রূপকথার শহর! (পর্ব-২২) | নবনী নীলা
রাহি গাল ফুলিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় চুপচাপ বসে আছে। এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম তাকে কায়ানের ঘর থেকে বের করে অন্য ঘরে আনা হয়েছে—তাও দেহরক্ষীদের ঘেরাটোপে।
তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তি। মনে মনে ভাব
নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে। এরা কোনো কিছুই এমনিতে করে না।
ঘরের চারপাশে অন্তত দশজন দেহরক্ষী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, যেনো সে একজন ভয়ংকর অপরাধী। রাহির ভ্রু কুঁচকে যায়, ধৈর্যের সীমানায় চিড় ধরছে তার।
ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে কায়ান।
দেখেই বোঝা যায়, সে জিম সেশন শেষ করে এসেছে। ভেজা শরীরে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। কপালের সামনে থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে তার ঘাড় বেয়ে।
পরনে কেবল কালো ট্রাউজার। উপরের অংশ উদোম—পেশীবহুল গড়ন ও উজ্জ্বল ত্বক ঘামের ছোঁয়ায় আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
বাঁ হাতে থাকা বিশাল ট্যাটুটি পুরোপুরি উন্মুক্ত—কালো কালি আর গাঢ় রেখায় আঁকা নিখুঁত এক শিল্পকর্ম।
রাহি চোখ ফিরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু পারছে না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার দৃষ্টি আটকে যায় কায়ানের দিকে। রাহি নিজেকে মনে মনে ধমক দিয়ে বলে—“চোখ নামা, রাহি!”
কায়ান টাওয়েলটা কাঁধে ফেলে নিজের ঘাম মুছতে মুছতে রাহির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো। তার চোখে সেই চিরচেনা ঠান্ডা দৃষ্টি।
কায়ানের দৃষ্টি পড়তেই রাহি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।
টাওয়েলটা একপাশে ছুঁড়ে রেখে কায়ান সামনে রাখা সোফায় গা এলিয়ে বসল—পায়ের উপর পা তুলে, যেন সে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রক।
“তোমাকে এখানে ডেকেছি কেন, জানতে ইচ্ছে করছে না?” কায়ানেরগলা ঠান্ডা, কিন্তু তাতে এক ধরনের শীতল আগ্রাসী রেশ।
রাহি আড়চোখে একবার তাকালো।
কায়ানের ঠোঁটে অদ্ভুত এক তৃপ্তির রেখা।
তারপর কায়ান নিজেই বলে উঠলো, “তোমার বস, আরহান। শেষমেশ সমঝোতায় রাজি হয়েছে।”
রাহি বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলে, “কি!”
“ইয়েস, সুইটহার্ট,” কায়ান ঠোঁটের কোণে এক চিলতে ব্যঙ্গমিশ্রিত হাসি টেনে বললো, “সময় হয়েছে তোমাকে গুডবাই বলার।”
রাহির ভ্রু কুঁচকে যায়। মুহূর্তেই মাথার ভেতর ঝড় শুরু হয়।‘সমঝোতা’ মানে ঠিক কী? কিসের বিনিময়ে? তাহলে কি… পেনড্রাইভটা?
