রূপকথার শহর! (পর্ব-১৩) | নবনী নীলা

ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-১৩

নিজের মাকে এইখানে ফেলে রেখে কায়ান ইশাকে নিয়ে পালিয়েছে কেনো?”, সহকারী অফিসার অবাক হয়ে বললো।

কারণ কায়ান নিজেকে বাঁচিয়েছে। ও মা এইখানে থাকলে তার কোনো ক্ষতি হবে না সেটা সে ভালো করেই জানে। তাই সে ইশাকে বন্ধি করে নিজেকে বাঁচিয়েছে।”, আরহান নিজের পিস্তলে গুলি ভরতে ভরতে বলল।

আপনি ওর মা বলছেন কেনো? উনি তো আপনার ও মা।”, সহকারী অফিসারের কথায় আরহান ফাহিমা খাতুনের দিকে তাকালেন। যিনি নির্লিপ্ত ভাবে বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছে।



আরহান জানে না তার কেমন অনুভব করা উচিত। যাদের সে এতদিন নিজের বাবা মা বলে জানতো আজ জানলো তারা তার আসল বাবা মা নয়? আরহান এইসব অনুভূতি নিয়ে ভাবতে চায় না। তার এখন একটাই লক্ষ্য ইশাকে উদ্ধার করা

এইসব বাদ দিন। আপনি এইখানকার খেয়াল রাখুন। এইসব আপনার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম।” বলেই নিজের টিম নিয়ে আরহান বেরিয়ে গেছে।

ইশা কোথায় আছে?  আরহান তার কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে। ইশার কাপড়ে আরহানের আদেশ মতন নাসরিন ট্র্যাকিং চিপ বসিয়েছিল। কিন্তু সেই চিপ টি ইশার সাথে নেই। তবে আশেপাশের যেকোনো লোকেশনে চিপটি ইশার থেকে আলাদা হয়েছে বলে আরহানের ধারণা।

ট্র্যাকিং চিপের লোকেশনে তারা পৌঁছে গেছে। কিন্তু ইশা কোথায় তার খোঁজ মেলেনি। আরহানের টিমে রয়েছে সাহসী অফিসার রাহি।

তারা সবাই মিলে চেষ্টা চালাচ্ছে।

অন্যদিকে,

ইশা বন্দি রুমে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তাকে যেই ড্রাগ দেওয়া হয়েছে তার রেশ এখনো কাটেনি। তাকে পাহারা দিচ্ছে কায়ানের লোকেরা।

কায়ানের স্পষ্ট আদেশ ঠিক বারো ঘণ্টা পর ইশার শরীরে যেনো আরেকটি ইনজেকশন পুশ করা হয়। বারো ঘণ্টা হতে আর কিছুক্ষণ সময় বাকি, রাত অনেক গভীর হয়েছে।

ইশাকে পেন্টহাউস থেকে সরিয়ে অন্য একটা জায়গায় আনা হয়েছে, সবই কায়ানের প্ল্যান। সে জানে ইশার জন্য আরহান এইখানে আসবেই, তাই কায়ান ইচ্ছে করে ট্র্যাকিং চিপটা এই বাড়ির আশেপাশে ফেলে রেখেছে। 

কায়ান বাড়িতে পৌঁছালো কিছুক্ষণ আগে। এতক্ষণে আরহানের চলে আসার কথা।

ইশার ইনজেকশন পুশ করার সময় হয়েছে। কায়ান চায় না অতিরিক্ত মাথা ব্যথা নিতে, তাই এই ব্যবস্থা। এখন শুধু দেখার পালা আরহান এই প্রানটাকে বাঁচাতে কি কি করে। 

পাশে থেকে একজন বলল, “ স্যার সময় হয়েগেছে।”

কায়ান মাথা নাড়লো। ইনজেকশনটা সে নিজের হাতে নিয়ে ইশার অচেতন শরীরের পাশে বসে বললো, “ আফসোস। তোমায় বাঁচাতে তোমার হিরো এখনো আসেনি।” 

কায়ান ইনজেকশন পুশ করতে যাবে এমন সময় বাইরে বিরাট বিস্ফোরণ হলো। জানালা দিয়ে আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। কায়ান দ্রুত উঠে দাড়ালো। ইনজেকশনটা পাহারাদারের হাতে দিয়ে সে বাইরে গেলো। পাহারাদার ঘড়ি দেখে নিলো সময় হয়েছে।

তারপর ইশার দিকে এগিয়ে যাবে সেই মুহূর্তে, জানালার কাচ ভেঙে পড়ল! সে এক বিটক শব্দ। সঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়লো অফিসার রাহি!

"হাত তুলে দাঁড়া।" রাহির কঠিন গলা।

পাহারাদার হতভম্ব হয়ে গেলো। তার হাতে থাকা ইনজেকশনটা মেঝেতে পড়ে ছিটকে গেলো।

রাহি এগিয়ে এসে সাথে সামনে থাকা লোকটার পায়ে গু’লি করলো। কাউকে কোনো সুযোগ দিবে না সে। লোকটা মেঝেতে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো। 

রাহি আর সময় নষ্ট করলো না। ইশা ডেকে তুলতে চেষ্টা করলো কিন্তু সে অচেতন , রাহি দ্রুত ইশার নাড়ি পরীক্ষা করলো। নিচে পড়ে থাকা ইনজেকশনটি হাতে তুলে দেখলো। তার আর  কিছু বুঝতে বাকি নেই।

রাহি তৎক্ষণাৎ কানে হ্যান্ডসেট লাগিয়ে বললো,

“স্যার, টার্গেট সিকিওরড! দ্রুত সাপোর্ট প্রয়োজন!”

আরহানের কণ্ঠ ভেসে এলো, “ ওয়েল ডান, জানালার পাশে যেই অফিসার আছে তার কাছে ইশাকে তুলে দেও।”

রাহি জানে, আর এক মুহূর্ত দেরি করলেই বিপদ। ইশা অজ্ঞান, তবে শ্বাস চলছে। তাই তাকে দ্রুত নিরাপদে নিতে হবে।

বাইরে ভীষণ গোলাগুলির শব্দ। আর ভিতর থেকে কারো একজনের গর্জন শোনা যাচ্ছে। রাহি ইশাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে আবার ভিতরে এলো।

তারপর আস্তে আস্তে খুব সাবধানে বাড়ির ভিতরে যেতে থাকলো। কায়ান এখনো বাইরে যায় নি। তার লোকেরা শুধু বাইরে আছে। 

রাহি খুব সাবধানে করিডোর ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই এক কোণ থেকে কায়ানের এক লোক বেরিয়ে এলো।

"এই! কে?"

