তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-১

জীবনের গল্প: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-১

ইয়াদ বিরক্ত হয়ে পিছনে তাকায়, প্রতিদিনের মতন আজকেও তিনটা মেয়ে তার পিছু নিয়েছে।  আগে টয়া একা তার পিছু নিতো কিন্তু দুদিন হলো আরো দুইটাকে সঙ্গে করে এনেছে। এই ব্যাপারটা ইয়াদের বরাবরই ভীষণ বিরক্তিকর লাগে। ভদ্রতার জন্যে সে কখনোই কিছু বলেনি তবে আজ কেনো জানি ভীষণ রাগ হচ্ছে তার।


ইয়াদ হাতের ইশারায় টয়াকে ডাকলো। ইয়াদকে দেখে টয়া ঘাবড়ে গিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ইয়াদকে না দেখার ভান করে টয়া একটা দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটায় ইয়াদের রাগ আরো বেড়ে গেলো, এই মেয়ে পিছে পিছে ঘুরবে আবার ডাকলে এমন ভাব করবে যেনো চিনেই না। ইয়াদ রাগ সামলে নিলো কারন ঠাণ্ডা মাথায় এদের হ্যান্ডেল করতে হবে নইলে শেষে দেখা যাবে  তার কলেজে ঢুকে ক্লাসে পর্যন্ত উকি  মারছে।

ইয়াদকে এদিকে এগিয়ে আসছে দেখে টয়ার পাশের দুই মেয়ে দৌড়ে একটা দোকানে ঢুকে পরে। টয়া অন্যদিকে তাকিয়ে সাইনবোর্ড দেখছিল তাই ইয়াদ যে এদিকে আসছে সেটা সে খেয়াল করেনি। হটাৎ পাশের দুইটাকে না দেখে টয়া চমকে উঠে। কি ব্যাপার ? গেলো কোথায় শয়তান গুলো, আয়হায়!এইসব বলে পাশে তাকাতেই টয়ার টনক নড়ে উঠেলো।ইয়াদ ঠিক তার পিছনে দাড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে । টয়া এর আগেও ধরা খেয়েছে কিন্তু এভাবে হাতে নাতে ধরা কখনো খায়নি। ইয়াদ পিছনে তাকালেই দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেছে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার কপালে মহাকাশের সব গ্রহ নক্ষত্র এক সঙ্গে ঘুরছে।

ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল কারণ সে ভেবেছে মেয়েটা নিজে থেকে কিছু বলবে আর যাই হোক নিজের সাফাই গাইবে নয়তো কোনো বাহানা বানাবে। কিন্তু টয়া সেসব কিছুই করলো না। সে হাসি মুখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াদ এই মেয়েকে যত দেখছে ততো অবাক হচ্ছে।

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে দুই হাত বুকের কাছে ভাজ করে বললো," কি ব্যাপার হাসছো কেনো? "

 টয়া প্রস্তুত হয়ে তাকালো। ইয়াদ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো," এইদিকে কোথায় যাচ্ছো? তোমার স্কুল তো এইদিকে না।"

টয়া ইয়াদের প্রশ্ন শুনে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা না কারণ সত্যিটা বলা যাবে না। ইয়াদের পিছু পিছু এসেছে এটা বললেই মান ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে। টয়া কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে রাহি আর ছোঁয়া আশে পাশে আছে কিনা দেখছে। 

এভাবে রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে কথা বলাটা আসে পাশের লোকজন ভালো ভাবে নিচ্ছে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে। দোকানদার গুলো তাকিয়ে আছে কিন্তু তাই বলে ইয়াদ আজকে টয়াকে ছেড়ে দিবে না। টয়ার এদিকে হার্টের অবস্থা খারাপ নিজের ক্রাশ সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাও আবার এতো সামনে। আবার তার সাথে নিজে থেকে কথাও বলছে।এইসব চিন্তা করেই টয়া দ্বিতীয় স্ট্যাচু অফ লিবার্টি হয়ে গেছে। ঘনো ঘনো হাত কচলাচ্ছে।

