এ দহন ভালবাসার| জান্নাতুল ফেরদৌস মমি| পর্ব-১

ভালবাসার গল্প: এ দহন ভালবাসার| জান্নাতুল ফেরদৌস মমি| পর্ব-১

৪ বছর পর লন্ডন থেকে নিজের দেশের মাটিতে পা রাখে রাওফিন এহসান রোশান। বাড়ি ফিরেই বাড়ির সাজসজ্জা আর ঝলমলে আলো দেখে অবাক হয় সে।বাড়ির সাজসজ্জা বলে দিচ্ছে এটা ঘটা করে আয়োজন করা বিয়ে বাড়ি।কিন্তু তাদের বাড়িতে বিয়ে হবে কার?


বাড়ির বড় ছেলেই তো সে। কাজিনদের বিয়েও তো না তাহলে মা ফোনে অবশ্যই জানাতো।আর রাদাতের বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না।কারণ সে তার ছোট।তাহলে বিয়েটা কার?এতো আলোকসজ্জা কেন বাড়ি জুড়ে।

মনে মনে সব ভাবতে ভাবতে লাগেজ নিয়ে বাড়ির গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে রোশান। চারপাশ ভালোভাবে লক্ষ্য করে সে।না না সত্যিই কোনো ব্যাপার আছে।সে বিচলিত ভাবে কালো চশমাটা খুলে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল।উদ্দেশ্য মা অথবা রাদাতের দেখা পাওয়া।একটু এগিয়ে পেয়েও গেল তার মা রাহেলা বেগমকে।

ছেলেকে দেখে মুখে হাসি আটলেন।খুশিতে চোখের ভিতর পানি চিকচিক করছে।হাসি মুখে আওড়ালেন সেই পুরোনো ডাক,,,,, আব্বাজান!

মায়ের এমন আবেগপ্রবণ ভাব দেখে রোশান দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরল।দূর থেকে রাদাত তাদের দেখতে পেয়েই ছুটে এসে ভাইয়ের ঘাড়ে হাত দিয়ে পিঠে লাফিয়ে উঠল।রাহেলা বেগম চোখের পানি মুছে মৃদুস্বরে ধমকে উঠলেন,,,,,,,

- নাম পিঠ থেকে ছেলেটা কত ক্লান্ত হয়ে এসেছে আর অমনি তোর শুরু হয়ে গেছে। রাদাত তৎক্ষণাৎ নেমে গেল।রাহেলা বেগম আলতো করে চাটি দিলেন রাদাতের পিঠে।ছেলেকে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে হলরুমে গেল রাহেলা বেগম।দেখতে দেখতেই সেখানে উপস্থিত হলো বাড়ির সকলে। বাবা বাহজাত সাহেব ছেলের ওপর রেগে থাকায় দেখার পরও কাছে যায় নি।তবে দুর থেকে ঠিকই ছেলের দিকে চেয়েছে।সেটা চোখ এড়ায়নি রোশানের।

বুড়ো বয়সেও তার বাবার সেই ছোট মানুষের মত অভিমান।আনমনে হাসল রোশান।চাচা বাহাদ সাহেব তার স্ত্রী সূচনা বেগম এগিয়ে আসলে তাদের সালাম জানায় রোশান।হাসি মুখে তারাও কেমন আছে জিজ্ঞেস করে। রোশানও উত্তর দেয়,,,,,,

- আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনারা কেমন আছেন?

