ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-১৪
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ইশার বিয়ে দিবো।
নিজের ভাইয়ের মুখে এই কথা শুনে ইশা থমকে দাঁড়িয়ে গেল,সে তখন তার ভাইয়ের রুমের বাইরে।
ভিতর থেকে ভেসে এলো আরও কিছু কথা—
আমার কাছে একটা ভালো ছেলে আছে। নাম নিহাদ। ছেলের ভাই আমার বন্ধু।
নিহাদ জার্মানি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে
বড় একটা কোম্পানিতে চাকরিও পেয়েছে।
বাবা-মায়ের অনুরোধে দেশে ফিরেছে, একমাসের ছুটিতে। এখন বিয়ে করে আবার চলে যাবে।"
ইশা কৌতূহলে উঁকি দিয়ে রুমের ভিতর তাকালো।
ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে আরহান।
কিন্তু তার ভাই কেন এই কথাগুলো আরহানকে বলছে? ইশার বুকের ভিতর কেমন যেন হালকা ধাক্কা লাগল।
ইশা নিশ্চুপে এক পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে।
রুমের ভেতরে আরহান বলল,“এই মুহূর্তে বিয়ে?”
ইশার ভাই নিশ্চিত কণ্ঠে জবাব দিল,
“হ্যাঁ, যত দ্রুত সম্ভব। বিয়ের পর নিহাদ ওকে জার্মানি নিয়ে যাবে।এইখানে থাকলে কায়ান আবার ওর ক্ষতি করতে চাইবে।
আমি আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না।”
ইশার ভাইয়ের কথায় চুপ করে রইল আরহান।
একটুখানি দ্বিধা জাগলো তার মনে—
তার ইচ্ছে হলো বলে, “ আমি ইশার খেয়াল রাখবো। ” কিন্তু কথাটা তার ঠোঁট পর্যন্ত এসেও আটকে গেলো।সে যেন নিজের সঙ্গে নিজেই একটা কঠিন যুদ্ধ করছে।
আমাকে কি এটা বলার জন্য ডেকেছেন?"
শান্ত গলায় প্রশ্ন করল আরহান।
হ্যাঁ, অফিসার। আমি জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ।
তবুও আমি চাই আপনি ছেলেটার সম্পর্কে একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন।
আপনাদের তো অনেক সোর্স আছে। আমি আর ইশাকে কোনো বিপদে ফেলতে চাই না।”
আরহান মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল।
ঠান্ডা স্বরে বলল, “আচ্ছা, আমি ব্যাপারটা দেখবো।
এইটুকু শুনেই ইশা আর দাঁড়াতে পারলো না।
হনহন করে নিজের রুমে ফিরে এলো। তারপর কিছুক্ষণ পায়চারি করে রাহিকে বলল,
তোমাকে মা খুঁজছে। একবার নিচে গিয়ে দেখো তো, কী কারণে ডাকছে।”
রাহি একটু অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে।
ইশার মা তাকে ডাকবে? কেনো?তবুও সে কিছু না বলেই মাথা নেড়ে সোফা থেকে উঠে নিচে নেমে গেল।
রাহি নিচ থেকে ঘুরে ওপরে উঠে আসছিল।
কই? তাকে তো কেউ ডাকেনি! তাহলে ইশা তাকে মিথ্যে বললো কেনো? মনে মনে প্রশ্ন করতেই সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে গেল।
তার হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি। পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে সে ধীরে ধীরে ইশার রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল।
আরহান ঠিক তখনই ইশার ভাইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে। আর সিঁড়ির মুখেই ইশার রুম।
আরহান যখন ঠিক ইশার দরজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ইশা হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের রুমে টেনে নিল। তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো।রাহি হতবাক।তার হাতের গ্লাসটা ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেল।ঠান্ডা পানির সাথে কাঁচটাও এক মুহূর্তে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা ফ্লোরে। নিজের চোখকে রাহি একদম বিশ্বাস করতে পারছে না।
এইদিকে কাঁচ ভাঙার শব্দে ইশার ভাই হন্তদন্ত করে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
চোখ গেল সোজা মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা গ্লাস আর পানির দিকে
“ঠিক আছো, অফিসার?”চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন তিনি।
তারপর বললেন,“আমি লোকপাঠাচ্ছি—জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলবে।”
রাহি ভয়ে গিলে ফেলল একটা ঢোক।
তারপর হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ল। সে চেষ্টা করল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার।
কিন্তু ঠিক তখনই ইশার ভাইয়ের চোখ আটকে গেল সামনে, ইশার রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
তিনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে।তার ভ্রু কুঁচকে গেল।এই সময়ে দরজা বন্ধ কেনো? ইশা তো সাধারণত দরজা খোলা রাখে! তার চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো কপালে।
রাহির বুক ধুক ধুক করতে লাগল।ঠিক এই ভয়টাই তো পাচ্ছিল!
এখন যদি তিনি কিছু জিজ্ঞেস করেন, সে কী বলবে?
রাহির জিভ শুকিয়ে কাঠ। মুখে এক ফোঁটা শব্দ নেই।
হঠাৎ, ইশা কোনো কথা না বলে এক ঝটকায় আরহানের হাত ধরে তাকে নিজের রুমে টেনে নিল।ঘটনা এতটা দ্রুত ঘটল যে, আরহান সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে গেল।
“ইশা! What the hell?!” — তার কণ্ঠে বিস্ময় আর প্রশ্ন একসাথে জড়িয়ে গেল।
কিন্তু ইশা কোনো উত্তর দিল না।চুপচাপ গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিল।দরজার ক্লিক শব্দটা ঘরের নিস্তব্ধতাকে আরও ভারী করে তুলল।তারপর সে ঘুরে দাঁড়াল।
তার চোখে এক অচেনা রাগ, অভিমান আর দৃঢ়তা।
আরহান হতবাক চোখে তাকিয়ে বলল,“তুমি দরজাটা লক করলে কেন?”
ইশা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কঠিন গলায় বলল,
“আপনার শ্লীলতা হানি করবো, সে জন্য।”এই কথা বলে, সে হঠাৎ দু’হাতে ঠেলে আরহানকে বিছানার উপর ফেলে দিল।
আরহান অপ্রস্তুতভাবে বিছানায় পড়ে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য একেবারে হতবাক হয়ে গেল।
ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে, সে বুঝে উঠতে পারছে না—ইশার এই আচরণে সে অবাক হবে, নাকি মুগ্ধ?
