রূপকথার শহর! (পর্ব-১২) | নবনী নীলা

ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-১২

ইশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আরহানকে দেখছে। আরহানের দৃষ্টি যেনো তার দিকে স্থির। হঠাৎ ইশার ভীষণ অসস্তি লাগলো। ইশা উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করলো,“ আপনি ফিরবেন না বলেছিলেন।”



আরহান উত্তরে কিছু না বলে ইশার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। ইশার আরহানের চোখের দৃষ্টি অন্যরকম লাগছে যেনো দুই চোখের কোণে রহস্য জমে আছে।

“ প্ল্যান চেঞ্জ হয়েছে।”, ইশার দিকে তাকিয়ে বলল আরহান। তার চোখে এক অচেনা স্থিরতা। যেন মানুষ নয়, শিকারির দৃষ্টি।

'আরহান' নামের ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরুষটি আসলে কায়ান।

অভিনয়ের মুখোশ নিখুঁত হলেও চোখের অভ্যন্তরের সেই পুরনো আগুন লুকানো যায়নি।

সে ধীরে ধীরে পা ফেলে ইশার দিকে এগিয়ে যায়। একেকটা পা যেন একেকটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণ।

ইশা নিশ্চুপে দাড়িয়ে আছে। নাসরিন পেছনে দাঁড়িয়ে রাডার মত নজর রাখছে বাইরের দিকে।

কায়ান ভেতরে ঢুকতেই দেয়ালের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নেয়। শার্ট ঠিকঠাক। হেয়ারস্টাইল মিলছে। কণ্ঠের টোনও চর্চা করা।

তবু চোখ... চোখের অভ্যন্তরের সেই শীতল নিষ্ঠুরতা ভুলে গেছে কি?

এত নিখুঁত প্ল্যান, এত ভালো রিহার্সাল...

কিন্তু এই মেয়ে যদি হৃদয় দিয়ে চেনার চেষ্টা করে, তবে কি এই মুখোশ ভাঙবে?

কায়ান ইশাকে লক্ষ্য করে।দৃষ্টি এমন, যেন সে ইশার মনের কথাও শুনতে পাচ্ছে।

তারপর তার চোখ সরে যায়। ধীরে ধীরে পুরো ভিলার গঠনটা বিশ্লেষণ করতে থাকে।

সিঁড়ির বাঁক, লাইটের সোর্স, কোন কোন দরজা খোলা থাকে, সব খুঁটিনাটি মেপে নিচ্ছে সে।

ইশার একদম কাছাকাছি পৌঁছাতেই নাসরিন পাশে এসে বলে,“ সব ঠিক আছে, স্যার? প্ল্যানটা কি সফল হয়েছে?”

কায়ান মাথা নাড়ে। কণ্ঠে রুক্ষ ভঙ্গি রেখে বলে,

“ তোমার সাথে এই ব্যাপারে সকালে কথা হবে।”

নাসরিন মাথা হেঁট করে সরে যায়। 

কায়ান ইশার সামনে গিয়ে দাড়ায়।

“ তুমি এখনো ঘুমাও নি?”, কায়ান খুব ভেবে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করছে।

“ নাহ। ঘুম আসছিলো না।”, ইশার শান্ত জবাব।

কায়ান হাত বাড়িয়ে ইশার গালে হাত দিয়ে বলল, “ ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে কথা হবে।”

ইশা এই স্পর্শে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। অনেক কিছু বলতে গিয়েও যেনো সে থেমে গেছে।

রাত আরো গভীর হয়। ইশা বিছানায় গড়াগড়ি করছিলো। ঘুম আসছিল না। বুক ধড়ফড় করছিল। সে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে।

আরহানের রুমের দরজার সামনে এসে থামে।

হাত কাঁপছে। দরজায় কড়া নাড়ে না, ধাক্কাও দেয় না। দরজা খোলা।সে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢোকে। পুরো রুমটা অন্ধকার ও ধোঁয়া আচ্ছন্ন।

