এক টুকরো ভালোবাসা|আনাবিয়া নূর- (পর্ব-৩)

ভালবাসার গল্প: এক টুকরো ভালোবাসা|আনাবিয়া নূর- (পর্ব-৩)

সিদ্দিকী ম্যানশনের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার থেকে নেমে পরে একজন সুদর্শন পুরুষ। সৌন্দর্যের সকল গুন তার মাঝে বিদ্যমান। নিসন্দেহে বলা যায় হাজারো নারীর হৃদয় হরণকারী। নিজের চোখের এঁটে থাকা সানগ্লাসটি খুলে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের পানে।তার চোখ জোড়া যেন কাউকে খুঁজছে।

আফনান অনেক্ক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে অজ্ঞাত লোকটিকে।তাই আর দেরি না করে। মানুষটির সামনে এসে দাঁড়ায়।

আফনান বিনীত কণ্ঠে প্রশ্ন করে-

আসসালামু আলাইকুম। কাউকে কি খুঁজছেন?

কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পিছনে তাকায় অজ্ঞাত পুরুষটি।সালামের উত্তর দিয়ে বলে-

জী।এটা কি এসপি তানভীর তাজ সিদ্দিকীর বাড়ি?

জী এটা উনার বাড়ি।আর আপনার পরিচয়টা যদি বলতেন তাহলে ভালো হত।

আমি হলাম এসপি মেহেরাব মীর।তানভীরের ফ্রেন্ড। তানভীর কে কি এখন পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ ভাইয়া, আমি হলাম আফনান আদনান ভাইয়ার চাচাতো ভাই। আমার সাথে আসুন।ভাইয়া বাড়িতেই আছে।

এই বলে আফনান মীর কে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। অনাকাঙ্ক্ষিত কারোর উপস্থিতিতে সবাই একটু অবাক হয়।

বর্তমানে বাড়ি প্রায় ফাঁকা। রেজাউল, রাজ্জাক,রিদওয়ান আর আরমান সকালের ব্রেকফাস্ট করে নিজেদের অফিসে চলে গেছেন।

তাহমিদা সামনে এগিয়ে এসে মীরকে উদ্দেশ্য করে আফনানকে বলে।

বাড়িতে অতিথি আসবে তুই আগে বলবি না?

আমি তো নিজেই জানতাম না।আর উনি হলেন তানভীর ভাইয়ার বন্ধু।

তাহমিদা মীরের দিকে তাকিয়ে বলে-

দাড়িঁয়ে আছো কেন?বসো তুমি। 

না আন্টি আজকে আর বসার সময় নাই।আপনি প্লিজ তাজকে ডেকে দিন।ওর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।

আফনান তুই ভাইয়াটাকে উপরে তানভীরের রুমে নিয়ে যা।

মেঝো মায়ের আদেশ পেয়ে আফনান মীরকে তানভীরে রুমে নিয়ে যায়।আফনান তানভীরে দরজায় টোকা দিতেই তানভীর বলে ওঠে -

দরজা খোলা আছে।

তানভীরের অনুমতি পেয়ে মীর দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে।

কিরে ভাই এভাবে একা একা কি করিস?

তানভীর চিরচেনা কণ্ঠ শুনে পেছনে তাকাতেই দেখতে পায় তার প্রানপ্রিয় দোস্তকে।অবাক হয়ে বলল-

আরে দোস্ত তুই!তোর না কাল আসার কথা ছিল?

না ভাবলাম যখন এই কাজের জন্য আমাকে বরাদ্দ করা হয়েছে, তখন দেরি করে কি লাভ। তাই তারাতাড়ি চলে আসলাম।

ভালো করছিস।তুই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নে তারপর একসাথে থানায় যাব।

ঠিক আছে,দোস্ত।এবার তাওয়াল টা দে ফ্রেস হব।

মীর ফ্রেশ হয়ে বের হলো ঘড়ি ধরে ঠিক আধাঘণ্টা পরে।মীর বের হতেই তাহমিদা মীরের জন্য নাস্তা দিয়ে যায়।নাস্তা শেষ হলে মীর তানভীরের উদ্দেশ্য বলে-

এই কেসের জন্য নাকি একজন সিআইডি তোদের সাহায্য করছে?কে সে?

