ভালবাসার গল্প: এক টুকরো ভালোবাসা|আনাবিয়া নূর- (পর্ব-১)
জানিস আপু কি হয়েছে? আদনান ভাইয়া কাউকে কিছু না জানায় বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসছে।
ছোট বোন রুহির বলা কথায় খুব একটা প্রভাব পড়ল না রিফার উপর। তাই বোনের কথায় কর্ণপাত না করে নিজের পড়ায় মনোযোগ দিল সে। রিফার এহেন কাণ্ডে দৃপ্ত কন্ঠে বলল-
তুই কি শুনলি আমি কি বললাম? এই আপু।
বোনের দিকে বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় য়ে বলল
ফাইজলামির একটা সীমা থাকে রুহি।দেখতেছিস আমি পড়তেছি তাহলে কেন আমাকে অযথা বিরক্ত করিস? ভাগ এখান থেকে নাহলে দু'গালে ঠা*স ঠা*স করে দুটো থা*প্প*ড় দিব।
আমি জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না।তোর যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে নিজের চোখে দেখে আয় আদনান ভাইয়া কাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে?
আর যদি এইসব মিথ্যা হয় তাহলে তোর কপালে যে আজ কি আছে আমি নিজেও জানি না।
বোনকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুমদাম শব্দ করে পা বাড়ালো ড্রয়িং রুমের দিকে। আদনানের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার।সে যে বাড়ি আসবে তাকে একবার বলেও নি।আর বাড়ি আসার পরও তার খোঁজ নিল না কেন?এসব ভাবতে ভাবতে সিড়ি বেয়ে নামছিল সে। তখন লক্ষ্য করে বসার রুমে সবাই উপস্থিত তবু পিনপিন নিরবতা।
রিফার বাবা তিন ভাই।সবচেয়ে বড় রেজাউল সিদ্দিকী যার তিন ছেলে আরমান, আফনান আর আদনান হলো জমজ ভাই।
তারপর রাজ্জাক সিদ্দিকী যার এক ছেলে এক মেয়ে তাহিয়া ও তাহভির।সবচেয়ে ছোট রিফা ও রুহির বাবা রিদওয়ান সিদ্দিকী----
হটাৎ নজর পড়ল আদনানের দিকে।আদনান কে দেখতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে রিফার।কিন্তু আদনানের পাশে ওই মেয়েটা কে? তাহলে রুহি এই মেয়ের কথাই বলছিল। কি নিষ্পাপ চাহনি।দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভয়ে সে জর্জরিত। কিন্তু পরক্ষণেই বোনের কথা মনে পড়তেই বুক কেপে উঠে রিফার।কিন্তু সে ভালো করেই জানে রুহি মিথ্যা বলেছে।কারণ আদনান তো তাকে ভালোবাসা। তাদের এত বছরের সম্পর্ক।তাহলে মেয়েটা কে? প্রশ্ন টা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সকলের দিকে।সকলের মুখের কঠিন ভাব তার মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে। তাহলে কি সত্যি আদনান কিছু করেছে?সে কিছু বলার আগেই রেজাউল সিদ্দিকী হুংকার দিয়ে উঠলেন। ছেলের গালে সজোড়ে থা*প্প*ড় দিয়ে বলেন—
আমার অনুমতি ব্যতিরেকে যেখানে সিদ্দিকী ম্যানশনের কেউ কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পায় না সেখানে তুমি আমার ছেলে হয়ে কি করে এতবড় অন্যায় করলে?আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজনবোধ মনে করলে না?তুমি এতটাও বড় হওনি যে নিজের জীবনের এতবড় সিদ্ধান্ত তুমি নিজে নিবে।আমি তোমার উপর এমন আশা করিনি৷ যে ছেলেকে নিয়ে আমি গর্ব করতাম সেই ছেলেই আজ আমাকে সকলের সামনে চরম ভাবে অপমানিত করল।তোমাকে নিজের ছেলের পরিচয় দিতেও আমার লজ্জা করছে।