রাহি কিছু বলার আগেই একজন দেহরক্ষী নিঃশব্দে এগিয়ে এসে টেবিলের উপর একটা ছোট্ট জিনিস রাখে—একটা আংটি। ঠিক সেই আংটিটা, যেটা রাহি ভেবেছিল চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে।
রাহির চোখ বড় হয়ে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে তার দৃষ্টি আটকে থাকে আংটির উপর।
সে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ধরতে যায়…
ঠিক তখনই কায়ান ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,
“নো নো, ওয়েট। এত তাড়াহুড়ো কিসের? টেক ইট স্লো, সুইটহার্ট।”
তার চোখে খেলে যায় এক বিদ্রূপাত্মক ঝিলিক।
তারপর হেলান দিয়ে বসে, এক অঙ্গুলির ইশারায় পেছনের বিশাল স্ক্রিনের দিকে নির্দেশ করে।
“তোমার হবু বর—তাঁর একটা ছোট্ট ভিডিও ফাঁস হয়েছে,” কায়ানের কণ্ঠে হালকা খেলা করা ঠান্ডা সুর।
স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এক দৃশ্য। রাহির মুখে সমস্ত রঙ ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু রাহি কোনো রিয়েক্ট করে না।
কায়ান কিছুটা থমকে যায়। এমন শান্ত প্রতিক্রিয়া সে মোটেও আশা করেনি। ভাবছিল, ভিডিওতে নিজের হবু স্বামীকে অন্য একজন মেয়ের সাথে একান্ত মুহূর্তে দেখে রাহি নিশ্চয়ই চিৎকার করবে, ভেঙে পড়বে… অথবা অন্তত কিছু তো বলবে।
কিন্তু রাহি নিঃশব্দে ভিডিওটা দেখে গেলো। ঠান্ডা চোখে। আবেগহীনভাবে।
ভিডিও শেষ হতেই কায়ান গলা পরিষ্কার করে বললো,“এখন তুমি ভেবে দেখো, এই আংটিটা রাখবে কি না।”
কায়ান ভেবেছিল — রাহি হয়তো এইবার কিছু বলবে। কিন্তু তার সব ধারণাকে উল্টে দিয়ে, রাহি শান্ত মুখে হাত বাড়িয়ে আংটিটা তুলে নিলো।
সে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো।
এক মুহূর্ত কায়ানের চোখে চোখ রাখলো।
তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানালার দিকে এগিয়ে গেলো।আর হঠাৎ করেই… জানালার ফাঁক দিয়ে আংটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো বাইরে।
কায়ানের ঠোঁটে এক প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠলো।এমনটাই সে চেয়েছিল।
রাহির এই বিয়ে কিংবা এনগেজমেন্ট নিয়ে কখনোই সত্যিকারের কোনো আগ্রহ ছিল না।
সে রাজি হয়েছিল শুধু তার বাবাকে কথা দিয়েছো বলে।
তার মন কখনোই এ বন্ধনের অংশ ছিল না।
এখন আর তার কোনো পিছুটান নেই।
এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সে কেবল একটা কারণ খুঁজছিল।
একটা অজুহাত।
আজ, সেই অজুহাতটা সে পেয়ে গেছে।
আরহান তৈরি হচ্ছিলো। আয়নায় চোখ রেখে চুল ঠিক করছিলো সে। আজ কায়ানের সাথে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং—যেটা সে ইশাকে কিছুই বলেনি এখনো।
পেছনে দাঁড়িয়ে ইশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো,
আরহান তখন নিজের শার্ট গায়ে দিচ্ছিলো, বোতামগুলো এখনো খোলা।
আরহান ধীরে ধীরে বোতামগুলো লাগাতে লাগাতেই ইশাকে বললো,“আপনি কোথায় যাচ্ছেন আমাকে বলবেন না?”
আরহান এক চোখে তাকিয়ে হালকা হাসলো, “একটু কাজ আছে।”
ইশা গাল ফুলিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, “একটু আবার কাজটা কী? এত সিরিয়াস ভাবে তৈরি হচ্ছেন!”
আরহান প্রথমে কিছু বলতে চাইলো না, কিন্তু ইশার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো—স্ত্রী হিসেবে তার জানার অধিকার আছে। নাহলে বারবার ইশা তাকে ভুল বুঝবে।
আরহান এগিয়ে এসে ইশার পাশে বসলো। চোখে নরম এক ভঙ্গি, গলায় শান্ত স্বর—
“একটা মিটিং আছে।”
ইশা আবার নাক ফুলিয়ে বললো, “কার সঙ্গে মিটিং? আপনার তো সারাক্ষণই মিটিং!”
