ইচ্ছের প্রনয় সিজন-২|পৃথী আক্তার| পর্ব-১
আমার আম্মিকে বাঁচিয়ে দিন আপনারা। দয়া করে
আমার আম্মির অপারেশন টা বন্ধ করে দিবেন না।
এত নিষ্ঠুরতা করবেন না আমার সাথে।" করুন কোমল কন্ঠে বলে মেয়েটি অঝোরে কান্না করতে থাকে। আশেপাশে সবাই শুধু তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করছে । আবার কেউ শুধু তাকিয়ে আছে নিরবে।
মেয়েটির বুকফাটা কান্না গুলো যেন আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে।তার আর্তনাদ যেন বারি খাচ্ছে এই কনক্রিটের মতো দেয়ালের চারপাশে। প্রতিটি কান্না ধ্বনি যেন দেয়াল কে ও থমকে দিয়েছে। একেকটা ফোঁটা অশ্রুতে যেন ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকারিসেপশনের ব্যক্তিটি কঠোর হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
সে শুধু দেখে যাচ্ছে মেয়েটির করুন আর্তনাদ। মেয়েটি
এমন কান্নায় কি লোকটির মনে একটুও মায়া হলো না? তার বুকটা কি একটু কাঁপল না ? মানুষ কি
এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? কিন্তু সামনে দাঁড়ানো লোকটির মনে সত্যি কোনো মায়া হচ্ছে না।মেয়েটির এমন বুক ফাটানো আর্তনাদ তার অন্তরকে আত্মাকে স্পর্শ করলো না। মেয়েটির এমন করুণ আর্তনাদ দেখেও লোকটি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছে আছে।একসময় লোকটির ধৈর্যের বাঁধ ছিঁড়ে গেল। মুখ- চাপলে একটা তীব্র বিরক্তি আর ক্রোধের ছাপ দেখা গেল। হঠাৎ মুখ খুলে সে কণ্ঠস্বর জোরালো করে বললেন,
“চুপ করো! একদম চুপ! এত ফেঁচ-ফেঁচ করে কান্নাকাটি করছো কেন?আশেপাশে অনেক পেশেন্ট আছে যাদের তোমার এই কান্নার জন্য অস্বস্তি হচ্ছে।"
লোকটি একটু থেমে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে এবার কঠিন কন্ঠে বললেন,
"অ্যাই মেয়ে কি যেন নাম তোমার, ইচ্ছে তাই না? দেখো ইচ্ছে এটা কান্নাকাটি করার জায়গা না। টাকার ব্যবস্থা কর অপারেশন হয়ে যাবে সেই তখন থেকে বলছি। তারপরও কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করছে।
লোকটির এমন গম্ভীর, কঠিন আর ধারালো কথায় ইচ্ছে এক মুহূর্তে জন্য কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটায় যেন কেউ পাথর চেপে ধরল। অশ্রু ভেজা চোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে সে আবার মিনতির সুরে বলল,
"আঙ্কেল, দয়া করে একটা ব্যবস্থা করে দিন না অপারেশনের। আমি তো টাকা জমা দিয়েছি, পুরো টাকাটা হয়তো এখনো দিতে পারিনি, কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়ি বাকিটা দিয়ে দেব। প্লিজ, আমার মায়ের অপারেশনটা বন্ধ করবেন না। দয়া করে…"
"না, আগে পুরো টাকা জমা দাও। এটা হসপিটাল স্বেচ্ছাসেবা কেন্দ্র নয়, বুঝেছো? উপমহলের কঠিন নির্দেশ আছে—পুরো টাকা ছাড়া অপারেশন হবে না।"
লোকটির কথায় এবার ইচ্ছের ভীষণ রাগ হলো।
একদিকে মায়ের জীবন হাতে নিয়ে হসপিটালের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্তরটা পুড়ে খাঁ খাঁ করছে।
আর অন্য দিকে লোকটির কথা ওর অন্তর আত্মাকে
যেন আরো পুড়িয়ে দিলো। সেই সাথে সুপ্ত একটা
রাগ এসে হানা দিলো মস্তিষ্কে। কতক্ষন ধরে বুঝালো
সে ,পুরো টাকাটা জমা দিবে । কিছুদিন সময় দিতে।
হাতে এখন এত টাকা নেই। টাকা জোগাড় করতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এরা পুরো টাকাটা চায়। টাকা ছাড়া নাকি অপারেশন করবে না। হায়রে পৃথিবী! মানুষ
এতটা নিষ্ঠুর ।
কীভাবে পারে মানুষ এতটা পাথর হতে?
