নির্বিচার|মারিয়া হাজান মারুফা| পর্ব-২

জীবনের গল্প: নির্বিচার|মারিয়া হাজান মারুফা| পর্ব-২

জ্ঞান ফিরে মেঘের! আবছা চোঁখে সবকিছু আবিষ্কার করতে থাকে! সে নিজেকে একটা আবদ্ধ রুমে স্থানান্তর করে! মুহূর্তে'ই হচমকিয়ে উঠে, মনে করে তখনকার কথা!

মেঘ'কে দেখেই ফিরোজা বেগম বলেন' —মেঘ!'

মেঘের দৃষ্টি যায় ফিরোজা বেগমের দিকে! তাৎক্ষনিক তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়! দড়াম করে কিছু পড়ার শব্দে সবাই অবাক হয়ে যায়! আমেনা বেগম দৌড়ে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরেন! মেঘ স্পষ্ট-স্বরে বলে' —দাদি মা!'

তখন'ই পেছনে থাকা গার্ড-টি মেঘের হাত চেপে ধরে! কেনো-না গাড়িতেই মেঘকে গার্ডটা বলেছিলো' —বাড়িতে কোনো কথা না বলতে!'

গার্ড-টি মেঘের হাত ধরায় মেঘ পিছনে তাকায়! মেঘ দেখে গার্ডটি এমন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো যেনো তার কাছে গার্ডটি প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছে! মুহুর্তে'ই মেঘের গালে পরপর চড় বসিয়ে দেয় অভি! তা দেখে গার্ডটি ভয়ে কাঁপতে থাকে!

মেঘের শরীলে শিহরণ বয়ে যায়! গার্ড এখন কোথায়? কি অবস্থায় আছে? সেটাও সে জানে না? এ কোথায় এসেছে ও? কি কারণ তাকে এখানে আনার? আর দাদিমা, দাদিমা এখানে কেন? আর অভির সাথে তার কিসের সম্পর্ক? চিন্তার মাঝেই নাকে বিশ্রী গন্ধ আসতেই সে তাকিয়ে দেখে! অভি আপন মনে সিগারেট টানছে! মেঘের প্রচন্ড রাগ হলো! পুরুষটিকে দেখে! তার সরলতার সুযোগ নিয়ে লোকটা তাকে তিলে তিলে মারছে! আব্বু-আম্মু! হ্যাঁ আব্বু আম্মু কোথায় আর কেমন আছে তারা?

মেঘ ভয়ে ভয়ে বলে' —শুনুন!'

অভি সিগারেট ছেড়ে মেঘের দিকে আসে! মেঘ গুটি-সুটি মেরে জড়ো-সড়ো হয়ে বসে। তাকে দেখে যে কেউ বলবে আস্ত ফকিরের পুটলি! মেঘ ভয়ার্ত কন্ঠে বলে' —'আপনাকে আমি আমার কথা শুনতে বলেছি! আমার কাছে আসতে বলিনি!'

অভি পিছনে পা বাড়িয়ে আবারও সোফায় বসে পড়ে' —'কি বলবেন বলুন?

মেঘ যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে! ভাঙা কন্ঠে জোর এনে কঠোর-স্বরে জবাব দেয়' _আমার আব্বু-আম্মু কই?'

অভি এক-পলক মেঘের দিকে তাকায়! মেয়েটি বেশ সাহস নিয়ে প্রশ্ন করেছে বটে! তাকে দেখলে যে কেউ বলবে সে মানুষ না জ্বিনের সামনে ধরা পরেছে! অভি একটু নরম স্বরে বলে' —'ছেড়ে দিয়েছি তাদের!'

মেঘ এবার একটু সাহস নিয়েই বলে' _'কোন সাহসে আমাকে বিয়ে করেছেন আপনি!'

অভি আর একটা সিগারেট হাতে নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেয়' —'বিয়ে করতে সাহস লাগে না বউ!'

মেঘ অবাক হয়ে বলে' —'বউ!'

সিগারেট মুখে নিয়েই অভি বলে' —'হ্যাঁ মেঘবতী!'

মেঘ জোড় কন্ঠে বলে' —'কার বউ কিসের বউ! আমি এই বিয়ে মানি না!'

অভি দ্রুত পায়ে বিছানার কাছে আসে! তাকে এভাবে উত্তেজিত হতে দেখে মেঘ ভয় পেয়ে যায়! অভি মেঘকে একটানে বিছানা থেকে ফ্লোরে নামায়! মেঘের চুলের মুঠি জোরে চেপে ধরে অভি! মেঘ দু-হাত দিয়ে চুল শক্ত করে ধরে! সিগারেটের আগুন মেঘের হাতে চেপে ধরতেই মেঘ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে! দরজায় কারও ডাকে অভি মেঘকে ছেড়ে দেয়! দরজা খুলে দ্রুত পায়ে অভি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়! হন্তদন্ত হয়ে ফিরোজা বেগম ঘরে প্রবেশ করে! মেঘ অন্য দিকে মুখ ঘুড়িয়ে দাড়িয়ে আছে!

