ইচ্ছের প্রনয় সিজন-২|পৃথী আক্তার| পর্ব-২

ইচ্ছের প্রনয় সিজন-২|পৃথী আক্তার| পর্ব-২

“বড়ো আব্বু, জানো দাদা ভাই আজ দেশে ফিরেছে।”

ছেলেটি উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল।

“জানি মেহতাব।”

আসাদ সরকার চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলে আবার চায়ে চুমুক দিলেন।

মেহতাব একটু হকচকিয়ে গেল। মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।ভেবেছিলাম ভাইয়া ফিরে এসেছে বলে বড়ো আব্বুকে চমকে দিব। অথচ ইনি আগেই জেনে আছেন। ধুর্ ভাল লাগে না। মেহতাব'রে তোর ফাটা কপাল।


“কে ফিরেছে রে মেহতাব? কার কথা বললি তুই?”

মিসেস আফিয়া সরকার মেহতাবকে জিজ্ঞেস করলেন।

“বড়ো মা, আসলে....... আসলে দাদা ভাই ফিরে এসেছে।”

মেহতাব মিসেস আফিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো।

“কী-হ্! ভাইয়া ফিরে এসেছে!!!!!”

বলে একটি মেয়ে চিৎকার করে উঠলো। সবাই মেয়েটির দিকে তাকাতে মেয়েটি একটু থতমত খেয়ে গেল।

“মিশু, আস্তে! কানের পর্দা তো মনে হয় ফেটে গেল।”

মিশি মেহতাবের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিলো। এরপর সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললো—

“সত্যি ভাইয়া এসেছে? তাহলে অনেক মজা হবে।

অ্যাই মেহতাব ভাইয়া, আহাদ ভাইয়া কোথায়?”

বলে মিশি মেহরাবের দিকে তাকালো।

কিছু একটা ভাবতেই চোখ বড় বড় করে সন্দিহান কণ্ঠে বললো—

“অ্যাই মেহতাব ভাইয়া, ভাইয়া কি সত্যি এসেছে? নাকি তুমি আবার মজা করছো ?”

“তোর কি মনে হয় আমি মজা করছি?”

“করতেই পারো। এর আগে তো অনেকবার করেছো। এখন যে করছো না তার কি সত্যতা আছে?”

“না, আমি মজা করছি না। আর প্রসঙ্গ যখন দাদা ভাইকে নিয়ে  তখন আমি করবো মজা ভাবলি কি করে? দেখেছিস কখনো দাদা ভাইকে নিয়ে এমনি এমনি কথা বলতে ? দাদা ভাই সত্যিই এসেছে। গাধি একটা!”

মেহতাব দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

‘গাধি’ বলায় মিশি'র রাগ লাগলেও কিছু বললো না। কারণ এখন ওর মন আনন্দে নেচে উঠছে। 

“উফ্ কতদিন পর ভাইয়া আসবে।”

“কিন্তু আহাদ কোথায়? এখনো তো বাড়ি ফিরলো না 

বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ছেলেটা যে কোথায় আটকে রইলো!”

মিসেস আফিয়া চিন্তিত কণ্ঠে বললেন। মায়ের মন

সন্তানের জন্য তো চিন্তা করবে।

“আহাদ হসপিটাল থেকে কিছুক্ষণ আগে বেরিয়েছে, বুবু। হয়তো খুব শিগগিরই ফিরবে। আমি রাফাতের সাথে কথা বলেছি।”

বলতে বলতে আসিফ সরকার বসার ঘরে ঢুকলেন।

“তুমি চিন্তা করো না তো আপা। দেখবে, ছেলে ঠিকভাবে ঘরে আসবে।”মিসেস মিলি বলে উঠলেন।

কিন্তু তার ভেতরেও একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে আহাদকে নিয়ে। ছেলেটাকে যে তিনি খুব ভালোবাসেন।