- এতো দিন ভালো না থাকলেও বাড়ির ছেলেকে বাড়িতে ফিরতে দেখে এখন বেশ আছি। বুড়ো বাপটার অভিমান ভাঙ্গাও।সে যে অভিমান করে দুর থেকেই ছেলের মুখশ্রী দেখছে বলে চোখ দিয়ে ইশারা করল বাহজাত সাহেবের চোরা চোখে ছেলের পানে তাকানোর দিকে।চাচার কথায় হাসল রোশান।বাবার কাছে যেতে নিলেই ঘটল বিপত্তি।বাড়ির পুঁচকে ছানা পোনা দুটো ধরলো রোশান কে।

এক প্রকার ঝাপটে ধরল তাকে।সেও বাধা দিল না। কত ভালোবেসে জড়িয়ে ধরছে বাদ সাধলে নিশ্চই মনে কষ্ট পাবে।বাড়ির ছানা পোনা দুটো তাকে দেখে যেমন ভয় পায় তেমনি আবার সবার থেকে তাকেই বেশি ভালোবাসে।

কার জন্যে কি আনা হয়েছে সেই নিয়ে হৈচৈ বাঁধল।রোশান সবাইকে থামিয়ে বললো,,,,,

- সবার জন্যেই গিফট আছে না থামলে দিব কিভাবে। ছানা পোনা দুটো শান্ত হলো গিফট পাবার আশায়।রাহেলা বেগম বলে উঠলেন,,,,,

- ওইসব গিফট ফিফট পড়ে হবে তুই আমার সাথে ঘরে আয় বাপ। রোশানও কোনো কিছু না বলে মায়ের পিছু পিছু ঘরে চলে গেল।রাহেলা বেগম ছেলেকে তার পাশে বসতে বললেন।রোশান মায়ের পাশে গিয়ে বসে পড়ল।রাহেলা বেগম কিছু বলার আগেই রোশান জিজ্ঞেস করল,,,,,,

- বাড়িতে কি কোনো অনুষ্ঠান মা বাড়িটা এভাবে সাজানো কেন?রাহেলা বেগম সাথে সাথে উত্তর দিলেন না।খানিকক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলেন,,,,,

- হুম!

- কিসের অনুষ্ঠান?রাহেলা বেগম উত্তর দেওয়ার আগেই ঘরে ঢোকেন বাহজাত সাহেব।ছেলের দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,,,,,,,

- বাড়ি ফিরলে কেন?বাবার অভিমানের পাল্লা ভারী টের পেল রোশান।

- ওখানেই থেকে যেতে অন্তত আমার বাড়ির বাকি ছেলে মেয়েরা ভালো থাকত। কি মনে করে ফিরে এলে আবার এই বাড়ির কার বুকে রক্তক্ষরণ করবে তুমি?বাবার কন্ঠে রাগ থাকলেও রোশান রাগল না শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,,,,,,

- বাড়ির সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে চলে গেছিলাম নাকি বাবা যে ফিরে আসার প্রশ্ন তুলছো? ছেলের প্রশ্নশুনে বাহজাত সাহেব রাগী চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। রোশান বাবার রাগকে অগ্রাহ্য করে গেল।

- আমি অভিমানে বাড়ি ছেড়েছিলাম।ভেবেছিলাম আর যাইহোক আমি দূরে চলে আসলে বাবা অভিমান পুষে রাখবে না আমায় ঠিক ফোন করে বলবে রোশান বাড়ি ফিরে আয় তোর বুড়ো বাপ তোকে ছাড়া থাকতে পারছে না।কিন্তু আমি ভুল প্রমাণ হলাম বাবা।আমি অভিমান ভুলে ছুটে এলাম তোমার অভিমান ভাঙ্গাতে।

- যেটা ভাঙ্গার নয় সেটা নিয়ে অযথা কথা বলো না।ভাঙ্গানোর হলে অনেক আগেই চলে আসতে। চার চারটা বছর অপেক্ষা করাতে না।রোশান এবার বাবার সামনেই হেসে ফেললো।

- আমার অভিমান ভাঙ্গানোর অপেক্ষায় ছিলে বুঝি? বাহজাত সাহেব ছেলের হাসিতে আরও রাগ চওড়া করলেন।