তার চোখে বিস্ময় জমে উঠছে ধীরে ধীরে,
কিন্তু সেই বিস্ময় চরমে পৌঁছাল, যখন ইশা তার গায়ের উপর জায়গা করে নিলো চোখে চোখ রেখে।
আরহান একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
একটি মুহূর্ত দুজনের চোখে চোখ রেখে স্থির।
কি করছো এসব? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
আরহান বিস্ময়ে ইশার উদগ্রীব চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
ইশা কঠিন গলায় জবাব দিল,
“আমার মাথা একদম ঠিক আছে।
কিন্তু আপনি? আপনি কী করছেন এখানে?
আমার বিয়ে ঠিক করতে এসেছেন?”
ইশার কন্ঠ যেনো কাঁপছিল।আরহান এতক্ষণে বুঝতে পারছে ইশার আচরণের কারণ।তার মানে… ইশা সব জেনে গেছে!
আরহান এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল।
মনে এক কঠিন লড়াই— কি করবে সে? এই মেয়েটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে,নাকি নিজের মনকে শান্ত করে এখান থেকে সরে যাবে?
ইশা এতটাই কাছাকাছি, তার গায়ের স্পর্শে আরহানের শরীরের শিহরণ দিয়ে উঠলো।
একটা ঘোরের মতো অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরল।
সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিজের সংযমটা যেন ধীরে ধীরে ফসকে যাচ্ছে…।
“আমার উপর থেকে সরে দাঁড়াও,”
আরহান দৃঢ় স্বরে বলল,“তারপর তোমার কথা শুনব।”
ইশা একচুলও নড়ল না, ঠোঁট শক্ত করে বলল,
“না। আমি সরব না। আর এই বিয়েটাও আমি করবো না।আর আপনি… আপনি আমার ভাইকে বলবেন, ছেলেটা ঠিক না।
বলবেন, সে নেশাখোর।”
আরহান ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার দিকে।
“কেন? যদি ছেলেটা ভালো হয়, তাহলে আমি মিথ্যে বলবো কেনো?”
ইশার কণ্ঠে ছিল চূড়ান্ত জেদ,“কারণ আমি বলেছি, তাই বলবেন।
আর যদি না বলেন…”
আরহান খেয়াল করল তার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। সে চাপা কণ্ঠে, ভেতর থেকে ফেটে পড়ার মতো স্বরে বলল,“ইশা… সরো। বলছি…
নয়তো আমি এমন কিছু করে ফেলব—যা আমাকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে দেবে।”
সংযম আর আকাঙ্ক্ষার মাঝে দিশেহারা আরহান।
আরহান আর সহ্য করতে পারল না।সে সাথে সাথে ইশার দুই হাত ধরে তাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলল,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না?
তুমি আমার সাথে ঠিক কী করছ?”
ইশা ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে জবাব দিল,“মানে?”
আরহান দৃষ্টি ইশার ঠোঁটের দিকে রেখে বলল,
“মানে? আমাকে নিজের ঘরে আটকে রাখার ভুল আর কোনোদিন করবে না। নয়তো এর শাস্তি কঠিন হবে।”
“কিন্তু ভুল তো করে ফেলেছি?”ইশা কণ্ঠে মিশ্র অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন করল। আরহানের মনের কথা তার জানতেই হবে। শেষ চেষ্টা সে করবেই, ইশা ধীরে ধীরে আরহানের কানের কাছে এসে বলল, “এবার এই ভুলের শাস্তি কী?”
ইশার গলায় আরহানের ভারী নিশ্বাস পড়তে লাগল। তার বুকের ওঠা-নামা দেখে আরহানের সংযম যেন একেবারেই ফসকে যাচ্ছে। আরহান ঝুঁকে একদম ইশার মুখের কাছাকাছি চলে এলো।
ঠিক তখনই—
হঠাৎ দরজায় কড়া নড়লো। ইশার বড় ভাই ডাকছে...
আরহান দৃষ্টি ইশার ঠোঁটের দিকে রেখে বলল,
“মানে? আমাকে নিজের ঘরে আটকে রাখার ভুল আর কোনোদিন করবে না। নয়তো এর শাস্তি কঠিন হবে।”
“কিন্তু ভুল তো করে ফেলেছি?”ইশা কণ্ঠে মিশ্র অনুভূতি নিয়ে প্রশ্ন করল। আরহানের মনের কথা তার জানতেই হবে। শেষ চেষ্টা সে করবেই, ইশা ধীরে ধীরে আরহানের কানের কাছে এসে বলল, “এবার এই ভুলের শাস্তি কী?”
ইশার গলায় আরহানের ভারী নিশ্বাস পড়তে লাগল। তার বুকের ওঠা-নামা দেখে আরহানের সংযম যেন একেবারেই ফসকে যাচ্ছে। আরহান ঝুঁকে একদম ইশার মুখের কাছাকাছি চলে এলো।
ঠিক তখনই—
হঠাৎ দরজায় কড়া নড়লো। ইশার বড় ভাই ডাকছে।
“ইশা!”