মীরের করা প্রশ্নে তানভীর কিছুটা হকচকিয়ে যায়।তার এখন কি উত্তর দেওয়া উচিৎ সে নিজেও জানে না।এ দিকে আদনানের পরিচয় গোপন করা তার জন্য ফরজে আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে।আর অন্য দিকে যদি সে মীর কে মিথ্যা বলে তাহলে মীরের এক সেকেন্ড লাগবে না ওর মিথ্যা ধরতে।কারন মীরের চোখ ফাকি দেওয়া এতো সহজ না। ছোট থেকে ছোট বিষয় গুলোর দিকেও তার নজর।আর সব কিছু নিয়ে সন্দেহ করা তো তার দৈন্দিন বিষয়।তাই তো এই কেসের জন্য মীরকে অতিরিক্ত এসপি হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য তার সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। তানভীরের থেকে উত্তর না পেয়ে পুনরায় মীর প্রশ্ন করে

কিরে কি হলো তোর।উত্তর দিচ্ছিস না কেন?

তানভীর শুনেও না শুনার ভান করে ইনোসেন্ট মার্কা লুক করে বলে-

কি বললি শুনতে পাইনি।আসলে মাথায় এতকিছুর  চিন্তা।তাই তোর কথায় কর্নপাত করিনি।

মীর ছোট ছোট চোখ করে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলে-

সিআইডি অফিসার টা কে যে তোদের সাহায্য করছে?আমি কি তার পরিচয়টা জানতে পারি?

আমি তো নিজেই চিনিনা।তোকে পরিচয় বলব কি করে?

তানভীরের কথা যে মীর বিশ্বাস করে নি সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবু মীর আর কিছু বলল না।নিরব ভূমিকা পালন করল।মনোযোগ দিল নিজের ফোনের দিকে।অন্য দিকে তানভীরের মন আনচান করছে।

মীর কিছুক্ষন চুপ থেকে পুনরায় বলল-

এবার চল থানায়?

মা বলছে খেয়ে যেতে।

না রে ভাই আমি কিছু খেতে পারবো না।

সেটা যদি তুই আমার মাকে বোঝাতে পারিস, তাহলে আমার মাকে বলে আয় যে তুই খাবি না।

মীর বুঝতে পারে তার না খেলে রক্ষে নেই তাই আর তর্কতে জোড়ালো না সে।

এভাবে বসে থাকতে আমার ভালো লাগতেছে না তাজ।

তাহলে ছাদে চল। 

এই বলে তানভীর মীরকে নিয়ে ছাদের উদ্দেশ্য যায়।পথিমধ্যে কারো মিহি কণ্ঠ ভেসে আসে মীরের কানে।থেমে যায় তার পায়।শব্দের উৎসের সন্ধানে চারদিকে চোখ বুলায় সে।কিন্তু কিছুতেই দেখা মিলে না সেই রমণীর। কি সুরেলা সেই আওয়াজ।মন মাতানো সুর যেন তীব্র ভাবে আকৃষ্ট করছে মীরকে।হটাৎ মীরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তানভীর প্রশ্ন করে-

কি হইছে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

মীরের খুব ইচ্ছে করল তানভীরের কাছে জানতে কণ্ঠটা কার।কিন্তু কিছু না বলেই তানভীরের সাথে উঠে পরে ছাদে।ছাদে আসতেই কণ্ঠটা আরো তীব্র হতে শুরু করলো। সামনে তাকাতেই নজরে পরে লম্বা কেশবতী বিপরীত দিকে মুখ করে আপন মনে গান গেয়ে চলেছে।তার গানের স্বর যে একজনকে প্রতিনিয়ত ঘায়েল করছে তা কি কেশবতী জানে?নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা আসে মীরের মনে।রমণীকে স্বচক্ষে দেখার বাসনা সে কিছুতেই দমাতে পারছে না।মীরের সমস্ত ধ্যান, মনোযোগ আপাতত অপরিচিতার পানে চেয়ে আছে।

মীরকে এভাবে হেবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে তানভীর তাকে কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে-

কিরে মাঝে মাঝে তোর কি হচ্ছে বল তো?তোকে কি ভুতে ধরছে?

আরে কি আবল তাবল বকে।ভুতে ধরবে কেন?

তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?এতক্ষণ ধরে যে আমি বকে গেলাম কিছু কি তোর কানে ঢুকে নি?

ওহ আমি শুনতে পাইনি।আসলে অন্য দিকে মনোযোগ ছিল আমার তাই হয়তো শুনতে পাইনি

সে তো আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি।

আচ্ছা দোস্ত সামনের ওই মেয়েটা কে?

ও। ওতো আমার ছোট চাচুর মেয়ে আদ্রিজা। 

ওহ আচ্ছা।

হৃদয়হরিনীর নামটা যেন মনে গেথে যায় তার।মীর আবার নিজের দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে থাকে।কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে তাকায় আদ্রিজা।তানভীরের সাথে অপরিচিত কাউকে দেখতে পেয়ে নিজের ওড়না দিয়ে অতি সন্তর্পণে নিজেকে ঢেকে নেয় সে।কিছুক্ষণ একা থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চেয়েছিল সে।কিন্তু তা আর হল কই?বিরক্তিপূর্ন মুখ নিয়ে প্রস্থান করে সে। আদ্রিজাকে দেখার পর থেকে ভয়ংকর রকম মুগ্ধ হয় মীর।কিন্তু আদ্রিজার চলে যাওয়ার বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তার মন।আর কিছু সময় অতিবাহিত করে নেমে পরে দুজনে।হটাৎ কারোর সাথে ধাক্কা খায় মীর সামনে তাকিয়ে দেখে প্রথম দেখা আফনান।তবে একিছুটা আলাদা।

ওহ সরি সরি।দেখতে পাইনি।আ'ম রেইলি সরি।

ইটস অকে।

ভাইয়া উনি?

এ হলো মেহেরাব মীর। আমার ফ্রেন্ড। 

আর মীর ও আমার ভাই আদনান!

হ্যা আমি অকে আগেই দেখেছি। 

তুই একে না আফনানকে দেখছিস।আদনান আর আফনান জমজ ভাই।

ওহ আই সি।

আদনানের মাথায় তখন থেকে একটা কথাই ঘুরছে "মেহেরাব মীর"। এই নামটা সে আগেই শুনেছে।তাহলে এই সেই মীর যার কথা তাকে তানভীর ভাইয়া বলেছিল।মীর কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক সেই সময়।মুনতাহা রান্নাঘর থেকে হাঁক ছেড়ে তানভীরকে ডাকছেন

তানভীর খাবার রেডি। তোর বন্ধুকে নিয়ে খেতে আয়।

তাই তানভীর আর দেরি না করে মীর কে নিয়ে নিচে গেল।খেতে বসল দুজনে।এর মাঝে বহু বার মীরের নয়ন জোড়া খুজেছে তার কেশবতীকে।কিন্তু কিছুতেই তার দেখা মিলেনি তার।

খাওয়ার পর্ব শেষ করে কিছুক্ষন রেস্ট নেয় দুজনে।এরইমধ্যে মীরের প্রাকৃতিক ডাক পরে। তাই কাজ ছাড়তে সে ওয়াসরুমে যায়।আর তানভীর বলে-

তাহলে তুই আয়।আমি এখন নিচে যাচ্ছি। তোর হয়ে গেলে চলে আসিস?

তানভীর আর সময় ব্যয় না করে নিচে নেমে পরে।মীর মিনিট পাঁচেক পরে ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে সোজা তানভীরের রুম থেকে বের হয়।চলতে চলতে আবার পা জোড়া থেমে যায় তার।সামনেই তার কেশবতী।নয়নপল্লব আদ্রিজার দিকে স্থির হয়ে রইল।

আদ্রিজা নিজের রুমে বসে নিজের মতো পড়ছিল।আর তাকে দেখেই মীর মুগ্ধ চাহনিতে তার পানে চেয়ে থাকে।মীরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদনান সামনে এগিয়ে আসে।যখন আদনান বুঝতে পারে মীর আদ্রিজার দিকে তাকিয়ে আছে, রাগে তার শিরা উপশিরা যেন স্পষ্ট হতে থাকে। চোখ জোড়া ক্রমশ লাল বর্ণ ধারণ করছে।তবু নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মীরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে

ওদিকে যাওয়ার পথ নয়।সিড়ি দিয়ে নেমে সোজা গেলেই যাওয়ার পথ পাবেন।

মীর আদনানের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বাঁকা ঠোঁটে বলে-

বাড়িতে আসা অতিথিকে বুঝি আপনি এভাবে তাড়িয়ে দেন!

