ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-১৭
রাহি চুপ করে সোফায় বসে আছে। সম্পুর্ন রুমটা অন্ধকার শুধু চাঁদের আলো জানলা দিয়ে এসে তার মুখে পড়েছে। নিজেকে এতটা দুর্বল হতে এর আগে সে কোনোদিন দেখেনি।
এ চাকরিতে সে যোগ দিয়েছে পাঁচ বছর। এই অল্প কয়েক বছরেই কত অন্যায় অপরাধ দেখেছে সে। তবু আজও কোনো মেয়ের অসহায়ত্ব দেখলে তার বুক কেঁপে উঠে।
ছোট বেলা থেকে সে তার মাকে দেখেছে ভয় পেয়ে বেঁচে থাকতে। কার ভয়? তার বাবার ভয়। তার বাবা কোনো আদর্শ বাবা ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক কাপুরুষ। মদ, গাঁজা আর পরকীয়া করে বেড়াতেন তারপর বাড়িতে ফিরে তার বউয়ের গায়ে হাত তুলতেন।
বাবার বাড়ির লোকজন ছিলো তার চেয়েও জঘন্য। বাবার যখন শেষ সময় তখন তার চিকিৎসার টাকা ছিলো না তাদের কাছে।
রাহির মা আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছেন। হ্যাঁ, সেই লোকটাকে বাঁচাতে যে লোকটা প্রতিরাতে তাকে আঘাত করতো।
বাবার চিকিৎসার টাকা না জোগাড় করতে পেরে সে তার মাকে— অঝোরে কান্না করতে দেখেছে।
মৃত্যুর আগে যদিও সেই লোকটি তার স্ত্রীর মর্ম বুঝে চোখের পানি ফেলেছে কিন্তু রাহি তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। কখনো পারবে না।
রাহি তখন ছোট। বাবার মৃত্যুর পর, তার মাকে আবার নিজের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে বসতে হয়। মা হয়তো বিয়েটা করতে কখনো রাজি হতেন না। কিন্তু রাহির মুখের দিকে তাকিয়ে, রাহিকে একটা সুন্দর জীবন দিতে— তিনি বিয়ে করেন।
যদিও এই বিয়ে তার মায়ের জীবনে সুখ এনে দেয়। কিন্তু রাহি মনে করে এই সুখের কৃতিত্ব শুধু তার মায়ের।
তাই তো রাহির এই পথ বেছে নেওয়া। তাকে যেনো কেউ দুর্বল না ভাবে।
বিশেষ করে পুরুষ মানুষের প্রতি এক রকম ঘৃণা নিয়েই তার বড় হয়ে ওঠা। তার সমস্ত জীবনে সে শুধু নারীদের কষ্ট পেয়ে যেতে দেখেছে।
যে নারী খুব সুখী তার সুখের উৎস আর যে নারী খুব দুঃখি তার দুঃখের উৎস এক — পুরুষ।
মা বলেন,নারীর সৃষ্টি নাকি পুরুষের জন্য। তাহলে তো নারীকে আগলে রাখার কথা, কিন্তু কয়জন পুরুষমানুষ সেটা করে, রাহির জানা নেই।
রাহির যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে তার নাম নিলয়। বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে কোনোদিন তার ছিলো না।তবে যেই বাবা তাকে বড় করে তুলেছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সে মত দিয়েছে। নিলয় কেমন রাহি বুঝতে পারে না। হয় সে অতি বোকা নয়তো ধূর্ত চালাক। শুধু মাত্র বাবার কথা রাখতেই –সে রাজি হয়। আজ এই মেয়েটিকে দেখে রাহির ভিতরটা কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে। নিশ্চয় মেয়েটির কোনো স্বপ্ন ছিল। পরিবার ছিলো। সে হয়তো অন্য সব সাধারণ মেয়ের মতন জীবন চেয়েছিল কিন্তু বিনিময়ে সে কি পেলো?