- এই চার বছর আমি আমার বাড়ির মেয়ের চোখের পানি ঝরতে দেখেছি।তাও শুধু তোমার কারণে।এই চোখের পানি মুছানোর অপেক্ষায় ছিলাম।কিন্তু তুমি এলে না।যখন বাড়ির মেয়েকে চোখের পানিতে ভাসাবেই তাহলে এবার আসার কি খুব দরকার ছিল। বাহজাত সাহেব ঘর ছাড়ার সময় পিছন না ফিরেই বললেন,,,,,

- মেয়েটা এখনও বের হয়নি।ঘরে বন্ধ দরকার আড়ালে নিজের জল আড়াল করছে।কথাটা বলেই সাথে সাথে প্রস্থান করলেন তিনি।রোশান বুঝতে পারল রাহা এখনও সেই চার বছর আগের ঘটনাতেই আটকে আছে।মায়ের দিকে ফিরল সে। রাহেলা বেগম হেসে বললেন,,,,,

- চিন্তা করিস না আব্বাজান ও বাচ্চা মেয়ে বুঝে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।মৃদু হাসার চেষ্টা করল রোশান।

তখনই কানে এলো মায়ের আজকের দিন নিয়ে বলা কথা।চমকে উঠল সে।সে কি ঠিক শুনল।তাহলে কি তার মা মিথ্যে বলে তাকে নিয়ে এসেছে?

নিজের ঘরে ফেরার পথে রাহার ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়েছে রোশান।দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে আর নিজে থেকে ডাকে নি।এমনিতেই মায়ের কথায় মাথা তার ১৯০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে।মায়ের কথায় যে সে আশাহত তা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।মাথা ভন ভন করে ঘুরছে।শুধু এই একটা সমাধানই কি আছে ?এই একটা কাজের দ্বারায় কি সব ঠিক করা যায়?সে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে ।

এক প্রকার উপায়হীন সে।জোরজবরদস্তি ভাবে একটা বিষয় তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।তার মা বুঝেও যেন বুঝলেন না।রাহার ওপর মনে মনে রাগ আরও বাড়ছে।এই মেয়ে তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।সেই চার বছর আগেও জ্বালিয়েছে।আবার চার বছর পর দেশে ফিরেও এর থেকে নিস্তার পাচ্ছে না।

মেয়েটাকে দু গালে দুটো থাপ্পড় দিতে পারলে মনে একদণ্ড শান্তি মিলতো।কিন্তু কি করে মারবে তার নিজেরই তো মাথা ফ্যানের ন্যায় ভনভনিয়ে ঘুরে যাচ্ছে।তার মধ্যে বাড়ি দুই ছানা তার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে পড়েছে।তাদের জন্যে কি আনা হয়েছে সে নিয়ে জ্বালিয়ে মারছে।নিজের জিনিস হাতে না পাওয়া পর্যন্ত এই দুই ছানা থামবে না।

অগত্যা নিজের ভিতরের সব খারাপ লাগা গিলে বিচ্ছু দুটো কে তাদের জিনিস হাতে ধরিয়ে দিল।দুই জনের জন্যেই রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি,দুই বক্স চকলেট,দুই ভাইয়ের পছন্দ করে দেওয়া জুতাসহ আরও কিছু হাতে ধরিয়ে দিল।খুশিতে গদগদ হয়ে দুই ভাই এ ওর জিনিস দেখতে দেখতে চলে গেল।এই দুটো তার চাচার যমজ ছেলে।দুই জনেই ক্লাস সেভেনে পড়ে।

একজনের নাম রায়ান আরেক জনের নাম রায়াত। আর তাদের বোনের নাম রাহা।যাকে নিয়েই বাবা ছেলের সম্পর্কে ফাটল। অথচ রাহার বাবা মা অর্থাৎ তার চাচা চাচী কিছুই জানে না এই বিষয়ে। বিষয়টা যাতে এতো ঘোলা না হয় তাই ঘটা করে করা আজকের আয়োজন মানে তার বিয়ে।