আদনান ভ্রু বাকিয়ে বলে-

না একদম না। তবে যে আমার রিফার দিকে তাকায় তাকে আমি  এত সহজে ছেড়ে দেই না, যদি না আমার ভাইয়ের বন্ধু হত। 

হুমকি দিচ্ছো আমাকে?

হুমকি না জাস্ট সত্যি কথাটা বলে রাখলাম।

আমি মেহেরাব মীর কখনো কারো কথায় ভয় পাই না।আর যেটা আমার পছন্দ হয় সেটা যেকোনো মুল্যে আমি নিজের করে নেই।

আদনান আর মীরের কথপোকথন আর বেশি দূর এগতে পারলো না তার আগেই তানভীর মীরকে জোরে জোরে ডাকতে থাকে তাই মীর সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।

মীর তানভীরকে উদ্দেশ্য করে বলে-

আমাকে একটা কথা বলত।আদ্রিজা আর আদনানের মাঝে সম্পর্কটা কি শুধু ভাই বোনের নাকি অন্য কিছু। 

হটাৎ তোর এত কিউরিওসিটি কেন আদ্রিজা আর আদনান কে নিয়ে?

আরে বলনা ভাই!

তানভীর সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা দেয় আদনান আর আদ্রিজার বিষয়ে।সব শুনে বাঁকা হাসে মীর সেই হাসির স্থায়িত্ব এত কম যা তানভীরের নজরে পরল না।

তানভীর থানা থেকে ফিরে এসে নিজের রুমে ঢুকতেই আদনান এসে উপস্থিত। আদনানকে আচমকা নিজের সামনে দেখে কিছুটা অবাক হয় সে।

কিরে কি হয়েছে?কিছু কি বলবি?

হ্যাঁ। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।আগে ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর বলব

না সমস্যা নাই।এখনই বল।

তোমার বন্ধুকে কিন্তু আমার একদম সুবিধার লাগে নি।

আদনানের কথায় সে আশ্চর্যের চরম পর্যায় পৌঁছায়।

এসব কি বলিস?মীর আবার এমন কি করল যে তোর সুবিধার মনে হলো না?

তোমার বন্ধু আমার রিফার দিকে নজর দিচ্ছে।এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে কিন্তু ভালো হবে না তাকে জানায় দিও।

কেন রিফাকে তার ভালো লাগতেই পারে?তোর এত গায়ে লাগছে কেন?

কারন ওর উপর শুধু আমার অধিকার থাকবে।আর কারোর না।সে আমার হয়নি পরিস্থিতির চাপে। কিন্তু আমি তার জীবনে নতুন কাউকে আসতে দিব না।

হাসালি আদনান।তোর অধিকার? আদৌ কি রিফার উপর তোর কোনো অধিকার থাকার কথা?তুই যেই কাজটা করছিস তারপরও কিকরে তুই রিফাকে আশা করিস।

জানি আমি ভুল করছি।আর তার মাশুল আমি রোজ দিচ্ছি।কিন্তু তাই বলে আমি আমার ভালোবাসা অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারব না।

তোর জন্য কি রিফা সারাজীবন একলা থাকবে?

প্রয়োজনে  একা থাকবে।তবু আমার জায়গা অন্য কাউকে দিতে দিব না।প্রয়োজনে ওকে মে*রে নিজে ম*র*ব।

পাগলামি বন্ধ কর।তোর একটা ভুল তিনটা জীবন নষ্ট করছে।এবার প্লিজ থাম।আর কোনো উল্টো পাল্টা কাজ করিস না।আর নিজের ভালোবাসাকে অপমান করিস না।

আমি পাগলামি করছি না ভাইয়া।যে মনে শুধু আমার বিচরণ সেই মনে আমি অন্য কারোর উপস্থিতি সহ্য করতে পারব না। 

তাহলে একবার ভাব রিফার কথা। সে তাহলে কি পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছে ভাব একবার?তুই রিফাকে মুক্তি দে।ওকে ওর মতো বাঁচতে দে।

আদনান আর কোনো কথা বলে না। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে পরে সে।তার মন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। মুক্তি না সে কিছুতেই রিফার থেকে দূরে থাকতে পারবে না।তার ব্যতীত অন্য কারোর উপস্থিতি সে সহ্য করতে পারবে না।

তোমার কাছে খুব করে একটা চাওয়া আছে আমার আদনান।তুমি কি আমার সেই ইচ্ছেটা পূরণ করবে?