রাহি আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করেনি। নিখুঁতভাবে তাক করে গু’লি করলো লোকটার দিকে,সে ছিটকে পড়ে গেল।

দৌড়ে এগিয়ে গেল রাহি। ঠিক তখনই সামনে দেখতে পেল এক ছায়ামূর্তি—অন্ধকারে দাঁড়ানো, হাতে বন্দুক।

রাহি একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। আরহান! কিন্তু না পরক্ষনেই হাতের ট্যাটু দেখে বুঝে ফেললো এ আরহান না।

ইশাকে উদ্ধার করেই এম্বুলেন্সে আনা হলো। আরহান কায়ানের লোকেদের দৃষ্টি নিজের দিকে নিতেই সংঘর্ষের একদম সামনে ছিলো সে। যেনো পিছন থেকে রাহি ইশাকে উদ্ধার করতে পারে।

ইশাকে উদ্ধারের খবর পেয়ে আরহান সাথে সাথে এম্বুলেন্সে ছুটে গেলো। ইশার অচেতন দেহ দেখে সে নির্বাক হয়ে গেলো। আরহান খেয়াল করলো তার হার্টবিট বেড়ে গেছে।

সে ধীরে ধীরে ইশার পাশে এসে বসেলো।  হাত বাড়িয়ে ইশার গলার পাশে হাত রাখতেই তার হাত যেনো একটু কেঁপে উঠলো। আরহান পালস দেখলো...একটা হালকা স্পন্দন…।কোনো কিছু না ভেবে আরহান ঝুকে এসে ইশার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ইশার গালে হাত রাখে বলল, “ I'm sorry, আমি বলেছিলাম তোমার ছায়া পর্যন্ত কাউকে পৌঁছাতে দিবো না। কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি। এমনটা আর কখন হবে না। যে তোমার এই অবস্থা করে ওকে আমি ছাড়বো না।” রুদ্ধশ্বাস নিয়ে বললো আরহান।


আরহান নিজের অনুভূতি গুছিয়ে নিয়ে এম্বুলেন্স থেকে বের হয়ে দ্রুত ইশাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল। আরহান ইশার সাথেই ছিল। ইশার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে সম্পুর্ন সময়টা কায়ান ঠাণ্ডা চোখে রাহির দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে বন্দুক ছিল। কায়ানের লোকেরা সাথে সাথে এগিয়ে যেতেই কায়ান হাতের ইশারায় ওদের পিছনে যেতে বলল।

কায়ান অবাক চোখে মেয়েটিকে দেখছে, মেয়েটির চোখে মুখে কোনো ভয় নেই। কি সাহসের সাথে তার দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে।

“ সাহস দেখানো ভালো কিন্তু এতো সাহস দেখিয়ো না যা তোমাকেই ডুবিয়ে দিবে।”

রাহি ভয় পেলো না মোটেও। দৃষ্টি তীক্ষ্ম করে বললো, “ তোমার উদ্দেশ্য কি?”

“ আমার উদ্দেশ্য আমার পথে যারা বাধা হবে প্রত্যেককে সরিয়ে ফেলা।”, বলেই কায়ান একদম রাহির বন্দুকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

দুজনের চোখে চোখ পড়ল। রাহি বন্দুক একদম কায়ানের কপালে রেখে বলল, “ তোমার শেষ একদিন না একদিন হবেই। এটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।”

কায়ান হাসলো। তারপর হাত বাড়িয়ে বন্দুকটা ধরতেই রাহি কঠিন গলায় বলল, “ একদম চালাকি করবে না। আমি কিন্তু গু’লি করবো।”

কায়ান ঠাণ্ডা হাসল, এক ঝটকায় বন্দুকের নল উপরের দিকে ঘুরিয়ে ট্রিগার টিপে একে একে সব গুলি ফাঁকা করে দিলো। তারপর বলল, “দেখলে? শুধু সাহসে কাজ চলে না, বুদ্ধিও লাগে।”

তারপর পিছন থেকে রাহির দুই হাত চেপে ধরে আটকে ফেললো। রাহি ছটফট করতে থাকলো কিন্তু লাভ হলো না। কায়ান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললো, “ কি নাম তোমার?” বলেই রাহির চোখের দিকে তাকালো।

রাহি রক্ত চোখে তাঁকালো। দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “ এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।”

কায়ান কোনো উত্তর দিলো না রাহির ইউনিফর্মের দিকে তাকিয়েই তার নামকার্ড দেখে বলল, “ রাহি, রাইট?”

তারপর নিজের লোকেদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ বাইরে জানিয়ে দেও। আমার মাকে আমার কাছে ফেরত দিতে হবে এবং তাকে নিয়ে আসবে অফিসার আরহান নিজে যতক্ষণ না আনছে অফিসার রাহি আমার জিম্মি থাকবে।

হাসপাতালের করিডোরে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে আরহান। তার এক হাতে ইশার রিপোর্ট, অন্য হাতে মোবাইল—বারবার চেক করছে কিছু এসেছে কিনা। হাসপাতালের নিঃশব্দ পরিবেশেও যেন বুকের ভেতর একপ্রকার যুদ্ধ চলছে তার।

কেবিনের ভেতরে ইশার চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার বলেছেন—“কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে।”

সব রিপোর্ট চেক করে আরহান ইশার কেবিনে ঢুকলো। চুপ করে চেয়ার টেনে ইশার পাশে বসে পড়ল।

আরহান জানে না ইশার মামা আমিনুল সাহেবকে সে কী উত্তর দেবে। আমিনুল সাহেব তাকে বিশ্বাস করে ইশার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ইশার বাবা-মা কিছুই জানেন না। তারা এখনো ভাবছেন, ইশা তার মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। আমিনুল সাহেব এমনটাই বলেছেন এই কয়দিন।

আরহান চুপচাপ ইশার মলিন চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। জ্ঞান ফিরছে না কেন মেয়েটার?

আরহান ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ইশার হাত ধরল।

তারপর ইশাকে ডাকতে গিয়ে সে হঠাৎ থেমে গেল,এই প্রথম সে ইশাকে নাম ধরে ডাকলো।

আরহান আবার ডাকল, “ইশা…”

ইশার হাত-পা আস্তে আস্তে নড়ল।

আরহান সময় নিয়ে খুব ধীরে ধীরে ইশাকে ডেকে তুলল। প্রথমবার চোখ খুলতে গিয়ে আলোর ঝলকানিতে ইশা চোখ বন্ধ করে ফেললো।

তারপর সময় নিয়ে সে চোখ মেললো। আশেপাশের পরিবেশ ঝাপসা লাগছে তার কাছে। কার যেনো হাত তার হাতে। 

“ইশা...”

আরেকবার নামটা কানে আসতেই চোখ স্থির করে পাশে তাকালো। তারপর কয়েকবার পলক ফেলে বলল, “ আপনি?”

ইশা উঠে বসতে চাইলো কিন্তু তার শরীর এখনো দুর্বল। আরহান চেয়ার থেকে উঠে ইশার পাশে বসে তাকে ধরে বসালো। ইশা আরহানের হাত ধরে উঠে বসতে বসতে মলিন কন্ঠে বলল, “ আপনি ঠিক আছেন ?”