আরহান যেন এক ধাক্কায় নিজের ঘোর থেকে জেগে উঠল। তার দৃষ্টির মধ্যে অনুতাপের ছায়া।
সে আসলে কী করতে যাচ্ছিলো?এভাবে… এতটা কাছে গিয়ে?আরহান হঠাৎ করেই পেছনে সরে আসল।
কিন্তু ইশা থামালো তাকে। আরহানের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে তাকে শক্ত করে নিজের দিকে টেনে ধরলো। ইশার স্পর্শে ছিল প্রশ্নের ঝড়।
আরহান কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ইশার হাতের দিকে ।তারপরে ধীরে ধীরে দৃষ্টি তুলে তাকালো ইশার চোখে। চাওয়ার আর না চাওয়ার মাঝের সেই তীক্ষ্ণ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
“ইশা... স্টপ ইট।”
ঠিক তখনই—
টক টক টক!দরজায় আবার কড়া নাড়ল।
আরহান আবার দরজার দিকে তাকাল।
আর সেই মুহূর্তেই ইশার ভেতরের সমস্ত সহ্যশক্তি ভেঙে পড়ল।
সে নিঃশব্দে এক ধাপ এগিয়ে এসে, একদম আরহানের গলার কাছে মুখ এনে রাখলো।
তারপর নিজের সমস্ত অভিমান, ক্ষোভ আর যন্ত্রণার এক অনুচ্চারিত উত্তর বসিয়ে দিলো তার উষ্ণ ত্বকে।
আরহানের নিঃশ্বাস আটকে এলো। সে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, চোখ বুজে নিজের ভিতরের দাবানল চাপা দিতে চাইছে। কারণ সে জানে,
এই মুহূর্তে যদি সে ইশাকে স্পর্শ করে, সে নিজেকে আর থামাতে পারবে না।
এক মুহূর্ত পর ইশা ধীরে ধীরে আরহানের কাছ থেকে সরে এল।
তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল আরহানের গলায়—
সাদা গলায় লালচে ছাপ, ইশার অভিমানের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। দাগটা দেখে ইশার চোখ পরক্ষণেই কঠিন হয়ে উঠল।
সে চোখ তুলে তাকাল আরহানের দিকে তাকালো,
চোখে তীব্র রাগ, অভিমান, আর অপমান। আরহান চুপচাপ তাকিয়ে রইল, কিন্তু কিছু বলল না।
হঠাৎ ইশা এক ধাক্কায় ঠেলে দিলো আরহানকে।
সে ভারসাম্য হারিয়ে বিছানার একপাশে গড়িয়ে পড়ল।
ইশা উঠে বসল, গা সোজা করে, মাথা উঁচু করে।
তারপর সে আড় চোখে তাকিয়ে বলল—
“ভীতুর ডিম!” শব্দগুলো ছিল ছোট, কিন্তু তার তীক্ষ্ণতা অনেক।
ইশা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না, তার মধ্যে কী হচ্ছে, সে কেন এমন আচরণ করছে। কিন্তু মনে হচ্ছে, এই মানুষটার ওপর তার একরকম অধিকার আছে বলেই হয়তো সে এমনটা করছে।
ঠিক তখনই দরজায় আবার টোকা পড়ল। ইশা একবার রাগ মেশানো দৃষ্টিতে আরহানের দিকে তাকাল, যেন চোখ দিয়েই বলছে, “আপনাকে দেখাচ্ছি মজা।" তারপর ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
আরহান বিছানায় গা এলিয়ে দিল। এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,"শেষ… এবার আর নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই।"
কিছু না করেই যেন এক বিভীষিকাময় ঝামেলায় পড়তে চলেছে সে। এমনটা হবে জানলে তোমাকে ছেড়ে দিতাম না, বিছানা থেকে উঠবার শক্তিও হারিয়ে ফেলতে।
ইশা ভয়ে ভয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। যা হবার হবে—মানুষ ভুল বুঝলে বুঝুক, কিন্তু দোষটা এই লোকটারই হবে। এক ঝলক আড় চোখে আরহানের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো সাহস সঞ্চয় করল সে। তারপর ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে দিল।
কিন্তু দরজা খুলতেই ইশা অবাক হয়ে গেল—সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে তার ভাই নয়।
আরহানও চমকে উঠে বসে পড়ল। ঘাড় কাত করে তাকাতেই তার চোখে বিস্ময়—দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রাহি!
রাহি কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক কষ্টে ইশার ভাইকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিচে পাঠিয়েছে সে—বলেছে, “ইশা ঘুমিয়ে পড়েছে। বলেছে কেউ যেনো তাকে ডিস্টার্ব না করে।”
এইদিকে রাহিকে দেখে ইশার রাগ যেন মাথায় আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। চোখেমুখে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে রাহির দিকে একবার তাকিয়ে রইল, কিন্তু একটাও কথা না বলে হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।
রাহি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, বুঝে উঠতে পারছে না—সে ভুলটা কোথায় করল।
আরহানকে এইভাবে ইশার রুমে, ইশার বিছানায় দেখে রাহি ইতস্তত বোধ করলো।
ইশার ভাই তখন টিভিতে খবর দেখছিলেন—ইরানের ওপর বোমা হামলা নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভে আমেরিকা আর ইসরায়েলকে তীব্র ভাষায় গালাগালি করছিল। এমন সময় চোখ পড়লো ইশার দিকে। সে হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সরাসরি দাদীর রুমে ঢুকে গেল। ভাই বিস্মিত হয়ে ভাবলো, "এই তো একটু আগে বললো ঘুমাচ্ছে! এত তাড়াতাড়ি ঘুম শেষ?"
ইশার দাদী, জেবুন্নেসা বেগম নামাজের বিছানায় বসে তসবি পড়ছিলেন। হঠাৎই ইশা এসে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।
জেবুন্নেসা মমতাভরে তার মাথায় দোয়া পড়ে ফু দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ইশা হঠাৎ বলল, “আচ্ছা, তুমি কি কখনো কারো প্রেমে পড়েছিলে?”
জেবুন্নেসা হালকা হেসে বললেন, “হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন রে?”
“আগে বলো।”
“প্রেমে? হ্যাঁ পড়েছিলাম, তবে সেটা সত্যি প্রেম ছিল কিনা জানি না। তখন খুব ছোট ছিলাম, হয়তো চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়স হবে। আমাদের গ্রামে তখন শহর থেকে এক ডাক্তারবাবু এলো—সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ওষুধ দিত।”
ইশার চোখ বড় হয়ে গেল, আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “লোকটা কি অনেক সুদর্শন ছিল?”
“অনেক। কি স্মার্ট তার কথা-বার্তা! দেখতে একেবারে রাজপুত্রের মতো।” বলে কিছুটা থেমে গেলেন জেবুন্নেসা।
ইশা আরও কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
“স্কুল থেকে ফিরবার পথে আমি প্রায়ই তার টিনের ঘরের চেম্বারের সামনে দিয়ে হাঁটতাম। মনে মনে ভাবতাম, আমিও একদিন তার মতো হবো...”
“তারপর কী হলো?”
“সতেরোতে পৌঁছাতেই তোর দাদার পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলো। তখন বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই বাবাও রাজি হয়ে গেলেন।”
“আর তুমি?”
আমি কী করতাম? বুকটা শুধু ফেটে যাচ্ছিল। কারণ মনে তখন সেই ডাক্তার বসে ছিল। তোর দাদাকে শুরুতে একদম সহ্য হতো না আমার। কিন্তু...”
“কিন্তু?”
কিন্তু পরে বুঝলাম, তোর দাদার মতো মানুষ হয় না। কত যত্ন করেছে সে আমাকে। তখন বুঝলাম, ডাক্তারটা ছিল আমার কচি মনের এক ছেলেমানুষী। তোর দাদার সঙ্গে কাটানো দিনগুলোই আমার জীবনের আসল সুখ।”
ইশা খেয়াল করল, দাদীর চোখ দিয়ে টুপটাপ করে পানি ঝরছে। সে হাত বাড়িয়ে আদর করে চোখের পানি মুছে দিলো। ইশার মনটা কেমন করছে। এই অস্থিরতা কিভাবে দূর করবে সে?
আরহান আর রাহিকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে ইশার ভাই বললেন,“কী ব্যাপার অফিসার! আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আগেই চলে গেছেন!”
আরহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকালেন, তারপর হালকা গলায় বললেন,“বাড়িটা ঘুরে দেখছিলাম। সন্দেহজনক কিছু আছে কিনা, সেটা যাচাই করছিলাম।”
বলেই তিনি চারপাশে একবার তাকাল। কিন্তু ইশা কোথাও নেই। চোখে এক মুহূর্ত খোঁজের ছায়া ফুটে উঠলেও তা চেপে রেখে বেরিয়ে গেলো সে।
রাহি তার পিছু নিয়ে বেরিয়ে এসে মৃদু স্বরে বলল,
“স্যার, কিছু মনে করবেন না। আমার মনে হচ্ছে ইশা…”
আরহান তাকে থামিয়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“ও এখনো বাচ্চা রাহি। ও নিজেই জানে না সে কী করছে।”
রাহি ধীরে বলল,
“হ্যাঁ, আপনার থেকে অনেকটাই ছোট—কিন্তু সেই কারণে তাকে পুরোপুরি বাচ্চা ভাবাটা ভুল হবে। এই বয়সে অনুভূতির তীব্রতা অনেক।”
আরহান থেমে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে একবার তাকাল। তারপর স্তব্ধ গলায় বলল,
“তাহলে আমি কী করবো? ওকে নিজের জীবনে টেনে এনে ওর জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলবো? সেটা কি ঠিক হবে?”
রাহি একটু জোর দিয়ে বলল,
“কিন্তু আপনি নিজেকে এত দুর্বল ভাবছেন কেন? আপনি আরহান আহমেদ। আপনার প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন—আপনার সামনে কেউ টিকবে না।”
আরহান কোনো কথা না বলেই নিজের গাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সে নিজেকে কখনো দুর্বল ভাবেনি, কিন্তু একটা দুর্বলতা ধীরে ধীরে তার ভিতরে জন্ম নিয়েছে। সেই দুর্বলতা ইশা।
রাহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার হেঁটে যাওয়া দেখছিল। আরহানের সঙ্গে কাজ করছে অনেক বছর, তবে এতদিনে খুব কম মেয়েকেই তার এত কাছে আসতে দেখেছে। কিন্তু ইশা... ইশার ব্যাপারটা একদম আলাদা। সেটা রাহি বুঝে।
ভাবনার ভেতরেই ছিল, ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল অচেনা একটি নাম্বার। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে ফোনটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক রহস্যময়, ঠান্ডা কণ্ঠ—“হ্যালো... সুইটহার্ট।”
কণ্ঠটা শুনেই রাহির গা শিউরে উঠলো। চেনা নয়, কিন্তু অচেনাও যেন নয়।সে কড়া গলায় বললো,“কে আপনি?”
ওপাশ থেকে একটা হালকা হাসির শব্দ—
“এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলে? ভেরি ব্যাড...”
রাহি বিরক্তি চেপে বললো,
“এই বাজে আলাপের সময় আমার নেই। পরিষ্কার করে বলুন, কী চান?”
কণ্ঠটা এবার একটু নিচু স্বরে, ঠাণ্ডা হুমকির মতো বললো,“ সেটা কাল দেখা হলেই বলবো কি চাই। গুড নাইট— সুইটহার্ট।”
এরপরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
"কাল দেখা হবে..."—এই কথাটা শুনেই রাহির আর বুঝতে বাকি রইলো না, এটা কায়ান।
তবে "সুইটহার্ট" শব্দটা শুনে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল সে।
রাহির মুখেও চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো।
একটু পর সে ইশার রুমের দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে গিয়ে দেখে, ইশা এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। চোখে-মুখে এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য।
এই মেয়েটা যেভাবে একের পর এক কান্ড ঘটাচ্ছে, তাতে রাহির—এখন থেকে তাকে আরও বেশি সাবধান থাকতে হবে।
ইশা চুপ করে বসে ছিল। হঠাৎ রাহির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি কখনো প্রেমে পড়েছো?”
প্রশ্নটা শুনে রাহি একটু থমকে গেল। এমন প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।সে ভ্রু কুঁচকে হালকা অবাক হয়ে বললো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
ইশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে হালকা হাসল,
“এমনিই… জানতে ইচ্ছে হলো।”
রাহি কিছু না বলে নিজের ডান হাতটা ইশার সামনে তুলে ধরলো।
ইশা লক্ষ্য করলো—রাহির অনামিকায় একটা চিকন আংটি। খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।
ইশা চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি… বিবাহিত?”
রাহি মুচকি হেসে মাথা নাড়ল,“না। তবে এনগেজড।”
ইশার চোখে কৌতূহল জ্বলে উঠলো।
“তাই নাকি?কীভাবে হলো সব?”
“আমরা চাইল্ডহুড সুইটহার্ট,” হালকা হেসে বললো রাহি। “ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে চিনি। তারপর একদিন ও আমাকে প্রপোজ করলো, আমি রাজি হয়ে গেলাম।”
রাহি সংক্ষেপে কথাগুলো শেষ করতেই ইশা ভ্রু কুঁচকে বললো,“ব্যাস? এইটুকুই?”
রাহি হাসতে হাসতে জবাব দিল,“হ্যাঁ। তুমি কি ভেবেছিলে কোনো রূপকথার গল্প শুনবে?”
ইশা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
“মনে হচ্ছিল যেন অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের গল্প বলছো! সে এখন কোথায়?”
“ও ঢাকার বাইরে। বিভিন্ন প্রজেক্ট সামলায়,” শান্তভাবে বলল রাহি।
“ওহ! লং ডিসটেন্স লাভ!” ইশা অবাক হয়ে বললো।
রাহি কিছু বললো না। এ নিয়ে কথা বলতে সে স্বচ্ছন্দবোধ করে না। একটু চুপ থেকে এবার রাহি ইশার দিকে তাকিয়ে বললো,“একটা প্রশ্ন করি? কিছু মনে করবা না তো?”
ইশা মাথা নাড়লো, “করবো না, বলো।”
“তোমার কি আরহান স্যারকে পছন্দ?”
প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ইশার গাল লাল হয়ে উঠলো।সে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে বললো,
“নাহ! একদম না! তুমি এমনটা ভাবলে কেনো?”
রাহি হেসে বললো,“না মানে, এমনি জানতে চাইলাম। পছন্দ না করাই ভালো।”
ইশা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,“কেনো?”
“মানে, তোমার বয়স কত? ২০ বা ২১ হবে। আরহান স্যারের বয়স ২৯। অনেক বড় ব্যবধান। তোমাদের মানাবে না।”
রাহি ইশার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করছিল। ইশার মুখ কালো হয়ে গেলেও রাহির ঠোঁটে খেলা করছিল এক দুষ্টু হাসি।
ইশা মনে মনে বললো, “তো কি হয়েছে? আমার তো এইজন্যেই লোকটাকে আরো বেশি ভালো লাগে।”
তারপর একটু চুপ করে থেকে, ইশা ধীরে ধীরে রাহির দিকে ঘেঁষে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা... তোমার আরহান স্যারের কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?”
