রূপকথার শহর! (পর্ব-৭)| নবনী নীলা

রূপকথার শহর! (পর্ব-৭)

অসভ্যতামি না দেখতে চাইলে জলদি জামা পড়ে আসো নয়তো এইভাবেই তুলে নিয়ে যাবো।” বলেই আরহান ইশার একদম কাছে চলে আসলো।

ছাড়ুন বলছি আমাকে, নয়তো চিৎকার করে আপনার মান সম্মান ডুবিয়ে দিবো?”



তুমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছো একবার? চিৎকার করলে আমার কিছুই হবে না। তোমাকে আমার সাথে এই অবস্থায় দেখে তোমার বাড়ির লোক কি করবে সেটা ভেবে দেখো।” বলেই আরহান ইশার হাত ছেড়ে দিলো।

ইশা সাথে সাথে তোয়ালেটা গায়ের সাথে শক্ত করে ধরে রাখলো তারপর আরহান কিছু বলার আগেই সজোরে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। 

আরহান ইশার রুমে জানলার পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় গিয়ে গা হেলিয়ে দিয়ে বসলো। ইশার এই বাড়িতে থাকা মোটেও নিরাপদ না বাড়ি যেহেতু চিনে ফেলেছে ওরা বার বার আসবে। আর কায়ানের লোককে মারার খবর পেলে ওরা আরো হিংস্র হয়ে উঠবে। 

আরহান ইশার ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখলো কাচের চুড়ি গুলো চিক চিক করছে। আরহান আহমেদ কাচের চুড়ি কিনবে এটা সে কখনো ভাবেনি। চুড়িগুলো ইশাকে ভার্সিটিতে দিয়ে দিতো যেহেতু তার রাগের কারণেই সেদিন ইশার চুড়িগুলো ভেঙে গেছে। কিন্তু ইশা আজ ভার্সিটি যায় নি। তাই ইশা যখন তার গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছিল তখনই ইশার ব্যাগে চুড়িগুলো রেখে দিয়েছিলো।

ইশা জামা পরে ধীরে ধীরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। তার চোখে মুখে রাগ আর বিরক্তি।আরহান তখনো জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে ছিল। ইশার পায়ের শব্দ শুনে ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাল।

কি চাইছেন কি আপনি? এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যান। নয়তো ভালো হবে না।," গর্জে ওঠে ইশা।

আরহান কোনো উত্তর দিল না। শুধু হালকা মাথা ঝাঁকাল, যেন সে কিছু ভেবে ফেলেছে। আরহান পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে উঠে দাড়ালো।

হুম ঠিক বলেছো। এখানে থাকা একদম ভালো হবে না।”, খুব ধীরে শান্ত গলায় বলল আরহান।

তাহলে চলে যান!",বলেই ইশা পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে এগোতেই...

আরহান পেছন থেকে এসে রুমালটা চেপে ধরল ইশার মুখে।

"ম্ম্ম্… ছে… ছেড়ে…",ইশার গলা রুদ্ধ হয়ে গেল। হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করেও ধীরে ধীরে শক্তি হারাতে লাগলো সে।

আরহান শক্ত করে ধরে রাখল, মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর ইশার শরীরটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল।চোখ বন্ধ হয়ে এলো, শরীর ঢলে পড়ল আরহানের বুকে।

আরহান নিঃশ্বাস ফেলল। রুমালটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে ইশাকে কাঁধে তুলে নিল। 

সূর্যের আলো মুখে পড়তেই ইশার চোখ  খুললো। তার দৃষ্টি ঝাপসা, মাথাটা যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে। ইশা ধীরে ধীরে উঠে বসল।

আমি... কোথায়?" — ফিসফিস করে বলল ইশা।

চারপাশে তাকিয়ে দেখল, অচেনা একটা ঘর। নরম বিছানা, জানালায় মোটা পর্দা, কাঠের আসবাব,অদ্ভুত রকম পরিচ্ছন্ন সবটা।

তারপর হঠাৎ সবটা মনে পড়ল তার।

আমাকে তুলে এনেছে? এইখানে!!”