আরহান ভ্রু কুঁচকে ইশার দিকে তাকালো। এই অবস্থায় নিজের কথা না ভাবে সে কিনা তার কি হয়েছে জানতে চাইছে।


তোমার এখন কেমন লাগছে?” আরহান সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করলো।

বুঝতে পারছি না। মাথাটা একটু ঝিম ঝিম করছে,কেমন যেনো নেশা নেশা লাগছে।”

আরহান অবাক হয়ে ইশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সাবলীল আচরণ! অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো কান্না করতো কিংবা ভয়ে কাপতে থাকতো। কিন্তু এই মেয়েটির দিকে দেখো সে বলছে তার নেশা নেশা লাগছে।

আমার কি হয়েছিলো?”, ইশা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো।


আর তখনই আরহানের ফোনটা বেজে উঠলো। আরহান পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে রুদ্র বলল, “ স্যার। অফিসার রাহি এখন কায়ানের জিম্মায় রয়েছে।”

আরহান একটা নিশ্বাস ফেললো। কোনো কিছুতেই এখন আর তার অবাক লাগে না। মনে হচ্ছে কায়ান সহজে তার পিছু ছাড়বে না।

ওপাশ থেকে রুদ্র আরো বলল, “ স্যার কায়ান ওর মাকে ফেরত চাইছে।”

আরহান দাড়িয়ে পড়লো তারপর বলল,“ ঠিক আছে, তাহলে তাই করো।”


কিন্তু স্যার, কায়ান চায় আপনি যেনো নিজে তাকে নিয়ে সেখান যান। কায়ান এখনো সেই বাড়িতে অবস্থান করছে আমরা হামলা করতে পারছি না কারন ভিতরে অফিসার রাহিকে আটকে রাখা হয়েছে। ”, ফোনটা কানে রেখেই আরহান একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরে হঠাৎ আগুনের মতন কেমন এক চাপা রাগ জমে উঠলো।


আমি কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আসছি।” বলে আরহান কানের থেকে ফোন নামালো। 

আরহান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইশা শক্ত করে তার হাত ধরে ফেললো।


কোথায় যাচ্ছেন আপনি ?”

তোমার জানতে হবে না। তুমি রেস্ট নেও।”, আরহানের কন্ঠ আবার কঠিন হয়ে গেলো।

ইশা হাত ছাড়লো না,“ না আমাকে বলুন। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”


“ ইশা, আমার হাত ছাড়ো। আমি কোথায় যাচ্ছি তার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবো না।”

ইশা অভিমানী চোখে আরহানের দিকে এক পলক তাকালো তার কিছুক্ষণ পরেই সে হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। আরহান এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো।

ইশার নিজের উপর ভীষন রাগ হলো। কি অধিকারে সে হাত ধরেছিলো? কি হয়েছে তার? আরহানের জন্য তার মন কেনো এতো অস্থির অস্থির করছে। এই লোকটাকে নিয়ে তো তার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই , তাহলে কেনো?

আরহান তো শুধু নিজের দায়িত্ব পালন করছে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

রাহির দুই হাত চেয়ারের পিছনে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মুখে রাগ আর ঘৃণার ছাপ স্পষ্ট। ঠোঁট কামড়ে সে নিজের ক্ষোভ চেপে রাখছে।

তার ঠিক সামনে, চামড়ার কালো সোফায় পা তুলে রিল্যাক্স হয়ে বসে আছে কায়ান। হাতে এক কাপ কফি, চোখে ঠান্ডা কিন্তু বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টি। যেন এই পরিস্থিতিটা সে উপভোগ করছে।

কি ব্যাপার!আমাকে এত পছন্দ হয়েছে যে চোখ ফিরাতে পারছো না?," কায়ান হালকা হেসে বলল। 

রাহি রাগে কটমট করতে করতে বলল, “ হ্যাঁ একদম। এতো পছন্দ হয়েছে যে ইচ্ছে করছে মে’রে উপরে পাঠিয়ে দেই।”

কায়ান উচ্চস্বরে হেসে বলল, “ এতো সাহস দেখানো কিন্তু ঠিক না। কাকে হুমকি দিচ্ছ আগে সেটা ভালো করে দেখে নেও।”

আর যাই হোক তোমার মতন ভীতু নই আমি।”, রাহির এই জবাবে কায়ান ভ্রু তুলে তাকালো। “কি বললে তুমি? আমি ভীতু?” 

সাহস থাকলে কাপুরুষের মতন আমাকে এইভাবে বেঁধে রাখতে না। তোমার এতজন লোক থাকতে একটা মেয়েকে বেঁধে রাখতে হচ্ছে?”, রাহি তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল।

কায়ান তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো তারপর বলল, “ তোমার কি মনে হয়, তোমাকে এমনি এমনি বেঁধে রেখেছি? এটা তোমার শাস্তি। তোমার কারণে আমার করা সম্পুর্ন প্ল্যানটা নষ্ট হয়েছে। তুমি ইশাকে আরহানের কাছে পৌঁছে দিয়েছো শুধু তাই নয় আমার দুইজন লোককে গু’লি পর্যন্ত করেছো। তুমি কি ভেবেছো তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিবো?”

রাহি মুখ ভেংচি মারতেই কায়ান অগ্নি চোখে তাকালো। এমন মেয়ে সে তার জীবনে কোনোদিন দেখিনি। না আছে ভয় না আছে মুখে লাগাম। কায়ান কফি হাতে উঠে দাড়ালো। 

 ছেড়ে তো দিতেই হবে। কয়দিন আটকে রাখবে আমায়?” 

“ যতদিন আমার ইচ্ছে ততদিন, চাইলে সারাজীবন আটকে রাখবো। বাকিটা জীবন কাটাবে তুমি আমার বন্দি হয়ে।”, রাহির সামনে দাড়িয়ে বলল কায়ান। রাহি দাঁতে দাঁতে চিপে কায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।

কায়ান রাহির সামনে বসতে বসতে বললো, “তোমাকে আটকে রেখে যে আমার খুব লাভ হবে ব্যাপারটা এমনও না। আরহান আমার মাকে ফেরত নিয়ে আসলেই তুমি ছাড়া পাবে।”

রাহির প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। হাত দুটো খোলা থাকেল এক্ষুনি ঘুষি মেরে এই বেয়াদপের নাকটা ফাটিয়ে দিতো।

“ এইভাবে তাকিয়ে থাকলে কিন্তু প্রেমে পড়ে যাবে।”, কায়ান একটু ঝুঁকে এসে বললো।

“ আমার বয়েই গেছে তোমার প্রেমে পড়তে।”, গর্জে বললো রাহি।

“ কত মেয়ে আমার জন্যে পাগল তোমার কোন ধারণা আছে? তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করতো।”, 

