ভালোবাসি কও| নুজাইফা নূন| পর্ব-৪
আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে তুলেছেন।আমি ,আমার মা দুজনেই এমনটাই ভেবেছিলাম। এক মূহুর্তের জন্য বাবার প্রতি থাকা সমস্ত ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল।
তখন অপরিচিতা নারীটি কে দেখেও মা কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেলেন।তার চোখে জল, ঠোঁট দুটো শক্ত করে চেপে রেখেছেন।আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।মা শান্তভাবে আলমারির চাবি ঘোরালেন।ধীরে ধীরে কাপড়-চোপড়, গয়না, গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন।
মায়ের এহেন কার্যে কপালে ভাঁজ পড়ে আমার,আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,“মা তুমি ঠিক কী করতে চাইছো ?”
তিনি কোনো কথা বললেন না।শুধু একবার আমার দিকে তাকালেন। মায়ের চোখের ভাষা আমি নিমিষেই পড়ে ফেললাম। মায়ের হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
“ এটা তোমার সংসার মা।তোমার ঊনিশ বছরের পরিশ্রম।তুমি কেন সবকিছু ছেড়ে যাবে?”
“এই বাড়িতে আমার আর জায়গা নেই।তোর বাবার জীবনে নতুন অতিথি এসেছে।তার জীবনেই যখন আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে, তখন এই বাড়িতেও আমার থাকার কোন প্রয়োজন নেই।”
আমি মাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মা আমার কথা আমলে নিলেন না।তিনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই বাবা পেছন থেকে মায়ের হাত আটকে দেন।মা এক ঝটকায় বাবার হাত ছাড়িয়ে দেন। কর্কশ কণ্ঠে বলেন,
“ তুমি ছুবে না আমাকে।তোমার ছোঁয়া বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধছে আমার শরীরে।”
“ কুল ডাউন চাঁদ।প্লিজ আমার কথা একটু শোন।”
মা চেঁচিয়ে উঠলেন,
“ তোমার আর কী বলার আছে হ্যাঁ? কী বলবে তুমি?এটাই বলবে যে তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়েছ?বুড়ো বয়সে নিজের খায়েস মেটাতে…
বাক্য শেষ হয় না মায়ের।তার আগেই বাবা ঠাস ঠাস করে মায়ের গালে থাপ্পড় মেরে দেন। ক্ষুদ্ধ স্বরে বলেন,
“ এনাফ ইজ এনাজ চাঁদনী।”
বাবার মুখে চাঁদনী নামটা শুনে আমি ,মা দুজনেই চমকে উঠি।বাবা কখনোই মাকে চাঁদনী নামে ডাকেন না। চাঁদ বলে ডাকেন।মা কিছুটা দমে গেলেন । বাবা পুনরায় গর্জে উঠেন,
“ হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড চাঁদনী।এই মেয়েটা আমার মামনির চেয়েও কম বয়সী।তুমি ভাবলে কী করে আমার ঘরে ব্যক্তিগত চাঁদ থাকতে, আমার রাজকন্যা থাকতে আমি দ্বিতীয় বিবাহ করব?বিয়ের সময় শ্বশুর আব্বা যখন তোমার হাত দুটো আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, আমি তখন তাকে ওয়াদা করেছিলাম আমি সারাজীবন তার মেয়ের হাত দুটো ধরে রাখবো , তার খেয়াল রাখবো।আমি ওয়াদা করলে জান দিয়ে হলেও সেই ওয়াদা পালন করি। মৃত্যু ছাড়া আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।তুমি এটুকু নিশ্চিত থাকতে পারো।”
বাবার কথা শুনে আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম।
পাঁচ ফুট এক ইঞ্চির একটা মেয়ে।বয়স আনুমানিক পনেরো কী ষোলো? হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটা দেখতে ভয়ংকর রকমের সুন্দরী।হয়তো মায়ের কথায় কষ্ট পেয়ে মেয়েটা কান্না করেছে।কান্নার ফলে তার চোখ ,মুখ নাক , লাল হয়ে উঠেছে।দেখতে অবশ্য মন্দ লাগছে না।
