বকুল তলায় এক জোড়া পায়রা | স্বপ্নিল সৌমিক

বকুল তলায় এক জোড়া পায়রা | স্বপ্নিল সৌমিক | পর্ব-১

পাত্র হিসেবে নিজের কোচিং সেন্টারের স্যার দেখে সাথে সাথে জ্ঞান হারালো অন্তি। ঘটনা টা এতো দ্রুত ঘটলো যে সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। 

সদ্যই পাত্র পক্ষের সামনে এনে অন্তিকে বসিয়ে ছিলো ওর ভাবি। সে মাত্র একবার পাত্রের দিকে তাকালো আর সাথে সাথে জ্ঞান হারালো।

কিন্তু কেউই আসল কারণ বুঝতে পারলো না। সোফায় পড়ে যেতেই দৌড়ে অন্তির মা এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।মুহূর্তেই শান্ত পরিবেশ গমগমে হয়ে উঠলো। 

তার ভাবি ছুটলো রান্নাঘরে পানি আনতে। 

ভাই আর বাবা ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন হঠাৎ মেয়ের মূর্ছা যাওয়া নিয়ে। 

এদিকে আয়ুশ পুরাই বেকুব বনে গেলো। সে নিজেও জানতো না মা তার জন্য তারই স্টুডেন্ট কে পাত্রি হিসেবে দেখতে নিয়ে আসছেন। 

মা তাঁকে এমন ভাবে বাড়িতে বললেন মেয়ে না-কি হিরের টুকরো। লাখে এমন একটা মেয়ে পাওয়া যায়। এই মেয়েকে উনার এতোটা মনে ধরেছে যে 

তাকে নিয়ে দেখতে আসার পর যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে একেবারে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলবেন।

মা'য়ের এতোটা পছন্দের উপর দ্বিমত করতে ওর ইচ্ছে করেনি। আলাদা কোনো পছন্দ ছিলো না। এমনকি এই সময় বিয়ের ও ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু মা'য়ের জোড়াজুড়ি তে বিয়ে করতে রাজি হতে হলো ওকে। কিন্তু কে জানতো পাত্রী ওর নিজেরই ছাত্রী।

আর কেউ বুঝতে না পারলেও সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে অন্তির জ্ঞান হারানোর কারণটা। হিশ কী এক লজ্জা জনক ঘটনা। এই মুহুর্তে ওর ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু না এমনটা মোটেই করা যাবে না। সবকিছু স্বাভাবিক হলে মা'কে কোনোভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোনোভাবে এখান থেকে চলে যাবে। কিন্তু এখন এখানে তো পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

অন্তির মা কান্না করতে শুরু করেছেন। ওর বাবার মুখের অবস্থাও করুন। ভদ্রলোক যেকোনো সময় কেঁদে ফেলবেন। 

আয়ুশের মা ও ইতিমধ্যে ওদের কাছে দাড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

অন্তির ভাবি চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তি চোখ পিটপিট করে খুললো।ওর সামনে পরিবারের এতোগুলা মুখ দেখে ভড়কে গেলো। 

যখনই মাথায় আসলো যে পাত্রের বেশে তার কোচিং এর স্যারকে দেখেছে সাথে সাথে তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে।

তারমানে সে এতক্ষণ মটকা মেরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো। ইশ কী এক বিশ্রি ঘটনা ঘটে গেলো। 

অন্তিকে চোখ খুলতে দেখেই ওর বাবা সাথে সাথে ওকে জিজ্ঞেস করলেন, “ অন্তি মা আমার। মাথা ঘুরে পড়ে গেলে কী করে? তোমার শরীর খারাপ ছিলো বুঝি? কাউকে বলোনি কেনো অসুস্থতা কথা। ”

অন্তির মা তারপর বললেন, “ আরও খাবার খাওয়ায় অনিয়ম কর। দেখ ঠিকমতো খাবার না খাওয়ায় দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিস। ”

মা বাবার কথা শুনে অন্তি কী বলবে ভেবে ফেলো না। তারা ওকে যেই ভোল্টেজের শক দিয়েছে তাতে সে কী করে জ্ঞান না হারিয়ে থাকতে পারে? 

