ভালবাসার গল্প: এক টুকরো ভালোবাসা|আনাবিয়া নূর- (পর্ব-২)
তোমাকে কি আল্লাহ লজ্জা শরম কম দিয়েছে মেয়ে?আমার মেয়ের জীবনটা নরক করে এখন এখানে বসে থাকা হচ্ছে।আল্লাহই জানে তোমার বাবা মার বিবেক বা কেমন?একটা ছেলের বাবা মা পরিবার ছাড়া মেয়েকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।
আমার মেয়ে আজ তোমার জন্য যদি কোনো প্রকার ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তোমার মা-বাবা সহ তোমাকে জে*লের ভাত খাওয়াব।ভেবেছিলে সিদ্দিকী বংশের ছেলেকে ফাসিয়ে বিয়ে করে সুখী হবে।তাহলে সেই ইচ্ছেটা তোমার কখনো পূরণ হবে না।
রওশনকে একা বসে থাকতে দেখে মুনতাহা এগিয়ে আসে কয়েকটা কটু কথা শোনানোর জন্য। তাই উপরোক্ত কথাগুলো বলে অনেক শান্তি লাগছে তার। যে মেয়ের জন্য তার মেয়ের জীবনে কালো অধ্যায় নেমে এসেছে সেই মেয়েকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না তিনি।মুনতাহার বলা তিক্ত কথাগুলো তীব্র ভাবে আঘাত হানে রওশনের মনে।চোখ থেকে আপনাআপনি গলিয়ে পড়তে থাকলো অশ্রু। দিনশেষে তার জন্য তার বাবা মাকে অপমানিত হতে হলো।যেই মাকে সে জন্মের পরে কখনো দেখেনি।সে মাকে আজ অপমান করল।ভেবেই তার কষ্ট দিগুণ বৃদ্ধি পায়।
রওশনকে কাঁদতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মুনতাহা।
এখন আবার ন্যাকামি করে কান্না করা হচ্ছে।আসলে তোমাদের মতো মেয়েদের তো আবার লজ্জা শরম কমই থাকে।
অনেক হয়েছে ছোট ।অনেকক্ষন যাবত তোর কথা গুলো শুনছিলাম। তুই এইভাবে কাউকে অপমান করতে পারিস না।
উপরোক্ত বলা কথাটি এবাড়ির মেঝো বউ অর্থাৎ রাজ্জাক সিদ্দিকী সহধর্মিণী তাহেরা তাহমিদা সিদ্দিকীর।
কেন সত্যি কথা বললে বুঝি অপমান করা হয়?আর যদি অপমান করে থাকি বেশ করেছি। যে যেটার যোগ্য তাকে সেটাই দিয়েছি।আর যখন আমার মেয়েটা এত কষ্ট পেল তখন কোথায় ছিল তোমার এই ন্যায়বোধ।
তুই আমাকে ভুল বুঝছিস ছোট। আমি তোকে সেভাবে কথাটা বলিনি।
তাহলে কিভাবে বলেছ আপা।যেই মেয়ের জন্য এই বাড়ির মেয়ের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে সেই মেয়ের তুমি পক্ষ নিচ্ছ?আদ্রিজা তো তোমারও মেয়ের মতো আপা।
আমি কারো পক্ষ নিচ্ছিনা ছোট। শুধু বলতে চাচ্ছি দোষ যেমন এই মেয়েটা করেছে ঠিক সমান দোষী কিন্তু আদনানেরও।তুই শুধু কেন একজনকে দোষ দিবি?
