অসমাপ্ত অনুভূতি | তৌসিব ইসলাম

অসমাপ্ত অনুভূতি | তৌসিব ইসলাম | পর্ব-১

আমার দেওয়া প্রথম উপহারটা তোমার পছন্দ হয়নি, অনিমা?"

গভীর রাতে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অনিমা চমকে উঠে পেছনে তাকাল। কখন যে নীল নিঃশব্দে ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ও টেরই পায়নি। রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে উড়তে থাকা ওর চুলগুলো যেন নীলের গম্ভীর প্রশ্নে স্থির হয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে সামলে নিল অনিমা।

নীলের চোখে সরাসরি তাকাতে পারল না সে। দৃষ্টি সরিয়ে নিল পাশের হাসনাহেনা গাছটার দিকে। তীব্র ঘ্রাণ আসছে। এই ঘ্রাণটা রাফির খুব পছন্দের ছিল। বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠল। এই মানুষটাকে সে কী করে বোঝাবে, উপহারটা অপছন্দের নয়, কিন্তু উপহার দেওয়া হাত দুটো বড্ড অচেনা। যে হাতে সে ছয় বছর ধরে মিশে ছিল, সেই হাত ছেড়ে অন্য কারো দেওয়া উপহার পরাটা কতটা কঠিন!

বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন মাস। এই তিন মাসে নীলকে খুব কমই বুঝতে পেরেছে অনিমা। মানুষটা যেন এক গভীর সমুদ্রের মতো । বাইরে থেকে শান্ত, কিন্তু ভেতরে হয়তো কত ঢেউয়ের আনাগোনা। প্রয়োজন ছাড়া একটিও বাড়তি কথা বলে না। অনিমা নিজে থেকে কিছু বললে উত্তর দেয়, নয়তো চুপচাপ নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

বিয়ের আগে অনিমা নিজের সবটুকু সততা দিয়ে নীলকে জানিয়েছিল রাফির কথা। তাদের ছয় বছরের সম্পর্কের কথা, রাফি বেকার বলে বাবা-মায়ের আপত্তির কথা, আর সবশেষে এই অনিচ্ছাকৃত বিয়ের কথা। অনিমা এটাও বলেছিল, 

- "আমি হয়তো আপনাকে কখনোই ভালোবাসতে পারব না। এই মেনে নেওয়াটা আমার জন্য খুব কঠিন।"

সেদিন সব শুনে নীল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শুধু শান্ত চোখে অনিমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই দৃষ্টির অর্থ আজও বুঝতে পারেনি অনিমা। ভালোবাসা ছিল? করুণা ছিল? নাকি নিছকই এক পরাজিত মেয়ের প্রতি সম্মান?

নীলের বাবা-মা, আফতাব সাহেব আর আয়েশা বেগম, অনিমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। তাদের ভালোবাসার এই বাঁধনে অনিমা আরও বেশি অপরাধ বোধে ভোগে। এত ভালো একটা পরিবার, এত ভালো একজন জীবনসঙ্গী পেয়েও সে সুখী হতে পারছে না। রাফির জন্য মনটা এখনো কাঁদে। এক আকাশ সমান দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ওর কাছে আর কিছুই নেই।

নীল ওর আরও কাছে এগিয়ে এসে বলল, 

- "কী হলো, উত্তর দিলে না?"

অনিমা ওড়নার এক কোণ আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে মৃদু স্বরে বলল,

- "না, মানে... এমন কিছু না। আসলে পরা হয়নি।"

বিয়ের পরদিন নীল এক বাক্স রেশমি চুড়ি এনেছিল অনিমার জন্য। গাঢ় নীল রঙের, তার উপর সোনালি কাজ করা। চুড়িগুলো সত্যিই সুন্দর। কিন্তু অনিমার চোখে তখন ভাসছিল রাফির দেওয়া একজোড়া সাধারণ কাঁচের চুড়ি। ভার্সিটির সামনে এক বিকেলে রাফি ওর হাত ধরে বলেছিল, 

- "এখন তোমককে এর চেয়ে দামী কিছু দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু একদিন দেখবে, তোমার হাত আমি সোনায় ভরিয়ে দিব।"

সেই কাঁচের চুড়িগুলো অনিমা এখনো লুকিয়ে রেখেছে ওর পুরনো বাক্সে। রাফির দেওয়া শেষ স্মৃতি।

নীলের উপহারটা তাই বাক্সবন্দী হয়েই পড়ে আছে।

অনিমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নীল রেলিংয়ে হাত রাখল। অনিমার থেকে খানিকটা দূরে। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

- "কোনো জোর নেই, অনিমা। তোমার যখন ইচ্ছে হবে, তখন পরবে।"

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না নীল। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনই নিঃশব্দে ঘরের ভেতরে চলে গেল।

বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে রইল অনিমা। নীলের এই অদ্ভুত শান্ত ব্যবহার ওকে আরও বেশি দ্বিধায় ফেলে দেয়। মানুষটা কি কিছুই বোঝে না? নাকি সব বুঝেও না বোঝার ভান করে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিমা আকাশের দিকে তাকাল। আজকের রাতটা বড্ড বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছে। রাফির কথা ভেবে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। আর ঠিক তখনই মনে হলো, এই দীর্ঘশ্বাসের শব্দটাও কি ঘরের ভেতর থেকে শান্ত মানুষটা শুনতে পায়? কে জানে! এই অচেনা মানুষ আর তার সাজানো সংসারের রহস্য ভেদ করা অনিমার পক্ষে হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না।

অনেকক্ষণ বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে থাকার পর অনিমা ঘরে ফিরে এল। ঘর অন্ধকার, শুধু রাস্তার নিয়ন আলোর হালকা একটা আভা এসে পড়েছে বিছানায়। নীল ওর দিকে পিঠ ফিরে শুয়ে আছে, কিন্তু অনিমা বুঝতে পারল, ও ঘুমায়নি। মানুষটার স্থির কাঁধ দুটো দেখেই কেমন যেন এক অব্যক্ত অস্থিরতা টের পাওয়া যায়।

অনিমা নিঃশব্দে নীলের পাশে এসে শুয়ে পড়ল, দুজনের মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে। এই নীরবতাটা দুজনের জন্যই পরিচিত। কিন্তু আজকের নীরবতাটা যেন একটু বেশি ভারী। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতার পর হঠাৎ করেই সেই নীরবতা ভাঙল নীলের গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

- "তোমার কি ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল?"

প্রশ্নটা এত সরাসরি আর অপ্রত্যাশিত ছিল যে অনিমার হৃৎপিণ্ডটা এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। এই তিন মাসে নীল কখনো তার অতীত নিয়ে একটিও প্রশ্ন করেনি। আজ হঠাৎ কী হলো? অনিমা ঘুরে নীলের দিকে তাকাল। আবছা আলোয় মানুষটার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার কণ্ঠের গভীরতা অনিমার ভেতরটা কাঁপিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিল অনিমা। তারপর ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক বিষণ্ণ, হালকা হাসি। এই হাসিতে কোনো আনন্দ ছিল না, ছিল শুধু ফেলে আসা দিনের একরাশ ক্লান্তি।

মৃদু স্বরে ও বলল,

- "না। ভালোবাসা মানেই তো শরীর নয়, তাই না? আমি বিয়ের আগে এমন কিছুতে জড়াতে চাইনি। রাফি চাইত, কিন্তু আমার অমত দেখে কখনো জোর করেনি। আমাদের সম্পর্কটা ছিল অনেকটা দূরত্বের। খুব কমই দেখা হতো আমাদের। বড়জোর হাত ধরে কিছুটা পথ হাঁটা, ব্যস। আমার ইচ্ছে ছিল, যা কিছু হবে, সব বিয়ের পরেই হবে।"

কথাগুলো বলার সময় অনিমার গলাটা ধরে আসছিল। রাফির প্রতি সম্মান আর নিজের বিশ্বাসের কথাগুলো এই অচেনা মানুষটাকে বলতে হবে, তা সে কখনো ভাবেনি।

অনিমার উত্তর শুনে নীল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর খুব শান্তভাবে বলল, 

- "আমি দুঃখিত। এভাবে জানতে চাওয়াটা হয়তো ঠিক হয়নি। কৌতূহল থেকে...।"

নীলের কণ্ঠের দ্বিধাটুকু অনিমার কান এড়াল না। সে আস্তে করে বলল, 

- "এর জন্য সরি বলতে হবে না। আপনি আমার স্বামী, এটা জানার অধিকার আপনার আছে।"

এই প্রথম অনিমা নিজ থেকে নীলকে তার স্বামী হিসেবে স্বীকার করল। কথাটা বলার পর ওর নিজেরই কেমন যেন লাগল। ঘরের নিস্তব্ধতা আবার ফিরে এল, কিন্তু এবার তার ধরণটা ভিন্ন।

নীল কি যেন ভাবল, তারপর খুব আলতো করে তার হাতটা রাখল অনিমার পেটের উপর। পাতলা কাপড়ের উপর দিয়ে নীলের হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেতেই অনিমার সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল। ওর দম বন্ধ হয়ে এল। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে শুরু করল।

অনিমা অবাক হয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার চোখে কী ছিল, অধিকার? নাকি ভরসা খোঁজার চেষ্টা? বোঝার আগেই নীল যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। যেমন আকস্মিকভাবে হাতটা রেখেছিল, ঠিক তেমনই আচমকা হাতটা সরিয়ে নিল।

তারপর কোনো কথা না বলে পাশ ফিরে শুলো। যেন কিছুই হয়নি।

অনিমা স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল। পেটের উপর যে জায়গায় নীলের হাত ছিল, সেই জায়গাটা এখনো উষ্ণ হয়ে আছে। রাফির স্মৃতি বুকের ভেতর এক জমিয়ে রাখা কষ্ট, কিন্তু এই মুহূর্তে নীলের স্পর্শের এই অনুভূতিটা কী? এটা সম্পূর্ণ নতুন, অচেনা আর সম্ভবত আরও বেশি জটিল।