“ কারণ ওরা মানসিক রোগী আমি না।”, রাহি নির্ভীক কন্ঠে বলল।

তারা দুইজনেই দুইজনের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কায়ান  উঠে যেতে যেতে বলল, “ তুমি একাই বসে বসে দাঁত চিপতে থাকো।সুন্দরী মেয়েরা বেশি কথা বললে, আমি আবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।”

কায়ান লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রাহি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রাগ কমিয়ে আনার চেষ্টা করলো। একবার হাতের বাঁধন খুলতে পারলে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিবে এই বদমাইসটাকে।

আরহান ফাহিমা খাতুনকে নিয়ে কথামত সেই জায়গায় অপেক্ষা করছে। 

আরহানের খুব আগ্রহ জানার যে কি কারণে আজ তিনি এমন মানসিক রোগী।

আরহান অপলকে নিজের গর্ভধারিণীর দিকে তাকিয়ে আছে। 

ফাহিমা খাতুন গাড়ির ভিতরে চুপ করে বসে আছেন। প্রথম কয়দিন তিনি খুব কথা বললেও কায়ানকে দেখার পর থেকে তিনি কেমন যেনো হয়ে আছেন।

কায়ান খবর পেয়ে রাহিকে যেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে আগে সেখানে পৌঁছালো। রাহিকে টেনে দাঁড় করিয়ে তার হাতের বাঁধন খুলে দিতে দিতে বলল, “ বাহ্ তোমাকে নিতে আরহান এতো তাড়াতাড়ি এসে পড়বে ভাবিনি।”

রাহি ছিটকে কায়ানের থেকে দূরে সরে এসে নিজের হাতের বাকি বাঁধন খুলতে খুলতে বললো, “ এটাই শেষ নয়। তোমাকে এই কাজের শাস্তি পেতে হবে মনে রেখো?”

এক্সকিউ মী। কিসের শাস্তি?”, কায়ান ভ্রু তুলে বললো।

সেটা তুমি খুব তাড়াতাড়ি টের পাবে।”,রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো রাহি।

কায়ান ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। 

বাইরে থেকে একজন এসে বলল , “ বস। অফিসার আরহান আপনার মাকে নিয়ে এসেছে।”

কায়ান রাহির দিকে দৃষ্টি ঠিক থেকে বলল, “ ভিতরে আসতে দেও।

বলেই সে রাহির দিকে এগিয়ে এলো। রাহি বিস্মিত চোখে তাকালো। রাহি একদম দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে যেতেই কায়ান তার চোখে চোখ রেখে বলল,“ সাহস দেখানোর আগে দশবার ভাববে, রাহি। তুমি একজন মেয়ে সাহস থাকলো শক্তিতে আমার সাথে পারবে না। তোমার এই অহংকার আর সাহস চূর্ণ করা আমার কাছে এক সেকেন্ডের ব্যাপার। তাই আমাকে বাধ্য করো না….” 

বাকিটা বলার আগেই, ঠাস! রাহি সজোড়ে কায়ানের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রাহির চোখে মুখে যেনো আগুনের ফুলঝুরি। 

কায়ান থমকে গেল। রাহির থাপ্পড়টা শুধু কায়ানের গালে নয়, তার অহংকারে, তার নির্ভীক আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানলো।

কায়ান ধীরে ধীরে তার গাল ছুঁয়ে দেখলো, চোখে অবিশ্বাসের ছাপ। তারপর সে হেসে উঠলো একটা ঠাণ্ডা, শীতল, বিষাক্ত হাসি। কায়ান শক্ত হাতে রাহির কব্জি ধরে পিছনে নিয়ে বললো,“ খুব সাহস তোমার তাই না? কিন্তু তুমি ভুল জায়গায় ভুল মানুষের সামনে সাহস দেখিয়েছো,” কায়ান নিচু স্বরে বলল, “এই কাজের চরম মূল্য দিতে হবে তোমায়।”

রাহি চোখ না নামিয়ে বলল,“ আমি মেয়ে, এই কারণ দেখিয়ে আমাকে দূর্বল ভাবার চেষ্টা একদম করবে না। ভয় পেয়ে আমি এই ইউনিফর্ম পড়িনি।”

কায়ানের চোখে যেন ক্ষণিকের জন্য কিছু একটার ঝলক এলো রাগ নাকি অন্যকিছু ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেটা চাপা পড়ে গেল তার ঠাণ্ডা দৃষ্টির নিচে।

এর মাঝেই বাইরে দাঁড়ানো লোকটি আবার দরজা খুলে বলল, “ বস।”

কায়ান এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিলো। যেন রাগকে ভিতরে গিলে নিচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে রাহির হাত ছেড়ে দিয়ে সে পেছন ফিরে দাঁড়ালো। তার কণ্ঠ এবার অস্বাভাবিকভাবে শান্ত, কিন্তু সেই শান্ততার নিচে চাপা পড়ে থাকা ঝড়টা অনুভব করা যায়।

রাহির সামনে সে আর কিছু না বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে সে সোজা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের দিকে তাকাল, আরহান।

দুই যমজ ভাই মুখোমুখি। একই মুখ, কিন্তু একটির চোখে জ্বলন্ত আলো, আরেকটির চোখে  বিষাদ অন্ধকার।

আরহান মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে থেমে থাকা বিস্ময়, কারণ মায়ের মুখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে কায়ানের দিকে। কায়ান চোখের ইশারায় ফাহিমা খাতুনের বিশ্বস্ত একজনকে ডাকলো। ডাক্তার আঞ্জুমান, তিনি কাছে যেতেই ফাহিমা খাতুন এক পলক আরহানের দিকে তাকালো। কিন্তু ফাহিমা খাতুনকে ডাক্তার আঞ্জুমান কৌশলে নিয়ে যেতে চাইলো।।

ডাক্তার আঞ্জুমান ভিতরে যাওয়া আগে আরহান বলে,” দাড়াও, আগে অফিসার রাহি আসবে তারপর।”

কায়ান ঠোঁট প্রসারিত করে ঈশারা দিতেই তার লোকেরা ভিতর থেকে দুই বাহু ধরে রাহিকে নিয়ে আসলো। তারপর কায়ানের ঈশারায় রাহিকে ছেড়ে দিতেই সে শক্ত করে রাহির হাত ধরে বলল, “এখন তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি—এর মানে এই নয় যে তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তাই প্রস্তুত থেকো, আবার দেখা হবে।”

রাহির চোখে এখনো আগুনের ঝলকানি, সে কোনো কিছু না বলে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো।

আরহান এই দৃশ্যটা লক্ষ্য করল। দুজনের চোখে চোখে যে অসমাপ্ত যুদ্ধ, তার আঁচ পেল। সে এগিয়ে এসে কায়ানের সামনে এসে দাঁড়াল।

তারপর রাহিকে গাড়িতে গিয়ে বসতে বলল।

অবশেষে দুই ভাই মুখোমুখি। তবে আরহানের কিছু যায় আসে না। তার নিজের ভাই একটা মাফিয়া ভাবতেই তার রাগ হচ্ছে। অস্বিকার করার উপায় নেই কারণ প্রমাণ স্পষ্ট।

রাহি নীরবে সেখান থেকে চলে আসে কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে কি কথা হয়েছে সেটা তার অজানা। রাহির ভয় হচ্ছে, কোনো অঘটন ঘটবে না তো?