হয়েছে আপা তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না।আমি সব বুঝে গেছি।
মুনতাহা আর কোনো কিছু না বলে গটগট শব্দ করে আদনানের রুম থেকে চলে যায়।তাহমিদা মুনতাহার চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবে।
মুলত আদনানের কথা মতো রওশনকে খাবার দিতে এসেছিল সে।আর এসেই শুনতে পায় মুনতার বলা কথাগুলো। রওশনের দিকে খাবারের ট্রে টা এগিয়ে দিয়ে মমতা ভরা কণ্ঠে বললেন
এই নেয় খাবার।আদনান পাঠিয়েছে। খেয়ে নিও
রওশন একটু ইতস্তত করে শেষমেষ ট্রে টা নিয়ে নেয়।এত মায়া ভরা কণ্ঠেও যে তার সাথে কথা বলতে পারে তা রওশনের কল্পনাতীত। খুব ইচ্ছে করল সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে।
শোনো মা তোমাকে একটা কথা বলি।তুমি বা আদনান যেই অন্যায় করছ তার কোনো মাফ হয়না।তোমরা দুজনে রিফাকে ঠকিয়েছ।যেই কাজটা তোমার একদম ঠিক করনি।
বিশ্বাস করুন আন্টি আমি নিজ ইচ্ছেতে এই বিয়ে করিনি।আর আমি জানতামও না যে আদনানের জীবনে অন্য কেউ আছে।যদি জানতাম তাহলে কোনো না কোনো ভাবে এইবিয়েটা আটকাতাম।
নিজ ইচ্ছেতেই কর আর অনিচ্ছায় ভুল তো তুমি করে ফেলছ।আমি জানি না ভবিষ্যতে তোমার কপালে কি আছে।
আর সময় ব্যয় না করে তাহমিদা নিজের কাজে চলে গেল।রওশন আর কোনো কিছু না ভেবেই খেতে শুরু করে দিল।সকাল থেকে তার পেটে একটা দানা পর্যন্ত পরেনি।খিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
আদনান আর আফনান দুজনের ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।দুজনেই গভীর চিন্তায় মগ্ন।
চারদিকের নিরবতাকে ভেঙে আফনান বলে উঠলো।
সবই তাও বুঝলাম ভাই। কিন্তু এখন কি করবি।এভাবে তো তুই রিফাকে হারাবি।আর রওশন নামের মেয়েটার সাথেও তো অন্যায় করা হচ্ছে।আর বাড়ির সবাই তো তোকেই ভুল বুঝবে।সবথেকে বড় কথা রিফাকে ছাড়া তুই বাঁচতে পারবি?
জানি না রে ভাই।আমি কিচ্ছু জানি না। আমি জানি আমি রওশনকে বিয়ে করে অনেক বড় ভুল করছি।কিন্তু আমি কি করতাম তখন।আমার যে আর উপায় ছিল না।
তুই অন্যের কথা রাখতে নিজের জীবনটা শেষ করলি?তোর নিজের জীবনে তোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো অধিকার নাই?সব ক তোর ওই স্যারই নিবে?তোর স্যার কি জানতোনা রিফাকে ভালোবাসিস?
হুম জানতো।
তারপরও কি করে তোকে বিয়ে করতে বলে আমি বুঝলাম না?রওশন নিশ্চয়ই ওই বুড়োটার মেয়ে আর মেয়ের বিয়ে হচ্ছিলো না তাই তোর মত অবলা ছেলে কে পেয়ে তার মেয়েকে তোর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।
না আফনান।ব্যপারটা তেমন না।আমি সিয়র রওশন স্যারের মেয়ে না। কিন্তু তাহলে কার মেয়ে?আর স্যারের সাথেই বা তার সম্পর্ক কি?আর এই বিয়েটা তিনি কেন করতে বললেন?
তুই এতটা সিয়র হলি কি করে? হতেও তো পারে এটা তার অবৈ*ধ মেয়ে।
আরে না।এটা কিকরে হবে।আমি স্যারকে এত বছর ধরে চিনি।তার চরিত্রে কোনো সমস্যা নাই।
তার চরিত্রে সমস্যা নাই ভালো কথা।তাহলে অন্যের মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার এত মাথা ব্যাথা কেন শুনি?