কিন্তু একথা মুখ ফুটে সে কী করে বলবে?

এরই মাঝে অন্তিকে তার মা আর ভাবি মিলে বসালো। অন্তি দেখলো আয়ুশ মাথা নিচু করে বসে আছে। সেই মুহুর্তে আয়ুশের মা বলে উঠলেন,

“ খাবার দাবারে এতো অনিয়ম করলে চলবে মা। এই যে আজ মাথা ঘুরে পড়ে গেলে। ”

অন্তির ইচ্ছে হলো গলা ফাটিয়ে সবাইকে বলুক। আন্টি আপনার ছেলেকে দেখে আমি যে পরিমান শক পেয়েছি তাতে তো এতোক্ষণেও যে হার্ট হ্যাটাক করিনি এটাই অনেক বড়ো৷

সে আয়ুশের মায়ের কথার প্রেক্ষিতে মেকি হাসলো শুধু। তখন অন্তির বাবা বলে উঠলেন, 

“ মেয়েকে তো দেখলেন। যদিও একটু ভিন্ন ভাবে। এখন অন্তিকে তাহলে ঘরে পাঠিয়ে দেই। সে বিশ্রাম করুক আর আমরা কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যাই। 

অন্তিকে আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে একটু পর না-হয় আবার ডেকে নিবো। ”

“ হ্যাঁ হ্যাঁ তাই ভালো। অন্তি মা বিশ্রাম করুক। ”

আয়ুশের মা কথাটি বললেন।

অন্তি তার বাবার কথা শুনে জানপ্রাণ অবাক হলো। কথা এগিয়ে নিবেন মানে কী? সে কী এই বিয়েতে রাজি না-কি? আয়ুশ স্যার কে বিয়ে? অসম্ভব! কিন্তু বাবার কথার উপর সে কী করে কথা বলবে? তবে এখন কথা না বললে যদি অনেক দেরি হয়ে যায়। 

আর আয়ুশ স্যারই কী করে পারলেন ওকে বিয়ের প্রস্তাব আনতে? না-কি তিনিও জানতেন না?

অন্তি সাহস করে তার বাবাকে ডাক দিলো, 

“ বাবা। ”

“ হ্যাঁ, মা। তোমার শরীর খারাপ করছে? এখানে বসে থাকতে হবে না। তুমি রুমে চলে যাও। "

একি বাবা ওকে কথা বলতে দিচ্ছে না কেনো? সে আবার বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ওর ভাবি এসে ওঁকে উঠিয়ে রুমে নিয়ে আসলো।

আয়ুশের অবস্থাও একই। মা'কে থামাতে হবে ওর। সে কিছুতেই অন্তিকে বিয়ে করতে পারবে না। 

এর মাঝেই আয়ুশের মা অন্তির বাবাকে বললেন, 

“ তা ভাই সাব। আপনাদের মেয়েকে যে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে তা তো আগেই আমি বলেছি। আর আমার ছেলেকেও যে আপনার পছন্দ হয়েছে তা-ও আপনি জানিয়েছেন আগেই তাহলে এখন কথা আগানো যাক। ”

“ অবশ্যই। ”

নিজের মা আর অন্তির বাবার কথা শুনে আয়ুশ যেন আকাশ থেকে পড়লো। ওর মাতো ওকে বাড়িতে বলছিলেন তারা-ও আজ প্রথমবার ওকে দেখবেন কিন্তু এখন তো ঘটনা পুরো ভিন্ন। 

তার মানে আজ তার মা ওকে নিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে এসেছেন? 

না কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। মা'কে থামাতেই হবে। তাই আয়ুশ তার মা'কে ডেকে উঠলো। 

“ মা তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলার আছে।”

“ বাড়িতে গিয়ে বলো। ”

“ না মা এখনই বলতে হবে। ”

অনামিকা বেগম পড়লেন বিপাকে। এখন এখানে ছেলের সাথে একান্তে কী করে কথা বলেন। 

তাই তিনি আবারও আয়ুশকে শুধালেন, 

“ আয়ুশ পরে কথাটি বলো। ”

“ মা তুমি একটু বুঝার চেষ্টা করো। আমায় কথাগুলো এখনই বলতে হবে। ”

“ আচ্ছা বেয়াইন তাহলে আপনি বরং আয়ুশ বাবার সাথে আলাদা একটু কথা বলে নিন। আমরা না-হয় ততক্ষণ একটু অন্য কাজ করে আসছি। ” 

কথাটি অন্তির বাবা বললেন। 

তিনি অন্তির মা আর উনার বড়ো ছেলে আরাফকে ইশারা করলেন ভিতরে যাবার জন্য। তারা উনার কথামতো তাই করলো।

সবাই চলে যেতেই আয়ুশ অনামিকা বেগমকে বলে উঠলো, “ মা আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। ”

“ কী বলিস এসব!বিয়ে করতে পারবি না মানে!তুই তো বলেছিলি তোর কোনো পছন্দ নেই আমার পছন্দেই বিয়ে করবি। এখন আমার অন্তুিকে পছন্দ হয়েছে। তাহলে এখন তোর সমস্যা কী? ”

“ মা অন্তি আমার কোচিং সেন্টারের স্টুডেন্ট। ”

“ তাতে কী হয়েছে?”

“ তুমি এতো স্বাভাবিক কী করে থাকছো? অন্তি আমার স্টুডেন্ট মা। আমি কী করে ওকে বিয়ে করবো? ”


“ সমস্যা কী তাতে আয়ুশ? অন্তি তোর স্টুডেন্ট এটাই? আচ্ছা পৃথিবীর কোনো স্যারের কী তাদের স্টুডেন্ট এর সাথে বিয়ে হয়না। তাছাড়া অন্তি তো আর বাচ্চা নয়। আর বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হচ্ছে তাতে তো কোনো সমস্যা হবার কথা না। ”

“ মা তুমি বুঝতে পারছো না। আমি কোনোভাবেই অন্তিকে বিয়ে করতে পারবো না। ”

“ এটাই তোমার শেষ কথা? ”

“ হ্যাঁ। ”

“ আমার সিদ্ধান্তের কোনো দামই নেই তোমার কাছে।আমি অন্তির মা বাবাকে কথা দিয়ে দিয়েছি আগেই আয়ুশ। এখন আমি কী করে কথার খেলাপ করি। তাছাড়া আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি তোমার নিজের কোনো পছন্দ আছে কী-না? তুমি না বলায় আমি আমার পছন্দ মতো মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করতে চাইছি আর তুমি এখন অন্য সুর তুলছো? ”

“ মা আমি তোমার পছন্দেই বিয়ে করবো কিন্তু অন্তিকে নয়। ”

“ তুমি কী চাও আমার কথার খেলাপি করে আমাকে অপমান করতে যদি এটাই চাও তাহলে আমি না করে দিচ্ছি। ”

“ মা তুমি ইমোশনাল কথা বলছো। ”

“ এখন আমার সম্মান তোমার হাতে আয়ুশ৷ তুমি ভেবে বলো কী করবে? ”

আয়ুশ আর পারলো না তার মায়ের কথার উপর কথা বলতে। ছোটোবেলায় ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে ওর মা অনেক কষ্টে ওকে মানুষ করেছেন । এখন সে কী করে মা'কে অপমানিত হতে দেখবে? 

“ তোমার চুপ থাকা কী আমি বিয়েতে সম্মতি ধরে নিবো আয়ুশ? ” অনামিকা বেগম জিজ্ঞেস করলেন।

আয়ুশ জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে রইলো। অনামিকা বেগম তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন।

সেই সময় অন্তির ভাবিকে অন্তির ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে আসতে দেখলেন।

অন্তির ভাবি সায়মা বসার ঘরে আয়ুশ আর ওর মা'কে একা বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ আপনারা একা বসে যে?মা বাবা উনারা কোথায়?”

