তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-২

জীবনের গল্প: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-২

পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে টয়া না বুঝে ইয়াদের কাধের শার্টের কিছু অংশ খামচে ধরলো। ইয়াদ ব্যপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো। সে টয়ার হাতের কব্জি ধরে ওকে দাড়াতে সাহায্য করলো। টয়া নিজের অন্য হাতের দিকে তাকালো যে হাতে সে ইয়াদের শার্ট ধরে ছিলো। মুহূর্তেই টয়া নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক হলো। হটাৎ এমন পরিস্থিতিতে টয়া বেশ ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। টয়ার নিজের হাত সরানোর পর ইয়াদ নিজের শাটের দিকে তাকালো ভাগ্যিস শার্টটা ঠিক আছে।


টয়া কি করবে কি বলবে বুঝতে পারছেনা এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যা হলো সেটা ঠিক তার বোধগম্য হচ্ছে না। টয়া এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে কি হয়েছে সেটা মনে মনে  করে দেখছে। ইয়াদ নিজের শার্টটা কাধ দিয়ে ঠিক করে টয়ার দিকে তাকালো মেয়েটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইয়াদ টয়ার মাথায় আস্তে করে হাতের দুইটা আঙ্গুল দিয়ে একটা টোকা দিয়ে বললো," দাড়িয়ে আছো কেনো এইভাবে? তোমার ঘড়ি দেখানো হয়েছে না? এবার স্কুলে যাও।"

ইয়াদের কথায় টয়ার হুশ ফিরল। সে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। ইয়াদ তাকে কিছুই বললো না বকাবকি পর্যন্ত করলো না! টয়ার চোখে মুখে বিস্ময়। বরাবরের মতই ইয়াদ কিছু না বলে হাটা ধরলো। 

টয়া এখনও ঘোরের মাঝেই আছে। এইদিকে ইয়াদকে চলে যেতে দেখে রাহি আর ছোঁয়া ছুটে টয়ার কাছে আসে। রাহি জোরে বলে উঠে," এটা কি দেখলাম টয়া?" 

টয়া রহির চিৎকারে চমকে উঠে আসে পাশে তাকিয়ে রাহির মুখ চেপে ধরলো। একটা দোকানদার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। টয়া ইয়াদের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে রাহির মুখ চেপে ধরে স্কুলের দিকে নিয়ে এসে বলে," গলা নাকি মাইক এইটা তোর? তোদের জন্য কোনদিন যে বাঁশ খাই। আস্তে কথা বলতে পারিস না।"

ছোঁয়া টয়াকে থামিয়ে বললো," যা দেখলাম তারপর আসতে কথা বলি কিভাবে? আগে বল কি হলো এটা?"

টয়া মলিন চোখে অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে বললো," আমি নিজেও জানি না। হটাৎ করে সুন্দর কিছু ঘটলো আবার মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেলো।"

রাহি টয়ার কথার কিছু না বুঝেই বললো," কি বললি কিছুই দেখি বুঝি না। এইসব বাদ দিয়ে বল ট্রিট দিবি কবে?"

টয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,"কিসের ট্রিট? আর জলদি চল ক্লাস শুরু হবে তো,দেরী হলে আবার আতিফ স্যার ক্লাসে ঢুকতেই দিবে না।"বলেই টয়া স্কুলের দিকে দৌড় দিলো। ছোঁয়া আর রাহিও দৌড়াচ্ছে টয়ার পিছনে।

স্কুল শেষে টয়া নাচতে নাচতে বাসায় ফিরলো। আজকের দিনটা তার অনেক ভালো গেছে। এছাড়াও বৃহস্পতিবারে টয়া বিকালে হাঁটতে যেতে পারে, সপ্তাহের একদিন সে এমন সুযোগ পায়। তার অকারণে বাসার বাইরে যাওয়া বারণ। এই একটা দিন সে নানা আকুতি মিনতি করে চেয়ে নিয়েছে। সেদিন সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। টয়া একটা জিন্স প্যান্ট, হাঁটুর উপরে একটা কামিজ আর গলায় একটা স্কার্ফ  আর কাধ পর্যন্ত চুলগুলো  খোলা রেখে বের হয়েছে। ছোট চুলে তাকে বেশ ভালোই লাগে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আজ ইয়াদও হাঁটতে বের হয়েছে। ইয়াদের মন ভালো নেই কারণ তার বাবার কিছুদিনের মধ্যেই ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে। তার মা কার সাথে জানি এই ব্যাপারে কথা বলছিলো ইয়াদ সেটা শুনে ফেলেছে। শুনেই কেনো জানি তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আবার কোনো এক নতুন শহরে যেতে হবে তাকে। ইয়াদ মন ভালো করার জন্য হাঁটতে বেরিয়েছে। সে হাঁটতে হাঁটতে রেলওয়ে স্টেশনের দিকে যাবে। তার বাবা কেনো যে পুলিশ বাদে আর কোনো পেশা বেছে নিলেন না। তার ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে প্রশ্নটা  বাবাকে  জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। তাহলেই এমন পরিবর্তন তার জীবনে আসতো না।

এদিকে টয়ার জ্যাকপট লেগে গেছে সে ইয়াদকে রাস্তায় পেয়েছে। কিন্তু টয়া ইয়াদের পিছু নেওয়ার আগে অজুহাত বানিয়ে নিলো। কখন আবার জিজ্ঞেস করে বসে কি কারণে এইদিকে এসেছো?

ইয়াদ পকেটে দুই হাত রেখে আপন মনে এগিয়ে যাচ্ছে, পিছু পিছু হেটে  যে কোনো লাভ নেই টয়া বুঝতে পারলো। টয়া দৌঁড়ে গিয়ে ইয়াদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। টয়াকে দেখে ইয়াদের বিস্ময়ের সীমা রইলো না। মেয়েটা তাকে  ফলো করতে করতে এতদূর চলে এসেছে ভেবেই ইয়াদের বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছে। 

টয়া হাঁটতে হাঁটতে বললো," আরেহ আপনি! কি করছেন এইদিকে?"