জ্বী স্যার বলুন।

দেখো আদনান আমি হয়তো আর বেশি সময় পাব না।কিন্তু তোমাকে কথা গুলো না বললে হয়তো আমি ম*রেও শান্তি পারলব না।তোমার কাছে যেটা চাইতে যাচ্ছি সেটা পূরণ করা তোমার জন্য অনেক কঠিন হবে আমি জানি।কিন্তু আমি নিরুপায়।প্লিজ আমাকে তুমি ভুল বুঝো না আদনান।আমি নিজের স্বার্থে না দেশের স্বার্থে তোমার কাছে নিজের শেষ ইচ্ছেটা পেশ করছি।আমার চাওয়াটা যত কঠিনই হোক না কেন তোমাকে পারতেই হবে।

যদি প্রয়োজন হয় তো আমি আমার জীবন দিব তবু আমি আপনার চাওয়ার মান রাখব স্যার।আমি কথা দিচ্ছি।আর আপনি ভালো করেই জানেন, আমি কথা দিলে সেটা যেভাবেই হোক পালন করি

তোমার জীবন দিতে হবে না আদনান।তোমাকে যে বেঁচে থাকতেই হবে।কারন তোমার কিছু হলে এই কেস কখনো সমাধান হবে না।

আদনানকে নীরব থাকতে দেখে আসাদুজ্জামান খান পুনরায় বলতে শুরু করে 

আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কথা গুলো আমাকে যে করেই হোক শেষ করতে হবে।তাই আদনান আমার কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো। আমি জানি তুমি রিফাকে খুব ভালোবাসো। তোমাদের আর কিছু দিন পর বিয়ে।

আদনান তার স্যার কে থামিয়ে দিয়ে বলে

স্যার এখানে রিফার কথা আসছে কেন? ওর সাথে তো এই কেসের কোনো সম্পর্ক নাই।

হ্যা, আমি জানি আদনান। এখানে রিফাকে আমি টানছিনা।

তাহলে?

তোমাকে বিয়ে করতে হবে আদনান।

আদনান কিছু বলতে যাবে তার আগেই আসাদুজ্জামান বলেন-

আমি রিফাকে বিয়ে করার কথা বলছিনা আদনান।বলছি অন্য কারোর কথা।

মানে।স্যার আমার জীবন থাকতে আমি রিফা ব্যতীত অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার কাছে মৃ*ত্য সমতুল্য। আমাকে এই কাজটা করতে বলবেন না স্যার আমার অনুরোধ রইল।

আমাকে ভুল বুঝোনা।আমি জানি আমি সারাজীবন তোমার কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো।কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাকে পারলে মাফ করে দিও।কিন্তু আমার এটাই শেষ ইচ্ছে।তোমাকে তা যেভাবেই হোক পূরণ করতে হবে।

এক নিমিষেই আদনানের জীবন যে তন্নতন্ন হয়ে যায়। যেই মনে সে রিফাকে জায়গা দিয়েছে সেই জায়গা সে কি করে অন্যকে দিবে।এ যেন মৃ*ত্যুর চাইতেও ভয়ংকর।সে কি আদৌঁ পারবে নিজের কথা রাখতে?দম ফুরিয়ে আসার আগে যেমন মানুষ তার মৃ*ত্যুর জন্য ছোটফোট করে ঠিক একি অবস্থা আদনানের।  সব কিছুকে ত্যাগ করে শুধু রিফাকে নিয়ে বাঁচবে চায় সে?কিন্তু সে যে নিজের দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারবে না। আবার রিফাকে ছাড়াও বাঁচবে না। নিজেকে পাগল লাগছে তার।সব কিছু যেনেও তার স্যার কি করে পারল এমন করতে।কোনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার।

আদনানের অবস্থা বুঝতে পারে আসাদুজ্জামান খান।তিনি একটা ছোট্টো চিরকুট হাতে দিয়ে বলে 