দোষ করল রাহা আর শাস্তি পাবে রোশান তা কি করে হয়।রাহেলা বেগম যখন জানান আজকে রোশনের বিয়ে।তখন রোশান একটা কথায় বলে "মা তুমি কিছু খেয়েছো?"অবশ্য তার মা এই কথার মানে বুঝতে পারে না।সে ভ্রুক্রুটি করে ছেলেকে বলেন তাড়াতাড়ি রেডি হতে মেয়ে অনেকক্ষণ আগেই পার্লারে সাজতে গেছে।

অবাক বনে যায় রোশান।তার মা মজা করছে না তার সাথে। তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।কিন্তু হঠাৎ এসব কেন?তারও তো পছন্দ অপছন্দ বলে কোনো ব্যাপার আছে।মেয়ে কে দেখতে কেমন মেয়ে হিসেবে কেমন এসব তো তার জানা দরকার।

রাহেলা বেগম আবার তাড়া লাগালে রোশান জানতে চায় কি এমন হলো যে হঠাৎ এসব করছে তার মা।রাহেলা বেগম ছেলের জানতে চাওয়াতে রাগ করলেন না।অবশ্যই তার ছেলের জানার অধিকার আছে।একটু পরেই যার সাথে বিয়ে সে কে? কেনই বা হুটহাট বিয়ের আয়োজন এসব জানতে চাইতেই পারে।স্বাভাবিক।তার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে থাকলেও জানতে চাইতো।

রাহেলা বেগম ছেলের দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মুখ সরালেন।

আমি চাইনা পরিবারের বিচ্ছেদ হোক।এই পরিবার ভাঙ্গুক এটা আমার মনে আসলেই দম আটকে যায়।এই পরিবারের প্রতিটা মানুষই আমার খুব কাছের ভীষনই প্রিয় তারা।হঠাৎ তাদের কাছে অপ্রিয় হতে চাইনা।রোশান তখনও মায়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মা কি বলছে সে সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে যেন।

কিন্তু মা পরিবার ভাঙবে কেন?আমি তো রাহা কে পাত্তা দেই নি।ওর ইশারায় চাইলেই আমি সর্ম্পকে জড়িয়ে যেতে পারতাম কিন্তু আমি তা করিনি।আমি পরিবারের মর্ম বুঝি।ওই বাচ্চা বলে কি আমিও ওর কথায় বাচ্চামো করতে যাবো নাকি?এতো টুকু বিশ্বাস রাখতে পারো না আমার ওপরে মা।রাহেলা বেগম ছেলের মধ্যকার কিঞ্চিৎ বোঝানোর সুর ধরতে পারলেন।তার ছেলে বড় হয়ে গেল নাকি? এখন তাকে বোঝায়।

- আমি তোর দোষ দিচ্ছি না বাপ।তুই তো সেই ঘটনার পর বাড়ি ছেড়ে গেলি।কিন্তু ফেলি গেলি সেদিনের রাহা কে যে এখনও আগের জায়গাতেই আছে।কথার নড়চড় হয়নি তার।সে বলেই দিয়েছে রোশান কে আমার চাই ই চাই।চাচার কাছে কেঁদেকুটে নাজেহাল অবস্থা। বাহাদ আর সূচনা এখনও এসবের কিছুই জানে না।জানলে কি বিশ্রী ব্যাপার হবে বুঝতে পারছিস?রোশান ভাবুক ভঙ্গিতে মায়ের কাছে জানতে চাইলো,,,,,,

- ও কেঁদেকুটে ভাসালেই ওর সাথে আমার বিয়ে দিতে হবে? এসব কি মা তুমি বললে তোমার আমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।দুর দেশে তোমায় ছেড়ে যেন আর না থাকি।তোমার কথা মতো চলে এলাম আর তোমরা সবাই মিলে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললে।একটা বারও কি আমায় জানানো যেত না?