দোকানদার এবার আরো সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। ইয়াদ কিছু না ভেবেই টয়ার হাত ধরে ওকে একটা দোকানের পিছনের ছোটো একটা জায়গায় নিয়ে এলো। রাস্তার সবার সামনে এইভাবে কথা বললে লোকজন ভুল ভাববে। টয়া অবাক হয়ে তাকালো। সে শুধু ইয়াদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াদ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাতে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। যেখানে খুশি নিয়ে যাক তার কোনো আপত্তি নেই।

টয়া মুগ্ধ হয়ে নিজের আর ইয়াদের একসাথে হাত ধরে হাঁটা দেখছে। নিজের অজান্তেই টয়া মাথা নুইয়ে একটু হাসলো।

ব্যাপারটা ঠিক কি হলো ওরা দুজনেই বুঝলো না। ইয়াদ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে আনলো। দুইজনেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। টয়া নিজের হাত দুটো গুটিয়ে একসাথে ধরে মাথা নিচু করে দেওয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মনে হচ্ছে সে কোনো এক ঘোরের মাঝে আছে।

ইয়াদ কঠিন হয়ে বললো," এবার বলো কি সমস্যা প্রতিদিন আমার পিছু আসো কেনো?"

ইয়াদের কথায় টয়া ঘাবড়ে গেলো সে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। কি বলবে এবার সে? চুপ করে থাকলে ধরা পড়ে যাবে তাই  চোখ তুলে তাকিয়ে অনেক সাহস নিয়ে বললো," আমি আপনার পিছু আসতে যাবো কেনো?আমি তো এমনেই আসি। আর এইদিকে  আসা বারণ নাকি? এমনিতেও আজ আমি দরকারে এসেছি। 

ইয়াদ একটা ভ্রু তুলে বললো," কি দরকার?"

টয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এতো প্রশ্ন করে কেনো এই ছেলেটা! টয়া এদিকে ওদিক তাকিয়ে বললো,"আজকে আমি... .আমি...ক..ল..ম নিতে এদিকে এসেছি।"

ইয়াদ একটা ভ্রু তুলে বললো," আচ্ছা তাই বুঝি? প্রতিদিন কলম কিনতে আসতে হয়? তোমার স্কুলের ঐদিকে কি কলমের সংকট দেখা দিয়েছে?"

টয়া একটা ঢোক গিললো কারণ সে ধরা পরে যাচ্ছে।ধুরো বেটা দেখছি বেশি চালাক। টয়া ভাব নিয়ে বললো," এই দিকে একটা দোকানে অনেক ভালো কলম পাওয়া যায় তাই আমি এদিকে আসি। ঐ কলম ছাড়া আমি লিখতে পারি না।আর ..আর ...আর ...।" বলতে বলতে টয়া চুপ করে যায়। কারন এর পর কি বলবে সেটা সে জানে না।

ইয়াদ টয়াকে ব্যাঙ্গ করে বললো," আর.. আর.. আর কি? বয়স কত তোমার? স্কুলে পড় মাত্র, এইসব ঘোরাঘুরি বন্ধ করে ভালো করে পড়ালেখাটা করো।"

টয়া মুখ কালো করে তাকালো। ইয়াদ সোজা হয়ে দাড়িয়ে দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে বললো," কয়টায় ক্লাস তোমার?"

টয়া চোখ তুলে আটটা বলে চোখ নামিয়ে ফেললো। ইয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল," কয়টা বাজে ঘড়িতে জানো?"

টয়া মাথা নিচু রেখে না সূচক মাথা নাড়লো। ইয়াদ টয়ার হাতের দিকে তাকালো। আশ্চর্য!মেয়েটার হাতে ঘড়ি নেই। স্কুলে পড়ুয়া একটা মেয়ের হাতে ঘড়ি থাকবেনা এটা কেমন কথা?