আমি দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। কোমল স্বরে বললাম,
“ তুমি যে মাগুরা আসবে , এটা আগে থেকে বলো নি কেন বাবা? আগে থেকেই বলে দিলে নিজেরদের মধ্যে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হতো না।”
“ আমি এসেছিলাম তোমাকে আর তোমার মাকে বরিশাল নিয়ে যেতে। তোমাদের কে ছাড়া একা একা আমার আর ভালো লাগছে না।তোমার মাকে এর আগে কতোবার বলেছিলি আমরা একসাথে বরিশাল থাকি। কিন্তু তোমার মা রাজী হয়নি।তাই এবার বিনা নোটিশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের তো আমার প্রতি কোন বিশ্বাস, ভরসা নেই।”
মা বাবার দিকে এগিয়ে আসলেন।নত হয়ে বললেন,
“ সরি ।আমি তোমাকে অবিশ্বাস করতে চাই নি।
কিন্তু ওই মূহুর্তে আমার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না।
আমার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছিল।সরি সজল।”
“ তোমার জায়গা থেকে তুমি ঠিক ছিলে চাঁদ। ভুলটা আমরই হয়েছে। আমার আগে থেকেই তোমাকে সবটা জানানো উচিত ছিল।এই মেয়েটার নাম নাদিরা, বাড়ি মুহাম্মদপুরে । সেখানকার চেয়ারম্যানের মেয়ে।গতকাল নাদিরার বিয়ে ছিল।ও বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে ঢাকা চলে যায়। নিজের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধার আশায়।কিন্তু ছেলেটা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।ওর থেকে টাকা পয়সা সব কেড়ে নেয়। গয়না গুলোও নিতে চেয়েছিল। কিন্তু নাদিরা বুদ্ধি করে বলেছিল গয়নাগুলো সিটি গোল্ডের।তাই অযথা গয়নাগুলো নেয় নি।
রাস্তায় নাদিরা কে আমি কান্নারত অবস্থায় দেখি।
সেই মুহূর্তে আমার মামনি র মুখটাই বারবার মনে পড়ছিল। একজন বাবা হয়ে আমি কীভাবে তাকে মাঝ রাস্তায় ফেলে আসতাম? মামনি তুমিই বলো আমি কি কোন ভুল করেছি?”
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার কানে মিও মিও শব্দ ভেসে আসে।আমি পেছনে ফিরতেই দেখি ব্রাউনি। আমাকে দেখেই ব্রাউনি ছুটে আসে।।আমি ব্রাউনি কে কোলে তুলে আদর করে দিই।ব্রাউনিও আমাকে আদর করে দেয়।
ব্রাউনি কে খাবার দেওয়ার জন্য কিচেনে যেতেই দেখি রুশু রান্না করছে।রুশু আমাকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করে,
“ আঙ্কেল , আর একটা অপরিচিত মেয়ে এক ঘরে থাকবে, ব্যাপার টা কেমন লেইম দেখায়।তাই আঙ্কেল বাড়ি ফেরার সময় আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”
এবার আমার ভীষণ কান্না কান্না পেল।আমি ছুটে গিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।ভেজা গলায় বললাম,
“ ইউ আর দ্য বেস্ট ফাদার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।আই লাভ ইউ সো মাচ বাবা।”
বাবা আমার কপালে চুমু খেলেন।মুচকি হেসে বললেন,
“ আই লাভ ইউ টু মাই ডেয়ার।”
পরাগ ভাই এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলেন।এসব ফ্যামিলি ড্রামা দেখে অভ্যস্ত তিনি।তার ফ্যামিলি তে প্রতিনিয়ত এমন ড্রামা সিরিজ চলতেই থাকে।বাবা এতোক্ষণ পরাগ ভাই কে দেখেন নি।হুট করে পরাগ ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই তিনি চমকে ওঠেন। থতমত খেয়ে বলেন,
“ আরে পরাগ বাবা যে? সরি বাবা।তোমার সামনে…”
“ ইটস্ ওকে আঙ্কেল।”
বাবা পরাগ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে আসলেন।তার কাঁধে হালকা চাপড় মেরে বললেন,
“ শুনলাম তুমি নাকি এম এম কলেজের লেকচারার হয়েছ?”