আরহান এবার একটু দম নিয়ে বললো, “কায়ানের সাথে।”
ইশার বুকটা হঠাৎ চিপ মেরে উঠলো। কায়ানের নাম শুনলেই তার বুক ধকধক করে ওঠে। কায়ানের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, কোনো না কোনোভাবে আরহান ক্ষতি হয়েছে। এই মিটিংটা সে কিছুতেই হতে দিতে চায় না।
হঠাৎই সে ফট করে টেবিল থেকে আরহানের বন্দুকটা তুলে নিলো। এক ধাক্কায় কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বললো—
“না! আপনি যাচ্ছেন না!”
আরহান কিছুটা অবাক হলেও ভেতরে হাসি চেপে রেখে শান্ত গলায় বললো, “বেবি... ওটা আমাকে ফেরত দাও।”
ইশা মাথা নাড়িয়ে বললো, “না। আমি আপনাকে কায়ানের সঙ্গে দেখা করতে যেতে দিবো না।”
আরহান এক ধাপ এগিয়ে আসতেই ইশা সাবধানী ভঙ্গিতে এক ধাপ পিছিয়ে গেলো।
দুজনের চোখে চোখ পড়লো—একজনের চোখে দুশ্চিন্তা, আরেকজনের চোখে ভালোবাসা।
আরহান ধীরে হাত বাড়িয়ে ইশার কোমর জড়িয়ে নেয়, তাকে একদম কাছে টেনে আনে। মাথা মাথায় ছুঁইয়ে বলে,“এতো ভয় পাচ্ছো কেন ?”
ইশা দুই হাতে আরহানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের উপর মাথা রেখে ফিসফিস করে বললো,
“না, আপনি যেতে পারবেন না। কী দরকার যাওয়ার?” তার কণ্ঠে স্পষ্ট উদ্বেগ।
আরহান তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,“অনেক দরকার।”
ইশা জেদ করে মাথা নাড়ালো,“নাহ, আপনি যাবেন না।”
তার এমন বায়নায় আজ আরহানের রাগ নয়, বরং ভালোবাসা আরও গভীর হচ্ছে।
আরহান এক টানে ইশাকে কোলে তুলে বিছানার পাশে বসে। ইশা তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। এমনভাবে, যেন আরহানকে কেউ কেড়ে নিচ্ছে।
এই সুযোগে আরহান ইশার হাত থেকে আস্তে করে বন্দুকটা সরিয়ে ফেলে মুচকি হেসে বলে,
“এই আদরটা রাতে করলেই পারো, বেবি! এখন কাজে যাওয়ার আগে আমাকে কন্ট্রোল হারাতে বাধ্য করছো কেন?”
ইশা তাকায় একবার আরহানের চোখে, তারপর মাথা রেখে এক হাতে ইচ্ছে করে তার শার্টের একটা বোতাম খুলে দেয়।
আরহান সাথে সাথে ইশার হাত থামিয়ে দেয়,
“একদম না। আমাকে কিভাবে দিশেহারা করতে হয়—ভালোই শিখে গেছো?”
ইশা বকাঝকিকে পাত্তা না দিয়ে ধীরে বলে,
“কী দরকার ওই কায়ানের সঙ্গে দেখা করার? থাকুন আমার কাছে।”
আরহান ইশার কপালে এক গভীর চুমু দিয়ে বললো,“রাহিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর কিছু এমন ব্যাপার আছে—যা কেবল কায়ান জানে। এই মিটিংটা জরুরি।”
এই কথা শুনে ইশার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।
“রাহি!”তার চোখে বিস্ময়, উদ্বেগ আর অজানা আশঙ্কা। রাহি যে কায়ানের বন্দি এই ব্যাপার ইশার অজানা ছিলো।
রাহি এবার সত্যিই প্রস্তুত—এই বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার বুকের ভেতর একরাশ ভয় যেন গুমরে উঠছে বারবার।
কায়ানের আসল উদ্দেশ্য কী, সেটা আজও রহস্য। গাড়ির ভিতরে বসে রাহি জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে, অথচ মনে চলছে নানা প্রশ্নের ঢেউ। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক পুরোনো পোড়া বাড়িতে, যেখানে কায়ান আর আরহানের মুখোমুখি হওয়ার কথা। কিন্তু রাহির জানা নেই—সেখানে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য।
প্রীতি? সেই মেয়েটি কোথায় গেল? সেদিনের পর তাকে আর দেখা যায়নি সেই বাড়িতে। আর কায়ানের মা? সেই বাড়িতে কায়ানের মা ছিলেন না। তাহলে কি তাদের অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে?
