মারজান ম্যানশন vs জামিন ভিলা | আরোহিতা সুরোভি|পর্ব-১
বাসর ঘরে ঢুকেমাত্র আদি সৃজাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে দাড় করিয়ে ওর গলা চেপে ধরলো। রাগে চোয়াল শক্ত করে হিসহিসিয়ে বলল,'শয়তানের বাচ্চা শয়তান,মীরজাফরের মতো পল্টি নেওয়ার আগে একটুও কলিজা কাপেনি তোর?আমার সাথে বিট্রে করিস?শাফিয়াল কবির আদির সাথে বিট্রে?এর ফল কি হতে পারে তুই জানিস না?'
আদির শক্তপোক্ত পুরুষালী হাতের বন্ধনে সৃজার যেনো দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় । নিজের নরম সরম হাত দিয়ে আদির চেপে রাখা হাত সরানোর চেষ্টা করতে করতে সৃজা বলে,'আদি বজ্জাতের কাদি,ছাড়ো আমার গলা...লাগছে আমার। মরে যাচ্ছি আমি। আম্মাহহহ!!'
'লাগুক। মরে যা তুই । তোর মতো মীরজাফরের মরে যাওয়ায় উচিত। আজকে তোকে মেরেই আমি ক্ষান্ত হবো।'
'উহুমম...এতো সহজ?আমাকে মেরে কি তুমি পার পেয়ে যাবে ভাবছো?একদম না। বাসর ঘরে বউ মারার দায়ে পুলিশে দেবে তোমায়। আজীবন হাজত বাস করবে তারপর ।',বলতে বলতে সৃজা আবিরের বুকে পেটে খামছানো শুরু করল। তারপরও আদি ওর গলা ছাড়ল না,উল্টো আরও জোর খাটিয়ে আগের থেকে শক্ত করে চেপে ধরলো।
'করলে করবো । তাও তোরে নিজ হাতে খুন করে যাবো । শালা দাদীর পুরো কার্বন কপি হয়েছে । দাদী যেমন ঠকবাজ,ঠকিয়ে আমার দাদার ঘাড়ে চেপেছিল,নাতিনটাও তেমন ঠকবাজ।'
সৃজার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে । হাত-পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে ।
'আদি ভ..ভাইয়া একদম আমার দাদীর নামে উল্টো পাল্টা কথা বলবা না। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু । আমার দাদী দাদাকে ঠকায়নি,বরং তোমার দাদী আমার দাদাকে ফাসিয়ে বিয়ে করেছিল,আমি জানি।'
'বা*ল জানোস তুই । আমার দাদী ছিল দাদার প্রণয়সিক্ত প্রেম,আর তোর দাদী হলো শেম শেম পাপ্পি শেম। তোর দাদী ছলচাতুরী করে আমার দাদার গলায় ঝুলে গেছিল,আর শুধু ঝুলেই নাই আস্ত একটা বাড়িও হাতায় নিছে শয়তান বেডি ।'
'একদম ফ...ফালতু কথা ব..বলবা না আদি ভাইয়া । দাদার সাথে অ...আগে আমার দাদীর বিয়ে হইছিল,তারপর তোমার দাদীকে বি...বিয়ে করছিল দাদা । হিসাব মতে তোমার দা...দাদী আমার দাদাকে ফাসাইছে । আমার পুকি দাদা-দাদীর সংসারে থার্ড পার্সন হ...হয়ে ঢুকে গ...গেছে ।'
'এ্যাহহ...আসছে আমার থার্ড পার্সন মা*রাইতে। বানান বলতো থার্ড পার্সনের?আর কি বললি,তোর দাদীকে দাদা আগে বিয়ে করছে?হ্যা,করছে । করতে বাধ্য হইছে । তোর দাদীর বাপে আমার দাদার বাপরে উষ্কে নিজের ঝাওড়া মাইয়ারে আমার দাদার গলায় ঝুলায় দিছে। নয়তো আমার দাদার মতো বিচক্ষণ মানুষ তোর দাদীর মতো কালসাপকে বিয়ে করে?নেহাৎই আমার দাদী ভালো মানুষ ছিলো দেখে দাদা বিয়াইত্তে জেনেও দাদার ভালোবাসা ফিরায় দেয় নাই । দাদারে বিয়ে করে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার চেষ্টা করছে । আমার দাদীর মনটা আবার মাটির তৈরি কীনা।'