“ জ্বি আঙ্কেল।এক তারিখ থেকে জয়েনিং।”
“আমার নিজেরও ইচ্ছে ছিল শিক্ষক হবার। কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি পুলিশ হয়ে গেলাম।
তুমি শিক্ষক হয়েছ শুনে আমি অনেক খুশি হয়েছি।আ’ম প্রাউড অফ ইউ মাই বয়। উইশিং ইউ অল দ্য বেস্ট উইথ লটস অফ প্রেয়ার্স।
“ থ্যাংক ইউ আঙ্কেল।এবার তাহলে আসি আমি?”
পরাগ ভাই চলে যাবে শুনেই আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠল।এই মানুষ টাকে আমি জাস্ট সহ্য করতে পারছি না।আপদ যতো তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততই মঙ্গল। কিন্তু আমার আশায় জল ঢেলে দিলেন বাবা।তিনি কপালে চোখ তুলে বললেন,
“ আসি মানে কী হ্যাঁ? কতো গুলো বছর পরে আমার বাড়িতে তোমার পায়ের ধুলো পড়েছে। তুমি কী ভেবছ আমি সহজে তোমাকে ছেড়ে দিব?”
“ আমাকে যেতে হবে আঙ্কেল।অনেক কাজ পেন্ডিং রয়েছে।”
“ তোমার সাহস তো কম নয়,তুমি এসিপির মুখে মুখে তর্ক করছো? কমপক্ষে দুটো দিন হলেও আমাদের সাথে থাকতে হবে তোমার।এখন যাও উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।মামণি তোমার ভাইয়া কে উপরের রুমে নিয়ে বলতেই বাবার ফোন বেজে ওঠে।বাবা এক্সকিউজ মি বলে বাইরে চলে যান।
পরাগ ভাই আমার অপেক্ষা করেন না।নিজেই দেমাগ দেখিয়ে উপরের রুমে চলে যান।আমিও ঠাঁই সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি।তার দেমাগ দেখার মতো সময় নেই আমার।আমি তার খাই না পড়ি যে তার দেমাগ দেখব? আমি ভেংচি কেটে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রুশু আমার পথ আটকে দাঁড়ায়।উপরের রুমের দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে মুচকি হাসে।মাতাল স্বরে বলে,
“এই হট মা'ল টা কে রে?”
“ আমার মামাতো ভাই।”
“ একটু সেটিং করিয়ে দে না।”
“পাঁচ লাখ টাকা দে, সেটিং করিয়ে দিব।”
কথাটা বলার সাথে সাথেই মনে হলো কেউ আমার কানে ফিসফিস করে বলে গেলো,
“ নিজের বর কে মাত্র পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছিস? তুই জাহান্নামে যাবি পাপিষ্টা নারী!”
পরাগ ভাই সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছেন ।মাঝে মধ্যে কাজ করতে করতে নিম্নাষ্ঠ কামড়ে ধরছেন।আপাতত আমার কোন কাজ নেই।আমি সিঁড়িতে বসে কাটা চামচ দিয়ে চা খাচ্ছি।আর পরাগ ভাইয়ের ঠোঁট কামড়ানোর দৃশ্য দেখছি।বুড়ো ব্যাটা বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কামড়াচ্ছে।বড্ড অশোভনীয় লাগছে দেখতে। কিন্তু কিছু করার নেই।মা কড়া গলায় বলে দিয়েছেন তার আব্বাজানের খেয়াল রাখতে। প্রয়োজনে হাগু, মুতু, ছুচু করিয়ে দিতে।
আমি পরাগ ভাইয়ের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ঠিক তখনই রুশু এসে আমার গাল বন্ধ করে দিলো। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
কীরে এতো মনোযোগ দিয়ে কী দেখছিস?”
আমার উত্তরের অপেক্ষা করলো না রুশু। পুনরায় বলে উঠলো,
“ পরাগ ভাই ল্যাপটপ কোথায় পেলো?”