ইয়াদ ভ্রু কুচকে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। তোমার ইউনিফর্ম দেখে তো মনে হচ্ছে কাছেই স্কুল একটা দৌড় দিয়ে চলে যাও। আর হ্যাঁ, ঘড়ি পড়ার অভ্যাস করো এই বয়সে সময়ানুবর্তিতা হওয়া খুব জরুরী।" বলে ইয়াদ কাধের ব্যাগ ঠিক করে চলে গেলো, তাকে গিয়ে আবার বাস ধরতে হবে কলেজের। দেরী করলে আর বাস পাওয়া যাবে না।

ইয়াদ যে উপদেশ বাণী টয়াকে দিয়ে গেলো তার সবই যেনো উলো বনে মুক্ত ছিটানোর মতন। সেই সব উপদেশের ধারের কাছেও ঘেঁষবেনা টয়া।

ক্লাস নাইন এ পড়ুয়া আর্নিহা তাবাসসুম টয়া, স্কুলের শীর্ষ দুষ্ট বালিকা আবার সবার আদরেরও একটা মেয়ে। এই মেয়েকে স্কুলের প্রিন্সিপাল পর্যন্ত স্নেহ করে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে বড়ো দুই ভাই আছে। বড় ভাই আমেরিকায় থাকে আর মেজোটা ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ার এ পড়ছে। একমাত্র মেয়ে বলে ছোটো বেলা থেকে আহ্লাদে বড়ো হয়েছে টয়া। আজ পর্যন্ত যা আবদার করেছে সবই পেয়েছে সে।

এবার ইয়াদের প্রসঙ্গে আশা যাক।

ইয়াদ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। খুবই শান্ত ভদ্র ছেলে। বন্ধু মহলে তার বেশ সুনাম রয়েছে। তার সব স্কুল কলেজের টিচাররা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ছাত্র হিসাবেও সে প্রচুর মেধাবী। তার বাবা একজন আর্মি অফিসার। ছোট বেলা থেকে বাবার ট্রান্সফারের কারণে তার ছোটবেলা ছিলো প্রচুর ডিস্টার্ব । তার বাবার ট্রান্সফারের কারণেই এবার সিলেট থেকে এসে ধানমন্ডিতে বাসা নেওয়া। বাসা নিয়েই সে পরেছে এক দুষ্টু পরীর পাল্লায়। দুষ্টু পরী টয়ার বারান্দা আর পড়ুয়া ছেলে ইয়াদের বারান্দা সামনা সামনি। এতেই হয়েছে বিপদ। টয়া জানালা দিয়ে তো তাকে জ্বালায় এমনকি সে রাস্তায় বের হলেও পিছু নেয়। ইয়াদ এই নিয়ে মহা বিপদে আছে। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি সে আগে হয়নি।

টয়া বাসায় এসেই ব্যাগ টেবিলে ছুড়ে দিয়ে বাবা বাবা ডাকতে শুরু করেছে। ফরিদুর রহমান আজ ফ্যাক্টরিতে যাবেন না, তিনি ইজি চেয়ারে বসে আরাম করে পুরনো গান গুলো শুনছিলেন। এর মাঝেই মেয়ের আওয়াজ পেলেন কানে। কানে আওয়াজ আসতে না আসতেই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে টয়া এসে হাজির। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে ড্রেস না বদলেই, না খেয়ে ফরিদুর রহমানের রুমে এসেছে দেখে তিনি কিছুটা চিন্তিত হলেন।

তিনি রেডিও টা বন্ধ করে বললেন," কিরে কি হয়েছে? খাসনি এখনো?"

টয়া বাবার কাছে গিয়ে না সূচক মাথা নাড়ল। ফরিদুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন," কি হয়েছে? আবার বকা খেয়েছিস নাকি?"

" না, বাবা শোনো না! আমি না ঘড়ি কিনবো। আমার ঘড়িগুলো পাচ্ছি না। নতুন ঘড়ি লাগবে।", মুখ শুকনো করে বললো টয়া।

ফরিদুর রহমান মেয়ের কথায় হাসলেন," আচ্ছা ঠিক আছে আমি কালকে তোর জন্য ঘড়ি কিনে আনবো। তা হটাৎ ঘড়ি পড়তে ইচ্ছে হলো যে?"