সেটাই তো রহস্য।
হ্যা রে ভাই।এই রহস্যের উদঘাটন করা তোর কাজ।আফটার ওল তুই হলি দ্যা গ্রেট সিক্রেট সি আই ডি অফিসার মিস্টার সারফারাজ আদনান সিদ্দিকী। আমার মতো নরমাল মানুষের জন্য এইসব রহস্য না।তরে একটা কথা অন্যের জন্য নিজের জীবনটা নিজের হাতে শেষ করিস না আদনান।এখন বুঝবি না যখন রিফা তোর থেকে অনেক দূরে সরে যাবে তখন পস্তাবি।
আফনান আর দাঁড়ালো না নেমে গেল ছাদ থেকে।
আমার রিফাকে কখনো আমার থেকে দূরে যেতে আমি দিব না।ওকে ভালোবাসি আমি।ওকে ছাড়া যে আমি অচল।
হটাৎ কারো শীতল হাতের ছোয়া পেয়ে পিছনে তাকায় আদনান।
তানভীর কে দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে আদনানের।
ভাইয়া তুমি আসছো।এখন আমার টেনশন অনেকটা কমে গেল।
তুই ফোন করবি আর আমি আসব না তা কি হয়।কিন্তু... কাজটা কি ঠিক হয়েছে আদনান?রিফা যে কষ্ট পাচ্ছে।
এখন আর আমার কিছু করার নাই ভাইয়া।
নিজের রুমে একাকী বসে আছে আদ্রিজা।বর্তমানে জীবনের সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত সে।বাহিরে নিজেকে যতই শক্ত দেখাক না কেন সেই শুধু জানে তার মনের অবস্থা।হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সামনে তাকায় আদ্রিজা।সামনে খাবার হাতে দাঁড়িয়ে
আছে আরমানের বউ মাইশা।
রিফা আসবো।
হ্যা আপু আসো। আর পারমিশন নিতে হবে কেন?
তুমি কি ঠিক আছো। তখন আমি বাড়ি ছিলাম না আর এত কিছু হয়ে গেল।
আপু থাক না এখন এসব কথা।ভালো লাগছে না এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে।আর প্লিজ এখন থেকে আমাকে আদ্রিজা বলে ডেকো
ঠিক আছে।এখন খাবারটা আমার সামনে খেয়ে নেও দেখি।
খেতে ইচ্ছে করছে না আপু। পরে খাব রেখে দেও
খেতে ইচ্ছে করছে না মানে।ছোট মা খাবার পাঠিয়েছে।ভালো মেয়ের মতো আমার সামনে খাবারটা খেয়ে নেও নাহলে ছোট মা আমার উপর রাগ করবেন
আদ্রিজা মাইশার জড়াজড়িতে খেতে শুরু করলো। খেতে খেতে কি যেন একটা ভেবে মাইশাকে উদ্দেশ্য করে বলল
চলো না আপু আমরা দূরে কোথাও ট্যুর দিয়ে আসি।
আচ্ছা সেটা হবে না হয়।এখন তারাতাড়ি খাবার টা শেষ কর।
খাওয়া শেষ করে মাইশা কিছুক্ষন আদ্রিজার সাথে গল্প করে। তারপর তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে মাইশা।আদ্রিজার জন্য ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।একদিনেই চোখেমুখের অবস্থা চেঞ্জ হয়ে গেছে।মাইশা সরাসরি রান্নাঘরে চলে আসে।
মাইশাকে আসতে দেখে মুনতাহা তাকে প্রশ্ন করে খেয়েছে?