আজ রাতে অনিমার ঘুম আসবে না। তবে কারণটা শুধু রাফির স্মৃতি নয়, নীলের অপ্রত্যাশিত স্পর্শও।

কয়েকটা দিন কেটে গেল সেই রাতের মতোই নিঃশব্দে, কিন্তু দুজনের মনের ভেতর বয়ে চলল অদৃশ্য এক ঝড়। নীলের সেই অপ্রত্যাশিত স্পর্শের উষ্ণতা অনিমা চাইলেও ভুলতে পারছিল না।

শুক্রবার সকাল থেকেই বাড়িতে একটা উৎসবের আমেজ। নীলের এক নিকটাত্মীয়ের বিয়ে। আয়েশা বেগম সকাল থেকেই অনিমাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য। অনিমা আলমারি খুলে কী পরবে ভাবছিল, এমন সময় নীল ঘরে ঢুকল। ওর হাতে একটা শপিং ব্যাগ।

ব্যাগটা অনিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল,

 - "এটা পরে নিও।"

অনিমা ব্যাগটা খুলে দেখল, ভেতরে একটা গাঢ় খয়েরি রঙের শাড়ি। শাড়ির আঁচলে সোনালি সুতোর নিখুঁত কাজ, যা দেখে গোধূলি আকাশে আবির ছড়ানোর মতো লাগছে। শাড়িটা অপূর্ব সুন্দর, কিন্তু অনিমার মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

নীল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, 

- "পছন্দ হয়নি?"

অনিমা ইতস্তত করে বলল, 

- "শাড়িটা খুব সুন্দর, কিন্তু আমি... আমি শাড়ি পরতে পারি না।" 

কথাটা বলতে গিয়ে ওর ভীষণ লজ্জা করছিল। মা থাকলে হয়তো শিখিয়ে দিতেন, কিন্তু তিনি তো এখন নেই তাই ওর  কাছে শাড়ি পরাটা বরাবরই এক কঠিন কাজ বলে মনে হচ্ছে।

নীল কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, 

- "আমি পরিয়ে দেব?"

অনিমার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেল। ও ঠিক শুনছে তো? এই গম্ভীর, চুপচাপ মানুষটা ওকে শাড়ি পরিয়ে দেবে? কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই নীল ওর হাত থেকে শাড়িটা নিল। তারপর দরজাটা ভেতর থেকে হালকা করে ভিড়িয়ে দিয়ে বলল, 

- "ঘুরে দাঁড়াও।"

অনিমা যেন এক ঘোরের মধ্যে নীলের কথামতো ঘুরে দাঁড়াল। ওর হৃৎপিণ্ডটা এমনভাবে কাঁপছিল যে মনে হচ্ছিল, এখনই বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে।

নীল খুব দক্ষ হাতে শাড়ির কুঁচিগুলো ধরতে শুরু করল। ওর আঙুলের হালকা স্পর্শ যখন অনিমার কোমরে এসে লাগল, অনিমা কেঁপে উঠল। শিরশিরে একটা অনুভূতি ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। নীলের নিঃশ্বাসের উষ্ণ বাতাস ওর কোমড়েে পাশে এসে লাগছিল, আর তাতে অনিমার শরীর আরও শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি ভাঁজে, প্রতিটি পেঁচে নীলের স্পর্শ ওকে নতুন করে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। এই স্পর্শে কোনো অধিকারের দাবি ছিল না, ছিল শুধু এক অদ্ভুত কোমলতা।

কিছুক্ষণ পর নীল শান্ত স্বরে বলল,

-  "হয়েছে।"

অনিমা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখে চমকে গেল। ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে এটা ও নিজেই। শাড়িটা নিখুঁতভাবে ওর শরীরে জড়িয়ে আছে, একটা কুঁচিও এদিক-ওদিক হয়নি। একজন ছেলে এত সুন্দর করে শাড়ি পরাতে পারে, এটা ওর কল্পনারও বাইরে ছিল।

বিস্ময়ভরা চোখে ও নীলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, - "আপনি এত সুন্দর করে শাড়ি পরাতে শিখলেন কোথায়?"

প্রশ্নটা শুনে নীলের মুখে যে কোমল ভাবটা ফুটে উঠেছিল, সেটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। ও আবার সেই আগের গম্ভীর মানুষটায় পরিণত হলো। কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ওয়াড্রোবের দিকে এগিয়ে গেল নিজের পাঞ্জাবিটা বের করার জন্য।

নীলের এই হঠাৎ নীরবতা অনিমার মনে একরাশ নতুন প্রশ্ন তৈরি করল। এই মানুষটার অতীতেও কি এমন কোনো গল্প লুকিয়ে আছে, যা সে কাউকে বলতে চায় না? যে গল্পে হয়তো মিশে আছে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার মতো এমন ছোট ছোট মুহূর্তের স্মৃতি?

Post a Comment

0 Comments