বারান্দার পাশে একটি অবয়ব দেখা যাচ্ছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,

অন্ধকার রাত। বাতাসে কেবল ইলেকট্রিক ওয়ারের ফিসফিস আর রাস্তার আলোয় পড়া ছায়া।

আরহান সাদা SUV গাড়ির সামনের সিটে বসে, রিসিভারে ফিসফিস করে বলেন, “দ্রুত চারপাশ চেক করো। GPS বলছে লোকেশন এইখানেই।”

টিমের বাকি দুজন আগে বেরিয়ে গেছে চত্বর স্ক্যান করতে। কিন্তু ১২টা ১৫মিনিট কোনো রেসপন্স নেই।

আরহান সন্দেহ করে, তখনই গাড়ি থেকে নেমে আসে। কোমরে তার গ্লক পিস্তল, কাঁধে জ্যাকেটের নিচে বুলেটপ্রুফ।সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় পুরনো ফ্যাক্টরি ভবনের দিকে।

হঠাৎ...


ছায়া! তার পাশ দিয়ে ছুটে গেলো এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি। দ্রুত, প্রশিক্ষিত, নিঃশব্দ।

আরহান তৎক্ষণাৎ পেছনে ঘুরতেই,পিছন থেকে চাপা ধাক্কা! দ্রুতগতিতে কেউ একজন তার ঘাড়ে বিশেষ সেডেটিভ ইনজেক্ট করে দেয়। কারণ ওরা জানে বুদ্ধি কিংবা শক্তি কোনোটায় আরহানকে কাবু করা সম্ভব নয়।

আরহান চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু চারদিক ঝাপসা।একটা মুহূর্তে সে দেখতে পায় মাস্ক পরা তিনজন।

তার কানে শেষ যে শব্দটা আসে,"টার্গেট কনফার্মড। অ্যান্টি-ট্রেস মোড অন।"

তারপর নিঃশব্দে, অন্ধকারে মিশে যায় সবকিছু।

[অজানা জায়গা | ঘণ্টা দুয়েক পর]


আরহান চোখ মেলে দেখে, তাকে একটা ধাতব চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। চারদিক অন্ধকার, হালকা সবুজ আলো কাঁপছে দেয়ালের কোণে।

সামনের ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।

তার ঠোঁটের কোণে ঠান্ডা হাসি। গলা থেকে নেমে আসে বিষাক্ত স্বর:" হ্যালো। সিআইডি আরহান আহমেদ। ফাইনালি তোমাকে নিজের জিম্মি করতে পেরেছি।”

আরহান জোর করে উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু হাত দুটো লক করা। অল্প আলোতে আরহান সামনের অবয়বের মুখ স্পষ্ট দেখতে পারছে না।

আরহান শ্বাস নিয়ে ফিসফিস করে বলে, “ কি উদ্দেশ্য তোর?”

কায়ান মুচকি হাসে।" কোনো উদ্দেশ্য নেই। তবে এই খেলাটা আমার খুব পছন্দের।” বলতে বলতে কায়ান এগিয়ে আসছে।

হালকা আলোয় চেহারা দেখা যাচ্ছে। আরহান নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না। অবিকল তার চেহারা। 

আরহান ঘেমে ওঠে। তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে,“এটা... এটা কীভাবে সম্ভব?”

কায়ান হাসতে হাসতে তার মুখটা আরও কাছে আনে। “ কিন্তু এটাই বাস্তবতা। অবিকল এক।”

আরহান ঝাঁকুনি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করে চেষ্টা করে। শিকল কেবল টনটন শব্দ করে। তার চোখে আগুন, “ তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সত্যি বের করতে আমার তোর প্রয়োজন নেই।”

কায়ান থেমে যায়। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,

“ উফ! এতো উত্তেজিত হলে তো সমস্যা। এরপর আমি যা যা করবো তা সহ্য করতে হলেও তো শান্ত থাকতে হবে।”

দেয়ালের পাশে এক লাল বোতাম টিপে দেয় কায়ান। মুহূর্তেই মেঝে কেঁপে ওঠে।

আরহানের গলা থেকে বেরিয়ে আসে চাপা চিৎকার,“কায়ান!”