তুই জানিস না আমার বাবা একজন এসিপি? আমার বাবার হাত অনেক লম্বা? তার একটা ফোনকলে পরাগ ভাইয়ের ল্যাপটপ যশোর থেকে মাগুরা চলে এসেছে।তবে আমার বাবার হাত অনেক লম্বা হলেও বুদ্ধি তে খাঁটো। শুধু পরাগ ভাইয়ের ল্যাপটপ টাই আনিয়েছেন।তার যে কাপড় চোপড় প্রয়োজন, সেটা তার গোবর পোড়া মাথায় আসে নি।ফ্রেশ হয়ে বাবার শার্ট, লুঙ্গি পরেছেন।”
রুশু আমার পাশে আয়েশ করে বসলো।পরাগ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
ঢিলেঢালা শার্ট, লুঙ্গিতে একটা ছেলেকে যে এতো হট লাগতে পারে, এটা হয়তো পরাগ ভাই কে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।কী ফিগার মাইরি! আ’ম তো ফিদা।”
অ্যাই চুপ কর না! পরাগ ভাই শুনতে পাবে।”
শুনতে পেলে পাক, কুচ পরোয়া নেহি।”
তুই পরাগ ভাই কে চিনিস না রুশু।উনি….”
রুশু হেসে ফেলে মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিল। রসিকতা করে বলল,
তুই এমন ভাবে বলছিল যেন পরাগ তোর বিয়ে করা বর। তুই তাকে ইঞ্চি তে ইঞ্চি তে চিনিস।”
বর কথাটা বজ্রের ন্যায় কানে বাজতে লাগলো আমার। হঠাৎ’ই গলা শুকিয়ে গেল। চায়ের স্বাদ তেতো হয়ে উঠলো। রুশুর মুখে হাসির ঝিলিক।কিন্তু আমার চেহারাটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলো।আমি উঠতে গেলে রুশু আমার হাত টেনে সিঁড়িতে বসিয়ে দিলো।ভাবুক হয়ে বলল,
“ পরাগ ভাই কয় ফুট লম্বা হবে রে?
আমি জানি না ভাই।”
তুই না জানলেও আমি জানি। পরাগ ইশতেহাম ইলাহী, সে একজন ছয় ফুট লম্বা গড়নের পুরুষ। গায়ের রং ফর্সা। এমন দিপ্তীময় ফর্সা , যেখানে আলো পড়লে ঝলমল করে উঠে। চেহারায় স্পষ্ট খাঁড়া নাক, মেয়েদের মত গোলাপী ঠোঁট, নিচের ঠোঁটের বাম সাইডে কালো কুচকুচে একটা তিল।মুখে দাড়ির ছিটেফোঁটা না থাকায় তিল টা স্পষ্ট ফুটে থাকে সর্বদা।যদিও মানুষ টা হাসেন কম। কিন্তু যেটুকু হাসেন, মৃদু হাসি।আর সেই মৃদু হাসির ফাঁকে বেরিয়ে পড়ে একজোড়া নিখুঁত গজ দাঁত। চুল মাঝারি লম্বা, ঘনও এলিগ্যান্টলি ব্যাক ব্রাশ করা থাকে সবসময়। চোখজোড়া গভীর ও প্রশান্ত।ছাই রঙা চোখের গভীরে যেন আফিম চাষ হয়।সেই চোখের দিকে তাকালেই কেমন নেশা ধরে যায়।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় অসম্ভব মনোযোগী সে।বইয়ের পাতায় ডুবে থাকাতেই যেন তার প্রকৃত সুখ।শিক্ষা জীবনে ফার্স্ট থেকে কখনো সেকেন্ড হয় নি। ক্লাসের প্রথম বেঞ্চেই তার জন্য বরাদ্দ থেকেছে সবসময়। আর শিক্ষকদের চোখে সে এক নির্ভরতার নাম ছিলো। মোদ্দা কথা তাকে এক নজর দেখলে চোখ ফেরানো যায়, কিন্তু তাকে ভুলে যাওয়া যায় না। কারণ, সে এমন সৌন্দর্য ধারণ করে যা চোখে নয়, মনে লেগে থাকে। শিক্ষাজীবনে ভার্সিটির অধিকাংশ মেয়ের হার্টথ্রব ছিলো সে।আই থিংক কর্মজীবনেও তার ব্যতিক্রম হবে না।”