আদির কথা বলার মাঝেই সৃজার দম বন্ধ হয়ে আসায় সে জ্ঞান হারায়। এদিকে আদি সেটা খেয়াল না করেই নিজের মতো বকবক করতে থাকে। সৃজার শরীরে সমস্ত ভার আদির উপর এসে পড়তেই আদির টনক নড়ে উঠে । সে বিস্মিত হয়ে নিজের দুহাতের মাঝে নিস্তেজ হয়ে যাওয়া সৃজাকে আগলে ধরে। তারপর গালে আসতে আসতে কয়েকবার চাপড় মেরে সৃজাকে ডাকতে শুরু করে,'এই সৃজার বাচ্চা,উঠ। চোখ খোল। আমার হাত থেকে বাঁচার জন্য নাটক করিস,না?একদম নাটক মা*রাবি না আমার সাথে। এমনিতেই মাথায় রাগ চড়ে আছে। এই রাতের বেলা তোর নাটক সহ্য করার ধৈর্য নাই আমার।'
কথাগুলো বলতে বলতে আদি সৃজাকে ডাকতে থাকলো। কিন্তু না,সৃজা একবারের জন্যও চোখ মেলে তাকালো না,আর না তো আদির ডাকে সাড়া দিলো। বেশ শক্ত করে গলা চেপে ধরায় মেয়েটা কেমন নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে আদির বুকের উপর। আদি এবার টেনশনে পরে গেলো। সত্যি সত্যিই মরে টরে গেলো না তো মেয়েটা?আদি কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। সৃজাকে বেডে শুয়ে দিয়ে আদি বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।
আদি সৃজাকে জাগানোর উপায় খুঁজুক ততক্ষণে আপনাদেরকে তাদের পরিচয় বলি।
আদি আর সৃজার সম্পর্কটা বেশ জটিল। তার কারণ তাদের দুজনের দাদা এক হলেও দাদী ভিন্ন। আদি আর সৃজার দাদা শাফওয়ান কবির । তার দুই বউ,মারজান আর জামিন। মারজানের সাথে শাফওয়ানের বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও,জামিনকে শাফওয়ান বিয়ে করেছিলো নিজে পছন্দ করে। তবে শাফওয়ান তাদের দুজনকেই খুব ভালোবাসেন । তাই দুই বউয়ের সুবিধা অসুবিধার কথা মাথায় রেখে শুরু থেকেই তাদের দুজনকে একই রকম এবং পাশাপাশি দুইটা আলাদা বাড়িতে রাখেন । সাথে সাথে শাফওয়ান নিজেও চেষ্টা করেন দুজনকেই সমানভাবে সময় দেওয়ার ।
মারজান যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়ির নাম মারজান ম্যানশন। আর জামিনের বাড়ির নাম জামিন ভিলা। মারজানের দুই ছেলে,বড় ছেলে মিনহাজ কবির ও ছোট ছেলে মিরাজ কবির। মিনহাজ একজন ভার্সিটির প্রফেসর আর মিরাজের নিজস্ব ব্যবসা আছে। তারা দুই ভাইই পরিবার সমেত যৌথভাবে মারজান ম্যানশনে থাকে।
মিনহাজের স্ত্রী জুহি। তাদের দুই মেয়ে,সিজদা আর সৃজা। সিজদা বিবাহিত আর সৃজা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে । মিরাজের স্ত্রী ইরা এবং তাদের দুই ছেলে জমজ,সোহান আর সুবান । সোহান আর সুবান বর্তমানে ক্লাস এইটে পড়ে।
অন্যদিকে জামিনের এক ছেলে,এক মেয়ে। ছেলে জুবায়ের স্ত্রী নেহা,ছেলে আদি আর মেয়ে আভাকে নিয়ে জামিন ভিলাতেই থাকে । জুবায়ের এক সময় আর্মির কর্নেল ছিল,এখন রিটায়ার্ড । জামিনের মেয়ে জেমি বিয়ের পর পরই স্বামীর সাথে চলে যায় কানাডায় । তার একমাত্র ছেলে জিসান,আদির থেকে বছর দুয়েকের ছোট সে । আদি একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করে,আর আভা সৃজার সমবয়সী । তবে ও পড়ে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।