কথাগুলো বলেই ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়। আজ তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যে তিনি তার সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ।নিজের বাবার এমন অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগে আদনানের। কিন্তু তার কিছু করার নাই।সে কেন একাজ করছে সে কাউকে বলতে পারবে না।তাই নিজের মনকে শক্ত করে মনে মনে সব প্রশ্নের উত্তর সাজাচ্ছে ব্যস্ত সে।
এমন কি করেছে আদনান যার কারনে বড়ো বাবা আদনানের উপর রাগ করেছে?খুব জানতে ইচ্ছে করছে রিফার।কিন্তু সে উপায় যে নেই।কারণ বড়োদের কথার মাঝে ছোটরা কথা বলতে পারবেনা এমনটাই নিয়ম এ বাড়ির।
আদনানের বড়ো ভাই আরমান বলল-
তুই কি নিজ ইচ্ছেই একাজ করছিস নাকি তোকে কেউ বাধ্য করছে?সত্যি কথা বল ভাই।এভাবে চুপ করে থাকিস না।আমি যতদূর জানি তুম এমনটা নিজ ইচ্ছায় করতে পারিস না।
আদনান ঝাঝালো কন্ঠে বলে ওঠে —
আমি তাকে ভালোবাসি।তাই বিয়ে করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছি।আর আমি কোনো বাচ্চা না যে আমাকে কেউ বাধ্য করবে বিয়ে করতে।
ব্যস আদনানের বলা এতটুকু কথাতেই রিফার জীবনে অন্ধকার নেমে এলো।কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে তার।তার কাছে সব কিছু সপ্ন মনে হচ্ছে।এইতো এখনি ঘুম ভেঙে যাবে।তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু না কিছুতেই তার ঘুম ভাঙছে না। তাহলে কি সত্যিই আদনান ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে? কিন্তু আদনান তো তাকে ভালোবাসে।এটা আদনান ভাইয়া হতেই পারেনা।এ নিশ্চয়ই আফনান।নিজের মনকে বোঝাতে ব্যস্ত রিফা। তাদের এত বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক সব কি তাহলে মিথ্যে? নিজেকে খুব অসহায় লাগছে রিফার।
আদনানের বলা কথায় তার গালে দ্বিতীয় আঘাত পরে।মাথে তুলতে ই দেখে সে আর কেউ না তার জন্ম ধাত্রী মা।যে ছেলের গায়ে আজ পর্যন্ত কেউ আঘাত করেনি সে ছেলেকে আজ সবাই একের পর এক আঘাত করছে।
তার মা আফরোজা সিদ্দিকী রাগান্বিত চেহারা নিয়ে আদনানের দিকে তাকায় তোর লজ্জা করল না। এই কথাটা বলতে।তুই যদি এই মেয়েকে ভালোবাসতি তাহলে রিফা কে? কেন ওর সাথে প্রেমের নাটক করলি উত্তর দে।তার এই মেয়ে তোমাকে বলি।তোমার কি নিজের কোনো ব্যক্তিত্ব নাই।কি করে পারলে আরেকটা মেয়ের সপ্ন ভেঙে দিতে।তুমি কি জানতে না আর কিছুদিন বাদে আদনান আর রিফার বিয়ে?
আফরোজার বলা তিক্ত কথায় বিষাদে ভরে ওঠে রওশনের। চোখের পানি গুলো কিছুতেই বাধ মানছে না।
রিফার কথা মনে পড়তেই হৃদস্পন্দন থেমে যায় আদনানের। রিফা কি বুঝবে তাকে। নাকি সকালের মতো ভুল বুঝবে?
হটাৎ রিদওয়ান সিদ্দিকী আদনানের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে-
তোর সাহস কি করে হয় এই মেয়েকে বিয়ে করার?আমার মেয়ের সম্মান তোর কারণে যদি নষ্ট হয় তাহলে তোকে আমি নিজের হাতে খু*ন করব।
রিফা দৌড়ে এসে তার বাবাকে আটকায়,কি করছ কি তুমি বাবা"ও তোমার হবু জামাই।
তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? শুনিস নি আদনান কি বলল।
আদনান যা বলছে মিথ্যে বলছে।আমি ওকে চিনি।ও এমনটা করতেই পারে না।তুমি ওকে অযথা ভুল বুঝছো।
আমাকে কেউ ভুল বুঝছে না রিফা।যত তারাতাড়ি তুমি সত্যটা মেনে নিবে তোমার জন্য ভালো।
আদনানের বলা কথায় তীরের মতো আঘাত আনে বুকে।আদনানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে আদনানের জানতে চাইল-
আদনান একবার বলো প্লিজ তুমি যা বললে সব মিথ্যে।তুমি তো আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না। তাহলে কেন এমন করছো?
আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসিনি। শুরু অভিনয় করেছি তোমার সাথে প্রেমের।
তাহলে কেন করলে এমন অভিনয়?কেন এত নিখুঁত ভাবে আমাকে ঠকালে? কেন আমার ভালোবাসা- অনুভূতিগুলোকে অপমান করলে?যদি ভালো নাই বাসতে তাহলে কেন সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে গেলে?উত্তর দেও।
আদনান সত্যি জানেনা সে কি উত্তর দিবে। রিফা আদনানের উত্তরের তোয়াক্কা না করেই এক ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল।তার পিছনে গেল রুহি।
রিফার মা মুনতাহা সিদ্দিকী আদনানের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন-
এতক্ষন আমি চুপ থাকলেও আর চুপ থাকতে পারছি না।আজ যদি আমার মেয়ের কিছু হয় তাহলে কাউকে ছাড়বো না।আর তুমি মেয়ে যদি ভেবে থাকো যে বড়োঘরের ছেলেকে বিয়ে করলেই তোমার সব পরিকল্পনা বাস্তব হবে তাহলে সেই আশা ছেড়ে দেও। বামন হয়ে চাঁদ ধরতে এসোনা। নাহলে সেই চাঁদই তোমার কাল হয়ে দাঁড়াবে।
কথা গুলো বলেই নিজের মেয়ের রুমের দিকে পা বাড়ালেন মুনতাহা।
রওশনের খুব খারাপ লাগছে আদনানের জন্য। যে মানুষ টা তার জন্য এত কিছু সহ্য করল সেই মানুষটার জন্য সে কিছুই করতে পারছে না। সবাইকে সব সত্য বলতে ইচ্ছে করছে তার কিন্তু আর কথা শুনবে কে? সে যে এখানে বড্ড বেমানান পরগাছার মতো।
নিজেকে শান্ত করে সহধর্মিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন -
তোমার ছেলেকে বলে দেও সে আজ থেকে আমার কাছে মৃত।আর এক সপ্তাহের মধ্যে যেন সে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।আমি আর তাকে সহ্য করতে পারছি না।আমি ওর মরা মুখও দেখতে চাই না।
বলেই আদনানের বাবা প্রস্থান করলেন।স্বামীর কথায় হুহু করে কেঁদে ওঠে আফরোজার মন। তবু ছেলের সামনে কঠিন হয়ে বলেন-
-আশা করি তোমার বাবা যা বলে গেছেন তা তোমার বোধগম্য হয়েছে।
আর কোনো কথা না বলেই তিনি চলে যান নিজের কাজে।
এবাড়িতে এতগুলো মানুষ তবু কেউ তার না বলা কথা গুলো বুঝলো না।তাই সবার প্রতি অভিমান জমে আদনানের।কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে রওশনের হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় নিজের ঘরে।
নিজেকে ঘরবন্দী করে চিৎ*কার করে কেঁদে ওঠে রিফা।নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার।আজ ভালোবাসা নামক যে তিক্ত অভিজ্ঞতা জন্মেছে তার মনে তা তিলে তিলে শেষ করছে তাকে।কেন ঠকালো আদনান তাকে?কেন শুধু স্মৃতি হয়ে রইল সে? কেন তার নিজের হলো না? রিফা নিজের মনকে ধিক্কার দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে কি করে মানুষ চিনতে ভুল করল?কিন্তু যার এত সুন্দর নিখুঁত অভিনয় তাকে যে চেনা দূষ্কর।রিফা পেন্সিল কম্পাস তুলে নিল আত্ম-আঘাত করার জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই তার হাত থেমে যায়। সে কি করছে?একটা কাপুরুষের জন্য হাত কাটবে?