অনামিকা বেগম তখন সায়মাকে বললেন, “ তোমার শশুর আমাদের মা ছেলেকে একা কথা বলতে দিয়ে একটু ভিতরে গিয়েছেন। তুমি ওদের এখন ডেকে দাও তো মা। ”

সায়মা সাথে সাথে গিয়ে ওর শশুর শাশুড়িকে ডেকে আনলো। অন্তির বাবা আয়ুশ দের সামনের সোফায় বসতে বসতে বললেন, “ তা বেয়াইন কথা হলো ছেলের সাথে। ”

“ হ্যাঁ,। ” অনামিকা বেগম হেঁসে বললেন।

“ তাহলে এবার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা যাক।”

“ অবশ্যই। ”

সেই সময় আয়ুশ হঠাৎ করে বলে উঠলো, 

“ আমি অন্তির সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। ”

“ অন্তি তুমি এই বিয়েতে মানা করে দিও।আমার পক্ষ থেকে আর না করা সম্ভব নয়। আমি আমার মা'য়ের সম্মান রক্ষার্থে কিছু বলতে পারছি না। ”


অন্তি মাথা নিচু করে রইলো। এইযে ওর স্যার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তা-ও শিক্ষক ছাত্রী সম্পর্কে নয় একজন বিয়ের পাত্র পাত্রী হিসেবে সেটা ওর কাছে অনেক দৃষ্টি কটু লাগছে।


আয়ুশের কাছে সে আজ একবছর ধরে কেমিস্ট্রি সাবজেক্ট টা ব্যাচের সাথে পড়াশোনা করছে। বান্ধবীদের কাছে আয়ুশ কে নিজের ক্রাশ বললেও কখনো সে ভাবতেও পারেনি এমনটা কখনো ঘটবে।

আয়ুশ যদি ওর স্যার না হতো তাহলে সে কখনোই এই বিয়েতে দ্বিমত করতো না। আয়ুশের মতো চার্মিং লুক আর উচ্চ ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যাক্তিকে বিয়ে করার জন্য যেকোনো মেয়েই মুখিয়ে থাকবে সেখানে সে নিজেও ব্যাতিক্রম নয়। 

তাছাড়া এই মুহুর্তে সে কী পারবে বিয়ে ভাঙতে? 

বাবার মুখের উপর আজ পর্যন্ত কখনো সে কথা বলেনি। আজ কী করে বলবে সে এই বিয়ে করতে পারবে না?


“ কী হলো অন্তি কী ভাবছো? ”


আয়ুশের প্রশ্নে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে সে। 

আয়ুশের পানে থাকিয়ে উত্তর দেয়, 

“ আমি চেষ্টা করবো এই বিয়ে আটকানোর তবে আপনি খুব বেশি আশা রাখবেন না স্যার। 

আমার বাবা খুব স্ট্রিক্ট মানুষ নিজে যা সিদ্ধান্ত নিবেন তাই করবেন। কখনো অন্য কারো কথা শুনবেন না। ”


“ তাই বলে বিয়ের মতো ডিসিশন তুমি পুরোটা তোমার বাবার উপর ছেড়ে দিবে?”


“ আপনিও তো আপনার মা'য়ের উপর ছেড়ে দিলেন। ”

“ আমার সিচুয়েশন টা ভিন্ন। ”

“ আমার সিচুয়েশন ও আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। ”

তারপর দু'জনেই চুপ হয়ে গেলো। দু'জনের কেউই তাদের মনের মধ্যে চলা কথাগুলো একে অপরকে বুঝাতে পারছে না। আয়ুশ নিঃশব্দে অন্তির রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো । 

তখন অন্তি বলে উঠলো, “ আমি শেষ চেষ্টা টা করবো স্যার। কিন্তু আপনাকে গ্যারান্টি দিতে পারছি না। পারলে আপনি-ও আপনার পক্ষ থেকে চেষ্টা করবেন। ”

