ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-৯
ইশার পুরো শরীর আরহানের ওপর, দুজনের ঠোঁটের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চি। আরহান কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল, তারপর ধীরে চোখ খুলতেই চোখে চোখ পড়ল ইশার দিকে।
একটা নিঃশব্দ থমথমে মুহূর্ত, দুজনে কিছু বলছে না।
এরপরই আরহান ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল," এইভাবে আটকানোর প্ল্যান আমাকে?”
ইশা সাথে সাথে উঠে বসে, চুলগুলো মুখ থেকে সরিয়ে নেয়, চোখেমুখে লজ্জা-মিশ্রিত রাগ।
নিজেকে কি মনে করেন আপনি?", ইশা গর্জে ওঠে।
আরহান বসে উঠে গম্ভীর চোখে তাকায়, " আমি যা তাই মনে করি।"
এ কথা বলার মাঝেই ফোনটা আবার ভাইব্রেট করতে লাগলো। এবার আরহান দ্রুত উঠে গিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে।
বার্তা:
Three unidentified movements. North-west perimeter. Possible breach attempt. Tactical team en route.”
আরহানের চোখ কুঁচকে উঠলো। সে দ্রুত কানে হ্যান্ডসেট গুজে দিলো।
ডেল্টা ইউনিট, উত্তর-পশ্চিম কোণ সুরক্ষিত করো। অপারেশন সাইলেন্ট মোড অন। আমি আসছি।”
ইশা ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছে। তার চোখে অজানা আতঙ্কের ছায়া।
কি হয়েছে?” – ধীরে জিজ্ঞেস করল সে।
তেমন কিছু না। বন জঙ্গল তাই কিছু শিকার পেয়েছি।”,ছোট্ট উত্তর আরহানের।
মানে?” ইশার কণ্ঠ কাঁপছে।
আরহান তাকালো তার দিকে, ঠোঁটে শক্ত রেখা।
“ মানে তোমাকে বুঝতে হবে না। এখন আমাকে যেতে হবে।” বলেই আরহান বেরিয়ে গেলো ভিলার বাইরে। রাতের অন্ধকারে তার ছায়া মিলিয়ে গেল।
অন্যদিকে…
জিসান একটা ভাঙা কারখানার ছাদে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার দিয়ে পাহারা দিচ্ছে। তার পাশে একজন মুখ ঢাকা লোক এসে বলল,
“লোকেশন নিশ্চিত।কিন্তু আম্মিজান এখনো নিখোঁজ…”জিসানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
সে কিছুটা থেমে বলল, “ কায়ানকে এখনো জানানো হয় নি।”
ভিলার উত্তর-পশ্চিম কোণে হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ। আরহান পজিশন নিয়ে গুলি চালাচ্ছে, নিখুঁত টার্গেটিং।
তার কানে ভেসে এলো কমান্ড ইউনিটের কণ্ঠ, “স্যার, এরা কায়ানের লোক। কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে অন্য গ্রুপ এসেছে। Heavy fire incoming!”
আরহান দাঁত চেপে বলল, “Backup now. Hold position.”
ভিলার ভেতরে ইশা টিভি মনিটরে বিস্ফোরণ দেখতে পাচ্ছে।
তার ঠোঁট ফাঁপছে শুধু একটাই কথা বলার জন্য:
“আরহান…”
ভিলার বাইরে গুলি চলার শব্দ থেমে গেছে। আরহান কানে হেডসেট গুঁজে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “রিপোর্ট?”