না আমি একদম নিজেকে আঘাত দিব না। একদম কান্না করব না।আর কার জন্য চোখের পানি ফেলব?যে আমাকে ভালোবাসেনা তার জন্য? এতটা নিচ আমি?আমি তো কোনো অন্যায় করিনি তাহলে আমি কেন কষ্ট পার। আমি কেন আত্ম*হত্যা করব?একটা বা*জে ছেলের জন্য। আমি কি এতটাই সস্তা তার কাছে?কেন আদনান তুমি আমার সাথে এমন করলে?আমি তো তোমাকে সত্যিই ভালোবাসতাম।এভাবে না ঠকালেও পারতে।আমি আজ থেকে সবচেয়ে বেশি তোমাকে ঘৃনা করি।আমি তোমাকে আজ থেকে চিনি না।আজ থেকে তুমি নতুন আদ্রিজা সিদ্দিকী কে দেখবে।তোমার দেওয়া রিফা নামটা চিরদিনের জন্য আমার নাম থেকে মুছে ফেললাম।
নিজের চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমের দড়জা খুলে দিল আদ্রিজা।এতক্ষন যাবত দড়জার পাশে দাড়িঁয়ে ছিল রুহি আর মুনতাহা। বাকিরাও থাকতে চেয়েছিল কিন্তু মুনতাহা তাদের থাকতে দেয় নি। মেয়েকে ডাকা সাহসে কুলচ্ছিল না মুনতাহার।মেয়ে যে তার বড্ড জেদী। রুমের ভিতরের শান্ত পরিবেশ তাকে আরো ভাবাচ্ছে।খুব টেনশন হচ্ছে তার।যদি মেয়ে কিছু করে বসে তখন? তাহলে এই বাড়ির কাউকে সে ছাড়বে না।
হঠাৎ দড়জা খোলার আওয়াজে সামনে তাকায় মুনতাহা। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে হুহু করে ওঠে তার মন।বোনকে বেরিয়ে আসতে দেখে আদ্রিজাকে জড়িয়ে ধরে রুহি।
কাদোঁ কাদোঁ কণ্ঠে বলে-
আপু তুই একদম কাঁদবি না।ভাইয়াই কি তোর সব?
আমরা কি কেউ না?তুই একদম কষ্ট পারি না বলে দিলাম।
বোনটা তার কতই বা বড়! কেবল নাইনে পড়া বাচ্চা মেয়েটা বুঝল তার মনের অবস্থা তুব যার বুঝার কথা সেই বুঝল না।সে বুঝবেই বা কি করে কষ্টটা তো তারই দেওয়া উপহার।এসব ভাবতেই বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘনিঃশ্বাস।
মুহতাহা বুঝতে পেরে রুহিকে চলে যেতে বলে তার রুমে।আর তিনি মেয়েকে নিয়ে রুমের ভিতর ঢুকলেন
তুমি আজ তোমার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছ রিফা...