আয়ুশ কয়েক মুহূর্ত অন্তির দিকে থাকিয়ে বেরিয়ে গেলো। বসার ঘরে ওর মা আর অন্তির বাবা ওর জন্য অপেক্ষা করছেন বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।

সে এসে অনামিকা বেগমের পাশে বসতেই অন্তির বাবা বলে উঠলেন, “ তা বাবা অন্তির সাথে কথা হয়েছে? ”

আয়ুশ মাথা নাড়লো। তখন তিনি আবার বললেন,

“ তাহলে আমরা কথা এগোতে পারি। ”

সেই মুহুর্তে আয়ুশ বলে উঠলো, “ আঙ্কেল অন্তির মতামত কী এই বিয়েতে? ”

অন্তির বাবা এই কথা শুনে চমকে উঠলেন। তিনি আয়ুশ কে জিজ্ঞেস করলেন,“ অন্তি তোমাকে কিছু বলেছে? ”

“ নাহ্। কিন্তু বিয়েতে অন্তির মতামত...। ”

বাকি কথা বলার পূর্বেই অন্তির বাবা আয়ুশ কে থামিয়ে দিলেন। তিনি হাসি মুখে বললেন,

“ আমার মেয়ে আমার পছন্দের উপর কখনো কথা বলবে না। সেই বিশ্বাস আমার অন্তির উপর আছে। 

আর অন্তির ও তার বাবার উপর পুরো বিশ্বাস আছে।”


এই কথার পর কী বলা যায় সেটা আর আয়ুশের জানা নেই। যখন তার মা আর অন্তির বাবা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করবেন তখন আয়ুশ বলে উঠলো, 

“ এই মাসে বিয়ে করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এই মাসের শেষ দিকে আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। ”


“ তাহলে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে না-হয় হোক।” অন্তির বাবা বললেন।

“ তাই ভালো হবে। আগামী মাসে তো আর তোমার কোনো সমস্যা নেই আয়ুশ? ” অনামিকা বেগম জিজ্ঞেস করলেন।

আয়ুশ মাথা নেড়ে না বুঝালো। এখন শেষ ভরসা অন্তিই। সে যদি কিছু একটা করতে পারে। 

নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে আয়ুশের অন্তি এবার ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে আর সে এবছর মাস্টার্স শেষ করেছে বয়সের গ্যাপ ছয় কী সাত বছর। তারচেয়ে বড়ো কথা একবছর ধরে অন্তিকে সে পড়াচ্ছে। 

যখন এই কথাটা বাকি সব স্টুডেন্ট দের কানে যাবে তখন তারা আয়ুশের সম্মন্ধে কী ভাববে? 

বাড়ি ফেরার পর থেকে একটু স্বস্তি পাচ্ছে না আয়ুশ। যতোবারই নিজের সাথে অন্তিকে ভাবছে ততোবারই একপ্রকার গ্লানি ওকে ঘিরে ধরেছে। 

সে যদি একটা বারও জানতে পারতো মা'য়ের পছন্দ করা মেয়ে অন্তি তাহলে সে অনেক আগেই মা'কে থামিয়ে দিতো। 

এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায় শুয়ে ডান হাতটা কপালের উপর রাখলো সে। এসব চিন্তা করতে করতে মাথা ধরে গিয়েছে। 

সেই সময় ওর ফোনটা ভাইব্রেট হলো। 

সে হাত আঁকড়ে ফোনটা বালিশের কাছ থেকে নিয়ে দেখলো ওর মামাতো বোন ঐশি কল দিয়েছে। 

সে কল রিসিভ করতেই ঐশি হড়বড় করে বলে উঠলো, “ ভাইয়া একী শুনলাম! অন্তি বললো তোমার সাথে না-কি ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। 

ফুফির দেখা মেয়ে তাহলে অন্তিই। ”


“ তুই সত্যি করে বলতো অন্তি কী সত্যিই জানতো না আমার সাথে ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে? ”