" এমনেই, বাবা  চলো আজ যাই আমার আজকেই ঘড়ি লাগবে। বাবা প্লীজ বাবা।", মেয়ের কথা ফরিদুর সাহেব ফেলতে পারেন না তাই তিনি বললেন," আচ্ছা যাবো বিকালে তোকে নিয়ে, এবার গিয়ে খেয়ে নে।"

টয়া লাভ ইউ বাবা বলে নাচতে নাচতে নিজের রুমে গিয়ে ধপাস করে বিছায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো নিজের টেডিটা জড়িয়ে ধরে। টয়া বারান্দার পাশের জানালা দিয়ে ইয়াদের রুমের দিকে কাত হয়ে শুয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। 

ইয়াদকে টয়ার ভীষণ ভাল্লাগে একবার বৃষ্টির দিনে ইয়াদ বারান্দায় এসে গান গেয়েছিলো। এতো সুন্দর চেহারা, লম্বা একটা ছেলে বৃষ্টিতে গান গাইছে দেখতে যে কত সুন্দর লাগছিল। সেই গান শুনেই টয়া এক ঘোরের মাঝে চলে গেছে। টয়ার খুব ইচ্ছা একদিন ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে টয়ার দিকে তাকাবে, যদিও এখন সে বিরক্তি নিয়ে তাকায়।

ছেলেটার একটাই সমস্যা ছেলেটা বেশি পড়ালেখা পড়ালেখা করে। আজ প্রথম কথা বললো তাও দেখো কত জ্ঞান দিয়ে গেলো। সময়ানুবর্তি হও, পড়ালেখা করো, ঘোরাঘুরি করো না। কত কি বাপরে!

 ইয়াদ এখন বাসায় নেই তবে কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে পড়তে বসলে আর উঠার নাম নেই। ইয়াদ কে উকি মেরে দেখার জন্য টয়ার ও প্রতিদিন টেবিলে বসে থাকতে হয়। টয়ার ধারণা এভাবে আর কিছু বছর বসলেই টয়া একদিন কুঁজো বুড়ি হয়ে যাবে। সে কুঁজো হয়ে গেলে ইয়াদেরই কষ্ট হবে ওকে কাধে করে  তাকেই ঘুরতে হবে।

ইয়াদ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছে সে পড়তে বসলে টয়াও একই সময় নিজের পড়ার টেবিলে বসে। কিন্তু বই মুখের সামনে থেকে সরিয়ে কিছুক্ষণ পর পর তার দিকে উকি মারে। টয়া পড়তে বসে নাকি ইয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকে সেটা তার জানা নেই। ইদানিং টয়া মেয়েটা তার মাথায় বসে গেছে কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না। ইয়াদের সামনে ফাইনাল পরীক্ষা তাই সে জানালার থেকে মনোযোগ সরিয়ে বইয়ে মনযোগ দিলো।

এইদিকে টয়ার এভাবে বই নিয়ে বসে থাকা তার পরিবারে কাছে একটা বিস্ময়। কিছুক্ষণ পর পর টয়ার মা রাহেলা বেগম মেয়ের রুমে এসে উকি দিয়ে যায়। যেই মেয়ে পরীক্ষার আগে বই নিয়ে বসে না সে এখন সন্ধ্যা হলেই পড়ার টেবিলে বই মুখে নিয়ে বসে থাকে। রাতারাতি হটাৎ মেয়ের এমন পরিবর্তন ঠিক হজম হয় নি তার।

আজকাল সবাই টয়ার রুমে এসে তাকে দেখে। টয়ার বড়ো ভাই তুহিন টয়ার রুমে এসে টয়া কি বই পড়ছে তার দিকে তাকালো। টয়া ম্যাথ বই মুখের সামনে নিয়ে বসে আছে আর ঘাড় এদিক ওদিক করছে।

তুহিন একটা ভ্রু তুলে বললো,"কিরে তুই মাথ বই মুখের সামনে নিয়ে বসে আছিস কেনো? অঙ্ক কি মুখস্ত করবার জিনিস?"