হ্যা ছোট মা।
ঠিক আছে”এখন হাতে হাতে কিছু কাজ করে দেও,নাহলে এক্ষুনি সবাই খেতে আসবে।এমনিতেই সকাল থেকে কারো পেটে দানা পানি পরেনি।
ঠিক আছে ছোট মা।
এবাড়ির নিয়ম হল রাত ৯টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করতে হবে।ছেলেদের যতই কাজ থাক না কেন রাত ৮ টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।আর সবাইকে একসাথে রাতের খাবার খেতে হবে।তবে আজ তার ব্যতিক্রম। আজ ডাইনিং টেবিলে সবাই উপস্থিত থাকলেও অনুপস্থিত রয়েছে আদনান,আদ্রিজা আর রওশন।
ভাইজান আমরা এই সংসার থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাই।কারণ এখানে থাকলে আমার মেয়ে কখনো সুস্থ হবে না আর আমি চাইনা আমার মেয়েকে এমন অসুস্থ পরিবেশে আর রাখতে। আমি ভেবেছি তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে সামনের মাসেই আমরা আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠবো। এখানে আদনান আর তার বউকে দেখলে আমার মেয়ে কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না।আর তুমি কি চাও আমার মেয়েটা এমন দুঃখে দুঃখে বাঁচুক?তার এখনো পুরো জীবনটা বাকি আছে।আমি আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে জানালাম ,এখন বাকি ডিসিশন তোমার।
নিজের ছোট ভাই রিদওয়ানের বলা কথায় নিস্তব্ধ হয়ে যান রেজাউল সিদ্দিকী। তার সংসার যে ভাঙতে বসেছে তিনি তো ভালো করে বুঝতে পারছেন। কিন্তু সে তো তার বাবা মাকে কথা দিয়েছিল কখনো এ সংসার ভাঙতে দিবে না।সবাইকে আগলে রাখবে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তিনি ব্যর্থ। তিনি তার বাবা-মার কথা রাখতে পারেননি। কিন্তু তিনি বা রিদওয়ানকে আটকাবেন কোন মুখে। যেন তার মাথায় হেট হয়ে যাচ্ছে। লজ্জা কার সাথে কথা বলতে পারছেন না।
রেজাল্টস থেকে চুপ করে থাকতে দেখে রিদওয়ান পুনরায় বলতে শুরু করল-
-ভাইজান আমি জানি আমার বলা কথায় হয়তো তুমি কষ্ট পেয়েছে কিন্তু আমার যে কিছু করার নাই। আমাকে যে আমার মেয়ের কথা ভাবতে হবে।
দেখ ভাই একজনের ভুলের জন্য তোরা যে বাড়ি ছেড়ে যেতে পারিস না।এতে করে বাবা মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে।
উপরোক্ত কথাটি রাজ্জাক সিদ্দিকীর। রিদওয়ান তার মেজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উপহাস করে বলবো
ভুল! আদৌ কি সেটা ভুল! তোমরা এখনো সেটা কি শুধু ভুল বলেই আখ্যায়িত করবা।আচ্ছা থাক এখন এসব কথা আমি এসব নিয়ে ঘাটতে চাচ্ছি না।তবে আমি এবারে ছেড়ে যাব এটাই আমাদের লাস্ট ডিসিশন।
রাজ্জাক প্রতিত্তোরে বলে।
মানছি আদনান অনেক বড় ভুল করেছে আমরা তো কিছু করিনি। তাহলেই ভুলের শাস্তি তুই আমাদেরকে কেন দিচ্ছিস। দেখ ভাই তুই যদি এখান থেকে চলে যাস তাহলে রিফার আরো বেশি কষ্ট পাবে। আমাদের সাথে থাকলে নিজের কষ্টটা কোন মত কাটে নিতে পারবে। আর কথা আদনানের তাহলে তাকে তো বড় ভাইজান এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে বাড়ি ছাড়ার। ওর জন্য তোরা কেন বাড়ি ছাড়বে। চলে যেতে হলে ও যাবে।
এরই মাঝে মুনতাহা বলতে শুরু করল যে -