রাহি এবার হাসি চাপতে গিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,“ছিলো। লন্ডনে মেয়েটা থাকতো। তবে ব্রেকআপ হয়েছে, মনে হয় এক মাসের মতো।”
“ও আচ্ছা...” ইশা মুখ একটু নামিয়ে বললো। এরপর মনেই মনে বিড়বিড় করলো,
“মানে ওই বদমেজাজির বিদেশি মেয়েদেরই পছন্দ… যারা লম্বা লম্বা পা দেখিয়ে মিনি স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়!”
ইশা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো, তারপর হঠাৎ বলল, “শোনো, কাল আমি ভার্সিটিতে যাচ্ছি। তুমি তৈরি থেকো।”
রাহি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কালকেই কেন?”
“আমার ইচ্ছে,” – মুখ কালো করে বলেই ইশা রাগে টগবগ করতে করতে বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়লো।
রাহি হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এরপর আর কিছু ভেবে না পেরে সরাসরি আরহানকে কল করল। ফোনে কায়ানের হুমকি আর ইশার এই জেদি সিদ্ধান্তের কথা শুনে আরহান বলল, “দেখি আমি কথা বলছি। ফোনটা ইশাকে দাও।”
ইশা তখন সিলিংয়ের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। রাহি তার সামনে গিয়ে ফোনটা বাড়িয়ে বলল, “নাও, কথা বলো।”
ইশা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কে? কার সঙ্গে কথা বলব?”
রাহি নিচু গলায় বলল, “আরহান স্যার।”
ইশা চোখ টিপে বলল, “উনি ফোন দিলেই কথা বলতে হবে নাকি? এখন আমার ঘুমানোর সময়। আমি ঘুমাবো। কথা বলতে চাইলে উনাকে বলো, আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে।”
এই কথা বলেই সে চাদর গায়ে মুড়ে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল।রাহি বিস্ময়ে হাঁ করে রইলো।
আরহান বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোন কেটে দিয়ে তা একপাশে ছুঁড়ে রাখল। এই মেয়েটা এত জেদি কেন, তা সে বুঝে উঠতে পারে না। যখন যা খুশি, মনে আসে, তাই করছে।
পরেরদিন সকাল।
আরহান গোসল সেরে তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমে ঢুকেছে। তখনই দেখে, তার খালাতো ভাই ইফতি রুমে বসে আছে।
আরহান ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোকে বলেছিনা, আমার রুমে আসবি না।”
ইফতি চেহারায় এক চোরা হাসি এনে বলল, “কেন, রুমে কিছু লুকিয়ে রেখেছিস নাকি?”
এই কথা বলতেই তার চোখ চলে গেল আরহানের গলার দিকটায়। স্পষ্ট লালচে দাগ—যেটা আরহানের ভেজা, উজ্জ্বল ত্বকে যেন নিজেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
আরহান তখনও ক্লোসেট খুলে জামাকাপড় খুঁজে ব্যস্ত।ইফতি হঠাৎ হেসে বলে উঠল, “নতুন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে বুঝি?”
এই কথায় আরহান চোখ গরম করে তাকাল, “বেশি পাকনামি করবি না।”
ইফতি খোঁচা দিতে ছাড়ল না, হালকা কেশে বলল, “কি এমন করছিস যে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে একেবারে গলায়?”
আরহান এবার রাগী চোখে তার দিকে এগিয়ে আসতেই ইফতি মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
“আজকে তোর কোথাও যাওয়া হবে না।”ইশার ভাই কঠিন গলায় বললো।
ইশা অবাক হয়ে তাকাল, ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেনো? আমি তো অফিসার রাহির সঙ্গে যাচ্ছি।”
“না, আজ যাওয়া হবে না। পাত্রপক্ষ আসছে তোকে দেখতে।”, ইশার ভাই শান্ত গলায় বললেন
“পাত্রপক্ষ? মানে?” ইশার গলায় বিস্ময় আর বিরক্তি একসাথে বাজলো।
“সন্ধ্যেবেলায় আসবে। পছন্দ হলে তাড়াতাড়িই বিয়ের কথা চলবে।”, ইশার ভাইয়ের কন্ঠে নির্লিপ্ত ভাব।
ইশা রাগে চট করে বলে উঠল,“আমি এই বিয়ে করবো না।”
ভাইয়া হালকা নিশ্বাস ফেলে বলল,“বিয়ে তো আর এখনই হচ্ছে না। ওরা আসুক, তারপর দেখা যাবে।”
তুমি হঠাৎ এমন করছো কেনো ভাইয়া? আমার ইচ্ছের কী কোনো মূল্য নেই?” নিজের কান্না চাপা রেখে বলল ইশা।
ভাইয়া মুখ শক্ত করে বলল,“আমি যা করছি, সব তোর ভালোর জন্য। এখন নিজের ঘরে যা।”
ইশা ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত রাখতে চাইল। কিন্তু ভেতরে তীব্র এক অসহায়তা আর ক্ষোভ জমে উঠছে। নিজের ঘরে গিয়ে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। চোখে জল এসে গেলো, কেউ তাকে বুঝতে চাইছে না।
ইশা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে ঠিক এক ঘণ্টা হলো।
রাহি বারবার কড়া নাড়ছে, অনুরোধ করছে—কখনো আদরে, কখনো ধমকে। কিন্তু ইশা একবার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সে দরজা খুলবে না।
মাঝে একবার ইশার মা এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনেক বুঝিয়েছিলেন।“ দরজা খুল ইশা। মা– আমার। এতো গুলো মানুষ আসবে তাদের সামনে আমাদের মানসম্মানটা কি থাকবে?”
তবু ভেতর থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
এইদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দোরগোড়ায়। ছেলেপক্ষের আসার সময় হয়ে গেছে।
ইশার ভাই সবকিছুর দায়িত্ব নিয়েছে। কারণ ইশার ছবি দেখে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। হয়তো আজ কালের মধ্যে বিয়েটা হয়ে যেতে পারে।
আর এক কোণে, ইশার বাবা চুপ করে বসে আছেন। পুরো ঘটনায় তিনি একেবারেই পছন্দ করছেন না। কিন্তু সেই বিরোধ তিনি করেননি, খালি দেখে যাচ্ছেন।
আরহানের মোবাইল স্ক্রিনে একের পর এক সিকিউরিটি এলার্ট ভেসে উঠছে।
তার চোখ আটকে গেলো একটাতে—“Bracelet Removal Attempt Detected”।ব্রেসলেটটা খুলে ফেলার চেষ্টা মানেই কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।
আরহানের বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো।
সে তৎক্ষণাৎ ইশার নম্বরে ফোন করলো—“The number you’re trying to reach is currently switched off…”নিঃশব্দে এক ধাক্কা খেলো আরহানের হৃদয়।
সে আর দেরি না করে রাহিকে কল করলো।
রাহি রিসিভ করতেই আরহান ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ইশা কোথায়? ওর মোবাইল বন্ধ। ব্রেসলেট অ্যালার্ট দিচ্ছে। সব ঠিক আছে?”