ইয়াদ আড় চোখে একবার শুধু টয়ার দিকে তাকালো কিছুই বললো না। 

টয়া আবার বললো," আমিও এইদিকে যাচ্ছিলাম। আপনাকে দেখে মনে পড়লো আপনাকে একটা জিনিস দেওয়া হয়নি।"

টয়ার কথা শুনে ইয়াদ থমকে গিয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো। এইসব কি বলেছে মেয়েটা!

টয়া ইয়াদের চোখের ভাষা বুঝতে পারছে।  নিশ্চয় সে জানতে চাচ্ছে কোন জিনসটা তাকে দেওয়া হয়নি। 

টয়া একটু হেসে বললো," আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয় নি।"

ইয়াদ এতেও কিছু বললো শুধু বিরক্তি নিয়ে একবার তাকিয়ে আবার হাটতে লাগলো। এই মেয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। যত কথা বলবে তত সে পিছু নিবে। ইয়াদও দেখতে চায় মেয়েটা তার পিছন পিছন কতদূর আসতে পারে।

ইয়াদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার কিছু হয়েছে। সে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছে। টয়া আবার দৌড়ে ইয়াদের পিছু গেলো তারপর টয়া ভয়ে ভয়ে ইয়াদকে প্রশ্ন করলো," আপনার কি কিছু হয়েছে?"

ইয়াদ দৃষ্টি সামনে রেখেই হেঁটে চলেছে সে টয়ার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবে না আজ। আর টয়া সে কি হাল ছাড়বার পাত্র নাকি? টয়া বলতে লাগলো মন খারাপ হলে কি করতে হয় জানেন? আরেকটা মন খারাপের কাজ করতে হয়। এতে মন খারাপে মন খারাপে কাটাকাটি হয়ে যায়। যদিও এটা আমার কথা না আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম কিন্তু এখন বইটার নাম মনে পড়ছে না।

ইয়াদের টয়ার কথায় একটু হাসি পেলো কিন্তু সে হাসলো না খালি একবার টয়ার দিকে তাকালো। টয়া বললো," আরে আমি গল্পের বইয়ে পরেছি। সত্যি কিনা জানি না কখনো এক্সপেরিমেন্ট করা হয়নি।" বলতে বলতেই টয়া দেখলো হটাৎ ইয়াদ টয়ার দুই বাহু ধরে তাকে অন্য পাশে নিয়ে এলো।

টয়া অবাক হয়ে ইয়াদের দিকে তাকালো। টয়ার কিছু বলার আগেই ইয়াদ বললো," এই ভাবে কেউ রাস্তায় হাটে?আরেকটু হলেই তো গাড়িটা তোমাকে উড়িয়ে দিয়ে চলে যেতো। তারপর তোমার ফ্যামিলি আমাকে ধরে জেলে দিয়ে বলবে আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছি।"

ইয়াদের কথায় টয়া নিজের হাসি থামাতে পারলো না। টয়া মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগলো। এই ছেলেটা মজার কথাও জানে সেটা টয়ার জানা ছিলো না। 

ইয়াদ হাঁটতে হাঁটতে হটাৎ থেমে গিয়ে টয়ার দিকে মুখ করে দাড়ালো মেয়েটা এখনো হেসেই যাচ্ছে। ইয়াদ টয়ার দিকে তাকিয়ে আছে বলে টয়া হাসি থামলো। ইয়াদ গম্ভীর গলায় বললো," হাসি থামাও। থামিয়ে আমাকে থ্যাঙ্কস দেও।"

টয়া ইয়াদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে চেয়ে চেয়ে এই ছেলে ধন্যবাদ নিচ্ছে কেনো? টয়াকে অবাক করে দিয়ে ইয়াদ বললো," এখুনি বলো নয়তো কাল সকালে আবার আমার পিছু পিছু হাটবে থ্যাঙ্কস বলার জন্যে।"

টয়া ইয়াদকে ব্যাঙ্গ করে বললো," কালকে শুক্রবার বুঝলেন।"

ইয়াদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তারপর আবার দৃষ্টি সামনে রেখে হাঁটতে লাগলো। টয়া ইয়াদের পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে বললো," আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো যাবেন?" ইয়াদ কিছু বললো না। 

টয়া আরো বললো,"আপনার ভালো লাগবে চলুন না।"

টয়া একপ্রকার জোর করেই ইয়াদকে কাশফুল ভরা এক জায়গায় নিয়ে এলো। ইয়াদ নিজেও বুঝতে পারছে না যে টয়ার কথায় সে কিভাবে রাজি হলো। এসব ভাবতে ভাবতে ইয়াদ টয়ার দিকে তাকালো। অন্য মেয়েদের থেকে এই মেয়েটা কেনো জানি আলাদা। ভাবতে ভাবতে ইয়াদ নিজেই নিজেকে বুঝলো ও একটা বাচ্চা মেয়ে। না বুঝে এইসব করছে হয়তো ওর মজা লাগছে তাই।

ইয়াদের এই জায়গায় এসে ভালোই লাগছে অপূর্ব এক পরিবেশ। আশে পাশে এতো সুন্দর একটা জায়গা আছে ইয়াদের জানা ছিলো না। ইয়াদ একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে একটা হাঁটু উচুঁ কোরে তার উপর হাত রেখে বসলো। ইয়াদের দেখাদেখি টয়াও ইয়াদের পাশাপাশি বসলো। টয়া দুই হাঁটুতে হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইয়াদ তার দিকে তাকানোর সাথে সাথে টয়া মাথা তুলে তার দৃষ্টি সামনের আকাশে দিকে স্থির করলো।

ইয়াদ কিছুক্ষণ টয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর এইটা ভেবে হাসলো যে এই মেয়েটা একদিন বড় হবে। তখন নিশ্চয়ই ইয়াদকে তার আর ভাল্লাগবে না। এই বয়সটাই ভালোলাগার বয়স বয়সটা পার হয়ে আসা মানে বুঝতে শেখা। তখন এই মেয়ে এইসব পাগলামি আর করবে না।

বাতাসে টয়ার চুল উড়ছে তাই  সে কপালে দুই হাত দিয়ে বসে আছে। ইয়াদের বিষয়টা বিরক্তিকর লাগছে টয়াকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় ভুগছে। ইয়াদ বিরক্তি নিয়ে বললো," কি সমস্যা তোমার? এভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছো কেনো?"