প্লিজ মা আমাকে আজকে থেকে তোমরা কেউ আর রিফা বলে ডাকবে না। আমার সার্টিফিকেটে যেই নাম আছে। তোমরা আমাকে সেই নামেই ডাকবে।প্লিজ
মুনতাহা বুঝতে পারে আদ্রিজা আদনানকে ভুলতে চায়।
মা আমি আজকে থেকে শুধু আদ্রিজা সিদ্দিকী পুরনো সব হিসাব চুকিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু করব।তাই প্লিজ এই বাড়িতে যদি তোমরা চাও আমি থাকি তাহলে পুরনো স্মৃতির খাতাটা আর খুলবা না কেউ।।
একটানে কথাগুলো শেষ করে দম নেয় আদ্রিজা।মেয়ের জন্য মায়া লাগছে মুনতাহার।সে মা হিসেবে এসব আর সহ্য করতে পারছে না।তাই তিনি আর কথা না বাড়িয়ে—
আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে।এখন একটু ঘুমাও দেখবে ভালো লাগবে।আর ঘুম থেকে উঠলে তানভীরকে বলব তোমাকে যেন একটু ঘুরতে নিয়ে যায়।এখন আমি যাচ্ছি কোনো কিছু চিন্তা না করে রেস্ট নেও।
মুনতাহা রান্নাঘরে এসে দেখে সেখানে আগে থেকেই আফরোজা উপস্থিত। আফরোজাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন-
দেখ আপা,তোমার ছেলে যদি এই বাড়িতে থাকে তাহলে কিন্তু আমার মেয়ে কখনো স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারবে না।আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া যে মেয়েটা কোনো উল্টোপাল্টা কাজ করে নি।
সেকথা তোকে আর ভাবতে হবে না ছোট। আরমানের বাবা তাকে চলে যেতেই বলেছে।শুধু একসপ্তাহ অপেক্ষা কর।
আফরোজার বলা কথায় অসহায়ত্ব স্পষ্ট। তিনি যে মা সন্তান যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন মার মন তো তাকে আলাদা করতে পারনে।তবু নিজের মনের কথা গুলো বুঝতে দিল না সে
চলে গেলে তো ভালোই।কিন্তু আমার মেয়ের যে এতবড় সর্বনাশ সে করল তার মাশুল কে দিবে শুনি?সবাই যখন জানতে চাইবে কেন তাদের বিয়ে হলো না তখন দোষটা কিন্তু আমার মেয়ের উপরেই পরবে। কারন আদনান তো ছেলে মানুষ। ওর শত দোষ মাফ।তখন আমার মেয়েটার কি হবে একবারও কি ভেবে দেখেছ আপা?
ছোট জায়ের করা প্রশ্নের কোনো উত্তর জানা নেই আফরোজার।কি উত্তর দেবে সে? না সে আর ভাবতে পারছে না।
কে মাশুল দিচ্ছে? কেন আমি।যার সামনে আগে কেউ সামান্য উঁচু গলায় কথা বলতো না সেখানে আজ আমার ছেলের করা ভুলের জন্য আমি অপমানে জর্জরিত হচ্ছি।
এটাকে ভুল বলে না আপা। যেটা ইচ্ছে করে করা হয় সেটাকে ভুল বলে না অন্যায় বলে।কারো মন ভাঙা মসজিদ ভাঙার সমান। আর অপমান? না আপা তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। আমি তোমাকে অপমান করছি না শুধু বাস্তবতা তুলে ধরলাম।
মুনতাহার কথার প্রতিউত্তর আফরোজা করলেন না।কারন আসলেই তিনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একবারও রিফার কথা ভাবলেন না।এসব ভেবে তীব্র গ্লানি গ্রাস করে তাকে।
আচ্ছা বাদ দেও এসব কথা এখন। বলো কি করতে হবে আমি করে দিচ্ছি।
মুনতাহা প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইছে বুঝতে পেরে তিনি আর নতুন করে কিছু না বলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।
যতক্ষন যাবত রুমের মধ্যে একা বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছে রওশনের।সম্পুর্ণ অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষের ভিড়ে থাকাটা কত টা ভয়ংকর তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে সে।আগের ঘটনা মনে পড়তেই গা কেপে ওঠে তার। এই বাড়ির মানুষ গুলো যে সহজে তাকে মানবে না তা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।না চাইতেও সবলের শত্রুতে পরিনত হয়েছে সে।
সেই কখন ওয়াসরুমে ঢুকেছে আদনান? বের হওয়ার নামও নিচ্ছে না। এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝে খট শব্দ করে ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে আসে আদনান।এতক্ষণ যে সে কাদঁছিল তা তার চোখ মুখের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছে রওশন।
ফ্রেস হয়ে নেও।
এতটুকু কথা বলেই পুনরায় চুপ হয়ে যায় আদনান। আর যে তার কথা বলার ইচ্ছে নেই।যার সাথে আমৃত্যু থাকার স্বপ্ন দেখেছিল তাকেই তো সে পেল না।তাহলে কার সাথে কে কথা করবে?কেনই বা বলবে?