গাড়ির দরজার শব্দে চমকে উঠলো রাহি।

আরহান ফিরে এসেছে। তার মুখ কঠিন, চোখে প্রচণ্ড রাগের ঝিলিক। একটা গুমোট স্তব্ধতা নিয়ে সে গাড়িতে উঠে বসল। ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথেই গাড়িটা নরম গুঞ্জনে কেঁপে উঠলো।


রাহি ধীরে ধীরে পাশে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর একটু সাহস করে জিজ্ঞেস করলো,

“স্যার... কায়ান কি চায়? কিছু বলেছে?”

আরহান ঠান্ডা গলায় বলল, কিন্তু রাগটা যেনো গলার প্রতিটা শব্দে ফুটে উঠছিলো—

“ বাস্টার্ডটা অন্য কারো হয়ে খেলছে। চায়, টাওয়ার ধসের তদন্ত না হোক। এই মামলাটা যেনো চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।”

রাহি চোখ বড় বড় করে বলল,“মানে? কেসটা বন্ধ করে দিতে বলেছে?”

“না, সরাসরি বলেনি। চেয়েছে, আমাদের কাছে যে প্রমাণগুলো আছে, সেগুলো ওর হাতে তুলে দিতে।”

রাহি ধীরে ধীরে বলল,“আর যদি না দেই?”

আরহানের চোখে আগুন। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে,“তাহলে আমাদের সবাইকে টার্গেট করবে। এমনকি ইশাকেও ছাড়বে না বলে হুমকি দিয়েছে। রাস্কেলটা ভেবেছে আমি ভয় পেয়ে যাবো? ১১৯ জন মানুষ—কর্মচারী, শ্রমিক—তাদের মৃত্যুকে ধামাচাপা দিতে চায়! শুধু একটা টাওয়ারের ধস না, এটা একেকটা জীবনের ধ্বংস। আমি ওকে ছাড়বো না।

রাহির গলা শুকিয়ে আসে সে বলল,“এর পেছনে নিশ্চয়ই বড় কেউ আছে।”

আরহান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

“অবশ্যই আছে। অনেক আগে থেকেই এই তদন্তে বাধা পেয়ে আসছি। কখনো কাগজ হারিয়ে যায়, কখনো সাক্ষীরা উধাও হয়ে যায়। এখন বুঝতে পারছি, কেউ অনেক ওপরে বসে এইসব চালাচ্ছে। কিন্তু এবার আমি থামবো না। আমি এই নোংরা খেলার শেষ দেখে ছাড়বো।”

একটু থেমে, রাহি নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“কিন্তু আপনি... আপনার মাকে কেন ফেরত দিলেন? উনি তো আপনারও মা।”

আরহান চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্তে সব আবেগ গিলে ফেলল। তারপর গলা নিচু করে বলল,

“আমি চাই না আমার কারণে আর কারো ক্ষতি হোক। আমি আর কাউকে বিপদে ফেলতে চাই না। এমনিতেই ইশা আমার জন্য—”

কথা শেষ না করে থেমে গেল সে। গলার কাছে কিছু আটকে আছে যেন। তারপর ভাঙা কণ্ঠে বলল,“ইশা আমার কারণে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। আমি না থাকলে, কায়ান ওকে কিডন্যাপ করতো না। না  আজ ওকে এইভাবে অচেতন অবস্থায় দেখতে হতো। ওর প্রাণ ঝুঁকিতে পড়েছে... শুধুই আমার জন্য।”

রাহি আর কিছু বললো না। চুপচাপ বসে রইলো আরহানের পাশে।

তার চোখ পড়লো জানালার বাইরে—গাড়ি যেনো পুলিশ স্টেশনের দিকে না গিয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছে। একটু পরেই সে বুঝতে পারলো, গাড়িটা যাচ্ছে হাসপাতালে।


কিন্তু কেন?

প্রশ্নটা গলার কাছে এলেও সে কিছু বললো না। শুধু অপেক্ষা করতে লাগলো।

হাসপাতালে পৌঁছে নিজের প্রশ্নের জবাবটা সে নিজেই খুঁজে পেল।

আরহান তখনই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল, রাহি কিছু না বলেই পেছন পেছন অনুসরণ করলো।

একটা নির্দিষ্ট কেবিনের সামনে এসে থেমে গেল আরহান। কাচের গ্লাসে চোখ আটকে গেল তার।

ভেতরে ইশা—চুপচাপ বসে আছে, পাশে তার বাবা-মা।

ইশার মুখটা রাগে ফোলা, মা-বাবা তাকে ফল খাওয়াতে চাইছে আর সে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে, একেবারে বাচ্চা মেয়ের মতো।

রাহি ধীরে ধীরে আরহানের পাশে এসে দাঁড়ালো।

আরহান যেনো সময়ের ফ্রেমে আটকে আছে—চোখ তার কেবিনে, মুখে একরাশ দায়িত্ব আর অপরাধবোধ 

রাহি নিচু স্বরে বললো,“ এর পর আমাদের প্ল্যান কি?”

সেটা তোমাকে পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। এখন থেকে ইশার দায়িত্ব তোমার, তুমি চব্বিশ ঘণ্টা ইশার সাথে থাকবে। ওকে নিজের চোখে চোখে রাখবে। আর প্রতিনিয়ত আমাকে খবর পৌঁছাবে। আমার অনুমতি ছাড়া ইশা কোথাও যাবে না।

ইশা চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বলল,“কি? আমাকে পাহারা দিতে তোমাকে পাঠিয়েছে?”


রাহি হালকা হেসে মাথা নাড়লো। যেন আগে থেকেই এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।

সে শান্ত স্বরে বলল,“বাবা-মা, ভাই সবাইকে আমি বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন শুধু আমি এখানে আছি।”

ইশার চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠলো।

আরহান নিজে আসার প্রয়োজন বোধ করেনি, অথচ এই অফিসারকে পাঠিয়ে দিয়েছে পাহারা দিতে! একবার এসে দেখে যাওয়াটাই কি যথেষ্ট মনে হলো তার কাছে?


রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইশা নিজেকে কোনোমতে সংযত রাখলো। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,“আর যে পাঠিয়েছে, সে এখন কোথায়?”


