধ্যে ভরে ভরে আছে। ছেলে মা একে অন্যকে পাল্লা দিয়েছে যেন।বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোশান একজন সুদর্শন পুরুষ হয়ে উঠেছে।বাইরে তো ছাড় এখন ঘরের মেয়েও পাগল তার এই তাক লাগানো সুদর্শনে। বাহজাত চৌধুরী শাশুড়ি ভক্ত।শাশুড়ি বাড়ি এলেই বিড়াল ছানার মতো মিউ মিউ করে ডাকবে,,,,,"আম্মা!"

শাশুড়িও কম কিসে বিড়াল ছানাকে কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বোলাবে।দেখে মনে হবে বিড়াল গিন্নি তার ছেলেকে নিয়ে গুটিশুটি মেরে সুখ দুঃখের কথা বলছে।এই নিয়ে বাড়ির লোকজন কম হাসাহাসি করে না।মা আসে অথচ মেয়ের খবর নেওয়ার আগে মেয়ের জামাইয়ের খবরে মরিয়া হয়ে ওঠে। আজো ব্যতিক্রম হয় নি।এসে নাগাদ কাপাকাপা গলায় বাজাত বাজাত করেই যাচ্ছে। বাহজাত মনে হয় তার মুখের উচ্চারণের জন্য কঠিনই লাগে।তাই যা পারে সেই নামেই ডাকে।

বাহজাত চৌধুরী ছুটে এসে সালাম জানালেন।বয়স বাড়ছে তাই কণ্ঠটাও এখন কথা বলতে কাপে।

- মুখডা ওমন শুকনা লাগতাছে ক্যান? খাওন দাওন ঠিক মতন কর না? ও রাহেলা জামাইয়ের খেতমত করস না ঠিক মতন।শুকাইয়া হাড্ডি সব বাড়ায়ছে।

ড্রয়িং রুমের সবাই এক যোগে হেসে উঠল।এই হলো শুরু যাওয়ার সময় পর্যন্ত বলতে থাকবে ও রাহেলা জামাইয়ের জন্য এডা করস নাই ওইডা করস নাই। তরী ঝাপটে ধরে রাহেলা বেগমকে রোশানের কথা জিজ্ঞেস করে।সেও কাজে ব্যস্ত থাকায় ছেলেকে অনেকক্ষণ যাবত দেখে নি। আশপাশ ফিরে উপরে চোখ পড়লেই দেখে রোশান চুপ চাপ তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাহেলা বেগম যেন ছেলের নীরব করে থাকার মানে বুঝল। তরীকে বসতে বলে উপরে ছেলের কাছে গেলেন।ছেলের হাত ধরে বললেন,,,,,,

- আয় আমার সাথে।

রোশান কোনো কথা না বলে মায়ের সাথেই যেতে লাগল।

- কাজে ব্যস্ত হয়ে ভুলেই বসেছিলাম যার বিয়ে তাকেই তো এখনও বিয়ের জন্যে পরিধানের কাপড় দেই নি।

কাভার্ড খুলতে খুলতে কথাটা বলে হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে রোশানের সামনে ধরলেন।

- এখনও টি শার্ট আর টাউজার পড়ে ঘুরবি।যা এটা পরে নে।

রাহেলা বেগম বুঝতেই পারছেন তার ছেলে তাকে কিছু বলবে।এবং কি বিষয়ে কথা বলবে তা তার জানাও।তাই সে ছেলেকে কথা বলার সুযোগ দিবেন না।শুধু নিজেই বলে যাবেন। করছেনও তাই।

রোশান কথা বলার জন্য হা করতেই এটা ওটা বলছেন।যেন রোশান কিছু বলতেই চায় না।কিন্তু ছেলের ধৈর্যের কাছে একসময় হার মানতে হলো তাকে।ছেলে তার ধৈর্য্য নিয়ে মায়ের সব কথা শুনে গেল।নিজের কথা বলার অপেক্ষা করল। আর শেষে সুযোগ পেয়েও গেল।

-দেখ মা তখন আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।কারণ তুমি কথা বলেই খালাস।আমার কথা শোনার বা আমাকে বলার সময় না দিয়েই বাইরে গেলে।কিন্তু এখন আমার কিছু বলার আছে।

রাহেলা বেগম জানে কি বলার আছে তার ছেলের। তারপরও সে কিছু হাতের কাজ করতে করতে অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন,,,,,,,

- বল।

রোশান দুইহাত বুকে ভাঁজ করে আছে।

- আমি এই বিয়েটা করবো না মা।রাহেলা বেগম যেন আশায় করেছিলেন ছেলে এরকমই কিছু বলবে।সে দিব্যি তখনও কাজ করছে।

-মা!