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো সে। পা দুটো কাঁপছে, মাথার ব্যথা তীব্র হচ্ছে, তবুও ভয়কে চেপে ধরে ইশা এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

পুরো বাড়িটা নিঃশব্দে ডুবে আছে। সে ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো।

ইশা দোতলার একটা ঘরে আছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই দেখল, বাড়িটা বড়, কিন্তু একদম ফাঁকা। কারও শব্দ নেই, কোনো টিভি, কোনো রান্নাঘরের শব্দ, শুধু নিঃস্তব্ধতা।

ইশা দরজার সামনে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। বাড়িটার চারপাশে যেন জনমানবহীন,দেয়াল দিয়ে ঘেরা, বাইরের রাস্তাও দেখা যায় না ঠিকমতন।

সে দরজার হাতল ঘুরালো। কিন্তু বাইরে থেকে বন্ধ। তার মানে তাকে আটকে রাখা হয়েছে।

ইশার গলা শুকিয়ে গেল। একসাথে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরতে লাগল ইশার মনে।

আমাকে এখানে কেন রাখা হয়েছে?আমি কি বন্দি? কি করবে আমার সাথে?"

হঠাৎ, পেছন থেকে দরজা খোলার শব্দ! সঙ্গে সঙ্গে ইশা পেছন ঘুরে তাকালো। ভয় প্রাণ বেরিয়ে আসতে চাইছে তার।

ইশা পাশের তাক থেকে একটা মোটা লাঠি তুলে নিলো। আজ হয় সে মরবে নয়তো কাউকে মারবে। ইশা নিঃশব্দে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

দরজা খুলে যেই না ছায়াটা ভেতরে ঢুকল, ইশা কোনো দ্বিধা না করে লাঠি উঠিয়ে মারতে গেল।

তখনই শক্ত একটা হাত তার কব্জি চেপে ধরল।

তোমার মাথা কি একদম গেছে?," ভারী ঠান্ডা কণ্ঠ ভেসে এলো।

আরহান। ইশা চমকে উঠলো। ভয়, রাগ সব মিলে ইশা আরো ক্ষেপে গিয়ে বললো। 

হ্যাঁ, আমার মাথা গেছে। এখন আমি আপনার মাথা ফাটাবো। আপনার সাহস তো কম না আপনি আমাকে তুলে এনেছেন। কি মতলব আপনার?”

আরহান ধীরে ধীরে ইশার হাত নামিয়ে দিল। তারপর ভিতরে ঢুকে বলল, “ তোমার মত এমন পাগল আমি আমার লাইফে দেখিনি। তোমার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে এতক্ষণে ভয়ে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলতো আর তুমি আমাকেই মারতে এসেছো।” বলেই টান দিয়ে ইশার হাত থেকে লাঠি নিয়ে নিলো।


ইশা এবার চিৎকার করে উঠল,

“আমাকে কোথায় এনেছেন আপনি? বলুন! আর দরজা বন্ধ কেনো? কি চান আপনি?”


আরহান বিরক্ত গলায় বলল,“ তুমি এখন আমার দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব কেউ ইচ্ছে করে নিতে চায় না, আমিও চাইনি। কিন্তু বাধ্য হয়েছি।”


“বাধ্য? আমাকে অজ্ঞান করে এনে দরজা বন্ধ করে রাখাটা বাধ্য হওয়া? আপনি আমাকে কিডন্যাপ করেছেন যেটাকে বলে গুন্ডামি। আপনি না শিক্ষক? শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে কেউ তুলে আনে?”,ইশার কণ্ঠে তীব্র তাচ্ছিল্য।


আরহান এবার একটু এগিয়ে এসে বলল,

“তুমি যেটা বুঝো না, সেটা নিয়ে তর্ক করবে না”


ইশা এবার একটু থেমে গেল। তার চোখে এখনও রাগ, কিন্তু মনে ভয় আর দ্বিধার ছায়া ফুটে উঠেছে।