আমি হাসবো নাকি কাঁদব বুঝতে পারছি না। পরাগ আমার বিয়ে করা বর হবার স্বত্ত্বেও আমি তার সম্পর্কে এতো কিছু জানি না।অথচ রুশু আমার বান্ধবী হয়ে তার নাড়ী নক্ষত্র জেনে নিয়েছে। কিন্তু রুশু এতো কিছু জানলো কীভাবে? রুশুকে প্রশ্ন টা করতেই রুশু একগাল হেসে বলল,
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় বেইবি।তোকে বললাম সেটিং করিয়ে দে, তুই দিলি না।তাই আমি নিজেই নিজেকে সেটিং করার চেষ্টা করছি।এখন থেকে পরাগ কে ভাই বলে ডাকিস না। দুলাভাই ডেকে ডেকে প্রাকটিস কর। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”
আমি একবার চোখ মেলে রুশুর মুখের দিকে তাকালাম।ওর মুখে সেই চিরচেনা হাসি।আমি ঠোঁট টিপে হেসে বললাম,
পাঁচ লাখ টাকা দিস, পরাগ ভাই কে দুলাভাই ডাকবো।”
আমার কথাটা পরাগ ভাইয়ের কান অব্দি পৌঁছে গেল।তিনি ল্যাপটপের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।আমি মুরগি চুরি করে ধরা পড়া চোরের ন্যায় মুচকি হাসি দিলাম।পরাগ ভাই কিছু বললেন না।তবে চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন,
“ অতি বাড় বেড়ো না।”
নাদিরা আজকে আমাদের সাথেই থাকবে।যদিও নাদিরা চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মা যেতে দেন নি। নিজের মেয়ের মতো আদর যত্ন করছেন।
বাবা বলেছেন আগামীকাল সকালে তিনি নাদিরা কে মুহাম্মদপুর দিয়ে আসবেন।আমি আর নাদিরা আমার রুমে বসে গল্প করছিলাম।মেয়েটা বেশ মিশুকে। নিজের প্রেমের গল্প শোনাচ্ছে আমাকে।
আমিও নির্লজ্জের মতো বসে বসে জুনিয়রের প্রেম কাহিনী শুনছি। মাঝে মধ্যে কান্নাও করছি।নাকের পানি চোখের পানি মুছতে মুছতে এক প্যাকেট টিস্যু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।
অন্যের দুঃখে ব্যথিত হয়ে কান্না করা বহু পুরনো অভ্যাস আমার। ২০০৯ স্টার জলসা চ্যানেলে মা নামের একটা সিরিয়াল হতো। আমি ঝিলিকের কষ্ট দেখে ডাক ছেড়ে কান্না করতাম।পাশের বিল্ডিং থেকে আন্টিরা ছুটে এসে আমাকে সান্তনা দিতো।সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ২০১৪ সালে শুরু হয় কিরণমালা।কিরণমালার উপর কটকটির অত্যাচার দেখে কেঁদে কেটে বুক ভাসাতাম।এখন অবশ্য সিরিয়াল দেখে কান্না করি না।তবে কারো মুখে কষ্টের কথা, ব্রেকআপের কথা শুনলে কান্না করে দিই।
নাদিরার গল্প অসম্পূর্ণ থাকতেই মা হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে ছুটে আসেন।রুঢ় কণ্ঠে বলেন,
আব্বাজান কতো গুলো বছর পর আমার বাড়িতে এসেছে।তোকে কতোবার বলেছি আব্বাজানের খেয়াল রাখতে। তুই সেটা না করে এখানে বসে বসে গল্প করছিস? বলি তোর কখনো আক্কেল জ্ঞান হবে না?”