টয়া ইয়াদের দিকে মুখ করে বললো," চুলগুলোর জন্যে এভাবে বসে আছি। অনেক রাগ লাগছে কখনো মুখের সামনে আবার কখনো চোখের সামনে চলে আসে।"

ইয়াদ অবাক হয়ে তাকালো মেয়েটার হাতে রাবারব্যান্ড পড়ে আছে অথচ  চুল বাধছে না। " চুল বাঁধছো না কেনো?",

 ইয়াদের কথার উত্তরে টয়া বললো," আমি চুল বাঁধতে পারি না"

টয়ার কথা সত্য কারন তার চুল কাধ পর্যন্ত বাসায় সে চুল ছেড়েই রাখে আর স্কুলে যাবার সময় প্রতিদিন হয় তার মা নয়তো বাবা তার চুল বেধে দেয়। দুই ছেলের পরে এই মেয়ে ফরিদুর সাহেবের তাই খুব আদরেই তাকে বড়ো করেছেন তিনি। টয়ার নিজে নিজে চুল বাঁধাটাও অতন্ত্য অপছন্দ করে তাই চুল বেধে দেওয়ার কেউ না থাকলে সে তাদের দোতলার ভাড়াটিয়ার মেয়ে তমা আপুর কাছে যায়। সে অনেক সুন্দর করে চুল বেধে দেয় টয়াকে। কাউকে না পেলে তখন থাকুক চুল খোলা।

ইয়াদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো," তাহলে স্কুলে?"

উত্তরে টয়া বলে,"মা করে দেয় বেনী।"

ইয়াদ আরো বিস্মিত হলো কারন তার জানামতে নিজের চুল বাঁধতে পারে না এমন কোনো মেয়ে এ পৃথিবিতে নেই। ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো," তাহলে হাতে রাবার ব্যান্ড নিয়ে ঘুরছো যে?"

" ও আচ্ছা, আমি ভেবেছিলাম রাস্তায় রাহিকে পাবো। রাহিকে বললে ও বেধে দিতো তাই হাতে নিয়ে ঘুরছি।", টয়ার কথায় ইয়াদ কিছু বললো না সে সামনে তাকিয়ে রইল।

টয়া হাত থেকে ব্যান্ডটা খুলে ইয়াদের দিকে এগিয়ে বললো," আপনি আমার চুলটা একটু বেধে দিতে পারবেন?"

আপনি আমার চুলগুলো একটু বেধে দিতে পারবেন?", টয়ার কথায় ইয়াদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো সে।এতো সহজে টয়া একটা ছেলেকে নিজের চুল বেঁধে দিতে বলছে। এতোটা সরল হওয়া ভালো নয়।

ইয়াদ টয়াকে বললো," শোনো তুমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছো নিজের চুল নিজে বাঁধাটা তোমার শিখা উচিৎ। আর এভাবে যাকে তাকে নিজের চুল বাঁধতে বলবে না।"

টয়া মুখ কালো করে রাবার ব্যান্ডটা আবার হাতে পরে নিয়ে বললো," আমি সবাইকে আমার চুল বেঁধে দিতে বলি না এতটুকু জ্ঞান আমার আছে। আমি কি বাচ্চা নাকি?"

" তাহলে আমাকে বললে কেনো?", প্রশ্ন করলো ইয়াদ। 

টয়া কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল," আপনি পারেন কিনা সেটাই দেখতে চাইলাম।"

বাহ্ টয়া কি সুন্দর করে গুছিয়ে ব্যাপারটা স্বাভাবিক করে ফেললো। যতটা বোকা তাকে ভাবা হয়েছে মেয়েটা এতো বোকা না। ইয়াদ উঠে দাড়ালো  সন্ধ্যা হয়ে এসেছে এখনে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। আর ইয়াদ না গেলে হয়তো এই মেয়েও এখানেই বসে থাকবে। 

ইয়াদকে উঠে দাড়াতে দেখে টয়াও উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো," কি হলো? উঠে দাড়ালেন যে?" 

"বাসায় ফিরবো।", বলে ইয়াদ হাঁটতে শুরু করলো। টয়ার আরো কিছুক্ষন থাকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে কিছু না বলে ইয়াদের পিছু পিছু হাটছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। এই দিকে  চায়ের দোকানে সব সময় কয়েকটা বখাটে ছেলেকে সিগারেট হাতে বসে থাকতে দেখে।  আজও তারা সেখানেই বসে আছে। ইয়াদ হেঁটে চলে গিয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকালো। টয়া দ্রুত পায়ে হাঁটছে তবে একটা ছেলে উঠে এসে তার পাশে পাশে আসছে।

ইয়াদ থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। টয়াকে চোখের ইশারায় তাড়াতাড়ি আসতে বললো। টয়া তো মহা খুশী একা একা হাঁটতে তার খুবই বিরক্তি লাগে। যতটা আহম্মক ভেবেছিল ইয়াদ ততটাও না। টয়া তাড়াতাড়ি পা ফেলে ইয়াদের কাছে গেলো দুজনে একসাথে হাঁটবে বলে।

ইয়াদ টয়ার ভাবনায় জল ঢেলে বললো," যাও হাটো। আমার আগে আগে যাও।"

টয়া মুখ গম্ভীর করে বললো," একসাথে হাটি।"

ইয়াদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল," যেটা করতে বলেছি সেটা করো।"

টয়া আর কথা না বাড়িয়ে আগে আগে হাঁটতে লাগলো। এই ছেলে সুযোগ পেলে আগে জ্ঞান দেয় এবার অর্ডার দিতে শুরু করেছে।

ইয়াদ টয়ার পিছনে হাঁটছে, সে বুঝেছে টয়া যেই মেয়ে পিছন থেকে মুখ চেপে ধরে নিয়ে গেলেও হুশ পাবে না। এর চেয়ে আগে আগে হাঁটুক খেয়াল রাখা যাবে। 

টয়া ভেবেই পাচ্ছে না  ইয়াদ কেনো টয়ার পিছে পিছে হাঁটছে। টয়া অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটছিলো হটাৎ তার চুলে এক টান অনুভব করে। কেও যেনো তার চুল ধরে এক টান মেরেছে। টয়া হাত দিয়ে চুল ধরে পাশ ফিরতেই দেখলো নিরব মুখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে আছে। নিরবকে দেখে টয়া হকচকিয়ে উঠলো। নিরব টয়ার খালাতো ভাই, টয়ার চেয়ে দশ মাসের বড়ো। টয়া বিস্ময় নিয়ে বললো," তুই এখানে কি করছিস?"