রোশানের কন্ঠে অধৈর্য্যটা।

-জানি না কার সাথে বিয়ে? কে সে? আদৌও আমাদের কোনো কিছু মিলবে কিনা?জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত আমি এভাবে নিতে চাই না।

রাহেলা বেগম এবার কাজ করা হাতটা থামলেন।

-এভাবে নিতে চাস না মানে?মেয়ে পছন্দ হবে কি না এই নিয়ে সমস্যা নাকি অন্য কিছু?খোলাখুলি ভাবে বল আমায়।আমিও না হয় দেখব আমার হীরের টুকরো ছেলের জন্য আমি ভুল করে তামা নিয়ে এলাম নাকি।

মায়ের কন্ঠে বিরক্ততা ঝরে পড়ছে।যেন সে বুঝাতে চাচ্ছেন বিয়ে করতে বলেছি করবে এতো প্রশ্ন কিসের।

মা আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। সবে দেশে ফিরেছি।বিজনেসে মনোযোগ দিতে চাই।

- এটাই তোমার শেষ কথা?

রোশানও বেশ দৃঢ় ভাবে উত্তর দিল,,,,,,,

- হ্যাঁ।

রাহেলা বেগম শান্ত।বোঝা যাচ্ছে না উনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে কিনা। রোশান কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রাহেলা বেগম তার হাত ধরলেন। টেনে দরজার দিকে নিয়ে গেলেন। রোশানকে দরজার বাইরে দাড় করিয়ে বললেন,,,,,,,,

- সিদ্ধান্তের বদল ঘটলে এই ঘরে পা রাখবে।অন্যথায় তুমি আমার মুখটা না দেখলে খুশি হবো।

সজোরে দরজা লাগিয়ে দিলেন রাহেলা বেগম।নিচে বসা প্রতিটা মানুষও তাকাল।কি হলো কেউ বুঝতে পারছে না।রোশান স্থির হয়ে দরজার পানে দৃষ্টি দিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।কি বলল তার মা।মায়ের মুখে নিজের তুমি সম্বোধন শুনে বুঝে গেল মায়ের রাগের মাত্রা। বুঝে গেল মা যখন বলেছে মুখ না দেখার কথা তখন উনি ঠিক তাই করবেন।

রোশান মায়ের দরজায় আর কড়াঘাত করার সাহস পেল না।মাকে সে ভীষন ভালোবাসে। আজ অব্দি এমন হয় নি যে রাহেলা বেগম কিছু বলেছে আর রোশান তা করে নি।

ড্রয়িং রুমের সব মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।এইতো সব ঠিক ছিল।তাহলে রাহেলার এমন কি হলো যে দরজা এটে ঘরে বসে আছে। বাহজাত সাহেব উঠে স্ত্রীর ঘরের দিকে গেলেন।দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন,,,,,,

- রাহেলা!

ওপর পাশ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার ডাকলেন,,,,,,,

- রাহেলা! দরজা খোলো।

ভিতরে রাহেলা বেগম কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল।সেটা বুঝতে পারল বাহজাত সাহেব।অপেক্ষা করলেন কথা শেষ হওয়ার।কথা শেষ হলে বাহজাত সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,,,,,,,

- দরজা তখনই খুলবো যখন এই বাড়িতে আমার সিদ্ধান্তের কোনো মূল্যায়ন হবে।

বাহজাত সাহেবের বুঝতে বাকি রইল না রোশান তার মায়ের সিদ্ধান্ত কে নাকচ করেছে তাই তার এমন রাগ।তার স্ত্রীর জেদের কাছে সে বারংবার হেরেছেন। আজ দেখার পালা ছেলেকে নিজের জেদে হারাতে পারে কিনা।

রওশান ঘরে চিন্তিত ভাবে বসে আছে।একদিকে মায়ের কথা ভাবছে অন্যদিকে রাহার কথা।দুইজনেই সমান তালে জেদি।কেউ কারো কথা ফিরিয়ে নেবে না এটা তার জানা। রাহা যদি সত্যিই কিছু করে বসে তখন।সে তো মাকেও কিছু বলতে পারছে না এই নিয়ে।

উঠে দাড়াল রোশান।আবার মায়ের ঘরের সামনে গেল। দরজায় পর পর শব্দ হলেও রাহেলা বেগম কোনো কথা বলল না।তার জানা ছিল তার ছেলে আসবেই।তার কথা মানবেও। আর যখন জানবে আমি তাকে জীবনের সব থেকে বড় উপহারটা দিলাম তখন চমকাবে সে।

মায়ের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ কেন করতে চায় নি তা নিয়ে বেশ বিরক্তও হবে নিজের প্রতি।কথাগুলো ভেবে মিটিমিটি করে হাসলেন রাহেলা বেগম।

আবার দরজার শব্দ সাথে মা ডাক শুনে।হাসি লুকিয়ে কঠিন ভাবে বলে উঠলেন,,,,,,,

-রাদাত কেউ যেন আর দরজায় শব্দ না করে।আমি কারো সাথে কথা বলতে চাইছি না।

আশেপাশে কোথাও রাদাত নেই।তার মা ইচ্ছে করেই রাদাতের নাম নিয়ে তাকে কথাগুলো শোনাল।দরজা খুলবে না জেনেও আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল রোশান।

হঠাৎ রাহেলা বেগমের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের শব্দ এল।তিনি ফোন হাতে নিয়ে ছবিটা দেখে হাসলেন সাথে সাথে উচ্চারণও করলেন মাশাআল্লাহ,মাশাআল্লাহ।

এতক্ষণ যাবত রোশানের নানাবাড়ির মানুষ এলেও রাহার সাথে দেখা হয় নি কারো।সে নিজের ঘরে চোখের জল ফেলতে ব্যস্ত ছিল।নিচে থেকে আসা সবার হাসাহাসি,কথাবার্তা শুনে ফ্রেশ হয়ে নিচে এল সে।

তাকে দেখেই তরী দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল।আদুরে গলায় বলল,,,,,,,,

- কতদিন পর তোকে দেখলাম।কেমন আছিস?