কায়ান ঠোঁট চেপে হাসে তারপর বলে, “ কি যেনো নাম মেয়েটার ? ইশা। রাইট?”

কায়ানের মুখে ইশার নাম শুনতেই রাগে আরহানের চোখ লাল হয়ে এলো। আরহান দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “ ডোন্ট ইউ ডেয়ার।”

“ আমি একটু দুষ্ট টাইপের, যেই কাজ করতে না করা হয় আমি সেটাই করি।”

“ ইশার কিছু হলে তোকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিবো।”, আরহান হুংকার দিয়ে উঠলো।

কায়ান এগিয়ে এলো, ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি।

“ না, না। কিছু করবো না। কিন্তু যদি একটু ছুয়ে দেখি।”, বলা শেষ না করতেই আরহান নিজের পা দিয়ে সজোড়ে কায়ানের হাঁটুতে লাথি দিলো।

কায়ান ব্যালেন্স হারিয়ে একটু দূরে ছিটকে যায়।

“ খুব খারাপ হলো। বলেছিনা যেটা করতে না করা হয় সেটাই আমি বেশি করে করি।” বলেই কায়ান একটু হাসলো তারপর বেরিয়ে গেলো।

“ আপনি সিগারেট খান?”, হঠাৎ এই প্রশ্নে কায়ান পিছন ফিরে তাকায়। ইশা দাড়িয়ে আছে।

কায়ান সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “ হ্যাঁ, কেনো অবাক লাগছে ?”

ইশা পাশে এসে দাড়ালো। তারপর বলল, “ হ্যাঁ। কখনো দেখিনি তবে আজকে আপনাকে অন্যরকম লাগছে।”

কায়ান ঝুঁকে গিয়ে ইশার চোখের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “ মানুষ কি সব সময় এক রকম থাকে ?” বলেই কায়ান ইশার কোমড়ে হাত দিতেই ইশা ছিটকে সরে গেলো।

কায়ানের চোখে মুখে বিজয়ের হাসি। সে হাতে থাকা সিগারেটটা আবার ঠোঁটে ধরলো। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “ তোমার ভয় হয় না? একা আমার সাথে এই বাড়িতে থাকতে?”

ইশা চোখ তুলে তাকালো। নিশ্বাস নিতেও কেমন অসস্তি হচ্ছে তার। ইশা নিচু গলায় বলল , “ মানে?”

“ মানে ? মানে বুঝার বয়স তোমার হয়েছে। তারপরও যদি না বুঝো তাহলে বলছি।” বলেই কায়ান হাতের সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে দিলো। 

ইশা একটা ঢোক গিলে তাকালো। তার শরীর ঘামছে। কায়ান এগিয়ে এসে ঝুকে ইশার চোখে চোখে রেখে বলল, “ ভয় হয় না?যদি আমি…” বলেই কায়ান ইশার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। “ যদি আমি ছুঁয়ে দেই, কে বাঁচাবে তোমায়? চিৎকার করলেও কেউ আসবে না।”

কায়ান এগিয়ে এসে ঝুকে ইশার চোখে চোখে রেখে বলল, “ ভয় হয় না?যদি আমি…” বলেই কায়ান ইশার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। “ যদি আমি ছুঁয়ে দেই, কে বাঁচাবে তোমায়? চিৎকার করলেও কেউ আসবে না।” 

ইশা পেছনে হেঁটে যায়। তার শ্বাস ভারী, শরীর থরথর করছে। কায়ানের চোখে সেই নিষ্ঠুর খেলা, যেটা আরহানের চোখে কখনো ছিল না।

কায়ান আর এক পা এগোয় না। ঠোঁটে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি নিয়ে বলল,“ভয় পাচ্ছো বুঝি? ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।”

“একদম অসভ্যতা করবেন না,” ইশা রক্তচক্ষু নিয়ে বলল।

কায়ান নীরবে হাসে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে।

“তাই? যদি করি... অসভ্যতা? তুমি কি করবে?”  বলেই ইশার কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলে।

“আপনি পাগল হয়ে গেছেন!” — ইশা জোরে বলতেই হাত ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কায়ান এবার দু'হাতে তার বাহু চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে,

“কোথায় যাচ্ছো? এসো, একটু পাগলামি করি তোমার সাথে...”