তোকে খুঁজতে বের হচ্ছিলাম। সন্ধ্যা বেলায় কোথায় ঘুরে বেড়াস?" বলেই টয়ার মাথায় একটা বাড়ি দিলো।

টয়া নিরবের পিঠে আরো জোরে দুটো দিয়ে বলে," আমাকে মারবি না বেয়াদব।"

ইয়াদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এদের কাণ্ড দেখলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে মারামারি শুরু করেছে। ছেলেটাই বা কে? দেখে তো মনে হচ্ছে টয়া চিনে একে। ইয়াদ নিজের মতো হাঁটতে লাগলো সামনেই বাসা। এইটুকু টয়া নিজেই চলে যেতে পারবে।

এদিকে নিরব হ্যান্ডস আপ করে বললো," হয়েছে হয়েছে আর মারিস না।। ছেরে দে মা কেঁদে বাঁচি।"

টয়া বিজয় ভরা হাসি দিয়ে বললো," আমাকে মারার আগে এরপর থেকে দশবার চিন্তা করবি।" বলতে বলতে টয়া থেমে গিয়ে পিছে তাকালো ইয়াদ কোথায়? এতোক্ষণে ইয়াদের কথা তার মাথায় ছিলো না। পিছনে না দেখে টয়া সামনে তাকালো ইয়াদ সামনেই আছে। টয়া রেগে গিয়ে বললো," তুই আর কোনো সময় পেলি না? দিলি তো সব ব্লান্ডার করে।"

নিরব সামনে হেঁটে যাওয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো," এই কি সেই তোর প্রেমিক পুরুষ?"

নিরবের কথা শুনে টয়ার গা জ্বলে যাচ্ছে। প্রেমিক পুরুষ আবার কেমন কথা? টয়ার রাগ মিশ্রিত চেহারা দেখে নিরব বললো," আচ্ছা সরি, বাবা। তোর ক্রাশ হয়েছে এবার?"

টয়া হা সূচক মাথা নাড়ল। নিরব টয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ঘামিয়ে গেছে। নিরব টয়ার চুল গুলো নিজের হাতে নিয়ে বললো," দে আমাকে রাবার ব্যান্ডটা। আমি বেধে দিচ্ছি। তুই তো আবার রাজকন্যা চুল বাঁধতে পারিস না।"

টয়া আড় চোখে তাকিয়ে ব্যান্ডটা নিরবের হতে দিলো। ইয়াদ হাঁটতে হাঁটতে কি মনে করে একবার পিছনে ফিরলো। পিছনে তাকাতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। ছেলেটা টয়ার চুল বেঁধে দিচ্ছে। ইয়াদ এক পলক তাকিয়ে গেটের ভিতরে চলে যায়।

ছেলেটা কি হয় টয়ার? বয়ফ্রেন্ড? নাকি অন্য কেউ? যদি বয়ফ্রেন্ড হয় তাহলে টয়া তার পিছনে পিছনে প্রতিদিন যায় কেনো? আর যদি বয়ফ্রেন্ড না হয় তাহলে কি এমন চেনা মানুষ যে কিনা এতো যত্নে টয়ার চুল বেঁধে দিচ্ছে। ইয়াদের রাগ হচ্ছে। টয়া নিজে বলেনি তো ছেলেটিকে নিজের চুল বেঁধে দিতে? একটু আগেই তো ইয়াদকে বলেছিলো। ইয়াদের মাথায় অনেক কিছু চলছে সে চুপ করে নিজের বাসার সিড়ি বেয়ে উঠে পড়লো।

নিরব টয়ার চুল বেঁধে দিয়ে বললো," তোর লজ্জা হয় না আমি ছেলে হয়ে পরলাম আর তুই? অকর্মের ঢেঁকি একটা। চল বাসায় চল।" রাস্তা বলে টয়া আর কথা বাড়ালো না। 

ইয়াদ বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসলো। তখনই তার মা তাকে বললো," ইয়াদ তোমার বাবার খুলনায় ট্রান্সফার হয়েছে। দুদিনের মধ্যেই আমাদের সেখানে যেতে হবে। তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখো।"

ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল," মা আমার ইয়ার ফাইনালের কি হবে?"

" সেই দশ বারো দিন তুমি হোস্টেলে এসে থেকো। আমাদের কাছে যে আর কোনো উপায় নেই। তোমার বাবাকে তো একা সেখানে পাঠাতে  পারি না।", ইয়াদ বাকি কথা না শুনেই নাস্তা না করে উঠে গেলো। তার এই শহর ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।  কোনো শহর ছেড়ে যেতেই তার ভালো লাগে না।

এদিকে টয়া আর নিরব গল্প করছে। নিরব দেখতে সুন্দর একদম ফর্সা তবে এই ফর্সা রঙটা নিরবকে মানিয়েছে। কিন্তু এতো ফর্সা হওয়ার কারণে টয়া নিরবকে সাদা চামড়া বলে ডাকে। এই বয়সে নিরবের গার্ল ফ্রেন্ডের অভাব নেই। আর মেয়েরা ওকে দেখে গলে পরে। রাহি পর্যন্ত নিরব নিরব করে টয়ার মাথা খায়।  নিরব তাদের বাসায় আসলেই উল্টা পাল্টা কথা বলে টয়ার মাথা খারাপ করে দেয়।

টয়া কপালে হাত দিয়ে নিরবের বক বক সহ্য করছে। এই ছেলে এতো কথা কেনো বলে? 

টয়া ধৈর্য্য হারিয়ে বললো," একটু থাম। আমার কান দুইটার রেস্ট প্রয়োজন।"

কে শুনে কার কথা? নিরব বলে উঠলো," কাল না তোর কিসের নৃত্য প্রতিযোগিতা আছে?  ভাবছি আজকে থেকেই যাই বুঝলি তোর প্রতিযোগিতা দেখে যাবো কেমন?"