“তোমরা চিন্তা ভাবনা না করে সবকিছু গোছগাছ করো। ছেলেটা এতদিন বাদে দেশে ফিরেছে। রান্নার আয়োজন করো। আর অ্যাই রহিমা, তুই আহাদের ঘর পরিষ্কার করে রাখ।”

“ঠিক আছে মেজো সাহেব।”

আর সবাই যে যার কাজে লেগে পড়লো। এতদিন পর 

ঘরের ছেলে ঘরে ফিরছে ত্রুটি কি আর রাখা যায়।

“আসিফ, তুই এবার ঘরে গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নে।

তোর শরীর ভিজে গেছে। আর আকাশকে বল, আমি তাকে ডাকছি।”

আসাদ সরকার বলে উঠলেন।

“ঠিক আছে ভাইয়া, আমি বলে দিব।”

বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন আসিফ সরকার।

আসাদ সরকার গম্ভীর মুখে বসে থেকে তার  ঘরে চলে গেলেল । তার মনের ভেতরেও চিন্তা হচ্ছে আহাদের জন্য। আহাদ যে আজ দেশে আসবে, সেটা সে আগে থেকেই জানতো। আহাদ নিজেই তাকে বলেছে।

সাথে আহাদের ওটি সম্পর্কেও বলে রেখেছে। আর কাউকে কিছু না জানাতে সবাই কে চমকে দেবে বলে তাই তিনি চুপ ছিলেন।কিন্তু এই মেহতাব  বিবিসি নিউজ সব ফ্ল্যাশ করে দিলো।


সরকার পরিবার....

সরকার পরিবার প্রধান ছিলেন আরিফ সরকার,

যিনি এখন মৃত। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে।


বড় ছেলে আসাদ সরকার ও তার স্ত্রী আফিয়া সরকার।

তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।

ছেলে আহাদ সরকার ও মেয়ে মিশি সরকার।


আহাদ—৩১ বছর। উনিশ বছর বয়স থেকে আমেরিকা থেকেছে। ওখান থেকে ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করেছে। অনেকবার দেশেও এসেছে।

শুধু গত পাঁচ বছরে দেশে আসতে পারেনি ব্যক্তিগত কিছু কারণে। এখন ঢাকা মেডিকেলে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে থাকবে।

মিশি—১৮ বছর। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছে।


মেজো ছেলে আসিফ সরকার ও তার স্ত্রী মিলি সরকার।

তাদের দুই ছেলে।

বড় ছেলে মেহতাব ও ছোট ছেলে আফনান।

মেহতাব—২৮ বছর। পারিবারিক ব্যবসায় নিযুক্ত।

আফনান—২৫ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সাথে পারিবারিক ব্যবসাও দেখে।

ছোট ছেলে আকাশ সরকার ও তার স্ত্রী রাজিয়া সরকার।

তাদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে।

বড় ছেলে দিগন্ত ও মেয়ে তিনজন হলো—

রুশা, তুশা, তুলি।


দিগন্ত—২৩ বছর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে।

রুশা-তুশা—১৭ বছর। জমজ। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার পড়ে।

তুলি —৬ বছর। প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।

আর মেয়ে সাবরিনা-তার স্বামী নুহাশ। তাদের এক মেয়ে সাবা।

সাবা—২৫ বছর। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন ডাক্তার।

“আহাদ স্যার......”

মেয়েটির মুখ থেকে নিজের নাম শুনে কিছুটা থমকে গেল আহাদ।

মেয়েটি কি ওকে চেনে? হয়তো চেনে। চারপাশে আরো বেশি ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আসছে।

বৃষ্টির ঝাপটা যেন আরো বেশি লাগছে শরীরে।

ইচ্ছের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। আহাদ প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফ্ল্যাশলাইট অন করে ইচ্ছের মুখের দিকে তাক করলো।

ইচ্ছে লাইটের আলোয় চোখগুলো খিচে বন্ধ করে নিলো।

আহাদ তা টের পেয়ে মুখ থেকে ফোনটা সরিয়ে নিলো।


“আপনি এই বৃষ্টির মাঝে এখানে বসে আছেন কেন?