রাহি হালকা হাসি মুখে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,“আরহান স্যার? তিনি এখন একটু ব্যস্ত আছেন…”

“কার সঙ্গে ব্যস্ত?...”বলেই থমকে গেলো ইশা। নিজেই বুঝতে পারলো, প্রশ্নটা ঠিক ঠিকভাবে বলা হয়নি।

একটা ছোট কাশি দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর দ্রুত সুর পাল্টে বলল,“না মানে, উনি… কিসে ব্যস্ত আছেন?”

রাহি হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, চোখে একরাশ ক্লান্তি।“আমি কীভাবে জানবো, ইশা?”

শান্ত গলায় বলল সে,“উনি আমার অনেক সিনিয়র। উনি কী করছেন, কাদের সঙ্গে আছেন, সেটা আমাকে বলবেন না।”

ইশা দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপ বসে রইলো।

রাত এখন অনেক—এই সময়েও কী এমন ব্যস্ততা? আরহান প্রায়ই রাতের বেলায় বাইরে থাকে। মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা প্রশ্ন ঘুরে উঠলো,

“তার কোনো প্রেমিকা নেই তো?”

নিজেকেই প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু যেন মনের ভেতর থেকে আরেকটা সত্তা গর্জে উঠলো—

“না থাকার কী আছে? এই বয়সে প্রেমিকা থাকবে না তো কী থাকবে? কী মনে আছে? নাকি মনে নেই, কীভাবে তোর হাত সরিয়ে নিতে বলেছিলো? নিশ্চয়ই আরহান নিজের গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে রাত কাটিয়ে বেড়াচ্ছে। আর তুই এখানে বসে কী আশা করে বসে আছিস? সে তোকে দেখতে আসবে?”

নিজে নিজেই এসব চিন্তা করে ইশার মাথায় যেন আরও রক্ত উঠে গেলো। তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো পাশে বসে থাকা রাহির দিকে। রাহির পরনে অফিসার ইউনিফর্ম—গম্ভীর, আত্মবিশ্বাসী, আর  তাকে লাগছে যেন অসম্ভব স্মার্ট ও রূপবতী।

ইশা নিজের দিকে তাকালো। হাসপাতালের রোগীর পোশাক গায়ে তার চেহারাটা যেন আরও বিবর্ণ লাগছে। মনে হলো—ডায়রিয়ার রোগী ছাড়া আর কিছুই নয়! হাত তুলে চুলে আঙুল চালাতেই বুঝতে পারলো—চেহারা তো দূরের কথা, চুলটাও এলোমেলো।

 ইশা কেবিনের বেড থেকে নেমে ভেতর পায়চারি শুরু করলো—অস্থির, উত্তেজিত পায়ে।

রাহি একবার ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। তবে কিছু না বলেই পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলো নিজের মোবাইলের স্ক্রিনে—ব্যস্ত হয়ে পড়লো অন্য কিছুতে।

ইশা জানে ব্যাপারটা ঠিক না কিন্তু তার আরহানকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। অথচ আরহান তাকে একবার দেখতেও এলো না। ইশার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ইশা চুপ চাপ নিজের বেডে কিছুক্ষণ বসে থেকে মন খারাপ করে শুয়ে পড়লো। 

গভীর রাত - ৩টা

রাহির চোখে ক্লান্তি নেমে এসেছে কিন্তু হঠাৎ তার ফোন কেঁপে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। রাহি কলটা রিসিভ করে বললো, “ স্যার!”

আরহান ইজি চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, “ ওখানে সব কিছু ঠিক আছে? সন্দেহ জনক কিছু দেখেছো কি?”

“ না। সন্দেহজনক কিছু পাই নি। রুমের বাইরেও দুইজন সিকিউরিটি রয়েছে।”, রাহি নিচু স্বরে বললো।

“ হুম” আরহান একটু থেমে বললো, “ ইশা এখন কেমন আছে?”

জ্বি স্যার ভালো। একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে আর কালকেই হয়তো ডিসচার্জ করে দিবে।”, 

আরহান মাথা নেড়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো, তারপর ফোনটা কেটে দিলো। ইজি চেয়ারে গা হেলিয়ে দিলো সে। চারপাশে নীরবতা, অথচ ভিতরে এক অদৃশ্য ঝড়।

নিয়তি যেন এক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে তার সঙ্গে। যাদের সবচেয়ে আপন ভেবেছিলো, যাদের জন্য জীবন দিতে পিছপা হতো না—আজ তাদের সঙ্গে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। আর যাকে শত্রু জেনে তার প্রাণ নিতে একটুও দ্বিধা করতো না, সে-ই নাকি তার আপন ভাই!

আর তার গর্ভধারিণী মা? যিনি তাকে জন্ম দিয়েছিলেন, আজ তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। আর বাবা? তার মৃত্যুর রিপোর্ট এখন আরহানের হাতেই। তাতে লেখা, “সন্ত্রাসীদের ছুরি আঘাতে মৃত্যু।” অথচ সেসব সন্ত্রাসের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কে? তারই সন্তান—কায়ান! নিজের রক্ত, নিজের ছায়া, আজ দেশের সবচেয়ে বড় অপরাধী।

আরহান চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতায় যেন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলো সে। ঠিক তখনই ফোনটা কেঁপে উঠলো। চোখ মেলেই সে হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিলো।

স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একটি ছবি, রাহি পাঠিয়েছে।

ইশা ঘুমিয়ে আছে, শান্ত মুখে নিঃশব্দ নিদ্রায় আচ্ছন্ন। ছবির নিচে রাহি ছোট্ট করে লিখেছে

"রিপোর্ট ডান।"

আরহানের ঠোঁটের কোণে এক ক্ষীণ হাসির রেখা খেলে গেলো যা অস্পষ্ট, কিন্তু গভীর।

সে ছবিটা জুম করে দেখলো।ইশার মুখটা কতটা নিষ্পাপ লাগছে! কেন জানি না, ছবিটার দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভিতরকার জ্বালাময় আগুনটায় একফোঁটা শীতল ছায়া পড়লো।

পরেরদিন,

ইশা তৈরি হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। গায়ে হালকা রঙের কুর্তি, মুখে নিঃশব্দ প্রশান্তি—তবু চোখেমুখে সেই চিরচেনা হাসিটা নেই। তার ভেতরে কোথাও একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করছে।

বাইরে করিডোরে ইশার ভাই একজন ডাক্তারের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। ঠিক তখনই সেখানে পৌঁছালো আরহান। দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা হলো। ইশার ভাই জানালেন, “আমি সত্যিই খুব দুশ্চিন্তায় আছি। ইশা আমার এক মাত্র বোন। ওকে আর কোনো বিপদে দেখতে চাই না।”

আরহান মাথা নাড়ল। তার চোখে অনড় প্রত্যয়।

“আপনার চিন্তা করার কিছু নেই। আমি কথা দিচ্ছি—এইরকম ঘটনা আর কোনোদিন ঘটবে না। ইশার নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন আমার উপর।”

বাইরের কথোপকথন শেষে আরহান কেবিনে ঢুকতেই চোখে পড়লো—ইশা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট মনখারাপের ছায়া। 