নিরবের কথা শুনে টয়ার হুশ হলো সে স্কুলের অনুষ্ঠানে একক নাচে নাম দিয়েছিল অথচ টয়া কিছুই প্রিপারেশন নেয় নি। টয়া অস্থির হয়ে গেলো," অ্যাহায় এবার কি হবে? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।"

নিরব উঠে দাঁড়িয়ে বললো," আরে চিন্তা করিস না আমি তো আছি। আমি তোকে নাচ শিখাবো।" বলে টয়ার হাত ধরে টেনে তুলে উল্টা পাল্টা নাচতে লাগলো।

ইয়াদের অসহ্য লাগছিলো তাই সে বারান্দায় এসেছিলো। এসে টয়া আর নিরবকে একসাথে দেখে মাথা আরো গরম হয়ে যায়। বিষয়টা একদমই ভালোভাবে নেয়নি ইয়াদ। টয়াকে সে যেমনটা ভেবেছিল মেয়েটা তেমন না। সে দ্রুত বারান্দা লাগিয়ে জানালায় পর্দা দিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলো। 

এদিকে টয়া নিরবকে ঘর থেকে বের করে  বিছানায় শুয়ে পড়লো কালকে সে কি করবে সেটা নিয়েই তার চিন্তা। টয়া ঘাড় ঘুড়িয়ে ইয়াদের রুমের দিকে তাকালো। সব দরজা জানালা বন্ধ আর পর্দাও টেনে দেওয়া। ওরা কি কোথায় বাইরে গেছে? একটু আগে না বাসায় ফিরলো। এতো অন্ধকার কেনো রুমটা?

আরও পড়ুন: রূপকথার শহর| নবনী নীলা

সকালে কলেজে যাওয়ার সময় আজ ইয়াদ টয়াকে গেটের সামনে দেখলো না।প্রতিদিন টয়া তার জন্য এইখানে দাড়িয়ে থাকে। ইয়াদ কিছুদূর যাওয়ার পর আবার পিছনে তাকালো  টয়া আজ আর তার আজ পিছু পিছুও আসছে না। ইয়াদ নিজের মতো করেই হাঁটছে তবে কেনো জানি আজ তার একা একা লাগছে এভাবে যেতেও ভালোলাগছে না। টয়া আজ আসেনি তাই বলে কি এমনটা লাগছে? 

টয়া অসুস্থ নাতো? ভাবতে ভাবতেই ইয়াদের কাল রাতের ঘটনা মনে পড়লো। না!  অসুস্থ হবে কেনো? কাল রাতে তো সেই বাঁদরের সাথে সুন্দর মতো নাচ্ছিলো। ভেবেই কেনো জানি ইয়াদের গা জ্বলে যাচ্ছে। কেনো এমন হচ্ছে ইয়াদ জানে না।

আজকের দিনটা ইয়াদের খুবই বাজে গেছে। তার কিছুই ভালো লাগছে না। বাসায় এসে রুমের জানালার পর্দা সরালো টয়া নিজের রুমে টয়া নেই। মেয়েটার হটাৎ আজ কি হলো? এতোক্ষণে স্কুল শেষে বাসায় ফিরে আসার কথা। ইয়াদের চিন্তা হতে লাগলো।

বিকালে ইয়াদ নীচে নামলো। প্রায় সময় নীচে টয়াকে দেখা যায়  আজ সেখানেও নেই। হটাৎ কোথায় উধাও হলো মেয়েটা।

ইয়াদ এমনেই হাঁটছিলো হটাৎ অপূর্বের সাথে দেখা। অপূর্ব ইয়াদের ক্লাসমেট। অপূর্ব ইয়াদকে  দেখে প্রশ্ন করলো," কিরে কোথায় যাচ্ছিস?"


এমনেই হাঁটতে বেরিয়েছি।"

চল সামনের মাঠে যাই। কোন স্কুলের নাকি অনুষ্ঠান হচ্ছে।"

ইয়াদ আসতে চাইলো না তবুও অপূর্ব জোড় করে তাকে নিয়ে আসলো। অন্য স্কুলের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না ইয়াদ। শুধু শুধু গিয়ে ভিড় বাড়বে। কিন্তু অপূর্ব নাছর বান্দা সে নিজেও যাবে ইয়াদকেও সঙ্গে নিবে। 

সেখানে গিয়ে ইয়াদ একটা চেয়ার নিয়ে নিজের মতো বসে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রোল করছিলো। অপূর্ব পাশেই বসলো। সে বেশ আগ্রহ নিয়েই অনুষ্ঠান দেখছে আবার কিছুক্ষন পর পর হাতে তালি দিচ্ছে। প্রায় পনেরো বিশ মিনিট  হলো ইয়াদ বসে আছে। এখানে অহেতুক বসে থাকবার কোনো কারন নেই। সে চলে যাবে বলে উঠে দাড়ালো এমন সময় একটা অ্যানাউন্সমেন্ট কানে এলো তার। অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে সে দাড়িয়ে গেলো।

এবার মঞ্চে একক নাচের জন্য আসবে  আমাদের পরবর্তী প্রতিযোগী অর্নিহা তাবাসসুম টয়া।"

এতটুকু শুনেই ইয়াদ চেয়ারে বসে পড়লো। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। ইয়াদ সেই দৃষ্টিকে তেমন গ্রাহ্য করলো না। অপূর্ব বললো," কিরে তুই না চলে যাচ্ছিলি? হটাৎ বসে পড়লি যে?"

ইয়াদ আমতা আমতা করে বলল," বসে পড়লাম কেনো ? আসলে ..... আমি ভাবলাম তোকে.... I mean তোর সাথেই যাই। তোকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না।"

অপূর্ব কথাটা ঠিক বিশ্বাস করলো না তবে সে আর কোনো প্রশ্নও করলো না। টয়া বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পরে স্টেজে উঠলো। তার ছোট চুলগুলো খোঁপা করা। ইয়াদের মুখ হা হয়ে রইলো কারণ টয়াকে এতো মায়াবতী লাগছে যে তার দিকে ইয়াদ সারাদিন অপলকে তাকিয়ে থাকতে পারবে কিন্তু কোনো ক্লান্তি আসবে না। এর মাঝে অপূর্ব বলে উঠলো," মেয়েটাকে দেখ কি মিষ্টি দেখতে। তাই না?"