আপনি কি কোনো বিপদে পড়েছেন?” আহাদ আবার ইচ্ছেকে জিজ্ঞেস করলো।

আহাদের কণ্ঠস্বর শুনে ইচ্ছে একটু কেঁপে উঠলো।

সারা শরীর ভিজে থাকার কারণে প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগছে।

সাথে শরীরটাকে আরো বেশি কাঁপুনি তুলে দিচ্ছে। আহাদ সেটা টের পেলো।ইচ্ছে তাকিয়ে আছে আহাদের দিকে।ইচ্ছের মনে আবার আশার আলো জেগে উঠলো।হয়তো এবার আল্লাহ তার সহায় হয়েছেন।

তাই তো আহাদ নিজেই তার কাছে হাজির হয়েছে।

ইচ্ছে আহাদকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ইচ্ছের মুঠো ফোনটা বেজে উঠলো।ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিতেই তার ভেতরটা কেঁপে উঠলো।

হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে!

হঠাৎ হসপিটাল থেকে কেন ফোন আসলো ইচ্ছে বুঝতে পারলো না।

অজানা ভয় জেঁকে ধরলো মনে।

কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই  সমস্ত দুনিয়া উল্টে গেল।

“আম্মিই!!!!” বলে  আকাশ কাঁপানো এক চিৎকার বেরিয়ে এলো ইচ্ছের কণ্ঠস্বর থেকে।চারদিকটা হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের ঝড়, পৃথিবীর সমস্ত আওয়াজ সবকিছু যেন মুহূর্তেই থেমে গেল ওর কাছে।নারী কণ্ঠে বলা কথাটি ইচ্ছের কানে যেন তীক্ষ্ণ ছুরির মতো বিঁধে গেল।


“আপনার আম্মু আর বেঁচে নেই।”

এই সর্বনাশী কথাটি ইচ্ছের ভেতরে তোলপাড় সৃষ্টি করলো।মস্তিষ্কের সব নার্ভ গুলো মনে হয় বন্ধ হয়ে এলো।ইচ্ছের শরীরটা ছেড়ে দিল।চারপাশটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে এলো।

মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তেই আহাদ ইচ্ছের বাহু আঁকড়ে ধরলো।

ইচ্ছে সমস্ত ভর আহাদের উপর ছেড়ে দিলো।

ইচ্ছের মুখের এমন চিৎকার শুনে আহাদ আঁতকে উঠেছিল।

বুঝে উঠতে পারলো না ঠিক কী হয়েছে।

কিন্তু ঠিকই অনুমান করতে পারলো— নিশ্চয় কোনো খারাপ কিছু হয়েছে।

এমন সময় ইচ্ছের শরীর অস্বাভাবিক হতে দেখে বুঝতে পারে মেয়েটি এবার হয়তো পড়ে যাবে।ঠিক তাই হলো।

আহাদ সাথে সাথে ইচ্ছের বাহু আঁকড়ে ধরে। আর ইচ্ছে আহাদের বুকের উপর পড়ে।

“ওহ্ শিট! মেয়েটি সেন্সলেস হয়ে গেছে। পালস খুব স্লো... ড্যাম ইট!

এভাবে বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। একেতো ভিজে শরীর, তার উপর আবার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এভাবে থাকলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।”

আহাদ ইচ্ছের পালস চেক করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো। এরপর ,

ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ির ভেতরে শুইয়ে দিলো।আর হিটার অন করে দিলো, যেন একটু হলেও শরীরে উষ্ণতা লাগে।

আহাদ গাড়ি থেকে বেরিয়ে মাটিতে থাকা ফোনটির দিকে দৃষ্টি যেতে ফোনটি হাতে নিলো।

সেখানে থাকা নাম্বার দেখে আহাদের বুঝতে বাকি রইলো না, কলটি কোথা থেকে এসেছে। 


আহাদ আবার দ্রুত গাড়ির ভেতরে উঠলো আর ইচ্ছের জ্ঞান ফেরানোর জন্য চেষ্টা করলো।

কিছুক্ষণের মাঝে ইচ্ছের সেন্স আসতেই আহাদ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