আমাকে তুমি ভুল বুঝছো এটাই স্বাভাবিক। তবুও আমি বলব তোমার দেওয়া কথা তোমাকে রাখতেই হবে। 

একটা বিয়ে কি করে সমাধান হতে পারে,যেখানে আপনি এতবছর চেষ্টা করেও সমাধান পাননি

আদনানের কথায় ক্ষোভ প্রকাশ পায়। কিন্তু তবু নিজের কথায় অচল থেকে তিনি বলেন

বিয়েটাই সব সমাধান নয়। কিন্তু এই মেয়েটাই একমাত্র পারবে তোমাকে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে।

স্যার অন্য কোনো কি উপায় নাই?

অন্য উপায় থাকলে আমার থেকে খুশি কেউ হতো না।আর সব সমস্যা যেমন এই মেয়েকে ঘিরে ঠিক একি ভাবে সব রহস্যের সমাধান তুমি এর থেকেই পাবে।


-কিন্তু.....

কিন্তু না আদনান আর কিছু বলার সুযোগ পেল না তার আগেই আসাদুজ্জামান খানের বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হয়।নার্স দ্রুত কেবিনে প্রবেশ করে আদনানের উদ্দেশ্যে বলে-

এবার আপনি বাইরে যান মিস্টার আদনান।পেশেন্ট এর অবস্থা ভালো না। উনাকে এক্ষনি এমারজেন্সিতে নিতে হবে।

আধঘন্টা পরে ডাক্তার আসাদুজ্জামানের সুস্থতা  ঘোষণা করেন।কিন্তু পেশেন্ট এর সাথে কাউকে দেখা করার অনুমতি দেন না।এদিকে আদনান বুঝতে পারে না এখন তার কি করা উচিত।সে কখনো ভাবতেও পারে নি তার জীবনে এমন মুহূর্ত আসবে।আর তার স্যার যাকে সে এত বিশ্বাস করত সেই বা কি করে এমন করতে পারল?কোনো কিছুই মাথায় আসছে না তার।কারে বিয়ে করবে রিফাকে নাকি মেয়েটিকে?নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে তার।

অশ্রুসিক্ত নয়নে চিরকুটটি খুলে দেখে সেখানে একটি ঠিকানা রয়েছে।আর মেয়েটিত নাম।আদনান বুঝতে পারে এটি সেই মেয়ের ঠিকানা।

আরো কিছু সময় অতিবাহিত করে হসপিটাল থেকে বার হয়ে আসে সে।রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো চলতে থাকে।সে কোন দিকে যাবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু না নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।এমন মনোবল দিতে থাকে সে নিজেকে।

আদনান মনে মনে বলে,,

যদি এই ছিল আমার নিয়তি তাহলে তাই হবে।এই ধরিত্রী যদি না চায় আমার আর রিফার পূর্ণতা তাহলে তাই হবে।মেনে নিলাম নিজের ভাগ্যকে।বরণ করলাম নিজের জীবনের অনাগত দুঃখকে। তবে এই বসুধা জেনে রাখুক,আমি  রিফাহীন মূল্যহীন।তাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীকে আমি ভালোবাসতে পারব না।যে হৃদয় আমার রানির স্থান সেখানে অন্য নারীর আগমনের আগে আমার মৃ*ত্যু হোক।

রওশন এদিকে একটু আয়।

কেন দাদি কে হয়েছে?

তোর জন্য একটা ছেলে প্রস্তাব নিয়ে আসছে?

কিসের প্রস্তাব?

তোকে বিয়ে করতে চায়।

দাদি তুমি আবার শুরু করলে।আমি কতবার বলছি আমি বিয়ে করবো না।তাহলে আবার কেন?আর চিনিনা জানিনা একজন এসে বলবে আমাকে বিয়ে করতে চায় তার তুমি রাজি হয়ে যাবে?