তার মুখ আর ইশার মুখের মাঝে আর একচুল ফাঁকা নেই।

ইশার চোখ জ্বলে উঠলো। ঠিক এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল সে। সজোরে নিজের মাথা দিয়ে কায়ানের মুখে আঘাত করে।

কায়ান হতবাক। নাক চেপে ধরে সরে যায়।

সে ভাবেনি, এই মেয়েটা এতটা সাহসী হতে পারে। তার তো মনে হয়েছিল, মেয়েটা হবে একেবারে শান্ত, কোমল একটা ফুলের মতো।

কিন্তু না—এই মেয়ে আগুন।


সে হাসে। ঠোঁটে তৃপ্তির ছাপ।


ইশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই হাসিটা… এত অচেনা লাগছে কেন?

“কে আপনি?” — আনমনে প্রশ্নটা বেরিয়ে যায় তার ঠোঁট থেকে। “আপনাকে এত অচেনা লাগছে কেন?”

কায়ান থেমে যায়। এই মেয়ে শুধু সাহসী না, বুদ্ধিমানও।তবে যতই বুদ্ধিমান হোক, সত্যিটা জানবে না সে কখনও।

ঠান্ডা গলায় কায়ান বলে,

“আমি শুধু দেখছিলাম, তুমি ঠিক কতটা সাহসী।

But I’m impressed.”

“অসহ্য!”  ইশা বিরক্তির সাথে বলে এবং দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

রাত।


ফাহিমা খাতুন ঘুমিয়ে আছেন। তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এই ঘুম সহজে ভাঙবে না।

ইশা চুপ করে বসে আছে তার বিছানার পাশে। এই কয়দিন একা থাকলেও এতটা ভয় তাকে কখনও পায়নি। কিন্তু আজ... কেন যেন নিজেকে খুব একা আর অস্থির লাগছে। সে দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয়। সে সারারাত শুধু পায়চারি করে।

ভোরের আলো ফুটতেই ইশার দম যেন একটু ফিরলো।সে চেয়ারে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলো।

অচেনা নম্বর।

ইশা ভ্রু কুঁচকে কলটা ধরে।

ওপাশ থেকে ভেসে এলো চিনা এক কণ্ঠ:

“হ্যালো, ইশা? তুমি ঠিক আছো? ওই বাস্টার্ড কিছু করেনি তো? বলো আমাকে!”

ইশার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।

আরহান?!

“মানে... আপনি কার কথা বলছেন?” — গলা কাঁপছে ইশার।

“কায়ান। ওর থেকে দূরে থাকবে। আমি যা বলেছি, মনোযোগ দিয়ে শুনো। ওই বাড়িতে তুমি যাকে আরহান ভাবছো, সে আমি না। সে কায়ান।”

ইশা যেন পৃথিবীটা থেমে গেলো।

“এটা কিভাবে সম্ভব? চেহারা তো হুবহু...!”