ছেলের যুক্তির কাছে নিজের হার টের পেয়েও থামলেন না। রোশানেরও জানা দরকার এই চার টা বছরে ঠিক কত কি পাল্টে গেছে।বদল ঘটেছে কত বিষয়ের।রাহেলা বেগম ছেলেকে শান্ত করে নিজের কাছে বসালেন।


দেখ বাপ বাহাদ ভাই তোকে নিজের ছেলের মত করে বড় করেছেন।তোর সামান্য ভুলও তাকে অনেক বেশি আঘাত দিবে। আর সেটা যদি হয় তার মেয়ে তাহলে সে একেবারে ভেংগে পড়বে।তোকে এতো ভালোবাসার এই পরিণাম সে মানতে পারবে না।তুই চলে যাবার পর রাহা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিল।অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওকে পেয়েছি আমরা। বাড়িতে কারো সাথে ঠিক ভাবে কথা বলে নি।মেজাজ চোটে থাকতো সবসময়।ঘুমের ট্যাবলেট খেতে খেতে অসুস্থ হয়ে পড়ে হসপিটালাইজ করা হয় ওকে। বাহাদ মেয়ের এমন অবস্থায় ভেংগে পরে।এই পুরো বাড়িতে একটাই মেয়ে আমাদের।সবার চোখের মণি ও।

রোশান অবাক হয়ে যায়।কি মেয়ে এতো কিছু করে ফেলেছে।সে তো এগুলা ধারণাও করে নি।ভেবেছে বয়সের দোষ কিছুদিন চোখের সামনে না দেখলে ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু এই মেয়ে তো সাংঘাতিক  সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়েছে।রাহেলা বেগম ছেলের দু হাত ধরলেন।

এতো কিছু হওয়ায় আমি আর তোর বাবা মেনে নিয়েছিলাম যে তোকে রাজি করিয়ে রাহাকেই ঘরের বউ করে আনব।কিন্তু.....থেমে গেলেন রাহেলা বেগম।মাকে থামতে দেখে রোশান জিজ্ঞেস করল থামলে কেন?

সূচনা তার বোনের ছেলের সাথে রাহার বিয়ে দিতে চায়।দিতে চায় বললে ভুল হবে ওরা রাহাকে বউ হিসেবেই দেখে।বাধ্য হয়ে আমি বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বিষয়টা থেকে পিছিয়ে এলাম।কারণ এই একটা ঘটনা কেন্দ্র করে সম্পর্কে ফাটল ধরবে বুঝে গেছিলাম। তাই তোর বিয়ে ঠিক করা। আশা করি মায়ের কথা বুঝবি।কোনো দ্বিমত করবি না।

রাহেলা বেগম ঘর ছেড়ে বাইরে গেলেন।প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে বসে রইল শুধু রোশান।

- যদি রাহার সাথে আমার বিয়ে না হয় তাহলে কার সাথে আমার বিয়ে?প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে রোশানের কাছে।

কাভার্ড খুলে তোয়ালে নিয়ে রোশান ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ে।একটা লম্বা শাওয়ার নেওয়া দরকার।একে তো জার্নি তারপর আবার মায়ের বলা কথা গুলো সব মিলিয়ে বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে সে। সত্যিই কি আজকে তার বিয়ে?তার কি উচিৎ হবে বিয়েটা করা?বিয়ের মতো একটা জিনিস নিয়ে এরকম জঘন্য ব্যাপার মানতে পারছে না সে।

মা তো বলেই খালাস।সে মায়ের কথার বিরুদ্ধ হয় নি কোনোদিন।কিন্তু আজ কেন যেন মানতে মন চাইছে না। এ কোন দ্বিধায় পড়ল সে।মায়ের মুখের দিকে তাকালে শক্ত কথা বলতে পারে না সে।না পারছে বিষয়টা মানতে না পারছে জোর গলায় মাকে বলতে আমি বিয়েটা করবো না।