আক্কেল দাঁত উঠলে ,তবেই না আক্কেল জ্ঞান হবে? তাছাড়া তোমার আব্বাজান কচি খোকা নয় যে তাকে গলা কাঁটা এসে ধরে নিয়ে যাবে।”
মুখে মুখে তর্ক করবি না।জলদি কিচেনে আয়।
আব্বাজানের রুমে কফি দিয়ে আসবি।”
আমি কিছু বলার আগেই নাদিরা লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে গেলো। মুচকি হেসে বলল,
আমি দিয়ে আসছি আন্টি।”
না না মা। এমনিতেই তোমার উপর অনেক ধকল গিয়েছে।তুমি বিশ্রাম নাও বলেই মা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।আমিও মায়ের পিছু নিলাম। কিচেনে আসতেই মা আমার হাতে ব্লাক কফি ধরিয়ে দিলেন।রুঢ় কণ্ঠে বললেন,
লাফিয়ে লাফিয়ে না গিয়ে হেঁটে হেঁটে যাস।এক ফোঁটা কফিও যেন কাপ থেকে পিরিচের উপর না পড়ে।”
কাপ ভরে দিয়েছো কেন ? একটু কম দিতে পারো নি হ্যাঁ?”
কেন রে ? আব্বাজান খাচ্ছে বলে তোর কি কম পড়ে যাচ্ছে? তোর ফুফু, ফুফাতো ভাইবোন এসে যখন গান্ডে পিন্ডে খেলে তখন কম পড়ে না?যতো সমস্যা আমার বাপের বাড়ির……”
ব্যাস মায়ের টেপ রেকর্ডার চালু হয়ে গিয়েছে।
আমি কিছু না বলে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই কফি দোল খেতে লাগল। ঠিক তখনই আমার একটা রিলস এর কথা মনে পড়ে গেল।আমি রিলস এর ট্রিক ফলো করে এক চুমুকে কাপের অর্ধেক কফি নিজের মুখে পুরে নিলাম।আর পরাগ ভাইয়ের রুমের সামনে এসে সেটা মুখ থেকে বের করে কফিতে মিশিয়ে দিলাম।ব্যাস! একটু চালাক না হলে দুনিয়া চলে না পাগলা।আমি তৃপ্তির হাসি হেসে দরজায় নক করলাম।আর সাথে সাথেই একটা হাত এসে আমাকে টেনে রুমের ভেতর নিয়ে গেলো।।”
পরাগ ভাই এক টানে আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেলেন।আমি কেবল হকচকিয়ে গেলাম না, আতঙ্কে হাত কেঁপে উঠলো।আর সেই কাঁপা হাত থেকে কাপের অর্ধেক কফিটা ছিটকে পড়ল সোজা তার বুকের উপর।
অটোমেটিক গালে হাত চলে যায় আমার ।আমি ও মাগো বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠি।।অথচ পরাগ ভাইয়ের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। তিনি চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।যেন কিছুই হয়নি।তার রহস্যময় দৃষ্টি দেখে আমার বুক ধক করে উঠে। মনে হয়, বুকের ভিতর একটা ছোটখাটো পাখি তীব্রভাবে ডানা ঝাপটাচ্ছে।
পরাগ ভাই তখনো নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কফি পড়ে শার্ট অনেকটা ভিজে গিয়েছে।সেই সাথে বুকও পুড়েছে বোধহয়।
বুক পুড়ুক বা কলিজা পুড়ুক,এতে আমার কী?