দরজা খোলার শব্দে রাহি পিছনে ঘুরে তাকালো। আবছা আলোয় যে অবয়বটা দেখা যাচ্ছে সেটা কায়ানের। কায়ান চুপ করে এসে জানালার পাশে দাঁড়ালো।
“ ওই মেয়েটি কে ছিলো?”, রাহি ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলো।
কায়ান রাহির দিকে তাকালো। রাহি চোখে মুখে ঘৃণা স্পষ্ট। কায়ান চোখ সরিয়ে বললো, “ মেয়েটি নাম প্রীতি।”
“ ও এই বাড়িতে কেনো আছে? কি ওর পরিচয়? তুমি করে জোড় করে আটকে রেখেছো, তাই না?”, কায়ান খেয়াল করলো রাহির কন্ঠ রাগে কাপছে।
কায়ান দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে বললো, “ ও এই বাড়িতে নিজের ইচ্ছায় আছে। আমি নিজের স্বার্থ ছাড়া কাউকে জোর করে আটকে রাখি না।” বলেই কায়ান থামলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “ প্রীতিকে তার প্রেমিক বিয়ের প্রলোভন দিইয়ে ঢাকায় এনে বিক্রি করে দেয়। তখন তার বয়স অল্প। কোথায় বিক্রি করে সেটা বলার প্রয়োজন নেই আশা করছি।”
“ আরো কয়েক বছর আগের ঘটনা। এক রাতে আমি গুলিবিদ্ধ হই। তখন প্রীতি আমার জীবন বাঁচায়। আমার জীবনের বিনিময়ে —মুক্তিপণ দিয়ে ওকে আমি সেই নোংরা জীবন থেকে মুক্তি দেই।”
রাহির ভিতরের আগুন যেনো ধীরে ধীরে পানি হচ্ছে। সে পলক না ফেলে কায়ানের কথা শুনছে।
“ কিন্তু প্রীতি তার বাবা মার কাছে ফিরতে চায় না। ফলস্বরূপ তাকে আমি আমার মায়ের দায়িত্ব দেই। আমি জানতাম তার আমার প্রতি দুর্বলতা ছিলো, কিন্তু তাকে আমি কখনও প্রস্রয় দেই নি। ওকে যেমনটা দেখছো, ও এমন ছিলো না।……খুব লাজুক স্বভাবের মেয়ে ছিলো।”
রাহি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, “ তাহলে এখন এমন কেনো?”
কায়ান ফ্লোরের দিকে তাকাতে তাকাতে বললো,
“ আমার মাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার শত্রু পক্ষের হাতে সে নিজেকে তুলে দেয়।”, বলেই কায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
রাহির চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে। কায়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “ মাকে একটা রুমে লুকিয়ে রেখে। সে নিজেকে ওদের সামনে রেখে যেনো শয়তানগুলো প্রীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়।”
“প্রীতিকে খুঁজে পাই আমরা দুইমাস পরে। দুইমাসের মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার সহ্য করে প্রীতির বেঁচে থাকা একটা বিস্ময় ছিলো।”
“ তার মানে প্রীতি এখন মানসিক রোগী?”, রাহি বিস্ময় নিয়ে বললো।
কায়ান মাথা নাড়লো তারপর বললো, “ হ্যাঁ।”
রাহি নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো। মানুষের জীবন কি আসলেই এতো তুচ্ছ? এতো মূল্যহীন!
বিকেল গড়িয়ে এখন রাত। তাও রাত কম হয়নি। রাতের দশটা। আরহান এখনো ফিরেনি।
অথচ আজকে ইশাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা। বিকেলে ইশা একাই বের হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু বাড়ির বাইরের গার্ড তাকে বের হওয়ার অনুমতি দিলেন না।
বিকেল পর্যন্ত বাড়ি ভর্তি লোকজন ছিলো। সন্ধ্যা হতেই একে একে সবাই চলে যেতে লাগলো। বাড়িটা যেনো মুহূর্তেই নীরব হয়ে গেলো। তবুও সন্ধ্যার পর আরহানের বাবা মা ইশাকে সময় দিয়েছে।
এইদিকে আরহানের ফিরবার নাম নেই।
আরহানের বাবা বললেন, “ এইটা নতুন কিছু না। আমার ছেলে পারে না সারারাত গোয়েন্দা গিরি করে বেড়ায়। আগে না হয় আমরা বুড়ো বুড়ি ছিলাম —তখন সে বাইরে থাকতো রাত করে —মানলাম। এখন?”