হাসার চেষ্টা করল রাহা।

ভালো আপু তুমি কেমন আছো?রাহার ধীর স্থির কথা বলার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল তরী।রাহার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে সে নিজেই প্রশ্ন করল,,,,,,,

-কি হয়েছে তোর?

রাহা নিজের চোখ লুকানোর জন্যে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,,,

- কই কিছু না তো।

রাহার থুতনি ধরে উপরে তুলল তরী।

- দেখি তাকা আমার দিকে।চোখ মুখ এমন ফোলা ফোলা লাগছে কেন? 

রাহা হেসে দিল।

- তুমিও না আপু ঘুমিয়েছিলাম তাই এমন লাগছে। চলো সবার সাথে কথা বলে আসি।

তরী হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকালো। রাহা রোশানের মামা মামী,নানি সবার উদ্দেশ্যে সালাম জানাল।তারাও হেসে উত্তর নিল।কেমন আছে পড়াশোনা কেমন করছে এসব টুকিটাকি কথাও জিজ্ঞেস করল।

রাহার পাশে বসা তরী তখন থেকেই ভাবনায় ডুবে আছে।রাহার মতো চঞ্চল সারাক্ষণ নেচে ধেয়ে বেড়ানো মেয়ে আজকে শান্তভাবে আছে।ক্ষণে ক্ষণে সন্দেহ বাড়ছে তার।কিছু একটা ব্যাপার তো অবশ্যই আছে।

শান্তিনিবাস ভিলায় যেন পূর্ণিমা রাত। অবশ্য প্রকৃতিতেও আজ অমাবস্যা না।পূর্ণিমা রাতেও এই বাড়ির বাড়তি ঝলমল করা আলোতে আরও সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ছে।প্রতিটা বিয়ে বাড়িতে বরের গাড়ি আসলে যেমন হৈচৈ পড়ে যায় এই বাড়িতে হচ্ছে তার ঠিক উল্টোটা। বউই উল্টে বরের বাড়ি আসছে।

বউয়ের গাড়ি আসতেই রায়াত,রায়ান আর টিনাসহ কয়েকজন হৈচৈ বাঁধিয়ে দিল।সন্ধ্যার শীতল পরিবেশ কিছু মানুষের আগমনেই যেন ভার হয়ে উঠেছে।বিয়েটা পারিবারিকভাবেই ছোট করে করা হচ্ছে।খুব বেশি আত্মীয়স্বজন নেই।

রোশানের নানা বাড়ির লোকজন,তাদের কোম্পানির কিছু লোক আর আশেপাশের কিছু লোকজন।তাতেই পরিবেশ বেশ গমগমে।বাইরের চিল্লাচিল্লিতে ড্রয়িং রুমের সবাইও জানল বউ আসার খবর।সেই বাড়ি থেকেও তেমন কেউ আসে নি।মেয়ের বাবা,চাচা,এক বান্ধবী, আপন কিছু মানুষ।ব্যাস এই কজন ব্যতীত আর কেউ নেই।

বাড়ির জাঁকজমকতা দেখতে ঘটা করে করা বিয়ে বাড়ি মনে হলেও ভিতরে তা নয়। রোশানের নানি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ায় সেই বউকে গাড়ি থেকে নামাল। বউ এতক্ষণ পার্লারে ছিল।সেখান থেকেই এই বাড়িতে এসেছে।

বউ এসেছে খবরটা রাহেলা বেগম ঘরে বসেই পেলেন।বন্ধ দরজা খুলে হাটা ধরলেন ছেলের ঘরের দিকে।দরজায় শব্দ করার আগেই রোশান দরজা খুলে বের হয়ে এলো।গায়ে জড়িয়েছে গোল্ডেন কালার শেরওয়ানি,মাথায় গোল্ডেন পাগড়ি আর পায়ে গোল্ডেন নাগরা জুতা।

রাহেলা বেগম ছেলেকে দেখে হাসলেন।

-কারো নজর না লেগে যায় আমার রাজপুত্রের।

নিচে থেকে সব দেখছেন বাহজাত সাহেব।সে হা করে ওপরেই তাকিয়ে।কি চমৎকার করল রাহেলা।তার ছেলেও তার জেদের কাছে হার স্বীকার করল।মনে মনে বউয়ের প্রশংসা না করে পারল মা।মন তো চাইছে তার ছুটে গিয়ে বউকে কোলে তুলে নাচতে।

কিন্তু এই বুড়ো বয়সে এসব মানায় না।ভিমরুতি ধরেছে বলবে সবাই। তাছাড়াও বাড়ির ছোটদের সামনে এসব করা মানে নিজে জেনে বুঝে লজ্জার দরজা পার করা।চারপাশে সমাগম উঠবে বাহজাত সাহেবের বুড়ো বয়সে বউয়ের সাথে নাচতে ইচ্ছে করছে।এর থেকে ওর কানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এলাকা ছারখার হয়ে যাবে।সে তো বিরাট কান্ড!