সে নিজের দোষে নিজেই পুড়েছে।কী দরকার ছিলো আমাকে এভাবে টেনে আনার? কথাগুলো মনে মনে বলে যখন আমি পরাগ ভাইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাই,অদ্ভুত এক আকর্ষণ আমার পা দুটো আঁটকে দেয়।আমি অর্ধেক কফিটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।তার শার্টের বোতামে হাত রাখতেই তিনি খপ করে আমার হাত দুটো ধরে ফেললেন।আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ে নিলাম কয়েকবার।
ভেবেছিলাম পরাগ ভাই আমাকে থাপ্পড় মেরে
আমার মুখের ডিসপ্লে পাল্টে দিবেন। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটলো না।ঘটলো তার উল্টো টা।
তিনি বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে কফিটা এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। নির্লিপ্ত স্বরে বললেন,
তাড়াতাড়ি শেষ কর।”
পরাগ ভাইয়ের কথা শুনেই আমার হেঁচকি উঠে যায়।না জেনে সাপের বিষও খাওয়া যায়। কিন্তু জেনে শুনে নিজের মুখের থুথু মেশানো কফি কীভাবে খাবো আমি?আমি একবার পরাগ ভাইয়ের দিকে তাকালাম।তার ভাটার ন্যায় জ্বলতে থাকা চোখ দেখে কিছু বলার সাহস হলো আমার। উপায়ান্তর না পেয়ে আমি কফিতে চুমুক দিলাম।কফি একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।মনে হলো যেন তেতো বিষ গলা দিয়ে নামছে আমার।
ইতিমধ্যে পরাগ ভাই শার্টের উপরের তিনটা বোতাম খুলে ফেলেছেন ।তার ফর্সা, উষ্ণ বুকের বাঁ পাশে কফির ছোঁয়ায় লাল হয়ে উঠছে।তার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হলো।আমি দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা বরফের টুকরো তুলে একটা সুতি নরম কাপড়ে জড়িয়ে আনলাম।
রুমে ঢুকে দেখি পরাগ ভাই বিছানার কিনারায় বসে রয়েছেন।আমি ধীরে ধীরে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বরফটা আলতো করে রাখলাম তার উলঙ্গ বুকে।পরাগ ভাই বাঁধা দিলেন না। বরং আমার হাতটা তার বুকের উপর রাখলেন।আমি থমকে গেলাম। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না আমার। বুকের নিচে তার হৃদয়ের স্পন্দন আমার কানে নয়, সোজা মনের মধ্যে বাজছিল।তার সামান্য হাতের ছোঁয়ায় আমার বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল।ছুটে পালাবো, তারও জো নেই।আমার হাত পরাগ ভাইয়ের হাতের মুঠোয়।
আমি চোখ তুলে উপরে তাকাতেই তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো।আমি ত্বরিত চোখ নামিয়ে নিলাম।তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,
গরম কফি পড়ে আমার বুক পুড়ে গিয়েছে? তোর মুখ পুড়ে নি?”
আমি আরেক দফা চমকে উঠলাম।তার মানে পরাগ ভাই আমার চালাকি ধরে ফেলেছেন ?
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরাগ ভাই পুনরায় বললেন,
আমার সাথে একদম চালাকি করতে আসবি না পাপড়ি।আমি মানুষ টা মোটেও ভালো না।”
আমি কিছু না বলে নিঃশব্দে পরাগ ভাইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।আমার কানে শুধু পরাগ ভাইয়ের বলা ভয়ংকর কথাটা বাজতে লাগলো, আমি মানুষ টা মোটেও ভালো না।
এশার নামাজ পড়ে আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিই। কখন যে ঘুম ঘুমিয়ে পড়ি নিজেও জানি না।ঘুম ভাঙ্গে নাদিরার গলার মিষ্টি কণ্ঠে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা বাজে।মা ডিনারের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন।আমি ত্বরিত বিছানা ছাড়ি।ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই খাবারের সুঘ্রাণ এসে নাসিকায় বারি খায়। ডাইনিং টেবিলে এসে দেখি ডিনারে মা হরেক রকমের মজাদার খাবারের আয়োজন করেছেন ।পাঁচ রকমের ভর্তা,সাদা ভাত, কাঁচা আম দিয়ে ডাল, চিংড়ি মাছ দিয়ে কচুর লতি, সর্ষে ইলিশ,পাবদা মাছের ঝোল, রুই মাছ,দেশি মুরগির রোস্ট, মহিষের গোশত,ডিমের কোরমা, পোলাও। ডেজার্ট হিসেবে রয়েছে পায়েস আর মাগুরার বিখ্যাত রসমালাই।
পরাগ ভাইয়ের ডান পাশের চেয়ারে বসেছে রুশু ,আর বাম পাশে নাদিরা।দুজনেই পরাগ ভাইকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।আমি ভেংচি কেটে চেয়ার টেনে বসতেই মা ভাত বেড়ে দিলেন।
বাবা খাবার চিবোতে চিবোতে বললেন,
“মাছের মাথাটা আমার মামণির পাতে তুলে দেওয়া হোক।”
মা বাটি থেকে মাছের মাথাটা আমার পাতে দেওয়ার আগেই আমি প্লেট সরিয়ে নিলাম। গলা উঁচিয়ে বললাম,
“না না বাবা আমি মাছের মাথা খাবো না।”
কেন মামণি?”