রওশন আদনানের কথা মতো ফ্রেশ হয়ে এলো। এখন কিছুটা হালকা লাগছে তার।কিন্তু মনকে সে কিছুতে ঠান্ডা করতে পারছে না।বারবার মনে হচ্ছে সে না চাইতেও একটা মেয়ের সাজানো স্বপ্ন ভেঙেছে সে।কিন্তু সে তো ইচ্ছেকরে করেনি।যদি সে জানত আদনানের সাথে কারো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তাহলে সে কখনোই এই বিয়েটা করত না।
আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।
বলেই আদনান রুম থেকে বের হয়ে গেল।রওশন আদনানের রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।এমন সময় নজর পড়ল একটা ডাইরির উপর। আর পাঁচটা ডাইরির থেকে সম্পুর্ন আলাদা।রওশনের কৌতুহল হলো। সে ডাইরিটা নিজের কাছে নিল।ডাইরির প্রথমেই লিখা।
“তুই আমার ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস"কথাটা মনে ধরে রওশনের।পাতা উল্টোতেই বড় করে লেখা"টুকরো টুকরো ভালোবাসাগুলো খন্ড খন্ড করে সাজিয়েছি তোমার নামে।।”
রওশন লক্ষ্য করে প্রথম দুপাতা শুরু রিফার ছবি দিয়ে ভরা।রওশন আর দেখলোনা ডাইরির মধ্যে কি আছে।কারো অনুমতি ব্যতীত কিছু ধরতে নেই।তাই সে ডাইরিটা আগের জায়গায় রেখে দিল।কিন্তু একটা জিনিস সে কিছুতেই বুঝছে না রওশন। আদনান যদি এতই ভালোবাসে তাহলে কেন সে রওশনকে বিয়ে করল।তাহলে কি সে আদনানের গলার কাটা হয়ে থেকে গেল।
কি হইছে রুহি? বাড়ির পরিচেয় এত ঠান্ডা কেন?আম্মু ফোন দিয়ে বলল আদনান নাকি আসছে? কই সে? আর বাকিরা কই?কিরে রুহি চুপ করে আছিস কেন?
উপরোক্ত কথা গুলো আদনানের জমজ ভাই আফনান।
কি জানতে চাইলে? আদনান ভাইয়া আসছে কি না? হ্যাঁ আসছে আর সাথে সারপ্রাইজও নিয়ে আসছে?
কি সারপ্রাইজ?
বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে।
কি উল্টো পাল্টা ফাইজলামি করিস এইসব। আদনান শুনলে কিলাবে তোকে।
আমাকে কিলানোর আগে সে নিজেই কিল খাইছে।আর ও আর আমার ভাই না। ও আমার বোনের সাথে চিট করছে।
রুহির কথায় আশ্চর্যের সপ্তমস্তরে পৌঁছে আফনান।যে মেয়ে আদনান ভাইয়া বলতে পাগল সে বলছে ওনাকি আর আদনানকে ভাই হিসেবে মানে না।
সত্যি করে বলনা কি হইছে?
যা সত্যি তাই বললাম।বিশ্বাস করতে মন চাইলে কর না মন চাইলে করিওনা। তোনার ইচ্ছা।
রুহিকে আর আফনান ঘাটল না। কারন রুহি যে সিরিয়ার ওর চোখে মুখে স্পষ্ট। তাহলে কি সত্যি আদনান বিয়ে করছে?কথাটা কিছুতেই মানতে পারছে না আফনান।
মা রুহি এইসব কি বলছে?আদনান কাকে নাকি দিয়ে করে আনছে?
যা সত্যি তাই বলছে।
মায়ের এমন উত্তর আশা করেনি আফনান।সে আদনানকে চেনে।সে ভালোকরেই জানে সে কতটা ভালোবাসে রিফাকে।তাহলে অন্য মেয়েকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।কিন্তু মা তো তাকে মিথ্যা বলবে না।মায়ের মুখের ভঙ্গি দেখে সে আর আফরোজাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না।তার আপাতত আদনানের সাথে কথা বলে সব ক্লিয়ার করা দরকার। তাই সে আদনানের রুমের দিকে যায়।।
আরো পড়ুন: এক টুকরো ভালবাসা| আনাবিয়া নূর(পর্ব-২)
আরো পড়ুন: রূপকথার শহর |নবনী নীলা
0 Comments