যাইহোক এইছিলো শাফওয়ানের পরিবার পরিচিতি। এখন আসি আদি আর সৃজার বিয়ের কাহিনীতে। মারজানের পরিবার আর জামিনের পরিবার উপরে উপরে সদ্ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে চলে তাদের সম্পর্কের টানাপোড়ন। এই বিষয়টার আঁচ শাফওয়ান অনেক আগেই পেয়েছিলেন তবে কাউকে বুঝতে দেননি। বাড়ি আলাদা হলেও উনি সবসময়ই চাইতেন উনার দুই পরিবার যেনো এক হয়ে মিলেমিশে থাকে। কিন্তু উনি এটাও জানতেন উনার মৃত্যুর পরই দুই পরিবারের মধ্যে তৈরি হবে দ্বন্দ্ব । ঘর বাড়ি বিক্রি করে আলাদা হয়ে যাবে দুই পরিবার । এখন যা ভাব আছে সেটা কেবল শাফওয়ানের ভয়েই আছে ।
তাই শাফওয়ান ঠিক করেন উনি মারা যাওয়ার আগেই দুই পরিবারের মধ্যে একটা দৃঢ় সম্পর্কের ভিত তৈরি করে যাবেন। যা তে সেই সম্পর্কের জের ধরে হলেও দুই পরিবার একসাথে থাকে । প্রথমে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিজদার সাথে আদির বিয়ে দিবেন । কিন্তু সিজদা হঠাৎই তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। তাই তিনি অপেক্ষা করেন সৃজার বড় হওয়ার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন সৃজার বয়স আঠারো বছর হলেই তিনি আদির সাথে সৃজার বিয়ে দিবেন।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে অন্য জায়গায়। সৃজার বড় হওয়ার অপেক্ষা করার মাঝেই শাফওয়ানের কানে খবর আসে আদি নিজের অফিসের কোনো এক কলিগের সাথে ইটিশপিটিশ চালাচ্ছে।
অগত্যা খবরটা জানার পর তিনি আর দেরি করলেন না। তৎক্ষনাৎ সকালবেলা সিদ্ধান্ত জানালেন আজই আদির সাথে সৃজার বিয়ে দিবেন। আদি তখন অফিস যাওয়ার জন্য বের হতে যাচ্ছিল,আর তখনই দাদার এমন মা-বাপ ছাড়া ঘোষণা শুনে আদির মাথায় যেন বাজ পড়লো। সৃজাকে আর তার পরিবারকে আদি ছোট থেকেই অপছন্দ করে। দুচোখে দেখতে পারে না ওদের। সেখানে সে কি না করবে সৃজাকে বিয়ে?কখনোই না।
কিন্তু এই কথাটা আবার আদি নিজের দাদার মুখের উপর বলতে পারবে না । দাদাকে সে ভিষন ভয় পাই। আদির মতোই অবস্থা দুই পরিবারের মানুষ জনের। তারাও মনে মনে এই বিয়ের সিদ্ধান্ত না মানলেও শাফওয়ানের মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। অতঃপর তারা না চাইতেও শাফওয়ানের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার ভং ধরে চুপ করে থাকে।
এদিকে আদি কিছুতেই এই বিয়েটা করবে না বলে ঠিক করে। সে নিজে কিছু করতে পারবে না তো কি হয়েছে,সে সৃজাকে দিয়েই বিয়েটা ভাঙ্গাবে। এতে করে দাদার কাছে খারাপ হলে সৃজা হবে,আদিকে কেউ দোষারোপ করতে পারবে না। তাই যে ভাবনা সে কাজ সারতে আদি সকাল থেকে সৃজাকে ধরার জন্য উত পেতে বসে থাকে এবং সফলও হয় । সৃজা দুপুরের দিকে ছাদে কাপড় তুলতে আসলেই আদি ছাদের রেলিঙ টপকে সৃজার সামনে চলে আসে। দুই বাড়ির মধ্যে মাত্র এক হাত পরিমাণ ফাঁকা জায়গা হওয়ায় আদির রেলিঙ টপকে আসতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।