হটাৎ আওয়াজ পেয়ে টয়া ভয় পেয়ে গেলো। এই শয়তানটা ওর রুমে এসেছে কেনো? টয়ার বিরক্ত লাগছে কাজের সময় সবার ডিস্টার্ব না করলে হয় না। টয়া বিরক্তি নিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে বললো," আমি অঙ্ক মুখস্ত করি বা চিবিয়ে খাই তাতে তোর সমস্যা কি? আমাকে একদম পড়ার সময় ডিস্টার্ব করবি না।" বলেই  মুখ ঘুড়িয়ে নিলো টয়া।

" ওরে আমার পড়ুয়া এসেছে রে। বই নিয়ে বসে ভাব দেখাচ্ছে। বুঝি না ভেবেছিস।", তুহিন টয়াকে উপহাস করে বললো।

" ভাইয়া তুই যাবি এইখান থেকে? নিজের রুমে গিয়ে নিজের বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে থাক। বিরক্ত করিস না আমাকে।", বলেই টয়া কলমের ক্যাপ টা খুলে হাতে নিলো। টয়ার আরো বিরক্ত লাগছে কখন যে বদমাইসটা যাবে ঘর থেকে।

তুহিন টয়াকে নাস্তা করতে আসতে বলে চলে গেলো, টয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো। টয়া জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে পড়ার টেবিলে ইয়াদ নেই। টয়া চিন্তায় পড়ে গেলো, কোথায় গেলো ইয়াদ? সেটা ভাবতে ভাবতে টয়া চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো।

সামনেই এগুতে যাবে তখনই বেশ বড় সাইজের একটা তেলাপোকা দেখে টয়া লাফ মেরে খাটে উঠে পরে। এটা আবার কোথা থেকে এলো? এক বিপদের পর আরেক আপদ এসে হাজির। তেলাপোকাটাকে যে করেই হোক রুম থেকে বের করতে হবে নইলে এই রুমে আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হবে। 

আশেপাশে ঝাটা নেই না হলে এক বারিতে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিতো টয়া। আশেপাশে কিছু না পেয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা পারফিউম হাতে নিলো টয়া। এইটা মারলে কেমন হয়? একসাথে অনেকবার স্প্রে করলে হয়তো কাজ হতে পারে। তেলাপোকার পারফিউম ভালো নাও লাগতে পারে । তেলাপোকা হয়তো রুম থেকে বেরিয়ে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। টয়া পারফিউম তেলাপোকার উপর স্প্রে করে। মনে হয় তেলাপোকার পারফিউম পছন্দ নি সে পাখনা মেলে উড়া উড়ি শুরু করেছে।

উড়ন্ত তেলাপোকা মানে টয়ার চিরো শত্রু। সে খাটের উপর মা মা করে লাফাতে লাগলো। তেলাপোকা মনে হয় বেশি ক্ষেপেগেছে। টয়া একবার খাটে লাফাচ্ছে, চেয়ারে উঠছে, বই খাতা ছুড়ে মারছে তেলাপোকার দিকে। হটাৎ তেলাপোকাটা কোথাও নেই। টয়া শান্তির নিশ্বাস ছাড়ার সাথে  আবার পর্দার ফাঁক থেকে শত্রু বেরিয়ে আসলো টয়া একটা চিৎকার দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো আর রুমের সাথের জানালাও বারান্দা দিয়ে  লাগিয়ে দিয়েছে। তেলাপোকা টয়ার রুমের এদিকে ওদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে আর টয়া মা মা শুরু করেছে। 

রাহেলা বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। রুমে এসে মেয়েকে কোথাও দেখছেন না কোথায় মেয়ে? টয়া জানালার গ্লাস দিয়ে মাকে ডাকলো। রাহেলা বেগমের কাছে এটা নতুন না। এই মেয়েকে নিয়ে সে কি করবে মাঝে মাঝে সে ভেবেই পায় না।

অন্যদিকে ইয়াদ পানির ফ্লাক্স ভরে নিয়ে এসে মা মা চিৎকার শুনেই এদিক সেদিক তাকাতেই টয়ার রুমের দিকে নজর পড়লো। দুটি বাসার সামনে ছোটো রাস্তা। তেমন দূরত্ব নেই তাই সামনে তাকালেই টয়ার রুম দেখা যায়। 