ড্রয়িং রুমে শুধু তিনজন আছে বাহজাত সাহেব,তরী আর রাহা।তরী বউয়ের গাড়ির কাছেই যেত কিন্তু পাশে দাঁড়ানো রাহার কোনো উৎফুল্ল না দেখে সেও আর যায় নি। আর বাহজাত সাহেব স্ত্রীর জন্য এখনও নিচে অপেক্ষমাণ আছে।

বাহজাত সাহেবের দৃষ্টি অনুসরণ করে তরী আর রাহাও ওপরে তাকায়। রোশানকে বরের বেশে দেখে রাহার মনে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতসহ ভয়ানক তাণ্ডব শুরু হয়।বুকের ভিতরে সব দুমড়ে মুচড়ে আসে।রোশান ভাই সত্যি বিয়ে করছে। শেরওয়ানিতে আরও দারুন লাগছে তাকে।তার দিকে অগ্রসর হওয়া সুদর্শন পুরুষটি তার নয় ভাবতেই হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হচ্ছে।

এতো দিনের পোষা ভালোবাসার মূল্য নেই যার কাছে তার কাছে ৩ মিলিয়নের হার্টের ভাঙ্গাচুরাতে কি যায় আসবে?তার হৃদয় ভাঙ্গার আওয়াজ কি ওই পাষণ্ড পুরুষ শুনতে পারছে।বুঝতে পারছে এই অষ্টাদশীর মনের গহীনে তার জন্যে জমিয়ে রাখা এক এক মুহূর্তের ভালোবাসা?

না,পারছে না।যদি পারতো তবে সে বর সেজে অষ্টাদশীর মনে তোলপাল তুলে মাঝ সমুদ্রে ফেলে যেত না।অবশ্য তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ারও তো কথা ছিল না কারণ অষ্টাদশী নিজেই তো সাতার না জেনে ঝাঁপ দিয়েছিল ওই সমুদ্রে।

নিচে এসে রাহার দিকে চোখ পড়ল রোশানের।দুজনের দৃষ্টি মিলে গেলে তড়িৎ গতিতে রোশান নজর সরিয়ে নিল।অথচ রাহা এখনও তাকিয়ে ওই পাষণ্ড পুরুষের দিকে।যাকে সে শখ করে মন দিয়ে বসেছে।তার এই ছোট্ট মনে যাকে নিয়ে হাজার জল্পনা কল্পনা করেছে।

- যাক অন্তত মায়ের কথা তো মেনে নিলে।

বাহজাত সাহেবের কথায় দৃষ্টি সরায় রাহা।পাশে তরী তার দিকে সন্দিহান হয়ে চেয়ে আছে।হয়তো তার চোখ কি বলছে তা পড়ার চেষ্টা করছে।কি মুশকিল যাকে চোখের ভাষা পড়াতে চায় সে চেয়েও দেখে না।আরেকজন পড়ার চেষ্টায় আছে।

রাদাত অতিথি আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে।পরনে সাদা শার্ট ভিজে শরীরে লেপ্টে আছে।কপাল বিয়ে ঘাম ঝড়ছে।বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ঘাম ঝেড়ে ফেলছে কপাল থেকে।একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা যদিও ছোট করেই সব হচ্ছে তারপরও সে চায় সবটা যেন ঠিকঠাক মতো হয়।কোনো কমতি যেন না থাকে।তাই নিজেও কাজে শামিল হয়েছে।

অথচ এই ছেলেকে দিয়ে অন্য কোনোদিন হাজার খানেক কথা শুনিয়েও কাজ করানো যায় নি।ভাইয়ের বিয়েতে ব্যস্ত হাতে সব কাজ যেন নিজে করতে চাইছে।

রোশানকে নিয়ে বিয়ের মঞ্চে যাচ্ছে রায়াত আর রায়ান।নিয়ে গিয়ে বসিয়েছে বউয়ের বিপরীত পাশে ফুলের পর্দার আড়ালে।দুইজন মুখোমুখি কিন্তু মাঝ বরাবর দুলছে হাসনাহেনা,রজনীগন্ধা আর লাল গোলাপের পর্দা।তাই যথার্থই কেউ কারও মুখ দেখতে পারছে না।রোশান মনে মনে ভীষন দুর্বল।মায়ের কথা রাখতে না জানি সে ঠিক করতে চলেছে নাকি ভুল করতে।

বাড়ির সবাই বাইরে বাগানের সাইডে।কারণ সেখানেই বিয়ের মঞ্চ করা হয়েছে।রোশান যাওয়ার পর রাহেলা বেগম আর বাহজাত সাহেব ঘরে নিজেদের আলাপ চারিতা করছে।কিন্তু ড্রয়িং রুমে এখনও দুইজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। তরীর দৃষ্টি রাহার ওপর থাকলেও রাহা দৃষ্টি কোথায় তা বোঝা যাচ্ছে না।

নিরবতা ভেঙ্গে তরীই প্রশ্ন করে,,,,,,,,

- রাহা বাইরে যাবি না?ওখানে হয়তো এখন রোশান আর ভাবির বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে।