“আ....আম্মি.....”   বলে ইচ্ছে পিটপিট করে চোখ খুললো। এরপর হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে।

“আ....আম্মি...... আম্মি... আমি আম্মির কাছে যাবো।

আম্মি আমাকে ডাকছে।

আম্মি দাঁড়াও, আমি... আমি এক্ষুনি তোমার কাছে আসছি।”

ইচ্ছে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে গাড়ির দরজা খুলতে যায়।

আহাদ আঁতকে উঠলো ইচ্ছের কার্যকলাপে।

মেয়েটির এখন মাথা ঠিক নেই। এই মুহূর্তে ওকে একা ছাড়া যাবে না— বলে ইচ্ছের হাত ধরে আটকে দিলো।


“অ্যাই, আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন?

আপনি কে? হ্যা?

আমার হাত ছাড়ুন।

আমি আম্মির কাছে যাবো।

আম্মি আমাকে ডাকছে।

দেড়ি হয়ে যাবে, আম্মি হয়তো চলে যাবে।

আ... আমাকে ছেড়ে দিন।

ছাড়ুন বলছি, ছাড়ুন।”

ইচ্ছে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে হাত মুচড়া'তে থাকে।

আহাদ ইচ্ছের পাগলামি দেখে ভর'কে গেল।

হালকা লাইটের আলোয় ইচ্ছের মুখের দিকে তাকালো।

মেয়েটিকে খুব অল্পবয়সী লাগছে। মায়ের শোকে হয়তো মেয়েটি ব্রেইন কাজ করছে না।

আহাদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো—

“রিল্যাক্স ... বলে আহাদ থেমে গেল।মেয়েটিকে কি নামে ডাকবে বলে ভাবলো।নামটাই তো জানা নেই।

“রিল্যাক্স... তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো।

আমি তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।”

আহাদ ইচ্ছের মুখের দিকে তাকালো।

“আপনি... আপনি আমাকে আম্মির কাছে নিয়ে যাবেন?

সত্যি আপনি নিয়ে যাবেন?”

“হ্যাঁ, আমি তোমাকে তোমার আম্মির কাছে নিয়ে যাবো। তুমি শুধু শান্ত হয়ে বসো।”

ইচ্ছে এবার একটু শান্ত হলো। আবার আহাদকে 

দিকে তাকিয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলে,

“আমার আম্মি ঠিক আছে তাই না? ওই মহিলা 

আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এমন বলেছে। 

ওটাকে পেলে আমি কমে ছাড়বো। পাজি মহিলা.....

মিথ্যা কথা বলার জায়গা পায়না না। দাঁড়া আমি আসছি।তোকে একেবারে খুন করবো। আমার আম্মির কিছু হয়নি। আমার আম্মি ভালো আছে.... আমার আম্মি সুস্থ্য আছে....... আম্মি...... আম্মি!!!!...... আম্মির কিচ্ছু হয়নি বলে ইচ্ছে পাগলের মতো কাঁদতে থাকলো।

ইচ্ছের কান্নায় আহাদের বুকটা ধক করে উঠলো।

মেয়েটিকে কি বলে শান্ত করবে ভেবে পেলনা।

প্রতিদিন এমন অহরহ কান্না শুনে আহাদ অভ্যস্থ।

তবুও আজ ইচ্ছের কান্নায় ওর মনটা কেমন যেন করছে। আহাদ ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন অন করলো।গাড়িটি বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চললো তার গন্তব্যের দিকে।

ইচ্ছে এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে।

চোখ দুটো—স্থির, শান্ত আর নিস্তব্ধ।

কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ফিসফিস করে বলছে—

“আম্মি..... আমি আসছি আম্মি।

তোমার ইচ্ছে আসছে তোমার কাছে।

তুমি শুধু আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে বুকে নিও আম্মি।

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ো।

কপালে একটু ভালোবাসার স্পর্শ একে দিয়ো।”

কিন্তু ইচ্ছে বলা কথাগুলো কি শুনবে ওর মা?