-আপনারা সকলেই এখন উপস্থিত তাই আপনাদেরকে আমি একটু কথা বলতে চাই। অনুগ্রহ করে রে আমার মেয়েকে আর কেউ রিফা বলে ডাকবেন না। সে এই নাম শুনলে কষ্ট পায়।কারণ যার দেওয়া এই নাম সে তো তার হলো না। তাই প্লিজ এখন থেকে সবাই তোমার মেয়েকে আনতে যা বলেই ডাকবেন।
-হে ছোট মা আজ থেকে আমাকে সেইম কথাই বলল।আর বলল সে কোথায় একটা ট্যুর দিতে চায়। তাই আমি ভাবলাম আমরা সবাই মিলে যদি সুন্দরবন বা রাঙ্গামাটি যাই তাহলে কেমন হয়? —(মাইশা)
সকলেই যে মাইসার প্রস্তাবে খুশি তা তাদের মুখে মুখে স্পষ্ট।
মনটা মশার উদ্দেশ্যে বলল -
-একদম ঠিক বলছো আমিও চাচ্ছিলাম তোমরা মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসো, তাহলে ওর মনটা এতে ভাল হবে।
-ঠিক আছে ছোট মা তাহলে আমি সব ব্যবস্থা করছি। (আরমান)
-হ্যাঁ কর সেই ভালো হবে।এমনিতেই মেয়েটার উপর দিয়ে আমার এত ধকল গেল একটু শান্তি পাবে । (মুনতাহা)
রুহি অনুরোধের কণ্ঠে বলে
না আপু সবাই মিলে বান্দরবান যাব। এর আগে বার তোমরা সবাই সুন্দরবন গিয়েছিলে আমাকে নিয়ে যাও নি এবার আমরা সুন্দরবনে যাব ব্যাস।
আদনান রুহির কথায় ঠাট্টা করে বলে -
আহা আইছে আমার পরামর্শদাতা রে।তোর কাছে কে শুনতে চাইছে রে কই যাবো না যাবো। হয় সুন্দরবন যাব না হলে রাঙ্গামাটি যাব। এটাই ফাইনাল। তুই যদি ইচ্ছে করে যাবি আর না হলে তুই যাবি না। বান্দরবান যাবনা।
রুহি রাগান্বিত চোখে আফনানের দিকে তাকায়। আছে আপনার চুলগুলো ছিড়ে দিতে। মুখ ভেংচিয়ে আফনান কে বলে, বেশি কথা বলবে না ভাইয়া।আমি যেটা বলছি সেটাই হবে। এর আগেরবারও তোমার জন্য আমার যাওয়া হয়নি।এবারও যদি আমার যাওয়া নিয়ে কিছু করছ তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না করে দিলাম।
আরমান রুহি আর আফনান কে ধমক দিয়ে বলে -
হয়েছে তোদের ঝগড়া করা? এবার একটু চুপ কর। সবাইকে খেতে দে।
এত কিছুর মাঝেও রেজাউল সিদ্দিকী আর আফরোজা সিদ্দিকী নিশ্চুপ।আজ তারা ডাইনিং টেবিলে থেকেও যেন নেই। তাদের মনের অবস্থা কাকে বোঝাবে তারা। তাদের ছেলের কৃতকর্মের ফল তাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে।আজ খাব তাদের গলা দিয়ে কিছুদিন আনতে চাইছে না।
এদিকে তানভীর কিছু একটা ভাবছে সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে তাই কোনো কথাই তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তো গিয়ে তো ভাবছি সে?
তাহমিদা আর মুনতাহা রাতের খাবার শেষ করে নিজেদের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে। আর তাদেরকে সাহায্য করছে মাইশা। নিজের কাজগুলো শেষ করে মাইশা নিজের রুমে চলে যায়। মাসাকে রুমে আসতে দেখে আরমান মাইশা কে উদ্দেশ্য করে বলে-
তাহলে কি সিদ্ধান্ত নিলে কোথায় যাবে? এই যে সব কিছু প্রস্তুতি নিতাম।
রুহি যেহেতু বান্দরবান যাইতে চাইছে তাহলে বান্দরবান যাব।
মাইশার কথা শেষ হওয়ার আগেই আরমান মাইশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে মাইশা তাকে এক ঝটকায় নিজের থেকে সরিয়ে দেয়।
আরমান মাইশার এমন ব্যবহারে ভ্যাবাচেকা খায়।অসহায় কন্ঠে বলে -
কি হয়েছে মাইসা এমন করছ কেন?