রোশানের বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে এই একটা কথায় রাহার মনে কাপাকাপি ধরানোর জন্য যথেষ্ট।সবকিছু ঘোর লাগছে তার।মনে হচ্ছে ঘোর কেটে গেলে সে শুনতে পাবে রোশান তাকে বলছে,,,,,,,

- বিয়েটা করতে পারলাম না রাহা।তোকে না চাইতেও ভালোবেসে ফেললাম।এখন বল তোকে ছেড়ে অন্য একটা মেয়েকে কি করে বিয়ে করতে পারি আমি।

রোশানের কথায় খুশিতে চোখে পানি চলে আসবে রাহার। রোশানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে সেও বলবে,,,,,,

- মামনি যে আপনায় এই বিয়েটা করতে বলেছে আপনি মামনির বিরুদ্ধে গিয়ে আমার হতে পারবেন?

রোশান নিজের বুক থেকে রাহার মাথা তুলবে না।আদুরে ভাবে মাথায় হাত বোলাবে।

ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।মায়ের কথায় তোর আর আমার ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দিতে পারিনি তাই বিয়েটা ভেঙ্গে দিলাম। মাও বুঝে যাবে আমাদের।

কিন্তু এরকম কিছু হওয়ার নয়।মানুষসহ প্রকৃতিও হয়তো তার বিপক্ষে।সে একা কি করে চাইতে পারে তার রোশান ভাইকে।

না,সে চাইতেই পারে।কিন্তু একা চাওয়াতেই কি পাওয়া যায়?নাকি একপক্ষিকভাবে চাওয়া মানুষগুলো দিন শেষে একাই থেকে যায়? উত্তর এখনও জানা নেই তার।

সব উত্তর কি মিলতেই হবে তা তো নয়।কিছু উত্তর সময়ের ওপরও ছাড়া দরকার।সময় কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর বেশ ভালোভাবে দিয়ে দেয়।তার প্রশ্নের উত্তরও হয়তো সময়ের সাথে মিলবে।

- রাহা কি ভাবছিস এতো?

নিজের হাতে হালকা ধাক্কা আর তরীর কথায় স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার চেষ্টা চালায় রাহা।কিন্তু সে পারছে কই।গলা ধরে আসছে তার।না এভাবে সবাইকে বুঝতে দিলে চলবে না।

মনে মনে কথাটা ভেবেই ঢোক গিলে হেসে বলে,,,,,,

- কই আপু কিছু ভাবছি না তো।

- তাহলে চল বিয়ে তো শেষ হয়ে যাবে।

মুখে হাসি রেখেই বলে রাহা,,,,,,

তুমি যাও আপু আমি আসছি।

তরীও আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।তরী চলে যেতেই  রাহার অশ্রু বিন্দু বিন্দু হয়ে কপোল বেয়ে পড়তে লাগল। 

হায় অষ্টাদশী মানুষ ভালবাসি বলতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে থাকে আর সে কি না ভালোবাসি বলেও ভালোবাসা পেল না। আর কিভাবে বুঝালে ওই নিষ্ঠুর পুরুষ মানুষটি বুঝত তার এই ছোট্ট মনের গভীর ভালোবাসা?

রোশান যাওয়ার আগেই বউকে কবুল পড়ানো হয়েছিল।এবার শুধু রোশানের পালা।কাজিকে সাধারণত মেয়ের বেলায় নার্ভাসনেসের জন্য দেরি করতে হয়।কিন্তু এখানে সবাই এতো করে বলার পরও রোশানের মুখ দিয়ে ওই ছোট শব্দটিই বের হচ্ছে না। খয়রুন বেগম মিটিমিটি হেসে বললেন,,,,,,,,

ও রোশান বউ সব ছেড়ে ছুড়ে তোর কাছে আইবো তুই তো যাইবি না।কিসের ভয়ে ওমন মুখে কুলুপ এঁটে রাখছিস।কবুল কস না ক্যান?নাকি আমার মত সুন্দরী বুড়ির সামনে ওই ছুরিরে মনে ধরতেছে না।

খয়রুন বেগমের কথায় হাসির রোল পড়ে গেল। রোশান ও লজ্জায় পড়ে তৎক্ষণাৎ কবুল বলে দিল।হয়ে গেল এক অচেনা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সবথেকে কাছের সম্পর্ক।যাকে একসময় চিনতো না সেই হয়ে গেল সবচেয়ে আপন।যার মুখ এখনও দেখা হয় নি সেই মুখখানিই সারাজীবনের জন্য একে অপরের হাসি,কান্না, সুখ, দুঃখের প্রতিচ্ছবি।

অদূরে দাঁড়িয়ে রোশানের কবুল বলার সময়টা দেখল রাহা।তার এতো যত্নে লালিত ভালোবাসা তার আর থাকল না।কিছু সময়ের ব্যবধানে আরেকজন এসে নিয়ে গেল।তার কাছে পড়ে থাকল শুধু শূন্যতায় শূন্য ভগ্ন হৃদয়।সে আজ থেকে অন্য কারো।অন্য কারো হাসির কারণ,অন্য কারো অভিমান ভাঙানোর কারিগর ।তার হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো?