আরে পাগলী।দেখলেই কি বিয়ে হয়ে যায়। একবাব শুধু দেখ ছেলেটাকে।যদি পছন্দ না হলো তো না হলো। আর আমি বলছি তোর পছন্দ হবেই।আর আগে থেকেই তো তুই জানতি একটা ছেলে তোকে পছন্দ করে? কেন আসাদুজ্জামান খান সেদিন যে ফোন করে বলল।

আহা আইছে আমার ফিল্মের হিরোটারে যে দেখলেই আমার পছন্দ হবে।আর সে আমাকে চিনলো কিভাবে।

তোকে নাকি রাস্তায় দেখেছিল আর তাই দেখে তোকে পছন্দ হয়ে যায়।

ওহ আচ্ছা।তো ছেলের সাথে কে কে আসছে?

ছেলে আর তার কিছু বন্ধু আসছে।

মানে?ছেলের বাবা মা কেউ নাই?

আছে তো।কিন্তু তাদের বাসা অনেক দূরে আর তারা নাকি বলছে তার ছেলে যাকে বিয়ে করবে তারা তাকে মেনে নিবে।

-ওহ আচ্ছা।

আচ্ছা কি। ছেলেটার সাথে দেখা করবি চল।

এই বলে দাদি রওশনকে বাইরে নিয়ে আসে।রওশন সামনে তাকাতেই অবাব নয়নে তাকিয়ে থাকে।মানুষ এতটা সুন্দর কি করে হতে পারে? তার ভাগ্য কি সত্যি এত ভালো নাকি সব সপ্ন।নিজেই নিজের হাতে চিমটি কেটে পরিক্ষা করে সে।

এদিকে আদনান নিজেও জানে না সে কি করছে। এই বিয়েটা কি সে সত্যি করবে নাকি করবে না এমনি দ্বিধায় ভুগছে সে। আজকের পর থেকে রিফা তার জীবন থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। কিন্তু এই মেয়েটার সাথেও তো সে অন্যায় করছে।কারো আওয়াজে ধ্যান ভাঙে আদনানের।তার সামনে দাঁড়ানো অষ্টাদশী মেয়েকে দেখে সে বুঝে যায় এই সেই মেয়ে।

এই যে নাতি আমার একমাত্র নাতনি।যার জন্য তুমি প্রস্তাব আনছো।

আদনান রওশনকে উদ্দেশ্য করে বসতে বলে।

দেখুন রওশন, আমি হলাম  সারফারাজ আদনান সিদ্দিকী।আমি আপনাকে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করছি।কারন আপনকে আমার খুব ভালো লেগেছে।

আদনানের কথাগুলো কেমন যেন দায় ছাড়া তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে রওশন। 

বিয়ে বললেই তো আর বিয়ে হয় না। তার আগে পরিচয় দরকার।

পরিচয় তো বিয়ের পরেও হতে পারে।

না।কারন বিয়ে একটা মেয়ের জীবন মরণ।আমি আগে আপনার বিষয়ে খোঁজ নিব তারপর সিদ্ধান্ত নিব বিয়ের বিষয়ে।আপনি এখন নাস্তা করুন?

ঘণ্টা খানেক পরে রওশন কাকে যেন ফোন দেয় -

হ্যালো রফিক চাচা কিছু জানতে পারলে?

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে -

হ্যা মা পেয়েছি।ছেলেটা ভালো ঘরের।কোনো খারাপ অভ্যাস নাই।খুব লক্ষ্যি ছেলে।

আচ্ছা ঠিক আছে চাচা।এই বলে রওশন ফোন রেখে দেয়,,

-কিরে রফিক কি বলল? ছেলেটা কেমন?

-ভালোই বলল।

-তাহলে বিয়ে করতে আপত্তি নাই তো।

-কিন্তু তবু

-কিন্তু কি?

দেখো দাদি উনি হলেন বড়োলোক ঘরের ছেলে।আমার মতো গরিবের মেয়ের সাথে তাকে মানায় না।আমি তাকে বিয়ে করতে পারবো না।

দাদি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদনান রওশনের রুমে আসার জন্য অনুমতি চায়।দাদি তাকে ভিতরে আসতে বললে সে ঘরে প্রবেশ করে। 

দাদি আমি কথা দিচ্ছি আপনার নাতনির কোনো কষ্ট আমি দিব না। তাকে নির্ভর আমার সাথে বিয়ে দিতে পারেন।তাকে খুব সুখী রাখবো কথা দিচ্ছি।