কীভাবে পারে কেউ এমন সময়েও টাকার অঙ্ক মেলাতে? এরা কি মানুষ?
ইচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। প্রচন্ড রাগ লাগছে
কিন্তু সেই রাগ চাপা দিয়ে, চোখের অশ্রু দুহাতের সাহায্যে মুছে নিজেকে শক্ত করে নিল। কারণ ও জানে, এখন দুর্বল হলে চলবে না। তবুও ভেতর থেকে যেন
তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।
"আচ্ছা আঙ্কেল, তাহলে আমাকে হসপিটালের ঊর্ধ্বতন কারও সাথে কথা বলিয়ে দিন।আমি অথরিটির সাথে কথা বলবো। প্লিজ, আমাকে ওনাদের কাছে নিয়ে যান।"
লোকটি এবার ইচ্ছের কথায় একটু থমকে গেল। এই মেয়ে তো দেখছি আমাকে পাগল বানাবে। অসহ্য কর!
হাতে টাকা পয়সা নেই অথচ আসছে অপারেশন করুন
অপারেশন করুন বলতে। আবার কিনা অথরিটির সাথে কথা বলবে। আরে ,তারা কি বসে আছে নাকি
কারো দুঃখ শোনার জন্য। লোকটি এবার বিরক্ত মুখে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
"আবার শুরু করলে? এসব নাটক করে কোনো লাভ হবে না মেয়ে।উপরে যাবার দরজা কি সবার জন্য খোলা থাকে নাকি? তুমি এখন এখান থেকে যাও।
বিরক্ত করো না তো।
লোকটির কথায় ইচ্ছের এবার খুব অপমানিত বোধ করলো, দাঁতে দাঁত চেপে একটু কঠিন গলায় বলল,
"আমি কারো কাছে ভিক্ষা চাইছি না। আমি আমার মায়ের প্রাণ বাঁচানোর কথা বলছি।একজন রোগীর পরিবার হিসেবে আমার অধিকার আছে।
আপনি ব্যবস্থা করুন। আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।
লোকটি এবার স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলল,
"আরে মেয়ে, বুঝতে পারছো না কেন? এই সময় কারও সঙ্গে দেখা করা—"
লোকটা বাক্য শেষ করতে পারল না।ঠিক তখনই বাইরে কোলাহলের আওয়াজ ভেসে আসলো। কেমন যেন গমগম করছে চারপাশে।
"কি হয়েছে বাইরে এমন শোরগোল হচ্ছে কেন?" ইচ্ছে কৌতুহল দমাতে না পেরে একটি নার্সকে জিজ্ঞাসা করল।
"আরে আপনি জানেন না আজ আমাদের হাসপাতালে
ভিআইপি'র এন্ট্রি হয়েছে।#ডক্টর_আহাদ_সরকার। আমেরিকা ফেরত। শুনেছি উনি নাকি দেশ-বিদেশের টপ কার্ডিয়াক সার্জনদের মধ্যে একজন।আর দেখতে? উফ্… আমি তো সোজা প্রথম দেখাতেই ক্রাশ খেয়ে গেছি।
ইচ্ছে নার্সটির কথাটা শুনে হঠাৎ থমকে গেল।
আহাদ সরকার—নামটা তার কাছে নতুন না। অনেক শুনেছে লোকের মুখে। বিশেষ করে ইয়ং জেনারেশনের
মানুষের কাছে। তাকে নাকি সবাই হার্টের ম্যাজিশিয়ান বলে । কিন্তু ইচ্ছে তাকে আজ পর্যন্ত একবারও দেখেনি। শুধু লোকের মুখেই শুনে গেছে। কথাগুলো
ভাবতে ভাবতে ঠিক তখনই ইচ্ছের চোখ পড়ে,
সুঠামদেহী একজন লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে এই দিকে। পড়নে হোয়াইট শার্ট আর ব্ল্যাক ডেনিম প্যান্ট ইন করা।গলায় ঝুলে আছে স্টেথোস্কোপ। হাতে ব্ল্যাক কালারের ওয়াচ। চুলগুলো হালকা এলোমেলো, তবে পরিপাটি। ধূসর রাঙা চোখদুটি যেন তীক্ষ্ণ ধারালো তবে খুব শীতল ।
পাশে দু চারজন ডাক্তার ও নার্স আছে। ইচ্ছে তাকিয়ে থাকলো ব্যক্তিটির দিকে।
তবে এই মানুষটিই কি ডক্টর আহাদ ?