কোনদিকে মোড় নেবে তার জীবন?শত ভাবনারা মাথায় এলো গেল।লম্বা শাওয়ার ছেড়ে প্রায় ৪৫ মিনিট পর বেরোল সে।সামনে বিছানায় নজর পড়তেই ভ্রু গোটাল।

তার স্পষ্ট মনে আছে সে গোসলে যাওয়ার সময় কাভার্ড থেকে কোনো টি শার্ট বা টাওজার কোনোটায় নামায় নি। অথচ খাটের ওপর টি শার্ট আর টাওজারটা গুছিয়ে রাখা।কথা হলো রাখল কে?মা তো রাখেনি।কারণ সে রাখলে ডেকে বলে যেত।তাহলে কে রাখল?

কোমরে তোয়ালে পেচানো ভাবেই ঘরের চারদিক নজর বুলাল। আর পেয়েও গেল এই কাজ করা মানুষটাকে।যে এখন দরজার পর্দার পিছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে।তবে ফোপানোর শব্দ স্পষ্টতো শোনা যাচ্ছে।

এতক্ষণ নিজ ঘরের দরজা আটকে কেঁদে ভাসানো মানুষটি এখন তার ঘর ভাসাতে এসেছে।রোশান টু শব্দটিও করল না। টি শার্ট আর টাওজারটা পড়ে নিল।পর্দার আড়াল থেকে এখনও বাইরে আসছে না রাহা তা দেখে রোশানই এবার বলে উঠল,,,,,,

- পর্দার অন্তরাল থেকে বেড়িয়ে মুখোদর্শন করা। ফুঁপিয়ে কেঁদে আমার ঘরখানা ভাসিয়ে দিস না।

রাহা কোনো উত্তর দিল না।কিন্তু পর্দার পিছন থেকে দরজার দিকে ঘুরে হাটা দিল।কি হলো রোশান ঠিক বুঝল না।তাই সেও দ্রুত পায়ে রাহার পিছন যেতে লাগল। রাহা নিজের ঘরে ঢোকার আগেই রোশান কঠোর স্বরে বলে উঠল,,,,,

- দাড়া রাহা।

রাহা চাইছিল না দাঁড়াতে কিন্তু পা ঠিকই দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় নিচু করে রোশানের দিকে ঘুরলে রোশান দেখল কাদতে কাদতে মেয়েটা গাল দুটো পাকা টমেটোর মতো করে ফেলেছে।

রোশান রাহার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল।শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,,,,,

- নিজের কি দশা করেছিস?আয়নায় দেখেছিস নিজেকে?চোখ নাক মুখ সবই ফুলে গেছে। চাচা চাচী এই অবস্থায় তোকে দেখলে কি মনের অবস্থা হবে তাদের বুঝিস কিছু।

 রাহা প্রতিত্তর না করে ঘাড় নিচু করেই রাখল।রোশান কন্ঠে গম্ভীর্যতা এনে শুধালো,,,,,,,

- শুনলাম তুই নাকি আমার নাম ধরে দেখেছিস।নিজের সাইজ দেখেছিস?লিলিপুট হয়ে আমায় আসছিস নাম ধরে ডাকতে।বয়স কত তোর যে আমায় নাম ধরে ডাকিস?

চোখ তুলে আর তাকানোর সাহস নেই রাহার। ভয়ে ঢোক গিললো সে।শব্দটা রোশানও শুনতে পেল।মেয়েটা তাকে ভয় পায় বড্ড।শাসন করলে কখনই নালিশ করে নি।বরং রোশান যা বলেছে ছোট থেকে তাই মাথা পেতে নিয়েছে।হোক সেটা ভুল বা ঠিক। মোট কথা রোশান যদি বলেছে "র" এর নিচে না ওপরে ফোঁটা। রাহা চোখ বন্ধ করে তাই মেনে নিয়েছে।

কোনো ভুল করলে রোশানের বকা ঝকাতে নাক ফুলিয়ে কেঁদেছেও।কিন্তু ফিরে ফিরে তাও রোশানের কাছেই গেছে।