“হ্যাঁ। এই সুযোগটাই সে নিয়েছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে পৌঁছাবো। ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের খেয়াল রেখো, ইশা।”

“আপনি ঠিক আছেন?” — ইশার চোখে জল।

কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসে না। কল কেটে গেছে। ইশা চুপ করে বসে থাকে। তার মাথায় যেন গোটা আকাশ ভেঙে পড়েছে।

আরহান রুদ্রকে এম্বুলেন্সে তুলে দিলো। তাকে বাঁচাতে গিয়ে রুদ্র আহত হয়েছে।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।

রাত ৩টা।

ঘন অন্ধকার। বাইরে ঝড়ো হাওয়া। পুরনো কারখানার ভেতরের একটা ঘরে আরহানকে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা। মুখে রক্ত, চোখে ক্লান্তি… কিন্তু দৃষ্টি এখনো তীক্ষ্ণ।

দেয়ালের কোণায় ক্যামেরা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দুই পাহারাদার। তাদের একেকজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র।

হঠাৎ দূরে একটা শব্দ—কোনো একটা কিছু পড়ে ভেঙে যাওয়ার শব্দ।পাহারাদাররা একে অপরের দিকে তাকালো।


তারপর...

“থাপ!”

একজনের মাথায় পিছন থেকে বাট দিয়ে মারলো কেউ। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো নিঃশব্দে।

আরেকজন পালাতে চাইলেও ছায়া থেকে রুদ্র বেরিয়ে এসে তাকে কুস্তির ভঙ্গিতে মাটিতে ফেলে দিল।

রুদ্র একঝলকে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো।

“ স্যার!”

আরহান চোখ তুলে তাকায়।"রুদ্র…?"

রুদ্র দ্রুত গতিতে আরহানের বাঁধন কেটে দেয়।ঠিক তখনই গর্জে ওঠে বন্দুকের গুলি।

ধাঁই ধাঁই!

বাইরে থেকে গুলি ছুটে আসে। কায়ানের লোকেরা বুঝে গেছে কেউ ঢুকেছে।

রুদ্র আরহানের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। পাল্টা গুলি চালায়। একজন শত্রু মাটিতে পড়ে যায়, কিন্তু আরেকজন পাশ থেকে গুলি ছোঁড়ে—

রুদ্রের বাঁ কাঁধে আঘাত!

"আহ্!" রুদ্র কেঁপে উঠে পেছনে হেলে পড়ে, আরহান পিস্তল ধরে শেষ শত্রুটিকেও নিস্ক্রিয় করে দেয়।

আরহান যে মুক্ত এই কথা কায়ান জানে না কারণ তার পাহাড়ায় যারা ছিল সবাই এখন জিম্মি। কিন্তু কায়ানের কানে কথা পৌঁছানোর আগেই আরহানকে ফিরতে হবে। ভিলার চারিপাশে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে যেনো কায়ান পালাতে না পারে। 

ইশা ড্রয়িং রুমে পায়চারি করছিল। নাসরিন ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। চোখ কান একদম খোলা। কায়ান নিচে নেমে এলো। এতো তাড়াতাড়ি কায়ান উঠে পরবে ইশা ভাবেনি। কায়ান নিচে নামতেই যেনো ওদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।

“ গুড মর্নিং সুইটহার্ট।”, কায়ান ইশার দিকে তাকিয়ে বললো।

ইশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কি অদ্ভুত একই চেহারা হবে স্বভাব কতটা ভিন্ন। ইশা উত্তরে শান্ত গলায় বলল, “ গুড মর্নিং।” 

কায়ানকে কোনোভাবে সে সন্দেহ করতে দিবে না, স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। ইশা মনে মনে একটা প্ল্যান করছে। হাতেনাতে ধরবে এই কায়ানকে।

কায়ান সকালের শুরুতেই সিগারেট ধরালো। তারপর সামনের বাগানে গেলো। খুব ভালো করে সবটা দেখছে সে। সিগারেট শেষ করে কায়ান ফোন দিলো জিসানকে। কিন্তু কল ধরছে না। কায়ানের মাথা গরম হয়ে গেলো। তারপর রুবানকে কল দিতেই বন্ধ হয়ে এলো। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কায়ান আচ করতে পারছে। কায়ান দ্রুত ভিলার ভিতরে এলো।

ভিতরে আসতেই বড় রকমের এক ধাক্কা খেলো সে। ইশা ফাহিমা খাতুনকে সিড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে আসছে। কায়ান যেনো নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। তার চোখে রক্ত ভেসে উঠছে। মা! 