আরহানের উপস্থিতি টের পেয়ে রাহি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল এবং কোনো কথা না বলেই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। 

আরহান নীরবে ইশার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

তার পা ফেলার শব্দে হঠাৎই ইশা ঘুরে তাকালো।

চোখে বিস্ময়ের ছাপ, মুহূর্তের জন্য যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না সে।

একপলক তাকিয়ে রইলো ইশা আরহানের দিকে। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

আরহানের কণ্ঠে চাপা দৃঢ়তা,“আমার ইচ্ছে।”

তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো, ইশার কণ্ঠে জমে থাকা রাগ।

ইশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার দিকে। তারপর ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলো, “শুনুন, আপনার আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো দরকার নেই। আমি ঠিক আছি। আর হ্যাঁ, অফিসার রাহিকে আর আমার সঙ্গে পাঠানোর দরকার নেই। আমাকে নিয়ে আপনাকে এতো ভাবতে হবে না।”

আরহান একটু ঝুঁকে তার চোখে চোখ রেখে চুপচাপ বললো, “আচ্ছা... তোমার কথা শুনতে হবে আমাকে?”

ইশা একটুও পিছু হটলো না। ঠান্ডা অথচ দৃঢ় গলায় জবাব দিলো,“হ্যাঁ, শুনতে হবে।”

আরহান এবার ধীরে ধীরে দেওয়ালের দুই পাশে হাত রেখে ইশাকে ঘিরে ধরলো। তার মুখ ইশার মুখের একদম কাছে। চোখে তীব্র দৃঢ়তা।

“তাহলে শোনো,” সে গম্ভীর স্বরে বললো,

“তুমি অফিসার রাহিকে সাথে নিতে চাও না? ঠিক আছে। তাহলে চলো আমার সঙ্গে আমার বাড়ি, আমার রুমে থাকবে তুমি। এই শহরে এর চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর একটাও নেই।”

“ আপনার রুমে কেন থাকবো আমি!!” ইশার কণ্ঠ রাগে কাঁপছে, গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে বিব্রততায়।

আরহান আরও একটু ঝুঁকে এলো। দুইজনের মাঝখানে থাকা ছোট্ট ব্যবধানটুকুও যেন হারিয়ে গেল। আরহান চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,“কারণ, ওটাই এখন তোমার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়।”

ইশা ধাক্কা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইল, গলা ঝাঁঝিয়ে বললো,“ফালতু কথা বলবেন না। সরুন সামনে থেকে।”

আপনার রুমে কেন থাকবো আমি!!” ইশার কণ্ঠ রাগে কাঁপছে, গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে বিব্রততায়।


আরহান আরও একটু ঝুঁকে এলো। দুইজনের মাঝখানে থাকা ছোট্ট ব্যবধানটুকুও যেন হারিয়ে গেল। আরহান চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,“কারণ, ওটাই এখন তোমার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়।”


ইশা ধাক্কা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইল, গলা ঝাঁঝিয়ে বললো,“ফালতু কথা বলবেন না। সরুন সামনে থেকে।”


“ যদি আমার কথা না শুনো তাহলে তুলে নিয়ে যাবো। বুঝেছো?” আরহান শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল।


ইশা ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপ করলো,“গুন্ডামিও দেখি বেশ ভালোই পারেন আপনি।”


আরহানের ঠোঁটে হালকা একরকম ঠাণ্ডা হাসি খেলে গেল,“শুধু গুন্ডামি না—আরও অনেক কিছু পারি। আর তুমি যদি সেগুলো দেখতে না চাও, তাহলে আমার কথামতো চলা ছাড়া তোমার আর কোনো উপায় নেই।”সে আরো বললো,

“ এখন থেকে আমার অনুমতি ছাড়া তুমি কোথাও যেতে পারবে না।”


ইশা চোখ বড় বড় করে তাকালো তার দিকে। কণ্ঠে রাগ আর বিস্ময়ের মিশ্রণ,“আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।”


“হ্যাঁ করছি। প্রয়োজন হলে আরও করবো।”, আরহানের কন্ঠ নির্লিপ্ত।


“ আপনি একটা অসহ্য মানুষ।”, বলেই আরহানের হাত সরিয়ে ইশা হনহনিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। আরহান ঠোঁট চেপে হালকা হাসলো। 


হাসপাতাল থেকে ইশারদের বাড়িতে ফেরার সময় আরহান ইচ্ছে করে ইশার ভাই আর রাহিকে অন্য গাড়িতে পাঠিয়ে দিলো।


ইশা মুখ গম্ভীর করে আরহানের গাড়িতে বসলো। আরহান ড্রাইভারের সিটে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট করলো।তার দৃষ্টি পুরোটা সময় রাস্তার দিকে স্থির।


কিন্তু এই নিঃশব্দ সফর ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে উঠলো ইশার কাছে।তার মাথায় দুষ্টু এক বুদ্ধি খেলে গেলো।সে গাড়ির মিডিয়া সিস্টেমে হাত বাড়িয়ে প্লে বাটন চাপ দিলো।


এক মুহূর্তেই ভেসে উঠলো উচ্চ শব্দে একটা পপ গান।


আরহান রীতিমতো চমকে তাকালো,“এটা কি করলে তুমি?”


ইশা ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিলো,“দেখতে পাচ্ছেন না? গান শুনছি।”


আরহান দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ি ব্রেক করলো।

গান বন্ধ করে শক্ত গলায় বলল,“Are you crazy, Isha? এটা আরহান আহমেদের গাড়ি। এই গাড়ি রাস্তায় দেখলে ক্রিমিনালদের বুক কেঁপে উঠে... আর তুমি কিনা ….!”


ইশা চোখ সরাসরি আরহানের দিকে রেখে বলল,“আপনার গাড়ি হয়েছে তো কি হয়েছে? প্লে বাটন আছে মানেই গান শোনার অনুমতি আছে!

আপনার গাড়ি দেখে যদি ক্রিমিনালদের বুক কাঁপে, তাহলে এই গাড়িতে  গান বাজলে ওরা নাচতে নাচতে পালাবে।”


আরহান চোখ কুঁচকে তাকালো।“ ইশা,আমি কিন্তু সিরিয়াস।”


ইশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো,“সেটা আপনাকে আলাদা করে বলতে হবে না। আমার তো মনে হয় জন্মের সময়ও মুখটা সিরিয়াস রেখে জন্মেছিলেন।”


আরহান এবার ঠান্ডা স্বরে বলল,

“তোমার মনে হচ্ছে না তুমি একটু বেশি বলছো?

ইশা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,“বললে বলেছি। এই গাড়িতে গান চলবে, বুঝলেন?