ইয়াদ পানির ফ্লাক্স হাতেই দাড়িয়ে টয়ার কান্ড কারখানা দেখছে। একবার টেবিলে উঠলো, আবার গিয়ে খাটে লাফাচ্ছে। হয়েছেটা কি এই মেয়ের? এবার বারান্দার দরজা লাগিয়ে  দিয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিসব করছে। 

মেয়েটা কি অসুস্থ? কিন্তু কথা বার্তা সবই তো স্বাভাবিক। এতদিনে এমন অস্বাভাবিক কিছু তো এর আগে দেখেনি সে।

কিছুক্ষন পর সব স্বাভাবিক হতে দেখে ইয়াদ নিজের পড়ায় মন দিলো। টয়া এদিকে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সাড়া বাড়ি মাথায় তুলে সে শান্ত হয়েছে। কিন্তু আতঙ্ক কমে নি তার মাঝে সে তাড়াতাড়ি নিজের বিছানায় মশারি খাটিয়ে ফেললো। তারপর মশারির ভেতরে বসে সে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করছে এবার বজ্জাত তেলাপোকা যতই উড়ে বেড়াক তাতে টয়ার কিছু এসে যায় না কারন তার গায়ে না পড়লেই হয়। তেলাপোকাটা পুরো রাতটাই নষ্ট করে দিলো টয়ার।

সকাল সাতটায় রাহি আর ছোঁয়া টয়াদের বাসার সামনে এসে দাড়ালো। টয়া কোনমতে দুধ দিয়ে একটা পাউরুটি গিলে ব্যাগটা নিয়ে নীচে চলে এলো।

রাহি এগিয়ে এসে টয়ার কানে ফিস ফিস করে বলল,"কিরে কাল কি হলো কিছুই তো বললি না।"

টয়া ব্যাগটা কাধে নিয়ে গেটের থেকে বের হয়ে বিজয়ের হাসি দিয়ে রাহি আর ছোঁয়ার দিকে তাকালো।

ছোঁয়া হাসি দেখেই বুঝেছে দারুন কিছু ঘটেছে। ছোঁয়া টয়াকে একটা বাড়ি দিয়ে বললো," ঢং কম কর। আগে কি হয়েছে সেইটা বল।"

টয়া ভাব নিয়ে সবটা বললো আর শেষে বললো," সে আমাকে সব সময় হাতে ঘড়ি পড়তে বলেছে জানিস!"

রাহি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল," ইয়াদ ভাইয়ার কাজ নেই তোর সাথে কথা বলবে আসবে আবার তোকে ঘড়িও পড়তে বলবে। বেশি বেশি বলিস না।"

টয়া রেগে বলল," বিশ্বাস হচ্ছে না তোদের ? তোরা তো পালিয়ে গেছিলি থাকলে দেখতি।"

এমন সময় ইয়াদ নিজের বাসার গেট থেকে কলেজের ড্রেস পরে ব্যাগ কাধে বের হলো। টয়াকে দেখে ইয়াদের বুঝতে বাকি রইলো না যে এই মেয়ে আজও তার পিছু নিবে। ইয়াদ নিজের মতো হাঁটা দিলো। টয়া পিছনে পিছনে যেতেই ছোঁয়া আর রাহি দুইজনেই টয়ার সাথে আসতে শুরু করলো। ছোঁয়া আর রাহির আসাটা টয়ার আজ ভালো লাগছে না।টয়া ওদের থামিয়ে বলে," দেখ একদম পিছু পিছু আসবি না। তোরা দূরে দূরে থাক তোদের জন্যই কালকে ধরাটা খেলাম।একদম দূরে দুরে থাক।"

টয়ার কথায় রাহি আর ছোঁয়া দুইজনেই দূরে দূরে হাঁটতে লাগলো। ইয়াদ আজ আর পিছে তাকাবে না। আর টয়াকেও কিছু বলবে না , কাল রাতে সে যা দেখেছে তাতে এই মেয়ে অসুস্থ না হলেও যে সাংঘাতিক মেয়ে সেটা তার বোঝার বাকি নেই। কিছু বললে যদি রাস্তায়  আবার লাফালাফি শুরু করে। আসুক পিছে পিছে কতদূর যেতে পারে ইয়াদও দেখতে চায়।