আমার ভালো লাগছে না আরমান।
কিন্তু কেন? আমি কি করলাম।
হ্যাঁ তুমি কিছু করোনি। ঠিক আছে কিন্তু তোমার ভাইতো করেছে।
তার জন্য তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিবে।
এক ভাইয়ের চরিত্র খারাপ। বাকিদেরও যে খারাপ হবে না তার কি গ্যারান্টি?আফটার ওল তোমাদের গায়ে তো আবার একই রক্তই বইছে।
আমরা তিন ভাই তিন রকম তা তুমি ভালো করেই জানো মাইশা। তাহলে এখন এমন করছ কেন? মানছি আমার ভাই ভুল করেছে, কিন্তু তার শাস্তি তুমি আমাকে কেন দিচ্ছ?
আমি তোমাকে কোন শাস্তি দিচ্ছি না আরমান। আমি শুধু বলছি আজকের দিনটার জন্য তুমি শুধু আমাকে একটু একা থাকতে দাও। কারন আমিও তো একটা মেয়ে আমি জানি কাউকে পাগলের মত ভালবাসলে তাকে হারালে কতটা কষ্ট লাগে।
হুম থাকো তুমি তোমার আবেগ নিয়ে আমি চললাম।
আর সময় ব্যয় না করে আরমান নিজের রুম থেকে বের হয়ে গেল। মাইশা আরমানে যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকল। সত্যি বলতে সকল পুরুষই স্বার্থপর হয়। তারা কখনো মেয়েদের মন বোঝেনা। শুধু নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে মেয়েদের। প্রয়োজন শেষে ছুড়ে ফেলে দিতে হয় এক মিনিটও দ্বিধা করেনা। এসব জেনেও কেন মেয়েরা বারবার ছেলেদের প্রেমে পড়ে?যারা ভালোবাসার যোগ্য নয় বরং তাদেরকেই মেয়েরা সবথেকে বেশি ভালোবেসে ফেলে।রিফার কষ্ট আজ মাইশাকে বড় পোড়াচ্ছে।
ফজরের আজান কানে ভেসে আসতেই ঘুম হালকা হয়ে যায় রওশনের।ঘুমাতে যতই দেরি হক না কেন ফজরের নামাজ দিয়েই প্রতিদিন তার দিনের সুচনা ঘটে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।ঘুম থেকে ওঠে অযু করে নামাজ পড়ে নেয় সে।নামাজ শেষ হতেই চোখ পরে সোফায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা আদনানের দিকে। বাচ্চার ন্যায় মুখশ্রী ভাব তার মুখে।রওশনের ইচ্ছে করল ছুয়ে দিতে।কিন্তু সাহস পেল না।বর্তমানে কোনো কাজ না থাকায় বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় সে। দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ প্রকৃতি উপভোগ করতে লাগল।রাতের অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যের সোনালী আভা চারদিক ছড়িয়ে পরছে।শুরু হচ্ছে আরেকটি নতুন দিন।পাখিরা ছুটছে তাদের আহারের খোঁজে।
আর কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে রওশন রুমে চলে আসে।রুমে আসতেই টের পায় আদনান ঘুম থেকে উঠে গেছে।নিজের ফোন হাতরে নিজের দাদিকে ফোন দেয়-
দাদি আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছিস রে বুবু?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি দাদি।তুমি কেমন আছো?
আমিও ভালা আছি রে।তোকে কি তোর শশুর বাড়ির লোক গুলো মেনে নিয়েছে?