“ আপনি আমাকে এইখানে কেনো এনেছেন? বলুন আমায়।”, 


“ তোমার নিরাপত্তার জন্য।” আরহান বিরক্তি নিয়ে সোফায় বসলো।


“ আমার নিরাপত্তা দেওয়ার আপনি কে ?” ইশা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো।


“ তোমার ধারণার বাইরের কেউ। আর একটা প্রশ্ন করবে তো আবার অজ্ঞান করে বিছানায় ফেলে রাখবো।”, আরহানের হুমকিতে ইশা একটু ভয় পেলো তারপর বলল।


“এখানে আর কেউ থাকে না?”


“না। তুমি, আমি, আর পাহারার জন্য বাইরে একজন আছে। দরজা তাই বন্ধ। তুমি চাইলে আমি খুলে দিতে পারি but only if you’re ready to face death.”


“ শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখাবেন না। আমার বাড়ির মানুষ জানলে আপনার কি হাল করে দেখবেন।”


আরহান তীক্ষ্ম চোখে তাকাতেই ইশা নিচের ঠোঁট কামড়াতে লাগলো।


“ তোমার মামা আমিনুল সাহেবের থেকে পারমিশন নিয়েই তোমাকে এইখানে আনা হয়েছে।”, আরহানের মুখে এই কথা শুনে ইশা হতভম্ব হয়ে তাকালো।


“ কিঃ ! মামা ? মামা আপনাকে পারমিশন দিয়েছে আমাকে তুলে আনার ? মিথ্যে কথা বলবে না।”, ইশা দ্রুত আরহানের কাছে গেলো।


“ তুমি চাইলে প্রমাণ দিতে পারি। কিন্তু একটা শর্ত।”,


“ শর্ত? কি শর্ত?”, শর্তের কথা শুনতেই ইশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।


আরহানের শর্ত শুনে ইশার মনে হচ্ছে তাকে এইখানে তুলে আনা হয়েছে মস্করা করার জন্য। ইশা রাগে গজগজ করতে বলল, “ আমি করবো রান্না ? আপনার মাথা ঠিক আছে?”


“ হ্যাঁ করবে আর না করতে পারলে মামার সাথে কথা বলার ও প্রয়োজন নেই।”, আরহান শান্ত গলায় বলল।


ইশা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেলুন হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো আর চিৎকার করে বললো, “ তুলে এনেছে নাকি নিরাপত্তা দিবে, এটা কেমন নিরাপত্তা? নিরাপত্তা তো আমার আপনার থেকে দরকার। পিশাচ কোথাগার”


_________________________


“একটা মেয়েকে তুলে আনতে পারলে না, ইউ বাস্টার্ড! উপর থেকে দুটো লোকও হারিয়ে বসে আছিস…”কায়ানের কণ্ঠে আগুন। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো সে, চারদিক কেঁপে উঠলো যেন।


তার হাতের পিস্তলটা হঠাৎই শূন্যে উঠে গেলো।!

টানা তিন রাউন্ড গুলি চললো, কানে তালা লাগার মতো শব্দ হলো।


সবাই থমকে দাঁড়ালো। কেউ নিশ্বাস ফেলতে পারছে না ঠিক করে। জিসান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কায়ানের চোখে চোখ রাখার সাহসও  তার নেই।


কায়ান এবার পিস্তলের নলটা সরাসরি জিসানের বুকে ঠেকিয়ে বলল,

“মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে না পারলে, এই গুলিগুলা ঠিক এই বুকের ভেতর ঢুকিয়ে দেবো আমি।  বুঝেছিস?”


জিসান ঢোক গিলতে গিলতে বলল, “বস আপনি তো জানেনই আরহান আহমেদ সবসময় আমাদের  থেকে একধাপ আগে চিন্তা করে।”

আরোও পড়ুন:

রূপকথার শহর পর্ব-৮| নবনী নীলা


“ এইসব অজুহাত আমাকে দিলে চলবে না। ওই মেয়েকে আমার চাই।”

Post a Comment

0 Comments