দাদি রাজি হয়ে যায় আদনানের সাথে রওশনের বিয়ের জন্য।

কিছুক্ষন পরে কাজি এসে বিয়ে পরিয়ে যায়।এতটুকু সময়ের মধ্যেই রওশনের বান্ধবিরা তার ঘর ফুল দিয়ে সাজিয়ে তোলে।

রাত আনুমানিক রাত ১১ টা।রওশনকে বসানো হয় বাসর ঘরে। কিছু সময় পর কারো উপস্থিতিতে মুখ তুলে চায় সে।দেখে আদনান তার মুখ পানে তাকিয়ে আছে।সে কিছু বলতে চায়।

আমার থেকে তুমি বয়সে অনেক ছোট তাই তুমি করেই বলছি।তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

হ্যা বলুন,,

তোমাকে আমি কখনো স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না।আমি বিয়েটা করেছি পরিস্থিতির শিকারে।এর আগে আমি তোমাকে কখনো দেখিনি ভালোবাসা তো দূরে থাক।

আদনানের বলা কথায় তীব্র ভাবে বাজ পরে রওশনের উপর।

পরিস্থিতির শিকার মানে? বিয়ে কি কোনো ছেলে খেলা যে ইচ্ছে করলো বিয়ে করলাম আর পরে তাকে ছুরে ফেলে দিলাম।

আমি জানি আমি খুব বড় অন্যায় করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।আমি একজনকে কথা দিয়েছিলাম তাই বিয়েটা করেছি।

আপনার লজ্জা করছে না এই কথা গুলো বলতে।আমার জীবনটা কি অন্যের কথায় চলবে?আপনি কি করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পারলেন।আপনার দিলে কি একটুও দোয়া মায়া নাই।

আদনানের বলার মতো সত্যিই কিছু নাই।কারন সে যানে সে অন্যায় করেছে।

আপনি তো আমার দাদিকেও কথা দিয়েছেন যে আপনি আমাকে ভালো রাখবেন।তাহলে সেই কথার দাম কি আপনি রাখবেন না।

আমি তোমাকে খুব ভালো রাখবো।কোনো কিছুর অভাব দিব না। কিন্তু প্লিজ স্ত্রীর দাবি নিয়ে আমার কাছে এসো না।আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসতে পারবো না।

টাকা পয়সা দিয়ে সব কিছু হয়না।একটা মেয়ের জীবনে তার স্বামিই সব। যদি সেই না থাকে তাহলে টাকারো কোনো মূল্য থাকে না মেয়েদের কাছে।এভাবে আমার জীবনটা না নষ্ট করলেও পারতেন।আমি আপনাকে কখনো মাফ করতে পারব না।

রওশন আর আদনানের সাথে কথা বাড়ায় না।ভাগ্যের প্রতি সমস্ত বিশ্বাস তার উঠে গেছে।কেন এমন নিষ্ঠুরতম কপালের অধিকারী সে?জীবন কি তাহলে তার সাথে নতুন খেলায় মেতেছে।নিজের অজান্তেই চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু গরিয়ে পরতে থাকে

এতক্ষন যা ছিল সব আদনানের অতীত স্মৃতি। যেটাকে সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।তার কারনে আজ দুটো মেয়ের জীবন নষ্ট। সে যেমন কিছুতেই রওশনকে ভালোবাসতে পারবে না ঠিক তেমনি রিফাকে নিজের থেকে দূরে যেতে দিতে পারবে না।

আদনান রিফার ছবিটা বুকের কাছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে

তোকে নিজের নামে বাধার অধিকার যেমন আমার নেই তেমনি তোকে অন্য কারোর হতে দেখার মতো সাহসীও আমি নই।তোকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু ভাগ্য চেয়েছিল তার উল্টো।আমি জানি আমি আজ অপরাধী।

এক সপ্তাহ পরেও সিদ্দিকী ম্যানশনের অবস্থা পুর্বের ন্যায়।এখনো কেউ রওশনকে আপ্ন করে নিতে পারে নি।আর রওশন আসাও করে না আর তেমন একটা। যেখানে আদনানই তাকে নিজে বিয়ে করা স্বত্বেও তাকে মেনে নেয় নি সেখানে তার পরিবার মানবে তা তো বিলাসিতা।ছাদে দাঁড়িয়ে আনমঅনে কথাগুলো ভাবছিল সে...

Post a Comment

0 Comments