এদিকে অনেক্ষন ধরে টয়া হেঁটেই চলেছে ইয়াদের পিছনে তাকানোর নাম নেই। আজকে কেনো তাকাচ্ছে না। নাকি টয়া কি নিজে থেকে গিয়ে কথা বলবে সেটাও বুঝতে পারছে না।

 নিজে থেকে কথা বললে যদি ইয়াদ ওকে গায়ে পরা ভাবে। কিন্তু কাল ইয়াদ যেহেতু নিজে থেকে কথা বলেছে, আজ টয়া গিয়ে কথা বলতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই বলে নিজেকে আশ্বস্ত করলো টয়া। ইয়াদ সামনে হাঁটছে টয়া দৌড়ে গিয়ে ইয়াদের সামনে দাড়ালো। হটাৎ টয়া এভাবে ইয়াদের সামনে এসে দাঁড়াবে ইয়াদ ভাবেনি। ইয়াদ এক হাত প্যান্টের পকেটে দিয়ে টয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে কি চায় ইয়াদ কিছুতেই বুঝতে পারে না। আজকে পথ আবার আটকে দাড়িয়েছে। 

টয়া হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াদের সময় নেই। সে কালকে এই মেয়ের জন্যে বাস মিস করেছে আজ সেটা হোক তা সে চাচ্ছে না।

ইয়াদ চোঁখ মলিন কোরে প্রশ্ন করলো," আজও কি কলম কিনতে এসেছো ?"

টয়া হাসি থামিয়ে না সূচক মাথা নাড়ল। ইয়াদ এবার দাত চেপে বললো," তাহলে নিশ্চয়ই পেন্সিল কিনতে এসেছো? এদিকে হয়তো খুব ভালো পেনসিল পাওয়া যায়।"

টয়া ভ্রু কুঁচকে না সূচক মাথা নেড়ে বিরক্ত নিয়ে বললো," জ্বি না। আমি কোনো কলম,পেনসিল এইসব কিছুই কিনতে আসিনি। আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি।"

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে আবার তাকে কি দেখাবে? এই মেয়ের আচরণের কিছুই সে বুঝে না। ইয়াদ একটা নিশ্বাস ফেলে বললো," ওহ আচ্ছা!"

টয়া ইয়াদের সামনে নিজের ঘড়ি পরা হাতটা নাড়তে লাগলো। ইয়াদ এবার অবাক হয়ে এই মেয়ের কান্ড দেখছে। কি করছে এই মেয়ে? এইভাবে হাত নাড়াচ্ছে কেনো? আসলেই কি কোনো সমস্যা আছে? হাত নাড়ানো শেষে টয়া বললো," দেখুন আপনার কথা মতো ঘড়ি পড়েছি।"

টয়ার কথায় ইয়াদের বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। এই মেয়ে একটা ঘড়ি দেখাতে বিশ মিনিট ধরে তার পিছু পিছু হাটছে। ইয়াদের নিজেকে নিজের চড় দিতে ইচ্ছে করছে, ঘড়ি পরতে বলাটাই তার ভুল ছিলো। ইয়াদ বিস্ময় নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো," ও আচ্ছা ভালো। আর কিছু বলবে?"

টয়া মুখ কালো করে না সূচক মাথা নাড়ল।টয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এতো কষ্ট করে খুজে ইয়াদের ঘড়ির সাথে মিলিয়ে ঘড়িটা কিনলো অথচ এই ছেলে শুধু ও আচ্ছা ভালো বলেই শেষ। 

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টাইম দেখে বললো," যাও স্কুলে যাও।" 

ইয়াদের কথায় মন খারাপ করে টয়া পা বাড়াতেই টয়া বেখেয়ালে পড়ে যেতে নিলো। পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে টয়া না বুঝে ইয়াদের কাধের শার্টের কিছু অংশ খামচে ধরেছে।

আরও পড়ুন: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-২

Post a Comment

0 Comments