-হ্যা, দাদি।
রওশন বাধ্য হয়ে তার দাদিকে মিথ্যা কথা বলে।যদি সে সত্য বলে দিত তাহলে তাকে নিয়ে দাদি অনেক টেনশন করত।সে আর তার দাদিকে কষ্ট দিতে চায় না।কারন এদুনিয়াতে তার দাদি ছাড়া কেউ নেই।আর বাবা থেকেও নেই।তাই দাদি আকলিমা আরা হলো রওশনের একমাত্র আপন জন।
কি হইল বুবু।এইভাবে চুপ কইরা গেলি কেন? তুই কি আমার থাইকা কিছু লুকাইতাছোছ?
না দাদি। তুমি অযথা চিন্তা করছ।আর আমি এখানে খুব ভালো আছি।সবাই আমার খুব যত্ন করছে জানো।একদিনের মধ্যেই সবাই আমাকে খুব আপন করে নিয়েছে।
কথাগুলো বলছে আর আপনা আপনি চোখের পানি গড়িয়ে পরছে রওশনের।কান্নার ফলে তার আওয়াজ বার বার আটকে যাচ্ছে।
তুই যদি ভালোই থাকস তাহলে কান্দস কেন?
এই প্রথম আমি ভালোবাসার মতো পরিবার পাইছি তো তাই আবেগপ্রবণ হয়ে পরেছি।আচ্ছা এসব কথা এখন বাদ দেও। তুমি ঠিক সময় কিন্তু ওষুধ খাবা বলে দিলাম
তুই ভালো আছিস এটাই আমার সবচেয়ে বড় ওষুধ। এখন আমি শান্তিতে মরতে পারব।আল্লাহ যত তাড়াতাড়ি নিয়া যায় ততই ভালো।
এই সব কোন ধরনের কথা বুড়ি।তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে শুনি।
আমি না থাকলে আমার নাতিটা তোকে আগলে রাখবে।এখন আমি না থাকলেও চলবে।
এসব কোন ধরনের কথা দাদি।তোমার কিছু হবেনা।আর একটা কথা। ঠিকঠাক সময় খাওয়া দাওয়া করবে। আর আমি রফিক চাচার থেকে তোমার বিষয়ে সব খবর নিব।তখন যদি শুনি কোনো কিছু নিয়মের বাইরে করছ, তাহলে তোমার খবর আছে বলে দিলাম।
দাদির সাথে কথা শেষ করে যেই ফোনটা রেখে দেয়,ঠিক তখনই আদনান বাথরুম থেকে বের হয়।দুজনের চোখাচোখি হতেই রওশন চোখ নামিয়ে নেয়।আদনানের দিকে তাকাতে তার ভীষণ লজ্জা করে।হাজার হক এখন থেকে আদনান তার জীবনসাথী। কিন্তু সে কি আদৌ আদনানকে পাবে?আদনানের জীবনে যে অন্য কারোর অস্তিত্ব। এসব মনে পড়তেই রওশনের মুখে কালো অন্ধকার ছেয়ে যায়।
কেন আল্লাহ আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ?আমি তো কখনো আরো কোনো ক্ষতি করিনি তাহলে আমার সাথেই এমন কেন হলো?আমি কি এতটাই খারাপ যে ভালোবাসার মানুষ পাওয়ার আগেই তাকে হারিয়ে ফেলি।আমার এই বুক ফাটা কষ্ট গুলো কাকে বোঝাবো।যেখানে সবাই আমাকেই ভুল বুঝছে।
একমনে কথাগুলো ভাবতে থাকে রওশন।আদনান কিছুক্ষন রওশনের দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে তার মেঝ মায়ের কাছে যায় রওশনের জন্য খাবার দিতে।
আদনান আপন মনে নিজের ল্যাপটপে কাজ করছিল,এমন সময় তানভীর উপস্থিত।
আদনান,আসবো"?
হ্যা ভাইয়া আসো।
তোকে কিছু বলার ছিল।তুই কি ফ্রি আছিস?
হ্যা আছি বলো।
আচ্ছা আগে বল মেয়েটা কোথায়?
ওয়াসরুমে হয়তো?
মেয়েটার পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানতে পারলি?
না।কি যেন গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল বললে না তো?