সে নিজেকে দুপুর থেকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে। কারো কথা শুনছে না। কারণ আজ সন্ধ্যেয় ছেলেপক্ষ তাকে দেখতে আসছে”, ক্লান্ত গলায় বলল রাহি।
সবকিছু এতটা তাড়াতাড়ি হবে, তা আরহান কল্পনাও করেনি। ইশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, তাও এতো তাড়াতাড়ি। আর এই মেয়ে? দরজা আটকে বসে আছে নিজের ঘরে।
এই মেয়েকে নিয়ে সত্যিই পারা যায় না!
আরহান গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেললো।
সে নিজের গাড়ির দরজা খুলে উঠলো ভেতরে।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ইশার বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় আরো এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে তাকে।
ইশাদের বাড়ির সামনে আজ যেন একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—যেহেতু ছেলেপক্ষ আসবে, তাই বহিরাগতদের প্রবেশে সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে।
বিশেষ করে কায়ানের লোকেরা যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য সাদা পোশাকে নিরাপত্তা বাহিনী আগে থেকেই মোতায়েন।
বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ভেতরে সবাই প্রস্তুত, নজরদারিতে একটুও ফাঁকি নেই।
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাহি আর রুদ্র।
হঠাৎ রুদ্র দেখে—একটা গাঢ় নীল রঙের গাড়ি এসে থামছে। আর গাড়ি থেকে নামলো আরহান।
রুদ্র সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়ে বললো,
“স্যার, আমরা সবাই প্রস্তুত। এইবার কোনো ভুল হবে না।”
আরহান কণ্ঠে যেন হালকা তীক্ষ্ণতা নিয়ে বললো,“গুড। অফিসার রাহি কোথায়?”
“আসুন স্যার, আমি নিয়ে যাচ্ছি।”রুদ্র নিজে আরহানকে ভিতরে নিয়ে গেলো।
রাহি একটু অবাক হয়ে তাকালো,
“আপনি হঠাৎ পার্সোনাল গাড়ি নিয়ে এলেন? অফিসের গাড়ি কি নষ্ট হয়েছে?”
আরহান তার সানগ্লাসটা খুলে ধীরে রাহির দিকে তাকালো। তারপর বলল,“হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো। এবার বলো এইখানকার অবস্থা কী?”
রাহি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,
“ইশা এখনো নিজের রুম থেকে বের হয়নি। আপনি গিয়ে দেখুন, যদি পারেন।”
আরহান গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লো,
“ঠিক আছে, তাহলে চলো।”
এই বলে সে দৃঢ় পায়ে বাড়ির ভেতর হাঁটা দিলো।
রাহি একটু থমকে গেলো। স্যার এতটা রিল্যাক্স কিভাবে? যাই হোক, এইসব ভাবার সময় নেই।
রাহি দ্রুত পায়ে আরহানের পেছন পেছন এগিয়ে গেলো।
বাড়ির ভেতরে পা রেখেই কায়ানের ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক চাপা বিজয়ের হাসি।
সাবধানে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো সে—দেয়াল, দরজা, করিডোর…সব কিছু যেন তার চোখে স্ক্যান হয়ে গেলো।
এমন সময় রাহি তাকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলল,
“স্যার, উপরে চলুন। ইশার রুম ওপরে।”
কায়ান হালকা মাথা নাড়লো, মুখে অপ্রকাশিত এক চিন্তার ছায়া।সে রাহিকে পাশ কাটিয়ে জায়গা করে দিলো,“তুমি আগে যাও, আমি আসছি।”
রাহি কিছু না ভেবেই সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলো।ইশার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
পিছন থেকে ধীর পায়ে উঠে এল কায়ান।
রাহির দিকে তাকিয়ে হালকা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“এই রুম?”
রাহি ভ্রু কুঁচকে একটু অবাক হয়ে বলল,
“হ্যাঁ, এইটাই তো ইশার রুম। আপনি জানেন না?”
কায়ান চালাকির সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে নিলো,“ওহ, না... আমি জানতে চাচ্ছিলাম, ইশা এই রুমে আছে কিনা?”
চালাকি ধরা পড়েনি। রাহি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে মাথা নাড়ল।কায়ান এবার গলার স্বর ভারী করে দরজার দিকে তাকিয়ে ডাকলো,
“ইশা!... ইশা, দরজা খুলো।”
কোনও সাড়া নেই।সে বিরক্তি চেপে আবার ডাকলো,
“ইশা।”
কায়ানের প্রচণ্ড রাগ লাগছে, তার তো দরজাটা লাথি মেরে খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু না—এই মুহূর্তে সেই রিস্ক নেওয়া যাবে না।
আরহান হলে কী করত—তা তো কায়ানের জানা নেই। তাই তাকে ঠাণ্ডা মাথায় চলতে হবে।
কায়ানের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই অবশেষে ইশা দরজা খুলে দেয়। কোনো কথা না বলে সোজা গিয়ে নিজের বিছানায় বসে পড়ে সে।
কায়ান রাহির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“তুমি বাইরে থাকো। আমি কথা বলছি।”
তারপর নিঃশব্দে ইশার ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ইশার সামনে বসে সে, কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। ইশার চোখে জমে থাকা কান্নার ছাপ, অস্থির নিঃশ্বাস—সবকিছুতেই এক গভীর অস্থিরতা। কায়ান জানে, আজকে এই বাড়িতে ইশাকে দেখতে লোকজন আসবে। কিন্তু ইশা কি সত্যিই এই কারণেই এত ভেঙে পড়েছে?
কায়ান গলার স্বর কঠিন করে বলল,
“তোমার সমস্যা কী? এইভাবে দরজা বন্ধ করে বসে কাঁদছো কেন?”