রোশানের দিকে চোখ তুলে তাকাল রাহা। অঝোরে ঝড়ল তার চোখের নোনাজল টুকু।যা এতক্ষণ সে আটকে রাখার বৃথা চেষ্টা করছিল। রোশান শক্ত কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু রাহার এহেন চোখের পানির জন্য কিছু বলতে গিয়েও বলল না। আস্তে করে শুধু বলল,,,,,,,

- রাহা!তাতেই যেন রাহার বাঁধ ভাঙ্গা কান্নারা আরও বেশি করে ঝরতে লাগল।এবার সে একপ্রকার ডুকরেই কেঁদে উঠল।অসস্তিতে পড়ে গেল রোশান।সামনে দাড়িয়ে কেঁদে ভাসানো মেয়েটা তার বোন।সে যতই বোন বোন করুক মেয়েটাতো তাকে ভাই মানতে নারাজ।কেউ দেখলে কি ভাববে এই মেয়ে তো কান্না বন্ধ করছে না।অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাহার মাথায় হাত রাখল রোশান।

সে স্পর্শে ছিল না অন্য কোনো মোহ,ছিল না অন্য কোনো চাহিদা।যা ছিল তা হলো এক বোনকে শান্তনা দেওয়া এক ভাইয়ের মাথায় বুলানো হাত। স্পর্শেও যে বোঝা যায় কোনটা বাজে আর কোনটা ভালোবাসার।যদিও তার মাথায় রাখা হাতটা ভালোবাসার হলেও সেটা প্রেমিক প্রেমিকার ন্যায় না।বরং বড় ভাইয়ের স্নেহ মেশানো তাতে।

স্পর্শটা ভালোই বুঝতে পারল রাহা।হঠাৎ করেই তেজীভাবে হাত ধাক্কা দিয়ে সরালো মাথা থেকে।রোশনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রাহা কর্কশ ভাবে বলে উঠল,,,,,,,

- ভালোবাসা চাওয়া মানুষের কাছে থেকে যদি ভালোবাসার অনুভব না আসে,চোখের পানি মোছানোর জন্যে যদি তার ব্যাকুলতা না বুঝি তাহলে ভাই বোন নামক বেড়াজালে জড়িয়ে কোনো স্নেহের হাত আমার চাই না।

রাহার কথায় থ মেরে গেল রোশান।এইটুকু মেয়ের কথার কি ধাঁচ।

- সাহস বেড়ে গেছে তোর?তোর সামনে দাঁড়ানো মানুষটা তোর বড় ভাই।ভুলে গেছিস তুই?কোন সম্পর্কের বেড়াজাল দেখাসছিস তুই?ভাই বোনের সর্ম্পককে বেড়াজাল মনে হলো তোর?অথচ দুনিয়ার সব থেকে মিষ্টান্নতা থাকে এই সম্পর্কে।

রাহা বাকা হাসল। ফোলা চোখে মুখে হাসিটা দারুণভাবে ফুটে উঠল যেন।

- আপনি আমার মায়ের পেটের ভাই? তা নন তো।তাহলে বড় ভাইয়ের অধিকার দেখাবেন না আমায়।

রাহার মুখে বেশ ভালোই কথা ফুটেছে।ধুয়ে দিচ্ছে রোশানের রাগকে।একেবারে রগরে রগরে ধুচ্ছে।

- চার বছর আগেও আপনি আমার মনের মানুষ ছিলেন আজ চার বছর পরও তাই আছেন আর থাকবেন ও।কি ভেবেছিলেন ভুলে যাবো?না,তিলে তিলে কষ্ট দিয়েছেন আমায়।কেন করছেন আমার সাথে এমন?আমার অপরাধটা কি?