“কখনোই না।”আরহানের গলা দৃঢ়।

ইশা তৎক্ষণাৎ দরজার হাতলে হাত রাখলো,

“ঠিক আছে, তাহলে আপনি একাই যান। আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না।

আরহান সাথে সাথে নিজের সিটবেল্ট খুলে হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা ধরলো। “ আমাকে একদম রাগিয়ে দিবে না। খুব সাহস দেখাতে ইচ্ছে করছে, তাই না? চুপচাপ বসে থাকো। নয়তো হাত পা বেধে নিয়ে যাবো।

আরহানের ধমকে ইশা গাল ফুলিয়ে রইলো। সে আর কোনো কথা পর্যন্ত বলল না।

ট্র্যাফিক সিগন্যালে লাল বাতি জ্বলে উঠতেই আরহান গাড়ি থামাল। এক পলক ইশার দিকে তাকিয়ে সে জানালার বাইরে চোখ ফেরাল। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল একটা ছোট্ট মেয়ে—হাতে বেলি ফুলের মালা, চোখে সরলতা আর মুখে ক্লান্তির রেখা।

আরহান চুপিচুপি হাত ইশারায় মেয়েটিকে ডাকলো। মেয়েটি ছোট ছোট পা ফেলে কাছে এল। জানালার পাশে দাঁড়াতেই আরহান পকেট থেকে একটা নোট বের করে মেয়েটির হাতে দিল, তারপর নিঃশব্দে ইশার দিকে ইশারা করল—ওর জন্য।

ইশা তখন আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে একটু চমকে তাকালো। শিশুটি নিষ্পাপ চোখে একগাল হেসে ইশার কোলে বেলি ফুলের মালাটা রাখলো, তারপর যেন বাতাসের মতো হালকা পায়ে দৌড় দিয়ে দূরে সরে গেল।

ইশা কিছুক্ষণ চুপ করে মালাটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখের কোণে ধীরে ধীরে এক কোমল হাসি ফুটে উঠলো—নিঃশব্দে যেন অভিমানের বরফ একটু গলে গেল।

কায়ান মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ফাহিমা খাতুন ধীরে ধীরে ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, মুখে ফুটে আছে শান্ত এক প্রশান্তি। তিনি আপনমনে গল্প করে যাচ্ছেন—কখনও হাসির, কখনও স্মৃতির, কখনও বা দুঃখের।

“তুই এত দুষ্টুমি করিস কেন বলতো?” মৃদু হেসে বললেন তিনি। “তোর বড় ভাই তো এখন এসে গেছে। বেশি দুষ্টুমি করলে কিন্তু ও খুব রেগে যাবে।”


চোখ বন্ধ রেখেই কায়ান মুখ বাঁকিয়ে বলল, “তোমার বড় ছেলেকে আমি যেনো খুব ভয় পাই?

ফাহিমা খাতুন হালকা ভ্রু কুঁচকে বললেন, “একদম ওকে রাগিয়ে দিবি না। দেখিস না, তোকে নিয়ে রাগ করে আমার সাথে দেখা করতেও আসেনি।

কায়ানের গলায় তিরিক্ষে সুর, “তোমার বড় ছেলে একটা স্বার্থপর। সে তোমাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসলে আমার কাছে তোমাকে রেখে যেতো না, নিজের কাছে রাখতো।

ফাহিমা খাতুনের মুখে ছায়া নামে। কায়ানের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলেন, “এইসব কথা বলিস না… তোর ভাইটা অনেক অভিমানী। সে ঠিকই আসবে আমাকে দেখতে।”

কায়ান চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকালো। কণ্ঠে দৃঢ় স্নেহ, “যত কিছুই বলো, আমার থেকে কেউ তোমাকে এতটা ভালোবাসে না মা।

এই বলেই সে মায়ের কপালে এক চুমু এঁকে দিল—নরম, মমতাময়।

তারপর ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ক্লান্ত কণ্ঠে গল্প বলতে বলতে নিঃশব্দে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

কায়ান চুপচাপ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে গভীর এক ভালোবাসা আর কোথাও যেন চাপা একটা যন্ত্রণা।

কায়ানের মোবাইলে হঠাৎ একটি ম্যাসেজ ভেসে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে চোখ যেতেই তার ঠোঁটের কোণে এক মৃদু হাসি খেলে গেল—অন্তর্দৃষ্টি মিশ্রিত এক হাসি।

সে ধীরে ধীরে ফোনটা পকেটে রাখল, তারপর কোনো তাড়াহুড়ো না করেই রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই ইশা হনহনিয়ে দরজা খুলে নেমে যাচ্ছিল। আরহান জানালার কাঁচ নামিয়ে একাধিকবার ডাকল, “ইশা... ইশা, দাঁড়াও!”

কিন্তু ইশা সাড়া না দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল। বাধ্য হয়ে আরহান গাড়ি থেকে নেমে এসে এক ঝটকায় তার হাত ধরে ফেললো।


আমার হাত ছাড়ুন!”—ইশা শান্ত গলায় বলল।

আরহান কোনো জবাব না দিয়ে তার কব্জিতে এক অদ্ভুত ধাতব ব্রেসলেট পরিয়ে দিল। সাদামাটা দেখতে হলেও মাঝখানে ছোট একটি লালবিন্দু নিয়মিত আলো দিচ্ছিল—জ্বলছে নিঃশব্দে।


“এটা কী?” ইশা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল।

আরহান ঠান্ডা, স্থির গলায় বলল,“ ভুলেও এই ব্রেসলেটটা খুলতে যাবার চেষ্টা করবে না। খুলতে চাইলেই সরাসরি আমার ফোনে অ্যালার্ট যাবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাব—তুমি কোথায় আছো? কী করছো?”

ইশার মুখ সাদা হয়ে গেল। “ এটা কেমন কথা? আপনি আমার উপর নজরদারি করবেন?”

আরহান তার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল,

“আমি নজরদারি করছি না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। তুমি যদি বিপদে পড়ো, আমি যেনো সময়মতো জানতে পারি। এটা সেই জন্যে।

নিরাপত্তার জন্য আমার রুমে পর্যন্ত পাহারাদার বসিয়েছেন আর কি করা বাকি। এইটা খুলুন বলছি।”, ইশা বিরক্ত কণ্ঠে হাত উঁচিয়ে ব্রেসলেট দেখাল।

আরহান ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল,

“অযথা চেষ্টা করো না। এটা আমি ছাড়া কেউ খুলতে পারবে না—তুমিও না।”

আমি এটা পরব না! এটা একদম অসহ্য!”ইশা গলা তুলে বলল।

আরহান চোখ সরু করে কঠিন গলায় জবাব দিল,

“তোমার পছন্দ-অপছন্দ এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, তুমি যেনো নিরাপদ থাকো। আর তার জন্য যা করতেই হয়, আমি করব।”

ইশা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে রাগ ও হতাশা… তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে কঠিন শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো।

আরোও পড়ুন: রূপকথার শহর পর্ব-১৪| নবনী নীলা

Post a Comment

0 Comments