আমি মাছের মাথা খাবো না।আমি শুধু আমার জামাইয়ের মাথা খাবো।
কথাটা শোনা মাত্রই পরাগ ভাই কেঁশে উঠলেন। আম্মুর পাশাপাশি নাদিরাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো।সে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলে আমি তার হাত ধরে বসিয়ে দিলাম।শান্ত স্বরে বললাম,পরাগ ভাইয়ের দেখভাল করার জন্য তার ফুপি রয়েছে।তোমাকে এতোটা ব্যতিব্যস্ত হতে হবে না।
তুমি চুপচাপ বসে খাও।”
নাদিরা একটু লজ্জা পেল বোধহয়।সে আর খেলো না।পেট ভরে গিয়েছে বলে আমার রুমে চলে গেল।সে যেতেই মা আমার পিঠে দড়াম করে কিল বসিয়ে দিলেন।ক্ষুদ্ধ স্বরে বললেন,
খুব শখ না জামাইয়ের মাথা খাওয়ার? এতো গুলো বছর আমার মাথা খেয়েও তোর স্বাদ মেটেনি?”
তোমার মাথা হচ্ছে ইলিশ মাছের, আর জামাইয়ের মাথা হচ্ছে পাঙ্গাশ মাছের।ইলিশ মাছের মাথার থেকে পাঙ্গাশ মাছের মাথা স্বাদ বেশি।বুঝলে?”
“ হ্যাঁ।”
কী বুঝলে?”
এটাই যে তোকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে যে তোকে উঠতে বসতে ছ্যাঁচতে পারবে। তোকে তীরের মতো সোজা করে দিতে পারবে।”
বাবা এবার গর্জে উঠলেন,
আহ্! কী হচ্ছে এসব?বাড়িতে এসেছিলাম একটু শান্তি করতে।এখন তো মনে হচ্ছে আমার এখানে আসাটাই উচিত হয়নি।আমি কাল সকালে নাদিরাকে মুহাম্মদ দিয়ে ওই পথেই বরিশাল ফিরে যাবো বলেই বাবা খাবার ছেড়ে উঠে গেলেন।
রুশু আমার সাথে থাকতে চেয়েছিলো, কিন্তু আবহাওয়া গরম দেখে রুশু অল্প পরিমাণে খেয়ে নিজেদের বিল্ডিংয়ে চলে গেলো।
আমি খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমনোর জন্য মায়ের রুমের দিকে পা বাড়াতেই হাতে টান পাই।আমি পেছন ফিরে দেখি পরাগ ভাই আমার হাত ধরে রেখেছেন।আমি চমকে উঠি।ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
কী হয়েছে?”
পরাগ ভাই ফোন টিপছিলেন।তিনি ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে আমার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন ।গলার স্বর টা নিচু করে বললেন,
ওই দিকে কোথায় যাচ্ছিস?”
শুতে।”
তোর মাথায় কি বুদ্ধি বলতে কিছু নেই? পুরোটাই গোবর দিয়ে ভরা? দেখছিস সকাল থেকে ফুপি আর আঙ্কেলের মধ্যে মান অভিমান চলছে। কোথায় রাতে তাদেরকে একা ছেড়ে দিবি।
তা নয় তো তুই তাদের মধ্যে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিস।ব্রেইনলেস একটা।”
আমি নত হয়ে বললাম,
“আমি ছোট বেলা থেকেই মায়ের সাথে ঘুমোই।
একা একা ঘুমতে পারি না।আমার ভয় করে।”
পরাগ ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“ ভয় করলে আমার সাথে শো।”
0 Comments