তার মা এইখানে কি করছে?

কায়ান সকালের শুরুতেই সিগারেট ধরালো। তারপর সামনের বাগানে গেলো। খুব ভালো করে সবটা দেখছে সে। সিগারেট শেষ করে কায়ান ফোন দিলো জিসানকে। কিন্তু কল ধরছে না। কায়ানের মাথা গরম হয়ে গেলো। তারপর রুবানকে কল দিতেই বন্ধ হয়ে এলো। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কায়ান আচ করতে পারছে। কায়ান দ্রুত ভিলার ভিতরে এলো।

ভিতরে আসতেই বড় রকমের এক ধাক্কা খেলো সে। ইশা ফাহিমা খাতুনকে সিড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে আসছে। কায়ান যেনো নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। তার চোখে রক্ত ভেসে উঠছে। মা! 

তার মা এইখানে কি করছে?

কায়ানের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। তার মাথায় যেনো রক্ত উঠে গেছে। 

ফাহিমা খাতুন নিজের ছেলেকে ঠিক চিনলেন। নাসরিন প্যান্টের পকেটে হাত ভরে বন্দুকটা শক্ত করে ধরলো। ইশার এই কাজ করা একদম ঠিক হয় নি। কায়ান ভয়ানক মানুষ, একবার পাগলামি শুরু করলে সবাইকে শেষ করে ফেলবে। ইশা ফাহিমা খাতুনের একদম কাছাকাছি দাড়িয়ে আছে। তার ধারণা পুরুষ মানুষ যতই হিংস্র হোক মায়ের সামনে সে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল।

ঘরের সবার নিঃশ্বাস যেনো শোনা যাচ্ছে। ইশা ফাহিমা খাতুনকে নাস্তার টেবিলে বসালেন। তিনি কেনো চুপ করে আছেন ইশা জানে না। কায়ানকে দেখে ফাহিমা খাতুন কোনো প্রতিক্রিয়া দেয় নি। সে চুপ চাপ নাস্তার টেবিলে বসলেন। ইশা ঠিক তার পাশের চেয়ারে বসে তার সাথে গল্প শুরু করলো। আচরণ এমন যেনো ওরা কেউ কিছুই জানে না। ইশা চায় কায়ান যেনো তাদের দুর্বল না ভাবে। এই ভয়টা কায়ানের ভিতরে দিতেই ইশা ফাহিমা খাতুনকে সামনে এনেছে।


কায়ান চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ ইশার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সে উপরে উঠে গেলো।


ইশা আর  নাসরিন অবাক হয়ে কায়ানের চলে যাওয়া দেখছে। কি আশ্চর্য! লোকটা কোনো কথা বলল না।


ইশা ফাহিমা খাতুনকে নাস্তা দিয়ে নাসরিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।


নাসরিন ফিসফিস করে বলল, “ লোকটা কি এতই নিষ্ঠুর যে নিজের মাকে নিয়েও চিন্তা নেই।”


“ আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু কায়ান উপরে গেলো কেনো?”


“ কি জানি। আপনি না বললে তো  বুঝতেই পারতাম না উনি কায়ান। আল্লাহর কি আশ্চর্য সৃষ্টি দুই ভাইকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন বুঝা মুশকিল কে আরহান আর কে কায়ান?”