কাপড় তুলতে গিয়ে হঠাৎ করেই আদিকে নিজের সামনে দেখে ভড়কে যায় সৃজা । আদি সেই সবে পাত্তা না দিয়ে সৃজাকে টেনে নিয়ে যায় ছাদের এককোণায়। তারপর সরাসরিই সৃজাকে শাসিয়ে দেয় সৃজা যেন বিয়েটা ভেস্তে দেয়। আদি সৃজাকে ব্ল্যাকমেল করে,সৃজা যদি বিয়েটা পন্ড না করে তবে সে সবাইকে বলে দিবে সৃজা কোচিং এর নাম করে তার বাপের টাকা মেরে বন্ধুদের সাথে এখানে ওখানে খেতে যায়। সাথে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করার নাম করে মানুষের থেকে সৃজার টাকা হাতানোর বিষয়টাও আদি বেফাঁস করবে বলে জানায়।
সৃজা আদির ব্ল্যাকমেলে ভয় পাওয়ার ভান করে আদির কথায় সায় জানায়,অর্থাৎ সে বিয়েটা ভেস্তে দেবে। কিন্তু মনে মনে কষে অন্য প্লেন। ছোট থেকেই আদি সৃজাকে অনেক জালিয়েছে,মেরেছে। কথায় কথায় সবার সামনে সৃজাকে ফেলটুশ বলে অপমান করেছে । আসলে সৃজা ক্লাস সিক্সে ফেল করে দুবছর থাকার পর ক্লাস সেভেনে উঠতে পেরেছিল । তাই তো আভা সৃজার সমবয়সী হয়েও সৃজার থেকে এক ক্লাস উপরে পড়ে ।
সেই থেকে আদি ওকে ফেলটুশ বলে ক্ষেপায়। শুধু ক্ষেপায় বললে ভুল হবে,আদি রীতিমতো প্রফেসর বাবার ফেলটুশ মেয়ে বলে এলাকায় সৃজার নাম প্রচার করে বেড়ায়। তবে আর নয়,এবার সৃজার টার্ন। সৃজা মনে মনে বলে,'এই আদি বদজাতের কাদি এবার বুঝবে ফেলটুশ বউয়ের অত্যাচার কেমন হয়। আদির বাচ্চা রেডি থাক,তোকে আমি হারে হারে টের পাওয়াবো এই শানাইয়া কবির সৃজা কি জিনিস ।'
আদি সৃজাকে ভয় পেতে দেখে নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজে চলে যায়। সে ভাবে সৃজা তার কথায় ভয় পেয়ে যেকোনো উপায়ে বিয়েটাকে পন্ড করবে। কিন্তু হয় তার উল্টোটা।
সন্ধ্যার সময় আদির দাদা জামিনের পরিবার,আদি আর কাজীকে নিয়ে উপস্থিত সৃজাদের বাড়িতে। আগে থেকে প্লেনিং না থাকায় খুবই সাদামাঠা ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়।
কিন্তু আদির সেই সবে কোনো খেয়াল নেয়। সে তো কুল মুডে বসে আছে,আর ভাবছে সৃজা তো বিয়েটা ভেঙেই দিবে। সে তো নামেই বিয়ে করতে এসেছে,আসলে তার উদ্দেশ্য তো সৃজা বিয়ে ভাঙ্গার পর কি কাহিনি হয় সেটা দেখা। মোটকথা আদি মনে মনে ভীষন খুশিই ছিলো। কিন্তু আদির এই খুশিতে এক ড্রাম পানি ঢেলে দিলো সৃজা।
গায়ে নীল শাড়ি আর ওরনা জরিয়ে সৃজা আদির সামনে গিয়ে বসে।
বিয়ে ভাঙা তো দূর উল্টো কবুল বলার সময় আদির দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে সে তিনবার কবুল বলে দাঁত কেলাতে থাকে। আদির তখন রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। না চাইতেও দাদার ভয়ে তাকেও কবুল বলতে হয়। অতঃপর দুই পরিবারের উপস্থিতিতে আদি আর সৃজার বিয়েটা সম্পন্ন হয়। রাতে সৃজাকে আভা আদির রুমে বসিয়ে দিয়ে যায়। আর তারপর আদি রুমে আসার পর যা হয় তা তো আপনারা জানেনই।
এখন দেখার বিষয়,দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক রাখার আগে সৃজা আর আদির সম্পর্কটা ঠিক থাকে কিনা। আপনাদের কি মনে হয়?সৃজা আর আদির মধ্যে কি কখনো প্রণয় ঘটবে নাকি বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে দূরে সরে যাবে দুজন?
সূচনাপর্ব!
0 Comments