ইশা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জবাব দিল,
“সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।”
কায়ানের ভ্রু কুঁচকে গেলো। কী আশ্চর্য! কি কারণে এসেছিলো আর কি করতে হচ্ছে।
সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,“ভাবতেও চাই না। আরহান আহমেদের হাতে এত ফালতু সময় নেই যে সে তোমার মতো কাউকে নিয়ে ভাববে।”
একটু থেমে ইশার মুখটা লক্ষ্য করল কায়ান। অপমানে তার মুখ লাল হয়ে গেছে।
কায়ান ঠান্ডা গলায় বলল,
“তাই নাটক বন্ধ করে, চুপচাপ নিচে এসে বসো।”
এইটুকু বলেই কায়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ইশার ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর ইশা রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলো। রাহি একদম অবাক হয়ে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে ইশাকে নামতে দেখে বললো, “ ইশা তুমি ঠিক আছো?”
ইশা চারপাশে একবার তাকিয়ে বললো, “ ওই লোকটা কোথায়?”
স্যার? উনি তো ঐযে দাড়িয়ে আছে।”, কায়ানের দিকে দেখিয়ে বললো রাহি
ওটা আরহান না,---কায়ান!”, ইশা নিচু স্বরে বলল।
রাহির চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো, যেন চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম।
“কি! এটা... এটা কীভাবে সম্ভব?”
“তুমি কি ঠিক বলছো?” রাহির গলায় স্পষ্ট শঙ্কা।
উত্তরে সেই ইশা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, আমি একদম ঠিক বলছি। ওটা আরহান হতেই পারে না।” তারপরএকটু থেমে বলল ,“আমি দু’জনকে আলাদা করতে পারি।”
রাহি ইশাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ঠিক কায়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
কায়ানকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না।
রাহি নিজের সন্দেহ দূর করতে ইশার কথা অনুযায়ী কায়ানের গলার দিকে তাকালো।
হ্যাঁ , ইশা ঠিক বলেছে।
এটা আরহান না।
কারণ তার গলায় গতকালের সেই চিহ্নটুকু নেই। রাহি নিশ্চুপে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। কায়ান এইখানে হলে আরহান কোথায়?
“আমার সর্বনাশ করে এখন আপনাদের মেয়ের জীবনও নষ্ট করতে এসেছে এরা!”,বলেই দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ল।
“ওই নিহাদ… বিদেশ থেকে ফেরার পর প্রতিদিন রাতে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। আমার বাবা-মা নেই, তাই আজ সে আমাকে অস্বীকার করছে!”
মেয়েটির কণ্ঠ থেমে গেল, কিন্তু সেই কান্নার ধাক্কায় পুরো ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
নিহাদ—যে ছেলেটির সঙ্গে ইশার বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছিলো। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলবারও সাহস হচ্ছে না তার।
হঠাৎ ছেলের বাবা রাগে লাল হয়ে গর্জে উঠলেন,
“এই শয়তান মেয়ে এখানে এলো কীভাবে? কে ওকে ঢুকতে দিল? বেশ্যা কোথাকার! আমার ছেলেকে ফাঁদে ফেলতে এসেছে!”
তখনই সামনে এগিয়ে এসে নাসরিন গম্ভীর গলায় বলল,“ওকে আমরা এনেছি —- চাচা, দয়া করে নিজের ভাষা ঠিক করুন।”
বলেই সে পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে দেখাল,“ আমি স্পেশাল অফিসার মাইমুনা নাসরিন।”
ছেলের বাবা থমকে গেলেন। মুখের রাগ গিলে কটমট করে তাকিয়ে চুপসে বসে পড়লেন।
এই ঘটনায় ইশার ভাই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন। আরহান রূপধারী কায়ান ছেলে সম্পর্কে তাকে যেই কথা বলেছিল তার যেনো কোনোটা মিলছে না। তিনি হঠাৎ গর্জে উঠে বললেন, “কি হচ্ছে এসব? এই মেয়ে যা বলছে… সব কি সত্যি?”
এই প্রশ্নের উত্তরে নিহাদের মা দাঁত কেলিয়ে বললেন,“ও একটা বাজারের মেয়ে! এই ধরণের মেয়েদের কথা বিশ্বাস করবেন না ভাই। ওদের কাজই হলো ভালো ঘরের ছেলেদের বিপদে ফেলা।”
ইশার বাবা আর চুপ করে থাকতে পারলেন না তিনি রেগে উঠে বললেন, “ ও বাজারের মেয়ে হলে সেই বাজারে আপনার ছেলে গিয়েছিল কি করতে? আপনার ছেলের চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে দোষী।”
কায়ানের চোখে মুখে এক রহস্যময় হাসি। দূরে থেকেও আরহান ঠিকই বিয়েটা আটকে দিলো।
তার দুষ্টু মনে একটা শয়তানি বুদ্ধি নাড়া দিয়ে উঠতেই সে অনুভব করলো, তার পিঠে কেউ বন্দুক ধরে আছে। কায়ান রাহির দিকে তাকাতেই রাহি কঠিন গলায় বললো, “ একদম চালাকি করবে না। তোমার মুখ থেকে যেনো একটা আওয়াজ বের না হয়।”
Oh sweetheart, You caught me!”, বলেই কায়ান হাসলো।
রাহি রাগে গজগজ করে বললো, “ এইখানে কি উদ্দ্যেশে এসেছো তুমি?”
তার আগে আমাকে বলো, তুমিও কি আরহান আর ইশার বিয়ের পক্ষে নাকি আমার মতন ওই এনদাদ ওর হোয়াট? নিহাদ আর ইশার বিয়ের পক্ষে।”
“ওই ছেলের সাথে ইশার বিয়ে অসম্ভব।”, রাহি কড়া গলায় বলল।
Alright. As your wish!”, বলেই রাহির দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো কায়ান।
এইদিকে নিহাদের পরিবার নিজেদের আসল রূপ দেখাচ্ছে। নানা খারাপ ভাষায় কথা বলছে।
নিহাদের বাবা, “ এই অপমানের জন্য আমাদের এইখানে ডেকে এনেছেন?” বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
নিহাদের মা ইশার দিকে তাকিয়ে অগ্নি কন্ঠে বললেন, “ এই মেয়ের কি আর বিয়ে হবে? অপয়া মেয়ে একটা! এইখানে না আসাই ভালো ছিলো। এই মেয়েকে কে বিয়ে করে দেখবো।” বলেই তিনি মুখ বাকালেন।
ইশার মা ইশাকে শক্ত করে নিজের বুকের কাছে ধরলেন। তার ইচ্ছে হচ্ছিল এই মহিলাকে কষে দুটো থাপ্পড় দিয়ে দেয়।
ইশার ভাই বলার আগেই কায়ান কঠিন গলায় বলে উঠে, “ আমি আরহান আহমেদ ইশাকে বিয়ে করবো। —হ্যাপি! —নাও, গেট লস্ট।”
কায়ানের এমন উক্তিতে আশেপাশে সবাই হতবাক। ইশা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।
রাহি দাঁতে দাঁত চেপে নিচু গলায় বললো, “ তুমি ইশাকে বিয়ে করবে মানে!”
