ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-৮
রান্নাঘরে ঢুকে ইশা কিছুক্ষণ চুপ করে চারপাশে তাকিয়ে রইল। চুলা, ফ্রাইং প্যান, ঝাঁ চকচকে কিচেন সবকিছুই অচেনা। তারপর ধীরে ধীরে রাগে গজগজ করতে লাগলো,“ আজ পর্যন্ত জীবনে ডিম ভাজা করিনি, আর আমাকে বলছে কিনা রান্না করো! ঠিক আছে, আজ এই লোককে অপহরণের স্বাদটা আমি ভালোভাবেই টেস্ট করাবো।”
তারপর শুরু হলো ইশার ‘রান্না অভিযান’।
একটু বেশি হলুদ, একটু বেশি মরিচ, লবণ না দিলে কি হয়? দিয়ে দিলো চার চামচ!
তারপর ঝোল গরম করতে গিয়ে পুরো রান্নাঘর যেন বারুদের গন্ধে ভরে গেল।
ইশা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,“এমন রান্না খাওয়াবো আজকে ইশা কি জিনিস বুঝবে।”
রান্না শেষে জয়ী ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে রুমে গেল ইশা।কিন্তু রুমে ঢুকেই তার মুখ থমকে গেল।
ড্রয়িং রুমে টেবিলজুড়ে থরে থরে রাখা খাবারের প্যাকেট সবই রেস্টুরেন্টের!
ইশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
তারপরই গর্জে উঠল সে,“এইটা কি? বাইরের থেকেই যখন খাবার আনবেন তাহলে আমাকে দিয়ে কষ্ট করালেন কেনো?”
আরহান কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,“তুমি কি ভেবেছিলে, আমি তোমার রান্না খাবো?”
ইশা বিস্ফোরণের মতো চিৎকার করে উঠল,
“মানে! তাহলে আপনি আমাকে শুধু শুধু রান্না করতে পাঠালেন?”
আরহান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,“তোমার বকবক থামাতে এটাই দরকার ছিল যাতে আমি শান্তিতে নিজের কাজ করতে পারি।”
ইশা ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর গম্ভীর মুখে আরহানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ দেখুন। আপনি রান্না করতে বলেছেন আমি রান্না করেছি, আপনি খাবেন কি খাবেন না সেটা আপনার বিষয়। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী, এখন আমাকে আমার মামার সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে।”
আরহান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে টেবিলে রেখে বলল,“ওকে, কথা বলতে পারো। কিন্তু সময় সীমিত।”
ইশা সঙ্গে সঙ্গে ফোন তুলে ডায়াল করল মামার নম্বরে। ইশার মামা কল ধরতেই আরহান ঘড়ির
দিকে দৃষ্টি তীক্ষ্ম করলো।
ইশার মামা ইশাকে একটু শান্ত করলো তারপর আরহান সম্পর্কে বলা শুরু করতেই আরহান ইশার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কল কেটে দিলো।
“ এইটা কি ধরনের অভদ্রতামি? আপনি কল কেটে দিলেন কেনো?”
আরহান ফোনটা সাথে সাথে বন্ধ করে বললো, “ আমার ইচ্ছে।”
“ আপনি কে বলুন তো?”, ইশা এই প্রথম শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো।
“ কেনো?আমি কে সেটা জেনে তুমি কি করবে ?”, আরহান ভ্রু তুলে প্রশ্ন করতেই ইশার ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো।
ইশার চুপ করে রইলো তার চুপ থাকার আরেকটি কারণ তার মামার বলা শেষের কথাগুলো।
“ আরহান সিআইডির স্পেশাল ইউনিটের শীর্ষ কর্মকর্তা সে দেশের জন্য কাজ করে কিন্তু ছায়ার মতো, যাকে শুধু রাষ্ট্রের গোপন চক্র চেনে। তোমাকে বলছি যাতে তুমি তাকে বিশ্বাস করতে পারো কিন্তু খেয়াল রাখবে আরহান যেনো এই বিষয় জানতে না….” বাকিটা বলার আগেই আরহান ফোনটা ইশার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে নেয়।
ইশা চুপ করে বসে আছে। বিষয়টা এতো জটিল সে কল্পনা করেনি। তাকে নিরাপত্তা দিতে নিয়ে এসেছে কিন্তু কার কাছ থেকে নিরাপত্তা দিচ্ছে? সে এমন কি করেছে যে তার নিরাপত্তার প্রয়োজন?