ও তো এখন কল্পনার মাঝে আছে।আর যে কখনোই ও ওর মায়ের ভালোবাসার স্পর্শ পাবে না। যখন কল্পনা 

থেকে বেরিয়ে আসবে তখন কি করবে ও?

মায়ের মৃতদেহের সামনে নির্বাক বসে আছে ইচ্ছে।

কান্নার কোনো শব্দ নেই শুধু চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে আছে। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের মুখটার দিকে। আশেপাশে অনেক মানুষ জন দাঁড়িয়ে আছে। তারা শুধু ইচ্ছের নিরবতা দেখছে।

আহাদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেকে দেখে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে ওরা হসপিটালে উপস্থিত হয়েছিল।

আর ইচ্ছে দৌড়ে ওর মায়ের কাছে ছুটে আসে।

আর সেই তখন থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কোনো সাড়া শব্দ না করে।

“আম্মি... আম্মি!!”—

হঠাৎ করেই ইচ্ছে ভাঙা কণ্ঠে ডাক দিলো।

“আম্মি ও আম্মি, তুমি কথা বলছো না কেন?

ও আম্মি, চোখ খুলো, দেখ আমি এসেছি! তোমার ইচ্ছে এসেছে। আম্মি আমাকে বুকে নাও না।

তুমি চোখ খুলছো না কেন? আর কত ঘুমাবে?

আমরা বাড়ি যাবো আম্মি। আমার এখানে ভালো লাগছে না। এখানে সবাই পঁচা।”

বলে ইচ্ছে ওর মায়ের হাত ঝাঁকাতে থাকে।

সবাই শুধু নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে আছে।

“আম্মি, তুমি আমার সাথে মজা করছো তাই না?

তুমি ঘুমের ভান ধরে আছো ,আমি জানি। ঠিক আছে, আমি আর তোমার কাছে পিঠে খাওয়ার বায়না করবো না। আর দুষ্টুমি করবো না। তোমার সব কথা শুনবো।

এখন তো তুমি চোখ খুলো । ও আম্মি, তুমি উঠে বসো না।”

“আম্মি শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি।

এই হসপিটালে না, অনেক পঁচা পাজি লোক আছে।

তুমি উঠে গেলে আমি আর তুমি মিলে সব কটা পাজি লোককে মেরে জেলে ভরবো। তারপর রিমান্ডে নেবো।

ভালো হবে না বলো ...” ফিসফিস করে 

বলে ইচ্ছে খিলখিল করে হেসে উঠলো।

আবার  হাসি থামিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে বললো—

“তুমি চোখ খুলছো না কেন? আমার খুব ভয় লাগছে।

ও আম্মি, ওঠো না। আম্মি... আম্মি...”

বলে ইচ্ছে ওর মায়ের বাহু ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে থাকে আর জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। সবাই ভয় পেয়ে যায়। সাথে সবার চোখের কোণে পানি আসলো।

“আপনার আম্মি আর বেঁচে নেই, ইচ্ছে। তাই উনি আর উঠবেন না।”

নার্সটির কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র ইচ্ছের শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।

এমনি ওর মাথা ঠিক নেই, তার উপর আবার এমন কথা শুনে ইচ্ছের রাগের মাত্রা বেড়ে গেলো।

উঠে এসে তেড়ে গিয়ে নার্সটির চুলের মুঠি ধরে বলতে লাগলো—


“অ্যাই কি বললি তুই? কে বেঁচে নেই?

আমার আম্মি বেঁচে নেই!

তোকে আমি খু*ন করবো।

অ্যাই তুই তখন ফোনে এই অলক্ষণে কথা বলেছিলি, তাই না?