নো সুইটহার্ট। আমি বলেছি আরহান আহমেদ বিয়ে করবে।”, বলেই সে রাহিকে চোখ টিপ মারলো। তারপর মনে মনে হাসলো, “ You should grateful to me for this brother.”
আরহান ইশাদের বাড়িতে পৌঁছে কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পরে গেলো। রাহি সবকিছু বলার আগেই ইশার ভাই তার সামনে এসে দাড়িয়ে বললো।
এতক্ষণ কোথায় ছিলে অফিসার?”, তিনি বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আরহানকে খুঁজেছেন। তারপর আবার বললেন, “একটু এদিকে এসো তোমার সাথে কথা আছে।”
রাহি সামনাসামনি না করতে পারছে না। কিন্তু সে ইশারায় আরহানকে না করলো। আরহান সেদিকে খেয়াল না করে ইশার ভাইয়ের সাথে গেলো। আরহানের কোনো ধারণা নেই তার অনুপস্থিতিতে কি কি হয়ে গেছে!
ইশার ভাই আরহানকে নিয়ে বাইরে এলেন তারপর বললেন, “ আপনাকে কিভাবে জিজ্ঞেস করবো বুজতে পারছি না।”
না আপনি নির্দ্বিধায় বলুন কি বলতে চান”, আরহান চিন্তিত গলায় বলল।
তখন সবার সামনে আপনি যে কথাটা বলেছেন। আমি জানি না আপনি মন থেকে বলেছেন? নাকি আমাদের সম্মান বাঁচাতে!”, তারপর আবার থেমে বললেন, “ আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিবো আমার জানা নেই।”
আরহান ঠিক বুঝে উঠতে পারল না কথাগুলো। তার অনুপস্থিতির সুযোগ কায়ান নিয়েছে সেই ব্যাপারে সে অবগত। কিন্তু এর বাইরে আর কিছু জানা নেই তার।
আপনি ঠিক কি ব্যাপার কথা বলছেন একটু স্পষ্ট করবেন।”, আরহান মাথা নেড়ে বলল।
ইশার ভাই খেয়াল করলো আরহানকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তখন তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “ইশাকে বিয়ে করার বিষয়টায় কি আপনি সিরিয়াস?”
আরহান থমকে তাকালো এই প্রশ্ন। এই প্রসঙ্গ আসছে কেনো হঠাৎ! তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “ হ্যাঁ, আমি সিরিয়াস।”
ইশার ভাই প্রথমে আরহানের নীরবতা দেখে ভয় পেলেও এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “ যাক —আলহামদুলিল্লাহ।” একটু থেমে জিজ্ঞেস করলেন, “ তাহলে বিয়েটা? না মানে আপনার সময় হবে কখন?”
আরহান এক পলক না ভেবে বলল, “ আজকেই —-যদি আপনাদের কোনো অসুবিধা না থাকে।”
ইশার ভাই হতভম্ব হয়ে তাকালেন। “ আজকে! এখন রাত– ৮টা। আর আপনার বাবা মা! তাদের মতামত?”
আমার বাবা মার ইশাকে সেদিন দেখেই পছন্দ হয়েছে। আর বিয়েটা আজ রাতেই হবে।—রাত —এখনো অনেক বাকি।”, শান্ত গলায় বলল আরহান।
ইশার ভাইয়ের বিস্ময়ের শেষ নেই। কি হচ্ছে এইসব! —-আজ রাতে বিয়ে? কিভাবে! —--কিভাবে ম্যানেজ করবে সে সবকিছু।
ঠিক আছে। তাহলে তাই হবে।”, বলেই ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন তিনি।
আরহান হুট করে কেনো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে নিজেও জানে না। তার মনে হয়েছে এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আরহান রুদ্রকে ডেকে গাড়ি নিয়ে তার বাবা মাকে নিয়ে আসতে বললো।
তার বাবা মাকে কল করলে এখন একটা হইচই হবে, যেটার মুখোমুখি হবার ইচ্ছে আরহানের নেই।
রাহি আরহানকে দেখে দৌড়ে এসে বললো,
“আপনি সত্যি বিয়েতে রাজি হয়েছেন?” রাহির চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ।
আরহান হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। রাহি অবাক হয়ে বিরবির করে বললো, “ কায়ান মনে হয় নিজের জীবনে এই প্রথম কোনো ভালো কাজ করেছে।
আরহান রাহির দিকে তাকালো। তারপর বললো,
“ কায়ান কি উদ্দ্যেশে এসেছিল?”
সে পেনড্রাইভের খোঁজে এসেছিল। বললো, পেনড্রাইভটা যতক্ষণ আমাদের কাছে আছে আমরা সবাই বিপদে আছি।”রাহি ধীর কন্ঠে বলল।
এই ব্যাপারে আমরা জ্ঞাত।”আরহান তাচ্ছিল্যের সাথে বললো।
কিন্তু সে বলেছে যদি পেনড্রাইভ কায়ানের হাতে তুলে দেই। সে আমাদের সাহায্য করবে। আপনি আসার কিছুক্ষণ আগেই সে উধাও।”, রাহি কিছুটা সন্দেহ নিয়ে বললো।
এইটা ওর নতুন চাল ছাড়া কিছু না। ওকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই উঠে না।”, কঠিন গলায় বললো আরহান।
রাহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, “ আপনি এত দেরি করলেন কেনো? আপনাকে কল করেও পাচ্ছিলাম না।”
তেমন কিছু না। একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট।”, বলেই হঠাৎ নিজের কন্ঠ আরো কঠিন করে বললো, “ এখন থেকে কাউকে বিশ্বাস করবে না রাহি।”
রাহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
কায়ান ও আরহানের এই দুইয়ের পার্থক্য জানতে হবে। তোমাদের বুঝতে হবে কে আরহান। আর কে কায়ান। এখন থেকে নিশ্চিত না হয়ে আমাকেও বিশ্বাস করবে না। কি বললাম বুঝেছো?” কড়া গলায় বলল আরহান।
রাহি আবার হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললো, “ ভাগ্যিস! ইশা বুঝতে পেরেছিল। নয়তো আজকে আর বড় বিপদ হয়ে যেতো।”
আরহান চুপ করে রইলো। ইশা তাদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এই ব্যাপারটা আরহানের জানা আছে। সেই জেদি মেয়েটা এখন কি করছে কে জানে?
আরোও পড়ুন: রূপকথার শহর পর্ব-১৫| নবনী নীলা
0 Comments