চাপা গম্ভীর স্বরে ঐশী কে জিজ্ঞেস করলো আয়ুশ।


“ অন্তি সত্যিই জানতো না ভাইয়া। আজ সকালেই না-কি ওর বাবা ওকে বলেছেন তাকে দেখতে পাত্র পক্ষ আসছে। আর তোমাকে দেখার পর না-কি সে জ্ঞান ও হারিয়ে ছিলো? ”

“ হুম। ”

“ জানো ওর বাপ একটা আস্ত হিটলার। কী দরকার ওকে এখনই বিয়ে দেওয়ার? ”

“ কিছু বুঝতে পারছি না ঐশী কী করবো? তুই একটু মামাকে বলে দেখনা সে যেন মা'য়ের সাথে কথা বলে। ”

“ আরে বাবা তো অন্তির ছবি দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে পড়েছেন। উনার না-কি নিজের ভাগ্নের জন্য অন্তির মতো সুন্দরী মেয়েই দরকার আছে৷ বাই দ্যা ওয়ে ভাইয়া অন্তিকে কিন্তু তোমার সাথে বেশ মানাবে। ”

“ বাজে কথা বলিস না। ”

আয়ুশ ধমকে উঠলো।

ঐশী তখন খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। অন্তি আর সে জানের জিগরের দোস্ত। একসাথেই দু'জনে আয়ুশের ব্যাচে পড়ে। এইতো মাত্রই অন্তি ওকে ফোন করে সব ঘটনা বললো।

আয়ুশের ভালো লাগলো না ঐশীর হাসি। সে খট করে কল কেটে দিলো। আপাতত ঘুমানো যাক পাঁচ টায় একটা ব্যাচ আছে।

অন্তি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনটা ওর বড্ড উদাস। সে জানে তার বাবাকে বলেও লাভ হবে না উল্টো আরও ধমক খেতে হবে। 

তার মন বলছে আয়ুশ স্যারের সাথেই তার বিয়ে টা হয়েই যাবে। 

তার মন শুধু এখন একটা কথাই বলছে কেনো সে ঐশীর কথায় আয়ুশ স্যারের কাছে পড়তে গেলো?

যদি না পড়তে যেতো তাহলে আজ সে আয়ুশ স্যারের স্টুডেন্ট ও হতো না।

আর এই বিয়েটা করে নিতে তারও কোনো অসুবিধে ও হতো না। 

অন্তির ভাবি সায়মা এতক্ষণ বিছানায় বসে অন্তিকেই দেখছিলো। এবার সে উঠে এসে পিছন থেকে অন্তির কাঁধে হাত রাখে। 

অন্তি ঘুরে থাকায় তার ভাবির দিকে। সায়মা তখন বলে, “ এখন কী করবে অন্তি? বাবাতো বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছেন। ”

“ জানি না ভাবি। বাবাকে বললে কী তিনি শুনবেন মনে হয়? ”

“ তোমার কী মনে হয়? ”

“ বাবা কারোর কথা শুনবেন না ভাবি। ”

“ তাহলে নিজের মনকে বুঝিয়ে ফেলো অন্তি। মনকে বুঝাও আয়ুশের সাথেই তোমার বিয়ে হচ্ছে।”

কথাটি বলে সায়মা অন্তির রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।অন্তি তখনও জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

দুনিয়ায় সব কিছুই ওর কাছে এই মুহুর্তে বিষাদ লাগছে। 

সেই সময় ওর জানালার সোজাসুজি কদম ফুলের গাছটার একটা ডালে একজোড়া চড়ুই পাখি এসে বসলো। একটা পাখি খুবই চটপটে কিছুক্ষণ পরপর ডানা ঝাপটাচ্ছে আর অন্য পাখি টার কাছে এসে কিচিরমিচির করছে। 

সেই পাখিটা যেন নিরবে তার সঙ্গিনীর কথা শুনছে।

অন্তির বুঝতে বাকি রইলো না তাদের একটি পুরুষ পাখি আর অন্যটি মেয়ে পাখি। 

বেশ কতক্ষণ সময় এদের দেখতে দেখতে ওর মন খারাপ টা কেমন করে যেন উবে গেলো। আনমনেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলে ওর। 

Post a Comment

0 Comments