ও হ্যা।ভুলে গেছিলাম। তোর জন্য একটা চিঠি আছে।
কিসের চিঠি?আর কে দিয়েছে?
যার কথায় তুই এত বড় একটা ভুল করলি, তোর ডিপার্টমেন্টের হেড আসাদুজ্জামান স্যারের।
দেখি চিঠিটা কি লেখা আছে সেখানে।
তানভীর আদনানের হাতে চিঠিটা হস্তান্তর করে
"প্রিয় আদনান,
আমার হাতে হয়তো আর বেশি সময় নাই।হয় আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যে মৃ*ত্যু কলে ঢলে পড়ব আর তা নাহলে তারা আমাকে মে*রে ফেলবে।কিন্তু মৃ*ত্যু আজ আমার নিশ্চিত। তবে আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না আদনান।আমি আমার শেষ ইচ্ছের কথা তোমাকে জানিয়েচ্ছি।আমার বিশ্বাস তুমি আমার কথা রাখবে।আমার জন্য নাহলেও নিজের দেশের জন্য তোমাকে পারতে হবে।এতদূর এসে যদি তুমি পিছিয়ে যাও তাহলে কখনো ক্রি*মি*নালদের ধরতে পারবেনা।তোমার একটা সিদ্ধান্ত এর উপর সব কিছু নির্ভর করছে।আমি চাইনা তুমি হেরে যাও।আমি জানি তুমি এখন ভাবছ এই মেয়ের সাথে এই কেসটার কি সম্পর্ক। এতটুকু শুধু জানো যে অনেক বড় সম্পর্ক আছে।আর কি সম্পর্ক আছে তা তুমি সময়ের সাথেই জানতে পারবে।মেয়েটাই পারবে তোমাকে সাহায্য করতে।আমি আর লিখতে পাড়ছিনা আদনান।যেটা আমি পারিনি সেটা তোমাকে করতে হবে।ক্রি*মি*নাল দের হাত থেকে এদেশের মানুষগুলোকে তোমাকে বাচাতে হবে।আমি জানি আজ আমি তোমার কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধী। কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না আদনান।পারলে আমাকে মাফ করে দিও।
এতক্ষন যাবত আদনান মনোযোগ দিয়ে যায় চিঠিটি পড়ছিল।
আদনানের মাথায় একটা কথা কিছুতেই ঢুকছেনা এই মেয়েটা আদনানকে সাহায্য করবে কিন্তু কি করে?আদনানকে চিন্তিত দেখে তাহভীর বলে ওঠে-
কি ভাবছিস?
অনেক কিছু।প্রশ্ন এতগুলো অথচ কোনো উত্তর পাচ্ছিনা। কে এই মেয়ে?একি তাহলে অপরাধীদের সাথে মিলিত?নাকি অন্য কিছু।আমার মাথায় কিচ্ছু আসছে না।বাড়িতে প্রবলেম।বাহিরে প্রবলেম। কোন দিক সামলাব আমি?
তোর জন্য আরেকটা চমক আছে আদনান।
আবার নতুন কি?
কালকে রাতে আননন নাম্বার থেকে একটা মেসেজ আছে?
তানভীর আদনানকে ফোন বের করে মেসেজটা দেখায়
আগুন নিয়ে খেলতে আসিস না। নাহলে এই আগুনেই পু*ড়ে ম*রতে হবে তোদের।আস্তে আস্তে তোর পুরো পরিবার কে আমি শেষ করে দেব।আমাকে ধরা এত সহজ না। কথাটা মাথায় রাখিস।(আননন)
এই নাম্বারটা ট্রেক করছো?
তোর বলার আগেই করছি?
কে সে?
জানি না।মেসেজ দেওয়ার পরপরই ফোন দেই। সুইচওফ দেখায়।
আদনান আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পরে।কাকে সে প্রশ্ন করলে উত্তর পারে?
আরো পড়ুন: এক টুকরো ভালবাসা| আনাবিয়া নূর(পর্ব-৩)
0 Comments