ইয়াদ আড় চোখে অপূর্বের দিকে তাকালো। ইয়াদের তীক্ষ্ণ চোখ দেখে অপূর্ব ঘাবড়ে গিয়ে বলে," এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? সুন্দরকে কি সুন্দর বলবো না।" অপূর্বর কথায় ইয়াদ কিছু বললো না।

ইয়াদ অবাক হয়ে টয়ার নাচ দেখছে, খুব সুন্দর নাচে মেয়েটা। নাচের তালে চোখের যে খেলা সব মিলে অসাধারণ। পুরো ভিড়টা এখণ শান্ত সবই মন দিয়ে টয়ার নাচ দেখছে। অপূর্বর মুখ তো পুরো হা হয়ে গেছে তা বন্ধের নাম নেই। ইয়াদ হাত দিয়ে অপূর্বের মুখ বন্ধ করে দিতেই অপুর্ব সন্দেহর চোখে তাকালো কিন্তু কিছু না বলে দৃষ্টি সামনে স্থির করে রাখলো।

নাচ শেষে টয়া স্টেজ থেকে নেমে গেলো। টয়ার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো কারন তার মনে হয়েছে ভিড়ের মাঝে ইয়াদকে দেখেছে সে। টয়া স্টেজ থেকে নেমে হাপাতে লাগলো। নিরব সেখানেই ছিলো, টয়ার অবস্থায় দেখে বললো," কিরে এমন কৈ মাছের মত ছটফট করছিস যে।"

টয়া বিস্মিত চোখে নিরবের দিকে তাকিয়ে আছে। টয়া নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না ওটা ইয়াদ ছিলো। নিরব  টয়ার অবস্থা দেখে  একটু অস্থির হয়ে গেলো। নিরব একটা পানির বোতল খুলে টয়ার হাতে দিলো। টয়া একদৃষ্টিতে অন্য দিকে তাকিয়ে পানি খেলো। নিরব টয়ার হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে বললো," এমন করছিস কেনো এবার বল।"

টয়া একটা ঢোক গিলে বললো," ইয়াদ এখানে এসেছে!"। টয়ার কথা শুনে নিরবের রাগ হলো। সে ভেবেছিল হয়তো নার্ভাস হয়ে গেছে মেয়েটা কিন্তু না এমন ভাব করছে এ মেয়ে যেনো কোনো হলিউড সিনেমার হিরো এসেছে।

 নিরব বিরক্তি নিয়েই বললো," তাতে হয়েছে টা কি?"

টয়া মাথা নাড়িয়ে বললো," তুই বুঝতে পারছিস না।" 

টয়া আর কিছু বলার আগেই নিরব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো," আমার বুঝেও কোনো কাজ নেই। কি আছে ঐ ছেলের যে তাকে এতো প্রায়োরিটি দিতে হবে?"

টয়া নিরবের কথা শুনে চুপ করে গেলো। নিরব আবার প্রশ্ন করলো," কিরে বল ওই ছেলের মাঝে কি পেয়েছিস তুই?"

টয়া কিছু বললো না কারন সে নিজেও জানে না ইয়াদকে কেনো তার এতো ভালোলাগে। ইয়াদের আশে পাশে থাকলে অদ্ভুত এক অনুভুতি কাজ করে। সে অনুভুতি অনেক আলাদা।সব কিছু ম্যাজিকাল মনে হয়। এটা কি শুধুই ভালোলাগা? 

টয়া সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। ইয়াদ পুরস্কার দেওয়া পর্যন্ত সেখানে বসে ছিল। এদিকে অপুর্ব ভেবেই পাচ্ছে না ইয়াদের মত ছেলে এতক্ষন ধরে একটা অনুষ্ঠানে কি করে বসে আছে। অপূর্ব অনেকবার যেতে চাইলো ইয়াদ নানা অজুহাত দেখিয়ে থেকে গেলো। টয়ার পুরস্কার পাওয়ার পর ইয়াদ উঠে দাড়ালো। অপূর্ব ঘাড় ঘুড়িয়ে ইয়াদের দিকে তাকালো। ইয়াদের মতিগতি সুবিদার লাগছে না তার। ইয়াদ অপূর্বকে বললো," চল আর কত থাকবি?"

এতক্ষন ধরে যে আমি যেতে বলেছিলাম তার বেলায়?এখন যাবি কেনো আরো বসে যা।", ব্যাঙ্গ করে বলে উঠে দাড়ালো অপূর্ব।

এদিকে টয়া স্টেজ থেকে নেমে নাচতে নাচতে নিরবকে পুরস্কার দেখাচ্ছে। নিরব টয়াকে থামিয়ে বললো," হয়েছে থাম এবার। বাসায় চল আজ সারাদিন বাসার বাহিরে। আর ভাল্লাগছে না।"

নিরবের কথায় টয়া বলল," আমি জিতেছি তাই তোর হিংসে হচ্ছে তাই না?"

নিরব হাত জুড়ে বললো," বইন আর কথা বলিস না। চল বাসায় চল।"

টয়া হাঁটতে লাগলো, তার ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। শাড়ি পড়ে সে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। টয়া পরে যেতেই নিয়েছিলো তখনই নিরব টয়াকে ধরে ফেলে। ইয়াদ সেই সময় সেই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো।পুরো ঘটনাটা ইয়াদের সামনেই ঘটে যদিও টয়া সেটা খেয়াল করেনি কিন্তু নিরব ইয়াদকে দেখে। দেখলেও তাকে পাত্তা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন সে মনে করেনি।

ইয়াদের সেদিনের কথা মনে পড়লো। সেদিনও তো টয়া পরে যেতে নিয়ে ইয়াদের শার্ট ধরেছিল। সবটা কি টয়ার নাটক ছিলো ? নাকি মজা ছিলো।  না হলে একই ঘটনা আরেকজনের সাথে  কি করে ঘটে। হতেই পারে সবটা মজা ছিলো, না হলে দিব্যি আজ ইয়াদকে ভুলে অন্য ছেলের সাথে ঘুরছে। সবটা ভেবে ইয়াদের রাগ বেড়েই চলেছে। মেয়েটার প্রতি তার দুর্বলতা তৈরি হয়েছে, সেটা ইয়াদ নিজেও বুঝতে পারছে। ইয়াদ মেয়েটাকে ঠিক বুঝতে পারছে না।

সকালে গেট থেকে বের হয়ে ইয়াদ টয়াকে দেখলো। ইয়াদ আজ নিজের মতো হাঁটতে লাগলো। টয়া আজ পিছু পিছু হাটছে না ইয়াদের পাশাপাশি হাঁটছে। ইয়াদ কিছু বলছেনা কারন তার এ কয়েকদিনের রাগ জমে তার মাথা ব্যাথা হয়ে আছে।

টয়া হাঁটতে হাঁটতে বললো,"  আপনি কি কালকে আমাকে দেখতে মাঠে গিয়েছিলেন?" 