গাড়ির ভিতরে রাহির সাথে আছে তিনজন কঠোর চেহারার লোক। কোনো কথা নেই, শুধু নীরব গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে গাড়ি।
চলার আগে কায়ানের সাথে রাহির আর দেখা হয়নি। কিন্তু তার জন্য রাখা ছিল একটা ছোট্ট চিঠি আর একটি আংটি।
চিঠিতে লেখা ছিল,
“ সুইটহার্ট।
না চাইতেও তোমাকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে আজীবন কাছে রাখি। প্রয়োজনে বন্দি করে রাখতাম—এই পৃথিবী থেকে আড়াল করে, শুধু আমার জন্য।
কিন্তু ভেবে দেখলাম, এতে ক্ষতি হবে আমারই।
এই অন্ধকার জগতে টিকে থাকতে হলে শক্তি লাগে। হৃৎস্পন্দন নয়।
আর তুমি… তুমি আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছো।
If you had wanted me, I would’ve turned that weakness into my greatest strength.
But sadly, you never did.
Still, I find a strange peace in knowing…
at least you’re not going back to that bastard again.
And maybe—just maybe—
that means I still have a chance
sweetheart.”
চিঠিতে আংটিটা সম্পর্কে কোনো কিছুই লেখা ছিল না।
কায়ানের এই আচরণ—এ যে পাগলামি, রাহির তা বোঝা দায়।
কায়ানের প্রতি তার মনে কোনো অনুভূতি নেই, কোনো টান নেই। তবুও কীভাবে কায়ান—একজন জটিল, দুর্ধর্ষ পুরুষ—কেনো তার প্রতি এতটা দুর্বল হয়ে পড়লো, সেটা রাহির বোধগম্য নয়।
হয়তো এটা কায়ানের নতুন কোনো খেলা, নতুন কোনো ফাঁদ।
আংটি বা চিঠি—কোনোটাই সে সাথে আনেনি।
আনবে কেমন করে? এসব নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
অসম্ভব!
পোড়া বাড়িটা যেন একেবারে ভূতুরে—চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংস, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, আর নিঃস্তব্ধ অন্ধকার।আলো নেই, শব্দ নেই—শুধু নিস্তব্ধতায় লুকিয়ে আছে অজানা কিছু।
আরহান জানতো, কায়ান যখন ডেকেছে, জায়গাটা এমনই হবে—অস্বাভাবিক, শহর থেকে অনেক দূরে, নির্জন ও রহস্যময়।
শহরের কোলাহল থেকে কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে এই ভাঙা বাড়ি।
আরহান চুপচাপ চারপাশে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো।তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সজাগ। যেন এক মুহূর্তেই সব অনাকাঙ্ক্ষিত যেনকোনো কিছু চিহ্নিত করে ফেলবে। তারপর সে ধীরে ধীরে সামনে থাকা পুরনো, ধুলোমাখা সোফায় গিয়ে বসল।
“হ্যালো, ব্রাদার।”
কায়ানের কণ্ঠ ভেসে এলো সিঁড়ির দিক থেকে—নরম, ঠান্ডা, কিন্তু ভেতরে লুকানো এক ধরনের খেলাচ্ছলে ভরা তীক্ষ্ণতা।
সে ধীরে ধীরে পা ফেলে নিচে নামছে, যেন প্রতিটি
ধাপ তার দাম্ভিকতার ছাপ রেখে যাচ্ছে।
ঘরটায় হালকা একটা হলুদ বাতি জ্বলছে—যথেষ্ট আলো শুধু একজনকে আরেকজনের মুখ স্পষ্টভাবে দেখার জন্য।
আলো-আঁধারির সেই পরিবেশে কায়ানের চোখে ঝিলিক, আর ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি।
আরহান তাকিয়ে আছে নীরবভাবে।
দুই ভাই—একটা নিঃশব্দ যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে শব্দের চেয়েও বেশি কাজ করছে চোখের ভাষা।
“তাহলে ফাইনালি—অফিসার আরহানের সাক্ষাৎ মিলেই গেলো!” তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললো কায়ান, “Feeling lucky.”
আরহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এই ধরনের ফাঁপা কথা তার সহ্যের বাইরে।
গলা কঠিন, মুখে কোনো আবেগ নেই—
“রাহি কোথায়?” —সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সে।
কায়ান ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়, “রিল্যাক্স। সে একদম ঠিক আছে।”একটু থেমে আবার যোগ করে, “পেনড্রাইভটা?”
আরহানের কণ্ঠ যেন বরফে মোড়া:
“আগে তোর লোকেরা রাহিকে আমার লোকেদের হাতে তুলে দেবে। তারপর... পেনড্রাইভ।”
কায়ান একটু হাসে, চোখে তার অদ্ভুত খেলা।
“You're so demanding, big brother…
Alright.”
বলেই কায়ান মোবাইলটা বের করে নিজের লোকদের ফোন করলো।
তার কল শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরহানের ফোন বেজে উঠলো—স্ক্রিনে রুদ্রের নাম।কল রিসিভ করতেই রুদ্র জানাল,
“রাহি এখন আমাদের কাছে। নিরাপদ। কোনো চিন্তা নেই।”
খবরটা শুনে আরহানের কপালের ভাঁজ কিছুটা মুছে গেলো।
কিন্তু কায়ান তখনো তার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছে— স্থির, ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে।
আরহান ফোনটা পকেটে রেখে ধীরে ধীরে কায়ানের চোখে চোখ রাখলো।
তার কণ্ঠে অদ্ভুত এক শান্ত ভাব, প্রতিটি শব্দ ধারালো।“কাকে বাঁচাতে চাইছিস তুই? কী উদ্দেশ্য তোর?”
কায়ান বিদ্রুপ করে হেসে উঠলো। সেই হাসির ভেতরটা যেন ঠান্ডা কিন্তু বিষ ছড়ানো।
“মানুষ বাঁচানো আমার কাজ না, ব্রাদার,”—ঠাণ্ডা গলায় বললো সে।
আরহান এবার খানিকটা ঝুঁকে এসে গাঢ় কণ্ঠে বললো,“তাহলে তোর কাজ কী? অন্যের পা চাটা?
এই পেনড্রাইভে যা আছে, সব প্রমাণ আহাদ মির্জার বিরুদ্ধে—তা আমি জানি, তুইও জানিস।
কিন্তু তোকে এতটা নাচাচ্ছে কে?”
এইবার কায়ানের চোখে আগুন জ্বলে উঠলো।
এভাবে কথা বলার সাহস আজ অবধি কেউ দেখায়নি তার সামনে।জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরহানের দিকে।
তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“ব্যাস এটুকুই? আহাদ মির্জা তো শুধু নামে ডন। কাজে? ঠনঠন... পুতুল। আর পুতুল তো নিজে নাচে অন্যকে নাচবে কি করে।”
আরহান এবার সোজা হয়ে বসল।
চোখে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ধীরে ধীরে বললো—
“তাহলে কে? কে আছে এই ছায়ার ভিতরে ?”
কায়ান শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো, “ আশরাফ মির্জা।”
আরহানের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
আশরাফ মির্জা—দেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ, যার নাম সরকারিভাবে অনেক আগেই ‘মৃত’ বলে ঘোষিত।
কিন্তু আসলে?
খাতা-কলমে মৃত হলেও, বিদেশের মাটিতে তার নতুন পরিচয় "মাফিয়া ড্রেক"—লুটপাট করা কোটি কোটি টাকা নিয়ে এখনো আরামে দিন কাটাচ্ছে।
তার পেছনে রয়েছে দেশের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নেপথ্য সহায়তা, ফলে এসব তথ্য শুধুই ‘ভিতরের লোকদের’ কাছেই সীমাবদ্ধ। বাইরের কেউ এর গন্ধটুকুও পায় না।
কিন্তু কায়ান? কতটুকু জানে সে?