পাজি মহিলা, তোকে একেবারে যমের দোয়ারে ফেলবো।”

বলে ইচ্ছে আরো শক্ত করে চুলের মুঠি ধরলো।

“আহ্... লাগছে ছাড়ুন! আমি আর বলবো না।

আমাকে ছেড়ে দিন। এই কে কোথায় আছো? আমাকে এই পাগল মেয়ের হাত থেকে বাঁচাও।”

নার্সটি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।

“কি বললি তুই? আমি পাগল?

তোকে তো...”

এই সময় দুজন নার্স এসে ইচ্ছেকে আটকে ধরলো।

“এই ছাড় বলছি! এটাকে আজ খু*ন করবো।”

ইচ্ছে নার্সটির সাথে ধস্তাধস্তি করতে থাকে।

ইচ্ছে আবার দৌড়ে গিয়ে ও মায়ের হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে—


“আম্মি, তুমি উঠছো না কেন?

দেখো তোমার ইচ্ছেকে এরা পাগল বলছে।

তুমি উঠে ওদের বকে দাও তো।”


কিন্তু ওর মা উঠে না। চোখ মেলে তাকায় না। ইচ্ছে ভরকে গেল। মনে ভয় হলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“অ্যাই আম্মি, তুমি... কি সত্যি মম... মরে গেছো?

আমাকে ছেড়ে চলে... না!!!...

তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো না।

আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবে না তুমি।”

বলে ইচ্ছে ওর মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে।

আহাদ নির্বাক হয়ে দেখে যাচ্ছে।

ইচ্ছের পাগলামি দেখে ওর মনে এখন শঙ্কা জাগছে।

ইচ্ছের দিকে এগিয়ে যাবে ঠিক তখনই ইচ্ছে উঠে চিৎকার দিয়ে বলে—

“খুশি হয়েছে আপনারা?

এখন নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছেন।

ওখানে রিসেপশনের সেই লোকটিও ছিল।

আঙ্কেল, খুশি হয়েছেন না?

দেখুন, আমার আম্মি মরে গেছে!

আমার আম্মি মরে গেছে!

আপনারা তো তাই চেয়েছিলেন।

আমার আম্মিকে আপনারা খুন করেছেন।

কেড়ে নিয়েছেন তাকে আমার কাছ থেকে।

আপনাদের কাছে টাকা আগে, তাই না?

আমার মায়ের প্রাণের দাম নেই।

কত টাকা লাগতো আপনাদের?

সামান্য কিছু টাকার জন্য আজ আমাকে এতিম করে দিলেন।

কেন অপারেশনটা বন্ধ করলেন?

কেন কেড়ে নিলেন আম্মিকে?

কেন আমাকে নিঃস্ব করলেন?”


ইচ্ছে এবার আহাদের দিকে এগিয়ে এসে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো—

“কেমন ডাক্তার আপনি?

শুনেছি আপনি নাকি অনেক বড় ডাক্তার!

দেশ-বিদেশে মানুষকে আপনি আপনার হাতের জাদু দিয়ে সুস্থ করে তুলছেন।

অথচ আমার কথাটা একটি বার শুনলেন না।

কেন শুনলেন না?

খুব কি আপনার সময় নষ্ট হতো আমার কথাটা একবার শুনলে?

আসলে আপনি ভালো ডাক্তার না।

আপনার কাছে আপনার নিজের প্রায়োরিটি আগে।

স্বার্থপর হৃদয়হীন ডাক্তার আপনি।

আপনি...”

ইচ্ছে আর বলতে পারলো না।

মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে আহাদ ইচ্ছেকে টেনে ধরে।

সবাই চমকে উঠলো।

আহাদ ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল।

ইচ্ছের শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।

ঠোঁট দুটো শুকিয়ে গেছে।

চোখের পাতা কাঁপছে, কিন্তু পুরো শরীরটা নিস্তেজ।

“ইচ্ছে? ইচ্ছে? শোনো আমার কথা... চোখ খুলো।” বলতে বলতে আহাদ ইচ্ছেকে বেডে শুয়ে দিলো।

“আপনারা এখান থেকে যান প্লিজ।

রাফাত, সবাইকে বাইরে বের করো, কুইক!