রোশান চুপ করে দাঁড়িয়ে।তাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে ম্লান হাসল রাহা।

- উত্তর নেই আপনার কাছে তাই না।কি উত্তরই বা আর দেবেন।পাষাণ মানুষ হয়ে কি আর অন্যের গুপ্ত রক্তক্ষরণ দেখা যায়।

রাহার কথায় রাগ হচ্ছে তার।এমনিতেই বিয়ের বিষয় নিয়ে মায়ের ওপর ক্ষণে ক্ষণে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তার মধ্যে এই মেয়ে যা নয় তাই বলছে।তবুও সে রাগ দেখাল না। রাগটুকু নিজের মধ্যেই দমিয়ে রাখল।

- তুই এই শান্তিনিবাস ভিলার সবার মনের প্রশান্তির ছোঁয়া।তোর জন্যই এই বাড়িটা প্রাণবন্ত।তোর জন্য শান্তিনিবাসে বয় শীতল বাতাস।

রোশানের কথায় ঠাট্টার হাসি হাসল রাহা। ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠল,,,,,,,,

- এতই যখন এই বাড়ির প্রশান্তির ছোঁয়া আমি,শীতল হাওয়া বইয়ে যায় আমার জন্য তাহলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করছেন কেন?

রাহার করুন মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে রোশান।মেয়েটা কোনো নড়াচড়া করছে না এতো কাছে থেকেও নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

- রাহা তুই আমার ভীষন আদুরে বোন।তোর এমন করুণ করা মুখমন্ডল দেখতে বুক ভেঙ্গে আসে।

জবাবের আশা না করলেও ওপর পাশ থেকে সাথে সাথেই জবাব পায় সে।

- আমি তো আপনার বোন হয়ে থাকতে চাই নি। রোশান আজকে এই মেয়ের কথার ঝড়ের সাথে পেরে উঠছে না। চার বছরের জমানো কথার ঝড় কি আর থামানো যায়।কিন্তু এখানে শুধু কথা আর হচ্ছে কোথায় সবই তো ঝাঝ মেশানো জমে থাকা হাহাকার।

- সত্যিই বিয়ে করবেন রোশান ভাই?এতক্ষণের সেই তেজী কণ্ঠস্বরে এবার অসহায়ত্ব নেমে এলো।যেন এই প্রশ্নে লুকিয়ে আছে বিয়েটা করবেন না।

- সবকিছুর জন্য তুই দায়ী।তোর মনের বেহায়াপনার শাস্তি মা আমার ওপর থেকে তুলছে।

- আপনি আমার বেহায়াপনা দেখলেন অথচ আমার ভালোবাসাটা দেখলেন না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে রাহা।তারপর হঠাৎই চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছোরে,,,,,,

- নাকি যাকে বিয়ে করছেন তার ভালোবাসার চেয়ে শরীরটায় বেশি টানে আপনাকে।কথাটা বলতে দেরি হলেও সজোরে চড় পড়তে দেরি হয় নি তার গালে।

বিষ চোখে রাহার দিকে তাকিয়ে রোশান।

- খুব বড় হয়ে গেছিস তুই?বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলার ধরন যদি নাই জানবি তাহলে কথা বলার প্রয়োজন নেই।ছোট বলে তোকে মাথায় উঠতে দিব না।

কথাটা শেষ করে উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেই রাহার কথায় পা জোড়া থেমে গেল।

- আপনি আমার ভালোবাসা দেখেছেন এখন এই ভালোবাসার জন্য পাগলামি দেখবেন না? আজ যদি ঝলমলে আলোতে বিয়ের আসরে অন্য মেয়ের ভালোবাসায় নিজেকে আলোকিত করেন তাহলে আজই হবে এই রাহার জীবনের শেষ দিন।

রোশান বাকরুদ্ধ।কি বলে গেল এই মেয়ে?তাকে কিছু বলতে না দিয়েই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রাহা। আর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল নির্বাক রোশান।

আরও পড়ুন: এ দহন ভালবাসার| জান্নাতুল ফেরদৌস মমি| পর্ব-২

Post a Comment

0 Comments