ইচ্ছের চোখে মুখে হঠাৎ একফালি আশার আলো জেগে উঠল। উনি তো একজন অনেক বড় ডক্টর।
আমার অসুবিধার কথা বলবো উনাকে? আবার
বুকের ভেতরে চাপা প্রশ্ন এসে ধরা দিলো,
উনি কি শুনবেন আমার কথা? নাকি এক নিমিষেই আমার সমস্ত আশার আলো নিভিয়ে দিবেন?তবে
কি আমি আর আম্মিকে বাঁচাতে পারবো না? ইচ্ছের
বুকের ভেতরটা ধক করে কেঁপে উঠলো। বুকের
প্রান পাখিটা যেন হাহাকার করছে। কি হবে ওর নিয়তি? নাকি মাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যাবে?
গোধূলি লগ্ন, আকাশ যেন আজ ঘন কালো মেঘের আবরণে আবৃত।গোধূলির সোনালী লালচে আভা বিলীন হয়ে কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।থেকে থেকে মেঘের তীব্র গর্জনে আকাশ যেন বারি খেয়ে আলোর রশ্মি ফেলছে।
সাথে বাতাসের তাণ্ডব যেন ধরনীর বুকে আছড়ে পড়ছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই অঝোর ধারায় বর্ষণ নামবে পৃথিবীর বুকে।
এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশের মাঝে রাস্তার এক প্রান্ত দিয়ে ধীরে ধীরে আনমোনা হয়ে হেঁটে যাচ্ছে ইচ্ছে।
তার পা দুটো যেন নিজের ইচ্ছেতে চলতে চাইছে না। শরীরটা কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে।কোনো এক অন্যমনস্ক ঘোরের মধ্যে চলছে সে।চারপাশে কি হচ্ছে, সেদিকে তার ধ্যান নেই। মনটা যেন বিষন্নতায় ছেঁড়ে গেছে।দুপুরের কথা গুলো মনে পড়তেই তার অন্তরটা পুড়ে গেলো। নিজেকে এখন কেমন যেন ছন্নছাড়া অযোগ্য মনে হলো। আবার সাথে খুব রাগও উঠলো।
Flashback.
ইচ্ছে যখন চোখমুখে আশার আলো নিয়ে আহাদের সাথে কথা বলতে যাবে ভেবে সামনে এগোয় ঠিক তখনই একজন নার্স ইচ্ছের হাত ধরে আটকে দেয়।
"আরে আপনি ঐ দিকে কোথায় যাচ্ছেন ? ঐ দিকে
এখন যাওয়া যাবে না। বড় স্যার এসেছেন।"
"আমি একটু আ....... আহাদ স্যারের সাথে কথা বলতে চাই।"
নার্সটি ভ্রু কুঁচকে ইচ্ছের দিকে তাকায় । এরপর সূচালো
চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বললো,
" আহাদ স্যারের সাথে কি দরকার আপনার? তাছাড়া উনি এখন কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না এখন উনার একটা ওটি আছে।"
"আমি বেশি সময় নেব না। আমাকে শুধু একটু সময় দিন। আমি অল্প কিছু কথা বলবো উনার সাথে।"
নার্সটি এবার ইচ্ছের কথায় বিরক্ত হলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
"আরে বাপু বলছি তো উনি এখন ওটি রুমে যাবেন।
ভি আই পি পেশেন্ট । কিছু একটা হয়ে গেলে পেশেন্টের বাড়ির লোক আমাদের হসপিটালকে দুমিনিটে ধূলিসাৎ করে দিতে সময় নিবে না। আপনি
বরং পরে উনার সাথে কথা বলুন" বলে নার্সটি মুখ
ঝামটা দিয়ে চলে যায়।
ইচ্ছে নার্সটি'র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস
ছাড়লো। মনে হলো এরা নার্স না, এরাই ডাক্তার।
মনে মাঝে থাকা আশার আলো এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। তবুও ইচ্ছে হাল ছাড়লো না হয়তো আহাদের সাথে একটু কথা বলতে পারবে ভেবে।
"ভাইয়া, আহাদ স্যার ওটি থেকে বের হলে তাকে একটু বলবেন আমি তার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।"ইচ্ছে একজন ওয়ার্ডবয় কে বললো।
ওয়ার্ডবয়টি ইচ্ছে মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
"ঠিক আছে আপু আপনি অপেক্ষা করুন আহাদ স্যারের অপারেশন শেষ হলে আমি উনাকে জানিয়ে দেব।"ইচ্ছে লোকটির কথায় একটু স্বস্তি পেল ।
কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর যখন ওয়ার্ডবয় এসে জানায় আজ নাকি ডঃ আহাদ কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না। তিনি নাকি এখন বাড়ি ফিরে যাবেন
সেই মুহূর্তে ইচ্ছে সমস্ত আশা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।
সাথে প্রচন্ড রাগও উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির
করে বললো,
"সেই কখন থেকে চাতক পাখির মতো বসে আছি
শুধু একটু কথা বলবো বলে । কতটা সময় অপেক্ষা
করলাম । আমার সময়ের মূল্য এরা একটুও দিলো না। বরং আমার সাথে উপহাস করলো বলে ইচ্ছে
মায়ের কেবিনে গেল মা'কে দেখতে। এটা কোনো ভি আই পি কেবিন না। এখানে ইমার্জেন্সির সব রোগী ভর্তি করা হয়। ইচ্ছের মায়ের কেবিনটা অনেক বড়ো। অনেক গুলো বেড পাশাপাশি আছে। ইচ্ছে গেল ২০৩ নং বেডে যেখানে ওর মা'র দেহটা নিথর হয়ে পড়ে আছে।চোখের পাতা দুটি বন্ধ, মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে।ইচ্ছে ওর মায়ের হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
"আম্মি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? আরেকটু কষ্ট করো আমি খুব দ্রুত তোমার অপারেশনের ব্যবস্থা করবো। তুমি সুস্থ্য হয়ে যাবে আগের মতো। তারপর তুমি আবার আমাকে জরিয়ে ধরবে। আমাকে আদর করবে। ও আম্মি বলোনা তুমি আমাকে আদর দিবে তো? আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি জানি আমার আম্মি আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবে না। আবার আমাকে আদর করবে বলে ইচ্ছে ঠোঁটে মলিন হাসি হাসলো। ওর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে কপোল বেয়ে। পাশের বেডে থাকা মানুষগুলো তাকিয়ে আছে তার দিকে।ইচ্ছের কষ্টগুলো যেন তারাও অনুভব করতে পারলো। ইচ্ছে আর না দাঁড়িয়ে কেবিনে ছেড়ে বাইরে চলে গেল ।
Flashback end.
"এই মেয়ে! দেখে শুনে চলতে পারো না? রাস্তায় হাঁটাচলা করতে শেখোনি নাকি? মন কোথায় নিয়ে হাঁটো?"