নিলা, আপনি ওর স্যালাইনের ব্যবস্থা করুন। অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে। দ্রুত সেন্স ফেরানোর চেষ্টা করুন।”

নার্সরা আহাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করলো।

আহাদ একদৃষ্টিতে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইচ্ছে বলা প্রতিটি কথা ওকে ভাবিয়ে তুলেছে।

ঠিক তখনই ফোনে টুং করে নোটিফিকেশন আসে।

স্ক্রিনে “ Mehtab”নামটি জ্বলজ্বল করছে।

মুহূর্তেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল।

ফোনটা হাতে নিয়ে গটগট করে বাইরে চলে গেল।

ইচ্ছের ধীরে ধীরে সেন্স ফিরে আসে।

ও উঠে বসে। এবার আর পাগলামি করে না।

হাতে থাকা ক্যানেলটি একটানে খুলে ফেলে। যার 

ফলে ছোপ ছোপ রক্ত পড়ছে।

উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের মর দেহটার দিকে এগিয়ে যায়।

আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

বুকের ভেতর যেন পাথর জমে গেছে।

মায়ের কপালে চুমু খেয়ে হাত দুটো আঁকড়ে ধরলো।


“আপনি এভাবে উঠে এলেন কেন?

আপনার তো স্যালাইন চলছিল।”

একজন নার্সের কথায় ইচ্ছে তার দিকে তাকালো।

“আপনার ফোনটা একটু দেবেন? আমি কথা বলবো।

আমার মোবাইলটা হারিয়ে গেছে।” ইচ্ছে ভাঙা ভাঙা 

গলায় বললো।

নার্সটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।

খুব অল্প বয়সে মাকে হারালো। ইচ্ছের জন্য ওনার মনে খুব কষ্ট লাগছে।নার্সটি ইচ্ছেকে ফোনটা দিল।

ইচ্ছে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে কথা বলতে চলে গেল।

পরের দিন সকাল বেলা।

কিছুক্ষণ আগে ইচ্ছের মায়ের দাফন কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

আহাদ ও রাফাত জানাজা পড়িয়ে মাটি দিয়ে এসেছে।


ছোট্ট বাড়িটা এখন মানুষে ভরা।

ইচ্ছেদের কিছু আত্মীয়, ওর মায়ের স্কুলের কলিগ ও ছাত্রছাত্রীও এসেছে।

এলাকার মানুষ তো  কাল রাত থেকে আছেই।

“স্যার, এখন কি বাড়ি যাবেন?

আমি কি গাড়ি রেডি করে রাখবো?”

“যাবো। তুমি যাও, আমি আসছি।”

আহাদের ঠান্ডা কণ্ঠে কথা শুনে রাফাত গাড়ির দিকে চলে গেল।

ইচ্ছে ঘরে চুপ করে বসে আছে।

মুখে কোনো সাড়া শব্দ নেই।

যেন মমির পুতুল।

আহাদ একবার ঘরে আসলো।

ছোট্ট একটা ঘর। এভাবে অন্যের ঘরে ঢুকতেও কেমন যেন দ্বিধা হচ্ছে ওর।

আগে কখনো এভাবে অপরিচিত কারো বাড়ি যায়নি।

কিন্তু কাল কি ভেবে যেন চলে এসেছে একটা অপরিচিত মেয়ের বাড়ি।

যার সাথে না আছে কোনো পরিচয়, না আছে কোনো সম্পর্ক।

হয়তো মেয়েটির প্রতি মায়া আর মনুষ্যত্বের জন্য ।

আহাদ দরজার পাশ থেকে ইচ্ছের মুখটা দেখলো।

মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।

কান্নার কারণে চোখ দুটো ফুলে আছে আর নাকটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চুল গুলো কপালে লেপ্টে আছে।

আহাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে চলে গেল।

কেন জানি মেয়েটিকে দেখে ভীষণ কষ্ট লাগছে।


Post a Comment

0 Comments