এতক্ষণের হাসি খুশি পরিবেশ হঠাৎই থেমে গেছে।এখন কান্নার রোল পড়েছে শান্তিনিবাসে।বিয়ের পর্ব মিটিয়ে গেছে সবে মঞ্চ ত্যাগ করেনি কেউ তার মধ্যেই অঘটন ঘটে গেছে।রাহার কাজে রোশান নির্বাক মেয়েটা যা বলল করল ও তাই।এতো হালকাভাবে নেওয়া তবে কি তার ঠিক হয় নি?

একটু আগে সূচনা বেগম রাহাকে না পেয়ে রায়াতকে পাঠায় ডাকতে। রাহা আর তরী যেন নতুন বউকে ঘরে নিয়ে যায়। রাহার ঘর থেকে রায়াতের চিৎকার শুনে রাহেলা বেগম আর বাহজাত সাহেব ঘর ছেড়ে দৌড়ে  বেরিয়ে আসেন। রায়াত চিৎকার করতে করতেই বাইরে যায়।তার চিৎকার করে কান্নার আওয়াজে সবার হাসি মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

সবাই জিজ্ঞেস করছে কিন্তু সে কোনো উত্তর দিচ্ছে না।সমানে রায়াত রাহা আপু রাহা আপু বলে কাদঁছে।কান্নার বেগে কোনো কথা বের হচ্ছে না তার গলা দিয়ে।তবে খারাপ কিছু যে হয়েছে তা ঢের বুঝতে পারছে সবাই।

নতুন বউ রেখেই রোশান হন্তদন্ত হয়ে ছুট লাগাল।তার পিছে পিছে বাড়ির বাকিরাও যেতে লাগলো।তরী নতুন বউকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। রোশানের রুমে বসিয়ে দিল তাকে।

-ভাবি আপনার কিছু লাগলে আমায় বলবেন।কোনো সংকোচ করবেন না।আমি দেখে আসছি কি হয়েছে।

ঘোমটার আড়াল থেকে শুধু ছোট করে মাথা নাড়ল।মুখে কোনো উত্তর দিল না।

তরী রাহার ঘরে ঢুকে দেখল ফ্লোরে রক্ত,রাহার হাত বেয়ে এখনও রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।পাশে পড়ে আছে ধারালো ব্লেড।যা দিয়ে সে হাত কেটেছে।ফর্সা বর্ণের মুখটা এইটুকু সময়েই পাংশু দেখাচ্ছে।

সূচনা বেগম মেয়ের পায়ের কাছে বসে বার বার ডাকছে আর কাদঁছে।রাহার মাথা রোশানের কোলে।সেও বার কয়েক ডাকলো। কোনো সাড়া না পেয়ে মুখে পানির ছিটাও দিল।কিন্তু রাহা চোখ খুলছে না। রাহাকে কোলে তুলে নিল রোশান।

- চাচী আপনি শান্ত হন রাহার কিছু হবে না।ওকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে।

সূচনা বেগমও রোশানের পিছু পিছু যাচ্ছে।বাইরে গিয়ে ড্রাইভার খলিলকে গাড়ি বের করতে বলে রোশান।গাড়িতে উঠে রাহার মাথা নিজের কোলে রাখতে নিলে বাহজাত সাহেব আটকে দেন।

- যার জন্য এই অবস্থা আমি চাই না তার কোলে মাথা রেখে আমার মেয়ে যাক।

রোশান কিছু বলার সুযোগ পেল না তার আগেই বাহজাত সাহেব রাহার মাথা নিজের কোলে নিয়ে নিলেন।

- নেমে যাও তোমার এখানে প্রয়োজন নেই।

এমন সময়ে বাবার এমন আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রোশান।

- আমি জানি আমি তোমার কাছে অপরাধী বাবা।কিন্তু এখন রাহার সুস্থতা আমাদের প্রয়োজন।

- আমাদের উচ্চারণ করো না বলো তোমাদের প্রয়োজন।রাহার সুস্থতা তুমি কামনা করতে পারো না।

রোশান বাবার রুষ্ঠতা বুঝল।

ভাই হিসেবে আমিও ওর সুস্থতা চাই।কথাটুকু বলে গাড়ির দরজা লাগাতে নিলে বাহজাত সাহেব কর্কশভাবে বলে উঠলেন,,,,,,,

জনসম্মুখে যখন দরদ দেখাবেই তবে দূর থেকেই দেখাও সামনে ড্রাইভারের পাশে জায়গা আছে ওখানে যেতে পারো অন্যথায় তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।

রোশান কথা বাড়ায়নি।এখন ছেলে আর বাবার জেদাজেদি করার সময় নয়।দ্রুত নামলো রোশান। সূচনা বেগম তখনই কাদতে কাদতে গাড়ির কাছে এলেন।তরী তাকে ধরে রেখেছে।

- আমিও যাবো বাবা আমায় নিয়ে চল।মায়ের মন মেয়েকে এভাবে দেখে শান্ত থাকা সম্ভব না। রোশানও তাই আর না করেনি।তরীকে বাড়ির সবার ওপর খেয়াল রাখার কথা বলে গাড়িতে বসে পড়ে।