টয়ার কথায় ইয়াদ চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ সামলাতে চেস্টা করলো। লাভ হচ্ছে না এইসবের একটা শেষ হওয়া দরকার। ইয়াদ টয়া হাত ধরে টেনে ওকে প্রথম দিনের সেই জায়গায় নিয়ে এলো।

ইয়াদ টয়ার হাত ধরে টেনে টয়াকে প্রথম দিনের সেই জায়গায় নিয়ে এলো। টয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইয়াদ বেশ রেগেই বললো," সমস্যা কি তোমার? আমার পিছু নিচ্ছ কেনো প্রতিদিন?"

হটাৎ ইয়াদের এমন আচরণে টয়া কিছু বুঝল না। টয়া রেগে বললো,"আপনার পিছু নিতে যাবো কেনো? রাস্তা কি আপনার একার?"

ইয়াদ রাগ মিশ্রিত একটা নিশ্বাস ফেলে বললো," হুম, জিজ্ঞেস করলে এটাই তো বলবে। সৎ সাহস থাকতে হবে তো তাই না। নাকি এটা কোনো ট্রিক?"

টয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। ট্রিক বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছে ইয়াদ। হটাৎ এমন আচরণ করছে কেনো সে।

টয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো," ট্রিক! কিসের ট্রিক?"

" হ্যা এখন তো কিছুই বুঝবে না। ইনোসেন্ট সাজবে কিন্তু এইসবে আমাকে বোকা বানাতে পারবে না। বয়স কতো তোমার? এই বয়সেই উচ্ছন্নে চলে গেছো? রাস্তা ঘাটে এইসব করে বেড়াচ্ছো? চুল বেঁধে দিচ্ছে, হাত ধরে টেনে তুলছে।", বলেই ইয়াদ থেমে গেলো। সে আর কিছু বলতে চায় না। রাগ হলে সে নিজেও জানে না সে কি বলে। তাই নিজেকে থামিয়ে নিলো সে।

টয়া চুপ হয়ে আছে।সে মাথা নিচু করে দুই হাত শক্ত করে ধরে দেওয়ালের সাথে ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে। তার সম্পর্কে কেউ এমন ধারণা রাখতে পারে সেটা সে কোনো দিন কল্পনাও করেনি। ইয়াদ তাকে এতো নোংরা ভাবে কেনো?টয়ার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তাও সে চোখ তুলে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো," আপনি ভুল করছেন।না জেনে কথা বলবেন না।"

" না জেনে বলছি না, নিজের চোখে তোমাদের দেখেছি।  আমারই ভুল হয়েছে তোমাকে সরল ভেবেছিলাম। আজকের পর থেকে আমি যেনো তোমার ছায়াও আমার আসে পাশে না দেখি, কথাটা যেনো মনে থাকে।", বলে  একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়াদ চলে যায়।

টয়া স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চোখের পানি সে আটকাতে পারছে না। তার সম্পর্কে ইয়াদ এতো খারাপ ধারণা রাখে সেটা ভেবেই তার কষ্ট হচ্ছে। সে এতো খারাপ একটা মেয়ে, সেটা তার জানা ছিলো না। টয়া সেখানে হাটুতে মাথা রেখে বসে পড়লো, চোখের জল তার গাল বেয়ে নামছে।

ইয়াদ কিছুদূর গিয়ে বুঝতে পারলো সে কাজটা ঠিক করেনি। রাগের মাথায় হয়তো বেশি বলে ফেলেছে। মেয়েটার যা ইচ্ছা সে করবে তাকে ইয়াদের কি যায় আসে। কেনো সে এত রাগ করছে। ইয়াদের একবার ফিরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো কিন্তু ইচ্ছাটাকে সে ইচ্ছা রেখেই কলেজের বাসে উঠে গেলো। কলেজ থেকে ফিরে প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় সে কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলো। উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম বের হওয়ার সাথে সাথে তার মাকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। ইয়াদ মুখ মুছতে মুছতে প্রশ্ন করলো," কি হয়েছে মা?"

ইয়াদের মা অস্থির হয়ে বললো," আরে আমাদের এলাকার একটা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগেই এলাকায় মাইকিং করে গেলো।  আজকাল যা অবস্থা চারিদিকের আল্লাহ যেনো মেয়েটাকে সুস্থ ভাবে তার বাবা মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়।"

ইয়াদ গলা শুকিয়ে এলো। এলাকার একটা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ইয়াদ ছুটে নিজের রুমে গেলো রুমের পর্দা সরিয়ে প্রথমেই টয়ার রুমের দিকে তাকালো। টয়া রুমে নেই। তাহলে যাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না সে কি টয়া? ইয়াদ চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটাকে বেশি বেশি বলে ফেলেছে ইয়াদ। সে কারণেই কি বাসায় ফিরে নি? ইয়াদ কোনোভাবেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। সে কোনো কিছু না ভেবেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।এমন হতে পারে মন খারাপ করে টয়া আগের জায়গায় বসে আছে, বাসায় যায় নি। সেখানে গেলেই তাকে পাওয়া যাবে।

ইয়াদ আর অপেক্ষা করল না দৌড়াতে শুরু করল। সেখানে পৌঁছে ইয়াদ আরেকটা ধাক্কা খেলো। টয়ার ব্যাগ পরে আছে কিন্তু টয়া কো থায়? ইয়াদ কিছু ভাবতেও পারছেনা ভাবতে গেলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে। কোনো কিছু হয়নি তো! না সে কিছুই ভাবতে পারছে না। টয়াকে খুঁজতেই হবে।ইয়াদ অনেক চিন্তা করলো কোথায় থাকতে পারে টয়া। সেদিনের সেই কাশফুলের মাঠে যায় নি তো। এটাই শেষ আশা, ইয়াদ আর দাড়ালো না। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা হবে তার আগেই মেয়েটাকে খুজে বের করতে হবে। 