এই প্রশ্নটা এখন ঝড়ের মতো বয়ে যাচ্ছে আরহানের ভেতর।
সে চোখ সরু করে কায়ানের দিকে তাকিয়ে ধীরে বললো—“আশরাফ মির্জা... সে তো সরকারি নথিতে মৃত...।”
কায়ান বিদ্রুপ করে হাসলো। চোখে ছিল অভিমান মেশানো এক কঠিনতা।
“সেসব নথির গল্প আমাকে বলে লাভ নেই, ব্রাদার,”—তার কণ্ঠে ছিল ঠাণ্ডা দৃঢ়তা।
“ওর সম্পর্কে সব আমি জানি। কোথায় আছে, কী করছে, সব। আমি জানি।”
আরহান গভীর দম ফেললো। এরপর ধীরে বললো,“তাহলে তুই বলতে চাস, এই সব কিছুর পেছনে আছে... আশরাফ মির্জা।”
কায়ান মাথা নাড়িয়ে বললো,
“পেছনে কে আছে, কে নেই—সেটা আমার বিষয় না। আমার একটাই টার্গেট—আশরাফ মির্জা অব্দি পৌঁছানো।”
আরহান ঠোঁটে এক চিলতে কঠিন হাসি টেনে বললো,“কীভাবে?”
“প্রতি বছর সে দেশে আসে, ভিন্ন পরিচয়ে। কখন আসে, কোথায় ওঠে—এই সব খবর রাখে একমাত্র আহাদ মির্জা। তাই এখন আমার দরকার তার বিশ্বাস।”কায়ানের কণ্ঠে ছিল নির্লিপ্ত বাস্তবতা।
আরহান ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলো,
“এই পেনড্রাইভ দিয়ে তুই আহাদ মির্জার বিশ্বাস অর্জন করতে চাস। কিন্তু আমি কেন তোকে পেনড্রাইভ দেবো? এতে আমার কী আসে যায়?”
কায়ান নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।
“না দিয়ে উপায় নেই,”—কায়ানের কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত নীরবতা।
আরহান তার কথাটিকে একেবারেই অগ্রাহ্য করে উঠে দাঁড়ালো। তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়—
“পেনড্রাইভ আমি দিচ্ছি না।”
এইবার কায়ান তাচ্ছিল্যের হালকা হাসি দিলো।
“জোর করে নিতে পারি... কিন্তু এইবার সেটা করবো না।”
এই অপ্রত্যাশিত উত্তর শুনে আরহান থমকে গেল। চোখে ছিল বিস্ময় আর কপালে এক রেখা চিন্তার।
তখনই কায়ান দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বললো—“আমাদের বাবার খুনি... আশরাফ মির্জা।”
ঘরে নেমে এলো হিম শীতল আবহাওয়া।
কায়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। চোখে জমে থাকা আগুন যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো তার কণ্ঠে।
“আমার সামনে… আমার সামনে দাঁড় করিয়ে ওই জানোয়ারটা আমার বাবাকে গুলি করেছিল।”
কায়ানের কণ্ঠ কেঁপে উঠলো, কিন্তু চোখে আগুন।
“বাবা আমাকে বলেছিল—চোখ বন্ধ কর কায়ান। কিন্তু আমি পারিনি…”
একটু থেমে কায়ান তীব্র গলায় বললো,
“ওর মৃত্যু না দেখে, আমি শান্ত হবো না। যত দিন বাঁচবো, এই আগুন আমার বুকের ভেতর জ্বলবে।”
আরহান কিছুক্ষণ চুপ করে কায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো, কিন্তু মুখে কিছু বললো না—শুধু হাতের মুঠোটা শক্ত করলো।
আরও পড়ুন: রূপকথার শহর! (পর্ব-২৩) | নবনী নীলা
0 Comments