ভাবনা গুলো ভাবতে ভাবতে আকস্মিক কারো সাথে ইচ্ছের ধাক্কা লাগে। চেতনা ফিরে পায় মস্তিষ্কে। সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয় হতে তার দিকে তাকায় সে । একজন মাঝবয়সী নারী
তাকে উক্ত ঝাঁঝ মিশ্রিত কথাগুলো বলেছে।
"আমি দুঃখিত! আমাকে ক্ষমা করবেন।" ইচ্ছে খুব
কোমল নম্র স্বরে বললো।
মহিলাটি ইচ্ছের কথার তোয়াক্কা করলেন না। ইচ্ছে দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হনহন করে সেখান থেকে চলে গেলেন। ইচ্ছে মহিলাটি যাওয়ার দিকে তাকিয়ে
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবার আশেপাশে একবার চোখ বুলালো। ঢাকার এই ব্যস্ত নগরীতে প্রত্যেকে যে যার মতো ছুটে চলছে। পাশে দিয়ে গাড়ি চলছে শোঁ শোঁ
শব্দ করে। ইচ্ছে তাকিয়ে থাকলো একদৃষ্টিতে। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় কমে যেতে লাগল। হুট করে আকাশ গর্জন দিয়ে প্রবল বেগে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো।আশেপাশের মানুষজন যে যার যার মতো দৌড়ে আশ্রয় নিতে ছুটে গেল। শুধু ইচ্ছে দাঁড়িয়ে রইলো বৃষ্টির মাঝেই। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি গুলো যেন ওর সারা শরীরকে ভিজিয়ে দিল মুহূর্তেই। শরীরকে করে তুললো শীতল কিন্তু মনটা যেন আরও বেশি ভারী হয়ে উঠলো। কেমন একটা অজানা আতঙ্ক আর কষ্ট মিলেমিশে বুকের ভেতর জমাট বাঁধতে শুরু করলো। ইচ্ছে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো। এবার আর পারলো না নিজেকে ধরে রাখতে। হাও মাও করে কাঁদতে লাগলো । তার বিন্দু বিন্দু অশ্রু গুলো বৃষ্টির পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
এই জনবহুল ব্যস্ত ঢাকা শহরের একটি ছোট গলির মোড়ে ইচ্ছের বড়ো হয়ে উঠা। বয়স এখন আঠারোর
কোঠায়। ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে সে। এখন ও ফলাফল
প্রকাশিত হয়নি।মাকে নিয়ে ছোট একটি বাড়িতে থাকে সে। অবশ্য বাড়িটা তাদের নিজস্ব। বাবাকে সে
কখনো দেখেনি। ছোট বেলা থেকে মায়ের কাছে শুনে এসেছে বাবা নাকি দূর আকাশে চলে গেছে।
ইচ্ছের মা আয়শা রহমান একজন হাই স্কুল শিক্ষিকা।
দিন রাত এক করে শুধু মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তিনি।উনি কিছুটা চাপা স্বভাবের। তাই তো নিজের শরীরের অবস্থা যে দিন দিন খারাপ হচ্ছে তা ইচ্ছেকে একটুও বুঝতে দেননি। একদিন ঘর পরিষ্কার করতে যেয়ে কিছু কাগজপত্র চোখের সামনে পড়তে থমকে যায় ইচ্ছে। যেখানে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল তার মায়ের হার্টের রোগ সম্পর্কে। ইচ্ছে তার মাকে বললেও তিনি হাসি মুখে বিষয়টি এড়িয়ে চলেছেন। আর চার পাঁচ দিন আগে তার শরীর হঠাৎ করে খারাপ হতে শুরু করে আর তিনি সেন্সলেস হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। ইচ্ছে এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় মায়ের নিথর দেহটা দেখে। দিশেহারা হয়ে স্থানীয় কিছু লোকদের সাহায্যে তাকে হসপিটালে ভর্তি করে। একজন ডাক্তার জানায় ইমিডিয়েটলি অপারেশন করতে হবে। এবং একটা বিল পেপার দেয় যেখানে অপারেশনের যাবতীয় খরচপাতির হিসাব লেখা আছে।আজ তার মায়ের অপারেশনের ডেট ছিল। ইচ্ছে ঘরে যা ছিল সব টাকা দিয়ে দিয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ না করার জন্য তার মায়ের অপারেশনটা বন্ধ হয়ে আছে।কতবার রিকোয়েস্ট করার পরও তারা অপারেশন করতে চাইছে না। কোনো মানুষের জীবনের আগে কি টাকায় আসল ?হয়তো টাকায় মানুষের প্রানে'র থেকে বেশি মূল্যবান নয়তো সামান্য কিছু টাকার জন্য এভাবে অপারেশন বন্ধ হয়ে যেত না। এখন বাকি বাকি টাকাটা কোথায় থেকে জোগাড় করবে ভেবে ইচ্ছের নিজেকে দিশেহারা লাগছে। বার বার চোখের সামনে মায়ের সুন্দর মুখটা ভেসে উঠছে। চোখের পানি গুলো গড়িয়ে পড়ছে তার কোমল কপোল বেয়ে নাটকা লাল টকটকে হয়ে গেছে।
ইচ্ছে কন্দনরত অবস্থায় তার মালিককে জানায়,