ইশা মাথা নিচু করে বসে আছে। আরহানের মা হতাশ গলায় বললো, “ এইসব বলে কি লাভ! ছেলেটার উপর কি কম কাজের চাপ।”
“ একদম ছেলের পক্ষ নিবে না। বিয়েটা তো নিজেই করেছে নাকি আমরা জোড় – করেছিলাম। এখন বউকে একা বাড়িতে ফেলে সে কাজ দেখাচ্ছে?”, আরহানের বাবা চটে গিয়ে বললো।
আরহানের মা ইশার লাজুক চেহারা দেখে —-আরহানের বাবাকে ঈশারায় চুপ করতে বললেন।
আরহান বাড়ি ফিরলো রাত ১১টার পর। সারাদিন চেষ্টা করেও রাহির খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদিকে পেনড্রাইভ দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। কায়ানকে বিশ্বাস করা অসম্ভব ব্যাপার। আরহান রীতিমতন দিশেহারা।
নিজের রুমে ঢুকতেই তার চোখ গেলো ইশার রাগী মুখটার দিকে। আরহান থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। কাজের চাপে সে ভুলেই গিয়েছিল আজকে ইশাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা। ফোনটা যে কখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে সেদিকেও তার খেয়াল ছিলো না।
“ আর বাড়িতে এসেছেন কেনো? বাইরেই থেকে যেতেন।”, ইশা ঠান্ডা গলায় চোখ রাঙিয়ে বললো।
“ আসলে….। আমি একটু ব্যাস্ত ছিলাম।”
“ একটু ব্যাস্ত?” ইশা কঠিন গলায় বললো।
আরহান ধীরে ধীরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
বুঝতে পারছে সে একটা ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু এখন সে কি বলবে? নিজেকে বাঁচানোর জন্য কোনো কথাই তার মাথায় আসছে না।
“ আচ্ছা। এতো ব্যাস্ত হলে বিয়ে করতে বলেছে কে? বিয়ের সময় জানতেন না যে বিয়ে করলে — বউকে যে সময় দিতে হয়।”, ইশা আজকে আরহানের বারোটা বাজিয়েই ছাড়বে।
আরহান নিজের কোমড়ে হাত দিয়ে ইশার দিকে তাকিয়ে আছে। আরহানের নীরবতা দেখে ইশার রাগ মাথায় উঠে গেছে।
“আমি কালকেই আমার বাবার বাড়ি চলে যাবো। আপনার বাইরের গার্ডও আমাকে আটকাতে পারবে না।”
আরহান কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো, “ এখানে– বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা উঠছে কেনো?”
“ উঠেছে কারণ আমি আপনার সংসার করবো না। আপনি আপনার কাজের সাথে গিয়ে সংসার করুন।”, রাগে গজগজ করতে করতে বললো।
“ ইশা!”, আরহান চোখ রাঙিয়ে বললো।
“ হ্যাঁ, সারাদিন বাইরে থাকবে। আবার এসে আমাকেই চোখ রাঙ্গাবে।”, ইশা গাল ফুলিয়ে বললো।
আরহান নিঃশব্দে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
“ এইসব কথা বললে— নেক্সট টাইম থেকে হাত পা বেঁধে বসিয়ে রাখবো।”
আরহান ইশার দিকে তাকাতেই দেখলো ইশার চোখে পানি চলে এসেছে। আরহান সাথে সাথে ইশার পাশে গিয়ে বসে রীতিমতন নার্ভাস হয়ে বললো, “ আমি মজা করছিলাম। এক..দম কান্না করবে না।”
আরহান বলে শেষ করার আগেই ইশার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানির বিন্দু পড়তে লাগলো। আরহান ইশার দুই গাল ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো তারপর বললো, “ I'm sorry।”
ইশা আরহানকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতেই আরহান তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো।
“ বোকা মেয়ের মতন কান্না করছো কেনো? বললাম তো সরি। আর কোনোদিন লেট করবো না।”
“ আমি থাকবো না –আপনার সাথে।”,ইশা ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো।
আরহান ইশার তর্জনী দিয়ে চিবুক ধরে নিজের কাছে এনে বলল, “ কি বললে তুমি?”
“ আমি আপনার সাথে থাকবো ন….”, বলে শেষ করার আগেই আরহান ইশার ওষ্ঠদুটি ছুঁয়ে দিলো।
আরও পড়ুন: রূপকথার শহর! (পর্ব-১৮) | নবনী নীলা
0 Comments