“ আসলেই কি তাই?”, ইশা আনমনে প্রশ্ন করলো। 


এর মাঝেই কায়ান হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। তার পায়ের শব্দ যেনো পুরো বাড়ি জানান দিচ্ছে। নাসরিন সতর্কতা অবলম্বন করলো। তার দৃষ্টি সরু, কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।


কায়ান হনহনিয়ে ইশার সামনে এলো। ইশার চোখে চোখ রাখতেই দেখলো, সে চোখে কোনো ভয় নেই। অথচ কায়ানের চোখে যেনো আগুন জ্বলছে। ইশা সেই অগ্নি চোখে চোখে তুলে তাকিয়ে আছে। কায়ান হাত বাড়িয়ে ইশার কব্জি শক্ত করে ধরতেই নাসরিন এগিয়ে এলো বন্দুক হাতে। কায়ানের দৃষ্টি এখনো ইশার দিকে স্থির। কায়ান অন্য হাতে বন্দুক বের করে ঠিক নাসরিনের ঘাড়ে ধরলো। 


কায়ানের দৃষ্টি এখনো ইশার দিকে স্থির। নাসরিন বন্দুক হাতে দাড়িয়ে কাপছে কারণ সে জানে গুলি চালাতে কায়ান দ্বিতীয়বার ভাববে না। 


“ নিজেকে খুব চালাক ভাবো? কিন্তু এই চালাকির মাশুল আজকে তোমাকে দিতে হব।”, দাঁতে দাঁত চিপে নিচু স্বরে বলেই কায়ান ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। তারপর সে নাসরিনের দিকে তাকালো।


“ ওকে আপনি কিছু করবে না।”, ইশা কঠিন গলায় বলল। ফাহিমা খাতুন ডায়নিং টেবিলে বসা যার কোনো ধারণা নেই তার পিছনে কি কি হচ্ছে। তিনি যেনো কোন ঘোরে চলে গেছেন।


কায়ান ইশার হাত ছেড়ে এবার তার কোমড় শক্ত করে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ইশার একদম মুখের কাছে এসে বলল, “ ঠিক আছে কিছু করবো না। কিন্তু একটা শর্ত।”


ইশা দাঁতে দাঁত চিপে তাকিয়ে আছে। আবার শর্ত! অবশ্য আরহান আহমেদের ভাই তো তার মতনই হবে। সবকিছুতেই এরা শর্ত দেয়।


“ কি শর্ত ?” ইশা একটা ঢোক গিলে বলল।


“ তোমার আমার সাথে আসতে হবে।”, এই কথা শুনে নাসরিন আর ইশা দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকালো। নাসরিন চালাকি করে নিজের প্যান্ট থাকা ইমার্জেন্সী বাটন প্রেস করতে চাইলো কিন্তু কায়ান সাথে সাথে দৃষ্টি নাসরিনের দিকে করলো।


“ পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কি খুব শখ? মেয়েদের আমি মারি না। কিন্তু ছেড়েও দেই না। আর কি করি সেটা নিশ্চয়ই তুমি জানতে চাইবে না।,”  


নাসরিন সাথে সাথে পিস্তল ফেলে দিয়ে দুইহাত তুলে দাড়ালো। কায়ানের দৃষ্টি আবার ইশার দিকে স্থির হলো। কায়ান ইশার কানের পাশে চুল গুজে দিয়ে বললো, “ কি হলো? আমার সাথে নিজের ইচ্ছায় যাবে নাকি লাশ ফেলতে হবে। ট্রাস্ট মী ওরা সবাই মিলেও একা আমার সাথে  পারবে না।”


ইশা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেলো। তাহলে তো তাকে যেতেই হবে এই লোকের সাথে। না যেতে চাইলে যদি সত্যি সত্যি গুলি করে। সে চায় না তার জন্য কারোর প্রাণ যাবে। 


“ আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইছেন কেনো?”


“ কায়ান নিজের কাজের কৈফিয়ত কাউকে দেয় না।, তোমার কাছে বেশি টাইম নেই।”, বলে কায়ান একদম নাসরিনের মাথায় বন্দুক তাক করতেই ইশা ছটফট করে বলে, “ওকে কিছু করবেন না। প্লীজ। আমি রাজি।”

কায়ানের চোখে বিজয়ের হাসি। কায়ান সাথে সাথে ইশাকে ছেড়ে দিয়ে নাসরিনকে জোরে একটা থাপ্পড় দিতেই সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ইশা চিৎকার করে উঠলো। 

“ কি করলে এটা? নাসরিন! উঠো।” 

ইশার চিৎকারে ফাহিমা খাতুন পিছনে ফিরলো। তারপর উঠে এসে বলল, “ কিরে ছটু? তুই আবার দুস্টুমি শুরু করেছিস?”