ফিরোজা বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে' _'মেঘলা!'

মেঘ আর দেরি করলো না! ফিরোজা বেগমকে চাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলো! ফিরোজা বেগম ও তার নাতনিকে স্বযত্নে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলেন! পরক্ষণেই চোঁখ যায় মেঘের হাত থেকে ঝড়ানো রক্তের দিকে!

অস্ফুট-স্বরে বলে' —'মেঘ তোর হাত! তোর হাতে কি হয়েছে?'

মেঘ ফিরোজা বেগম কে ছেড়ে বলে' —তেমন কিছু না দাদিমা! এটা আমার ভুলের ক্ষতিপূরণ!'

ফিরোজা বেগম বেশ অবাক হয়! তার মেঘ আর আগের মতো চটপটা স্বভাবের নেই! বরং খুবই শান্ত আছে! এখন আর তাকে দেখে কেউ বাচ্চা বলবে না! কিন্তু রক্ত, মেঘ তো রক্ত দেখতেও ভয় পায় তাহলে কিভাবে!

ফিরোজা বেগম শান্ত-স্বরেই বলে' —'আয় তো বস আমার কাছে!'

মেঘ চুপচাপ বিছানার এক পাশে বসে পড়ে! ফিরোজা বেগম ফাস্ট-এইচ বক্সটা হাতে নিয়ে বিছানায় এসে মেঘের সম্মুখে বসে! মেঘের হাতটা নিজের কাছে নিতেই, সেখান থেকে সিগারেটের তীব্র গন্ধ বেরোচ্ছে! ফিরোজা বেগম গভীর ভাবনায় ডুবিয়ে গেলেন! এক-ফোটা পানি হাতে পড়তেই ফিরোজা বেগমের ধ্যান ভাঙে! সে দেখে মেঘ নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে! ফিরোজা বেগম পরম যত্নে চোঁখের পানি মুছে দেয়! তারপর মেঘের হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়!

ফিরোজা বেগম মেঘকে জড়িয়ে ধরে বলে' —'সব কিছু ঠিক হবে রে! তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না!'

মেঘও দাদিমাকে জড়িয়ে বলে' —'দাদিমা! তুমি এখানে কেন? তুমি না আমাদের বলতে তুমি ফুপির সাথে তাদের বাড়িতে থাকো? তাহলে তুমি এখানে কি করছো? আর অভি? অভি তোমার কে হয়? দাদিমা?'

ফিরোজা বেগম উত্তর দিতে চাইলেন না! কিন্তু মেঘের ভাবান্তর চেহারা দেখে বল' —'এই সেই আনন্দ চৌধুরী অভি! যে তোর বড় বাবার ছেলে!'

ফিরোজা বেগম জোরে-জোরে ডাকতে লাগলেন' —'রহিমা? ও রহিমা?'

মিনিট দুয়েকের মধ্যে একজন যুবতী দরজার কাছে এসে হাজির হয়েছে! জলপাই রঙের সালোয়ার-কামিজ পড়ে আছে সে! উড়না দুই-বাহু মিলিয়ে দিয়ে আছঁ! দুই হাত সামনে এনে একহাতের তালুতে আর একটা মালিশ করছে! ফিরোজা বেগম রহিমাকে দেখে বলেন' —'যা তো! আমার মেঘের জন্য গরম গরম কিছু খাবার নিয়ে আয়!'

—'আচ্ছা বড়মা!'

রহিমা সেখান থেকে চলে গেলো! ফিরোজা বেগম আলমারি থেকে একটা নতুন শাল বের করে মেঘের শরীলে জড়িয়ে দিলেন! শীত-কালে উত্তরে বেশ হাওয়া বয়! জানালার পর্দাগুলো তরতর করে উঠা-নামা করছে! ফিরোজা বেগম এগিয়ে গিয়ে জানালা দুটো বন্ধ করে দিলেন!

কিছুক্ষণ বাদেই রহিমা খাবার দিয়ে গেলো! মেঘ খেতে নারাজ! ফিরোজা বেগম এনিয়ে বিনিয়ে মেঘকে খাইয়ে দিলেন! এমনকি মেঘের পড়াশুনা সহ বাকি সবকিছুও তিনি আলোচনা করলেন মেঘের সাথে! মেঘও তার দাদিমাকে সবকিছু বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে! ক্ষান্ত হয়ে বিছানায় শরীল এলিয়ে দেয় মেঘ! পাশেই তার দাদিমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে!