তরী রোশানের ঘরে গিয়ে দেখে নতুন বউ এখনও ঘোমটা টেনে ওইভাবেই বসে আছে।তরী পাশে বসে কথা বলতে থাকে।নতুন বাড়ি নতুন সব মানুষজন সে নতুন বউ হয়ে এসেছে কথা বললে হয়তো কিছুটা স্বাভাবিক লাগবে।তাদের কথা বলার মধ্যেই ঘরে ঢোকেন খয়রুন বেগম আর রাহেলা বেগম।

রাহেলা বেগম হাসপাতালে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সবাই তাকে বাধা দেয়।নতুন বউ রেখে শাশুড়ি হয়ে রেখে যাওয়াটা ঠিক নয় তার। তাই সবার কথায় সেও আর যায়নি।তবে মন ঠিকই পড়ে আছে সেখানে।মেয়েটার কি হবে,জ্ঞান ফিরবে কখন,তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে তো এসব কথা মনে খচ খচ করছে তার।

খয়রুন বেগমকে দেখে তরী উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বসতে দেয়।সে বসে নতুন বউয়ের নাম জিজ্ঞেস করে।

- ও নাতবউ নাম কি তোর?ঘোমটার আড়াল থেকে খুব আস্তে করে উত্তর দেয় ফাওজিয়া ফারিন ।

- তা ঘোমটাটা খোল তোর মুখখানা দেখি।

ফারিন খয়রুন বেগমের কথায় মুখ থেকে ঘোমটা সরায়।শ্যামবর্ণের হলেও নিঃসন্দেহে এই মেয়েকে মায়াবতী বলা যায়।খয়রুন বেগম কপালে চুমু খেলেন।হাতে ৫ হাজার টাকা দিলেন।নাতবউয়ের মুখ কি আর এমনি এমনি দেখা যায়।

- নাতবউ তোর বাপের বাড়ি কোন খানে?আমার মাইয়া এমনে হঠাৎই বিয়া ঠিক করছে যে তোর সমন্ধে আমাগো কিছুই জানা নাই।


ফারিন উত্তর দিল,,,,,,,

- বীরপুর গ্রামে।নাম শুনে চমকাল তরী।এই মেয়ের নাম শুনে অবাক হয়েছিল সে। এক নাম তো কত মানুষেরই থাকতে পারে তাই সে কিছু ভাবে নি কিন্তু সেই বীরপুরেরই মেয়ে তাহলে কি এই মেয়েই সে মেয়ে।ভাবতেই হাসি ফুটল মুখে। সত্যিই যেন তাই হয়।

কিন্তু ফুপি একে কোথায় পেল?কত খুঁজেও একজন একে বের করতে পারল না আর ফুপি হুট করে পেয়ে গেল।এটা কিভাবে সম্ভব। সে অবাক চোখে একবার রাহেলা বেগমের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ফারিনের দিকে। এই ফারিন সম্পর্কে কত কথা শুনেছে সে।যদিও সেসব ফারিনের ছোটবেলার কাহিনী।তারও হয়তো সেসব মনে আছে। দেখার ভীষন ইচ্ছেও ছিল তাকে।ফারিন বয়সে তার ছোট হলেও সম্পর্কে বড় হয়ে গেল।

খয়রুন বেগম গ্রামের মেয়ে শুনে বোধহয় খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না। তৎক্ষণাৎই সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন।রাহেলা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,,,,,,

- রাহেলা চল তোর সাথে আমার  কথা আছে।

ঘরে গিয়েই খয়রুন বেগম নিজের রাগ বের করলেন।

- আমার রোশান বিদ্যাশ থাইকা আইছে কিনা এরকম গেরামের মাইয়া বিয়ে করার লাইগা।এই বিয়া আমি মানি না।আমার বিদ্যাশ ফেরত নাতির গলায় এমন মাইয়া ঝুলাইলি ক্যান?

রাহেলা বেগম মায়ের কথায় অবাক।গ্রামের মেয়ে তো কি হয়েছে।তার মা এ কিরকম কথা বলছে।গ্রামের মেয়েরা সহজ সরল টাইপের হয়।সংসারটা মূলত বোকাদের সাথেই হয়।দুজনেই সমান তালে চতুর হলে সংসারের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে যায়।

মা তুমি কি করে বলতে পারো যে এই বিয়ে মানো না। সবে বিয়ে শেষ হলো।অতিথি আপ্যায়নও এখনও শেষ হয়নি তার আগেই এমন কথা বলছো।দ্বিতীয়বার এ কথা মুখে আনবে না।আমার ছেলের সুখের সন্ধান দিতে পেরেছি আমি এর চেয়ে আর কি পাওয়ার থাকতে পারে বলো মা?

খয়রুন বেগম পান চিবোতে চিবোতেই উত্তর দিলেন।

রোশান তো এই মাইয়ার মুখই দেখে নাই এখন পর্যন্ত। ওর এতে সুক আছে না দুক আছে তা কেমনে বুঝবি তুই?মা হইয়া শেষ পর্যন্ত ছেলের হাতে অপাত্রী তুলে দিলি?