টয়া কাশ ফুলের সেই মাঠে মাথা নিচু করে বসে আছে। এক মুহুর্তে যেনো তার পৃথিবীটাই পাল্টে গেছে। ষোলো বছরের একটা মেয়ের কাছে এই অনুভুতিগুলো অনেক বেশি মূল্যবান। ইয়াদ না বুঝেই সে অনুভূতিতে ছুরি দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করেছে। নিজেকে এতো বিচ্ছিরি এর আগে লাগেনি তার কাছে।

ঐদিকে টয়ার বাসার সবাই অস্থির। তার বাবা পুলিশে ফোন করে রাগারাগি করছে। তার মেয়েকে যেকোনো মূল্যে খুঁজে দিতে হবে নয়তো কারোর চাকরি থাকতে দিবে না। নিরবও টয়ার নিখোঁজের সংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছে। খুঁজতে খুঁজতে নিরব টয়াকে দেখলো স্কুল ড্রেস পরা অবস্থায় এক কোণে বসে আছে। নিরবের মাথায় রক্ত ওঠে গেছে। এই মেয়েকে খুঁজতে খুজতে সে পাগল হয়ে গেছে আর দেখো সে এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে। নিরব টয়ার হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো। টয়া দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে কোনো কথা বলছে না।

নিরব ভেবেছিলো ইচ্ছা মতন বকবে টয়াকে কিন্তু টয়ার অবস্থায় দেখে  নিরব  আর কিছু বলতে পারলো না। অনেক কেঁদেছে বুঝাই যাচ্ছে চোখ মুখ ফুলে আছে, নাক লাল হয়ে গেছে। টয়াকে এই অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেলো সে।

নিরব বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো," কি হয়েছে তোর? এমন লাগছে কেনো তোকে?"

টয়া কোনো কথা বললো না। নিরব বুঝতে পেরেছে কোনো কারনে টয়া অনেক কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কি সেটাই বুঝতে পারছে না। নিরব গলা নরম করে বললো," কি হয়েছে তোর আমাকে বল। কেউ খারাপ কিছু করেছে? টিজ করেছে? আমাকে বল, দেখ কি হাল করি।"

টয়া না সূচক মাথা নাড়ল তারপর আবার কাদতে লাগলো। নিরব কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা না টয়াকে এভাবে দেখতেও ভালো লাগছে না তার। নিরব একটা নিশ্বাস ছেড়ে টয়াকে  হাত দিয়ে আগলে টয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লাগলো।

ইয়াদ খুঁজতে খুঁজতে টয়াকে পেয়েছিলো কিন্তু ইয়াদের পৌঁছানোর আগেই নিরব এসে টয়াকে টেনে  তুলে তাই ইয়াদ আর আগায় না। টয়াকে নিরব সেখান থেকে নিয়ে যায়। 

ইয়াদ পুরোটা দেখে চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ফেললো। 

রাত হয়ে গেছে কিন্তু ইয়াদের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। এই মাঠে কিছুক্ষণ বসতে ইচ্ছে করছে এমনিতেও আর হয়তো  এই মাঠে আসা হবে না কোনোদিন।

ইয়াদ সেই জায়গায় চুপ করে দৃষ্টি সামনে স্থির করে বসে রইলো। কাল সে চলে যাচ্ছে, এই শহরে আর কোনোদিন আসা হবে কিনা সেটা সে জানে না। 

টয়া মেয়েটির সাথে কি তার আর কোনোদিন দেখা হবে? যাকে চলে যাবার আগে একরাশ কষ্ট দিয়ে ফেললো। টয়া হয়তো এর পর আর ইয়াদকে মনে করবে না কোনোদিন।ভালোই হয়েছে ঐ ছেলেটা তার আগে এসেছে। ইয়াদ গেলে হয়তো টয়া তার সাথে ফিরতে চাইতো না। ইয়াদ ঘাস ভরা গা হেলিয়ে মাঠে শুয়ে পড়লো। এভাবে আকাশ দেখতে অনেক ভালো লাগে, কি সুন্দর তারা জ্বলছে। টয়া কি এভাবে ঘাসে শুয়ে কোনোদিন  আকাশ দেখেছে? চোখ বন্ধ করে দুই হাত ঘাসে মেলে দিতেই ইয়াদের ডান হাতে কি যেন লাগলো। ইয়াদ ঘাড় উচু করে হাত বাড়িয়ে সেটা তুললো। কারোর ঘড়ি মনে হচ্ছে। ইয়াদ শুয়ে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘড়িটা চেনা চেনা লাগছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো এই ঘড়িটা টয়ার। টয়া সেদিন তাকে এই ঘড়িটা দেখাতেই পিছু পিছু এলো।ইয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যে জিনিস আবিষ্কার করলো, তা হচ্ছে ইয়াদের হাতের ঘড়ির সাথে এই ঘড়িটার অনেক মিল।

খুজে খুজে মেয়েটা একই ঘড়ি কিনেছে। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ইয়াদের মুখে হাসির ঝিলিক এলো।

পরের দিন সকালে ইয়াদরা চলে গেলো। যাওয়ার আগে ইয়াদ অনেক চেস্টা করেছে টয়াকে দেখতে কিন্তু পারে নি কারণ টয়ার রুমের সব পর্দা দেওয়া ছিলো। একবার দেখে যেতে ইচ্ছা হয়েছিলো ইয়াদের। কিন্তু জীবনের সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই। এই ইচ্ছাটা অপূর্নই থাকুক।

টয়া ইয়াদ গল্পটা কি এইটুকুই ছিলো? সব গল্পের শেষটা তো আর সুন্দর হয় না। টয়া ইয়াদকে ভুলবে কিনা জানা নেই তবে টয়া নামের এই মেয়েটিকে ইয়াদ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কারন টয়া নামের মেয়েটি তার হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলেগেছে।

আরও পড়ুন: তোমার খোঁজে এই শহরে| নবনী নীলা| পর্ব-৩

Post a Comment

0 Comments