_________________
কায়ানের লোকেরা ইশাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু নির্ভুল কোনো ঠিকানা মেলেনি। কিন্তু শেষমেষ, এক গোয়েন্দার মাধ্যমে তারা ইশার মামার ফোন কল আর যোগাযোগের তথ্য বিশ্লেষণ করে, ইশার অবস্থান নিশ্চিত করতে পারে।
কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের কল্পনার বাইরে। শহর থেকে দূরে নিরিবিলি জনমানবহীন ভিলা। ভিলার বাইরে দেওয়া আছে কড়া নিরাপত্তা বাহিনী। ইশার ছায়া পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারবে না তাদের কেউ। ভিলার আশেপাশে গেলেই মৃত্যু নিশ্চিত।
কায়ানের বিশ্বস্ত জিসান কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এর মাঝেই এলো আরেক দুঃসংবাদ।
জিসানের শরীর ঘামছে, ঠোঁট কাঁপছে, চোখদুটো ছানাবড়া। কায়ানের মায়ের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই খবর যেন বজ্রাঘাতের মতো এসে পড়েছে তার ওপর।
গলা শুকিয়ে আসছে, কিন্তু কথা বলতে হবে। কায়ান জানার আগেই আম্মিজানকে খুঁজে বের করতে হবে।
জিসান ফিসফিস করে বলল,
“তোমরা বুঝতে পারছো না… উনি কায়ানের মা… কায়ান তার জন্য পাগল। আর উনি যদি না ফেরেন… কায়ান পাগল হয়ে যাবে। নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাবে… তখন ওর সামনে যে থাকবে, সেই মরবে। তুমি আমি আমরা কেউ বাঁচবো না।”
জিসানের কণ্ঠ হঠাৎ চড়ে উঠল,“তোমরা খুঁজে বের করো তাকে! জলদি করো! কিছু একটা করো! না হলে আমরা কেউ বাঁচবো না। কায়ান হিংস্র হয়ে ওঠবে।”
জিসানের চোখদুটো ফাঁকা, যেন সামনে কল্পনা করছে রক্তে ভেসে যাওয়া ভবিষ্যৎ।
“আম্মীজান না ফিরলে কায়ান নিজেকেও শেষ করে দেবে। আমি জানি… আমি দেখেছি…” অস্থিরতায় বলল জিসান।
কায়ানের মা শহরের এক বিক্ষিপ্ত রাস্তায় একা একা ঘুরছেন। তিনি ডিমনেশিয়ার রোগী, ডিমেনশিয়ার প্রভাব তাকে নিজের মৃত ছেলে আর স্বামীকে খুঁজতে বাধ্য করেছে।
তাকে ঘর থেকে বের করলেই তিনি পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। এইবার তিনি সফল হয়েছেন। বয়সের সাথে সাথে তার মধ্যে এক ধরনের পাগলামি কাজ করে যা তার সাথে কথা বলে বুঝা যায় না। তাকে দেখে মনে হয় একদম স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলেই বোঝা যায় , বর্তমান ভুলে যাচ্ছে অতীতটা স্মৃতিতে আরো গাঢ় হচ্ছে। হঠাৎ চিনতে পারছেন আবার পরক্ষনেই অচেনা লাগছে।
__________________
রাত আটটা, আরহান নিজের কাজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতেই ইশার দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। এতক্ষণ সে চুপচাপ থাকলেও এইবার সে নড়ে চড়ে বসলো।
আরহান শান্ত গলায় বলল,“ আমি বের হচ্ছি। চিন্তার কিছু নেই, তোমার জন্য এখানে প্রয়োজনীয় সব কিছুই আছে...”
বাকিটা শেষ করার আগেই ইশা ঝড়ের মতো সামনে এসে দাঁড়াল।“বের হচ্ছেন মানে? কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।”
“ তুমি ঠিক করবে আমি যাবো কি যাবো না?”, আরহান বুকের কাছে দুইহাত ভাজ করে জিজ্ঞেস করলো।
“ যেতে পারবেন না কারণ আপনি আমাকে এইখানে আটকে রেখেছেন তাই আপনিও আমার সাথেই আটকে থাকবেন।”,
আরহান ভ্রু তুলে তাকালো,“ আচ্ছা ? তুমি আটকে রাখবে আমাকে? নিজের হাইট দেখেছো? এই টুলে দাঁড়ালেও আমার নাক অব্দি পৌঁছাবে না”
ইশা চোখ টিপে রাগ চেপে রাখল, তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, “একদম হাইট নিয়ে কথা বলবেন না। আমিও চাইলে আপনাকে দানব বলতে পারি কিন্তু আমি কি বলেছি?”
আরহান পাত্তা দিলো না। তার পকেটে রাখা ফোন ভাইব্রেট করতে লাগলো। সে পকেট থেকে ফোন বের করতেই ইশা পাশের থেকে বড় একটা টুল এনে আরহানের সামনে রাখলো। আরহান ফোনের দিকে ব্যাস্ত ছিলো এইদিকে ইশা টুলে উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরহান ম্যাসেজটা খুলার আগেই ইশা টুলে উঠে দাড়িয়ে বলল, “ এইবার বলুন। এইবার তো আপনার সমান সমান হয়েছি।”,
আরহানের দৃষ্টি স্ক্রিনে ব্যাস্ত ছিলো। তার স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা এনক্রিপ্টেড বার্তা "Movement detected near the outer perimeter. Identity unconfirmed.”
পুরোটা পড়ার আগেই ইশার ভারসাম্য একটু নড়বড়ে হতেই হঠাৎ তার পায়ের নিচের টুলটা কাঁপতেই সে দুলে উঠলো পরক্ষণেই সোজা গিয়ে পড়ে গেল আরহানের ওপর। আরহান ও এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না ইশাকে ধরার আগেই ইশার নিজের সম্পুর্ন ভার নিয়ে আরহানের উপর পড়ে গেলো। ইশাকে ধরতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে দুইজনই মেঝেতে।
ইশার পুরো শরীর আরহানের ওপর, দুজনের ঠোঁটের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চি। আরহান কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল, তারপর ধীরে চোখ খুলতেই চোখে চোখ পড়ল ইশার দিকে।
একটা নিঃশব্দ থমথমে মুহূর্ত, দুজনে কিছু বলছে না।
এরপরই আরহান ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল," এইভাবে আটকানোর প্ল্যান আমাকে?”
আরোও পড়ুন:
0 Comments