মা ছেলে আমার আমায় ভাবতে দাও।ওর কিসে ভালো কিসে খারাপ তা আমি বুঝি।

রাহেলা বেগমের কথায় খয়রুন বেগমের অন্তরে ঘা হলো।তার ছেলে বলে নানি হিসেবে সে কিছু যদি বলতেই না পারে তাহলে এই বাড়ি ডাকতে গেল কেন?মায়ের ছেলে বলে কি আর সবাই তার ভালো চাইবে না। খারাপই বা চাইবে কেন?

রাহেলা তুই আমায় এ কথা কইতে পারলি?আমি রোশানের খারাপ চাইবো নাকি? তোর ছেলে বইলা কি আমি কোনো সিদ্ধান্তে থাকতে পারমু না?

খয়রুন বেগমের কাপা কন্ঠ আর কাপছে।তবে এই কাপা বৃদ্ধা হওয়ার জন্যে নয়।বরং মেয়ের কথায় কষ্ট কান্না পাওয়ায় কাপছে।রাহেলা বেগম নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।ওতো ভেবে তখন সে বলে নি কথাটা।কিন্তু কথাটা সত্যিই কষ্ট পাওয়ার মতো করেই সে বলেছে।বৃদ্ধা মাকে সে জেনে বুঝেই কষ্ট দিল।এখন ক্ষমা চাইবে কোন মুখে?

খয়রুন বেগম ইতোমধ্যে খাটে বসে গুনগুনিয়ে কান্নার সুর তুলেছেন।চোখের পানির সাথে মুখের পানে পিকও গড়িয়ে পড়ছে।রাহেলা বেগম মায়ের পাশে বসে মায়ের মুখে গড়ানো পানের পিক আর চোখের পানি মুছে দিলেন।

মা তোমার নাতি ওই গ্রামের মেয়েটার সাথেই ভালো থাকবে।মায়ের মন যা বলে তাই নাকি সত্যি হয় তাহলে আমার মনের বলা কথাটাও তো সত্যিই হবে তাই না মা?তুমি দোয়া করো তোমার মেয়ের নেওয়া সিদ্ধান্তে যেন কোনো ভুল না হয়।তোমার দোয়াটাই যে আমার কাছে সবচেয়ে বড়।

খয়রুন বেগম মেয়ের গালে হাত রাখলেন।

তোর আর রোশানের জন্যে দোয়া আমার থাইকা চাওয়া লাগবো আবার?তুই ছোট থাইকাই সব সামলান শিখছস তোর দ্বারা কোনো ভুল হইবো না এই বিশ্বাস আমার আছে।

মা মেয়ের মুহূর্তেই মন কষাকষি হলো আবার মুহূর্তেই তা ঠিক হয়ে গেল।

বাহাদ সাহেব আর রাদাত বিয়ে শেষে কোনো কাজে বাড়ির বাইরে ছিল তাই তারা দুজনেই রাহার ব্যাপারে জানত না। রোশানের ফোন পেয়ে তৎক্ষণাৎই দুইজনে হাসপাতালে গেছে। বাহাদ সাহেব গিয়েই ধপ করে সূচনার পাশে বসে পড়েছেন। স্বামীকে পেয়ে যেন আরও কান্নারা বাঁধনহারা হয়েছে তার।ভরসার মানুষটাকে কাছে পেয়েছেন। বাহাদ সাহেব ভেঙ্গেছেন ভিতর থেকে কিন্তু উপরে শক্ত খোলস তার।

একটু বাদেই ডাক্তার বেরিয়ে আসলে রাদাত রাহার অবস্থা জিজ্ঞেস করল।

-চিন্তার কিছু নেই।খুব বেশি রক্তক্ষরণ হয় নি তার আগেই নিয়ে এসেছেন। প্রেশেন্ট এখন বিপদমুক্ত। কাল সকালেই উনাকে বাড়িতে নিতে পারবেন।তবে বিশেষ যত্ন রাখতে হবে।হয়তো ঠিক মতো খাওয়া ঘুম কিছুই করে না।শরীর অনেকটাই দুর্বল।এভাবে চলতে থাকলে বড় কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে। আশা করি কি বলছি বুঝতে পারছেন আর খেয়ালে কোনো ত্রুটি হবে না।

ডাক্তারের কথায় স্বস্তি মিলল সবার।রোশান বাড়িতে মাকে ফোন করে সব জানালো।একটু পর পরই রাহেলা বেগম রাহার খবর নেওয়ার জন্য ফোন করছিল।ডাক্তারের কথা শুনে বাহাদ সাহেব স্ত্রীকে শান্ত করে রোশান কে বাড়ি ফিরতে বললেন।সদ্য বিয়ে করা ছেলের এভাবে এখানে থাকার দরকার কি।বাকিরা তো আছেই।তাছাড়া মেয়েটা এখন বিপদমুক্তও রোশানের আর এখানে থাকা ঠিক হবে না।

সূচনা বেগমও তার কথায় সায় জানালো। রোশান আর দ্বিমত করল না।কেবিনের ভিতর গিয়ে একবার রাহাকে দেখে আসলো।ঘুমাচ্ছে সে।বাইরে সবাইকে বলে হাসপাতালের কলিডোর পেরিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সে।

Post a Comment

0 Comments