হঠাৎ ভাঙচুড়ের শব্দে মেঘ বিছানা ছেড়ে ধর-ফরিয়ে উঠে! বিষ্মের রেখায় কপালদ্বয় ভাঁজ করে ফিরোজা বেগমের দিকে তাকান! কিন্তু তিনি স্তব্ধ! মেঘ কিছু না বলে বাইরে আসতেই ফিরোজা বেগম তড়িঘড়ি মেঘের পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে আসে! তাকিয়ে দেখে সবাই চুপচাপ অভির কর্ম-কান্ড দেখছে কেউ কিছু বলছে না! ফিরোজা বেগম এগিয়ে গেলেন! মেঘ ভয় পেয়ে ফিরোজা বেগমের পিছনে লুকিয়ে পড়ে! অভি একটার পর একটা জিনিসপত্র ভেঙেই যাচ্ছে! অস্ফুট-স্বরে কেউ বলে' —'অভি!

অভি থেমে যায়! ছুটে আসে হুইল চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তির দিকে! দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নেয় বুক পাঁজরে! ফিরোজা বেগম ছেলের কাছে আসে! মেঘ ফিরোজা বেগমের পিছে লুকিয়ে আছে! আড়াল থেকে একবার অভি তো একবার হুইল চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তির দিকে দেখছে মেঘ! তার মনে হচ্ছে অভি এখন তাকে পেলেই সবার সামনে ঠাটিয়ে আবারও চড় মারবে! মেঘ ফিরোজা বেগমের গা ঘেষে দাড়িয়ে পরে! অভি আর চোখে মেঘকে পরখ করছিল! অভি বুঝতে পারে মেঘ তার ভয়েই দিদুনের পিছে ঘাপটি মেরেছে! অভি হুইল চেয়ারের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে' —'বাবা!'

হ্যাঁ হুইল চেয়ারে বসা ব্যক্তিটি অভির বাবা! অভির বাবা কোনো উত্তর দিলেন না! অভি আবারও প্রশ্নে মনোযোগ দেয়' —:বাবা! তুমি না বলতে তোমার কলিজা সেদিনই ঠান্ডা হবে যেদিন আমি তোমার এমন অবস্থা আর মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবো?'

অভির বাবার হাতের আঙুল কিছুটা নড়েচড়ে উঠে! অভি মুচকি হেঁসে মেঘকে একটানে তার দিদুনের পেছন থেকে সামনে আনে! অভির বাবা তাকাতেই অভি বলে' —'বাবা দেখো! আমি খুনিকে নিয়ে এসেছি! এখন তোমার সামনেই আমি তাকে খুন করবো!

মেঘ এক ঝটকায় অভির থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়! কাঠ-কাঠ গলায় জবাব দেয়' —'কি সব আবোল-তাবোল বলছেন আপনি? মুলত জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে করেছেন? আবার এখন জোর-জবরদস্তি করে খুনি বানিয়ে খুনও করবেন বাহ?'

অভি মুচকি হেঁসে বলে' —'আপনি খুনি মিসেস মেঘলা চৌধুরী!'

মেঘের সাড়া শরীল বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়। কিসব বলছে অভি! কিছুই জানে না সে! এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে অভির দিকে!

অভি বলে' —'এই সেই ফিরোজ চৌধুরী! যে আমার বাবা! আজ আপনা'র জন্য'ই তার এই অবস্থা! আর আমার মা! ওনি তো আপনা'র জন্য'ই এই দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে গিয়েছেন! সবকিছু আপনা'র জন্য'ই হয়েছে মেঘ! আপনি'ই আসল খুনি!'

মেঘ দৌড়ে পালায় সেখান থেকেই! ফিরোজা বেগম পেছন থেকে বলে' —'মেঘ যাস নে তুই! আমার কথা শোন! মেঘ!'

পরক্ষণেই গুলির শব্দে সবাই চুপ হয় যায়!

মেঘের আসল পরিচয় কি? কেন'ই বা অভি তাকে বিয়ে করলো? কোন প্রতিশোধের কথা মাথায় রেখে মেঘকে কষ্ট দিচ্ছে? নাকি মেঘ সত্যি অভির মায়ের খুনি? অভি কি মেঘ কে খুন করবে? নাকি তাকে স্ত্রী রূপে গ্রহন করবে? কি হতে চলেছে মেঘের সাথে জানতে হলে পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন!

Post a Comment

0 Comments