ওপাশ থেকে ডেল্টা ইউনিটের প্রধান জানালো,
“তিনজন আক্রমণকারী গুলিতে আহত। একজন ধরা পড়েছে, বাকি দু’জন পালিয়েছে। লোকাল কন্ট্রোল সিস্টেম হ্যাক করার চেষ্টা হয়েছিলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। এখন পুরো এলাকা সুরক্ষিত।”
আরহান দম ফেললো। তারপর বলল,
“ধরা পড়া ছেলেটিকে ইন্টেরোগেট করতে হবে। কোড ১৪৪ একটিভ ককরো আর চারপাশের নিরাপত্তা বাড়ানো হোক।”
ভিলার ভেতরে ইশা এখনও ব্যাকআপ মনিটরগুলোতে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে।
সে নিজের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো। তারপর মনে পড়ে গেল মামার কথাগুলো—আরহান সিআইডি স্পেশাল ইউনিটে কাজ করে, রাষ্ট্রের গোপন চক্রের অংশ।
হঠাৎ যেন নিজেকে এক গভীর ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে মনে হলো।
অন্যদিকে—
এক ভাঙাচোরা গুদামঘরে জিসান থম মেরে বসে আছে। সামনে রাখা গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছে। তার চোখে খালি ক্লান্তি।
একজন এসে বলল,
“বস, আমরা ঢুকতে পারিনি। তারা ভেতরে পুরো এলাকা বুলেট-প্রুফ করে রেখেছে। সেন্সর, ড্রোন, ইনফ্রারেড সবকিছু। এ যেন দুর্গ।”
জিসান হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,
“তোমরা সবাই ব্যর্থ! কায়ানকে আমি কী জবাব দেব? আম্মিজানও হারিয়ে গেছে আর ইশার ছায়াও পাচ্ছি না!”,তার কণ্ঠে আতঙ্ক নয়, এখন কেমন পাগলামির রেশ।
“কায়ান জানলে... সব শেষ। সে তখন আর থামবে না।”
ভিলার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে আরহান। তার চোখে দূরদৃষ্টি।
পাশ থেকে এলো আরেক এজেন্ট:
স্যার, ধরা পড়া লোকটা মুখ খুলছে না। কিন্তু তার মোবাইলে কিছু এনক্রিপ্টেড ডেটা পাওয়া গেছে। খুব সম্ভবত কায়ানের লোক।”
আরহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
হুম। সতর্ক থাকবে। কায়ানের কাছে আমাদের যেতে হবে না ও নিজেই আমাদের কাছে আসবে।”
ইশা দাঁড়িয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো দেখছে। কি হচ্ছে এইসব? কেনো তার সাথেই এমনটা হচ্ছে? আরহানকে এখনো তার কাছে অস্পষ্ট লাগছে।
এক পাহাড়ি সেতুর নিচে দাঁড়িয়ে কায়ানের আরেক বিশ্বস্ত লোক “রুবান” কথা বলছে ফোনে।
স্যার, ফেইল করেছি। জিসান হতাশ। ইশা এখনো নিরাপদে।"
ওপাশ থেকে এক গলা আসে “ এবার তাহলে আমি নামবো।”
রুবান থেমে গেল।
তৈরি হও। কায়ান আসছে। কিন্তু যেমনভাবে আসবে, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না…।”ফোনটা কেটে গেল।
রাত গভীর। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দূরে কোনো শেয়ালের ডাক কিংবা বাতাসে পাতা ওড়ার শব্দ।
ভিলার গেট খুলে আরহান ভেতরে ঢুকলো।হাঁটতে হাঁটতে লিভিং রুমের দিকে এগোতেই থমকে গেল।
সোফার এক কোণে ইশা বসে আছে নিঃশব্দে। চুল এলোমেলো, চোখেমুখে হতাশা।
আরহান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ এখনো এইখানে কি করছো?”
ইশা কোনো উত্তর দিলো না। শুধু একবার তার দিকে তাকালো। আরহান নিঃশব্দে পাশে গিয়ে বসতেই ইশা প্রশ্ন করলো, “ আমি কি এমন করেছি যার জন্য আমাকে এত নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে।”
নাহ তুমি কিছুই করোনি। আমার কারণেই তুমি এইসবে জড়িয়ে পড়েছো।”, আরহান শান্ত গলায় বলল।
আপনার কারণে মানে?”, ইশা অবাক হয়ে তাকালো।
হ্যাঁ। আমার কারণে। তুমি কায়ানের সম্পর্কে তো জানো?”, আরহানের প্রশ্নে ইশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
কায়ান যেকোনো কারণে হোক আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেষ্টা করছে। ওর উদ্দেশ্য আমার অব্দি পৌঁছানো। কিন্তু ও কি চায় সেটা স্পষ্ট নয়।”
আপনার কাছে পৌঁছানোর উদ্দেশ্য কি ?”, ইশা ভয়ে ভয়ে বললো।
সেটা জানতেই আমি এ শহরে এসেছি। আমি কে সেটা তো তোমার মামা তোমাকে বলেই দিয়েছে। সাধারণ এইসব ক্রাইম ইভেস্টিগেশনে আমি সরাসরি কাজ করি না।”,
কিন্তু সে আমার পিছু নিয়েছে কেনো?”, ইশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো
কারণ আমার বাবা মা অব্দি পৌঁছানো সম্ভব নয়। বাড়ির চারিদিকেই সর্বক্ষণ নিরাপত্তা থাকে। তাই কায়ান এখন এই নোংরা পলিটিক্স খেলছে।”
আমাকে পেলে কি করবে ওরা?”, ইশা আনমনে প্রশ্ন করতেই আরহান ইশার মুখের দিকে তাকালো।
তোমাকে পেলে কি করবে? কি করবে না সেটা জিজ্ঞেস করা ভালো।”,
ইশার চোখে মুখে ভয়। যেনো চোখের পানি অনেক কষ্টে আটকে রেখেছে। আরহানের মুখভঙ্গি একটু নরম হলো।
সে হাত বাড়িয়ে ইশার গাল আলতো করে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল, “বোকা মেয়ে। এ পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় রেখেছি তোমায়। তোমার ছায়া পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে প্রাণ হারাবে আর কেউ যদি তোমায় ছোঁয়ার কথাও ভাবে জীবন্ত জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলবো তাকে।”
আরোও পড়ুন:
0 Comments