কায়ান  নিজের মায়ের কাছে এগিয়ে গেলো। ইশা জানে না তাদের মাঝে কি কথা হয়েছে, সে নাসরিনকে ডেকে তুলতে ব্যাস্ত।

কায়ান কিছুক্ষণ পর ইশার সামনে এসে বলল, “ কিছু হয়নি। একটু পরই উঠে পরবে।”, বলেই ইশার হাত ধরে টেনে তুলল।

“ উঠার আগেই তোমার আমার সাথে আসতে হবে।”, বলেই ইশার চোখে চোখ রাখল।

ইশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কায়ান ইশার কাধে ইনজেকশন পুশ করতেই ইশা বিস্ময় নিয়ে কায়ানের দিকে তাকালো।

“ এই সুন্দর চেহারায় থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে না। এতো দয়া কায়ান এর আগে কখনো কাউকে করিনি।” 

ইশা পুরো কথা শুনার আগেই অচেতন হয়ে পিছনে হেলে পড়তেই কায়ান ইশাকে কাধে তুলে নিলো।

কায়ান ইশাকে নিজের পেন্টহাউসে নিয়ে এলো। ইশার জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে অনেক। তাকে যেই ড্রাগ দেওয়া হয়েছে তার প্রভাব কাটতে বারো ঘণ্টা সময় লাগবে।

কায়ান ইশাকে রুমে রেখে বাইরে দিয়ে আটকে দিলো।

কায়ানের বিশাল ড্রয়িং রুমে রুবান আর জিসান মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। যেনো শুধু তাদের প্রাণ যাওয়ার অপেক্ষা। কায়ান সোফায় এসে বসতেই তার পিছনের দাড়ালো তিন জন। মুখে কালো মাস্ক পরনে কালো পোশাক।

“ বলো কি শাস্তি চাও তোমরা?”, বলতে বলতে কায়ান সিগারেট ধরালো।

“ স্যার এইবারের মতন মাফ করে দিন।”, জিসান কাপা কাপা গলায় বলল।

“ মাফ? অসম্ভব। এর শাস্তি পেতেই হবে। আমার মা আরহানের কাছে আছে বলে বেঁচে আছে কিন্তু যদি কোনো শত্রুর হাতে পড়তো। তাহলে আজকে তার মরদেহ দেখতে হতো আমাকে।”, কায়ান যেনো গর্জন করে উঠলো।

“ সাহস কি করে পেলে আমার থেকে লুকানোর?”, 

“ স্যার। দয়া করে এইবারের মতন ক্ষমা করে দিন।”, জিসানের চোখে পানি। রুবান মাথা নীচু করে আছে যেনো তার মৃত্যু সে মেনে নিয়েছে।

কায়ান নিজের পিছনে দাড়িয়ে থাকা কালো পোশাকধারীদের ঈশারা দিয়ে বলল, “ ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।”

দুজন দুইপাশ থেকে এসে জিসানকে শক্ত করে ধরে ফেললো। জিসান আকুতি মিনতি করে প্রাণ ভিক্ষা চাইলো কিন্তু লাভ হলো না। জিসানকে নিয়ে যেতেই রুবানের পায়ের নিচের থেকে মাটি সরে গেলো। সে থর থর করে কাপছে।

কায়ান সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “ তোমাকে মাফ করলাম রুবান। কিন্তু এটাই লাস্ট।”

রুবান অঝোরে কেঁদে ফেললো। 

“ দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে।”, কায়ান নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল।

আরোও পড়ুন: রূপকথার শহর পর্ব-১৩| নবনী নীলা

Post a Comment

0 Comments