"হে আল্লাহ! আমাকে কেন এত দুঃখ দিলে?তুমি তো জানো দেখো সবকিছু। তাহলে কেন করছো আমার
সাথে এরকম? কেন আমার আম্মিকে কেড়ে নিতে চায়ছো? আম্মি ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই।
আমার আম্মি'কে নিয়ে যেও না তুমি। তাকে সুস্থ্য করে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও না তুমি।আমাকে এতিম করে দিয়ো না" বলতে বলতে ইচ্ছে দুহাত তুলে আরো জোরে কান্না করলো। কন্ঠস্বরটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে এলো । বৃষ্টির পানিতে তার কান্নার অশ্রু গুলো
মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
প্রবল বেগে ঝড়ো হাওয়া সাথে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা
পানিতে রাস্তাগুলো যেন মুহূর্তেই পাল্টে গেছে।
রাত নামেনি, অথচ আকাশের রঙ দেখে মনে হচ্ছে বহুক্ষণ ধরে অন্ধকার। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটায় চারপাশে কেমন স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। এমন সময়
শোঁ শোঁ করে ছুটে চলছে বিএমডব্লিউ মডেলের গাড়ি।
হেডলাইটের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে ভিজে থাকা কংক্রিটের রাস্তা। আহাদ এক মনে গাড়ি ড্রাইভ করছে। মুখটা কেমন থমথমে। কিছুক্ষণ আগে হসপিটালে থেকে বেরিয়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এসেছিলো হসপিটালে ওটির জন্য। নয়তো বাড়িতে আগে যেত।দীর্ঘ পাঁচবছর পর দেশে ফিরেছে সে । অকস্মাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলোতে রাস্তার পাশে একটি ছায়ামূর্তি দেখে থমকে যায় আহাদ । বৃষ্টির কারণে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। মনে হলো কেউ বসে আছে ।আহাদ দ্রুত ব্রেক চাপলো। এবং তার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করতে দেখতে পেল একটি মেয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আছে ।আশেপাশে কেউ নেই পুরো থমথমে পরিবেশ। এমন সময় মেয়েটিকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখে ও ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল।
"Strange.... এই প্রবল বৃষ্টির মাঝে মেয়েটি এভাবে বসে আছে কেন? মেয়েটি কি পাগল.... নাকি?"
আহাদ গাড়ির ডোর খুলে ছাতা হাতে নিয়ে বাইরে দাঁড়ালো। সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টির ঝাপটা এসে শরীরের লাগলো। ছাতা মাথায় নিয়ে
মেয়েটির সামনে দাঁড়াতে ঠিক তখনই ,
"আম্মু… আমাকে ছেড়ে চলে যেয়ো না… প্লিজ…”
এই ফিসফিস করে বলা কথাটুকু অস্পষ্ট শুনতে পেল। আহাদের ভ্রু কুঁচকে গেল। মেয়েটি হাঁটু মুড়ে মাথা গুঁজে বসে আছে যার দরুন মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। শুধু চুল গুলো দেখা যাচ্ছে যেগুলো মেয়েটির মুখটা কে আড়াল করে রেখেছে।
"হেই মিস… আপনি ঠিক আছেন? এই বৃষ্টির মাঝে এখানে এভাবে বসে আছেন কেন? এনি প্রবলেম?"
অকস্মাৎ কোনো পুরুষালি কন্ঠে ইচ্ছে চমকে গেল।
বুকের ভেতর ধক করে উঠলো অজানা আশঙ্কায়।
ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাতে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির পা দুটো দেখতে পেল। এরপর আরো একটু মাথা উঁচু করে তাকাতে দেখতে পেল একজন সুঠামদেহী পুরুষ যিনি ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা অন্ধকার ও বৃষ্টির কারণে পুরুষটির মুখখানা দেখা যাচ্ছে না। কান্নার কারণে চোখ দুটো ফুলে কেমন যেন ব্যাথা করছে। ইচ্ছে আবার পুরুষটির মুখে দিকে তাকাতে ঠিক তখনই বজ্রপাতের আলোক রশ্মি পড়তে চমকে উঠে সে। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিটির মুখ আবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই মুহূর্তের জন্য থমকে যায় । বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেড়িয়ে আসলো,
"আহাদ স্যার......"
আরও পড়ুন: ইচ্ছের প্রনয় সিজন-২|পৃথী আক্তার| পর্ব-২
0 Comments