রূপকথার শহর! (পর্ব-২৩) | নবনী নীলা

রূপকথার শহর! (পর্ব-২৩) | নবনী নীলা

রাহিকে নিয়ে রুদ্র এখন আরহানের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরটা একধরনের চাপা উত্তেজনায় ঠাসা। রাহির মন অস্থির—আরহান ও কায়ান একসাথে, এটা যেন আগুন আর বারুদের সাক্ষাৎ। মুখোমুখি হলে কী অঘটন ঘটে, সেই আশঙ্কায় তার বুক ধড়ফড় করছে।

রুদ্র চুপচাপ কিছুক্ষণ গাড়ি চালিয়ে হঠাৎ বললো,

“আমি এখনো বুঝি না—এই কায়ান যখন-তখন তোমাকে তুলে নিয়ে যায় কেন?”

রাহি আড়চোখে তাকালো। রুদ্রর প্রশ্নের ধরণটা তার পছন্দ হয়নি।


কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর রুদ্র আবার বললো,

“স্যারের বাড়ির বাইরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে—তুমি নিজেই কায়ানের গাড়িতে উঠে পড়েছো। এই বোকামি তুমি করলে কীভাবে, রাহি?”

এইবার রাহি পুরোপুরি অপ্রস্তুত। সত্যিই তো… সিসিটিভি দেখে কারও মনে হতেই পারে সে স্বেচ্ছায় গিয়েছে। কী বলবে এখন?

একটু থেমে, নিচু গলায় রাহি বললো,

“আমি নিজের ইচ্ছায় যাইনি। কায়ান আমাকে হুমকি দিয়েছিল।” রাহির কণ্ঠে ব্যর্থ আত্মপক্ষের সুর।

“ ওহ। যতই হোক। নিজে আত্মসমর্পণ না করে আমাদেরকে ডাক দিলেও পারতে।”, রুদ্রের এই উক্তিতে রাহি আগুন চোখে তাকালো। এই প্রসঙ্গ তার পছন্দ হচ্ছে না।

রাহির অগ্নি চোখ দেখে রুদ্র আর কিছু বললো না। 

গাড়ি এসে থামলো আরহানের বাড়ির সামনে। ইশা বাগানে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। রাহিকে বাড়িতে আনার নির্দেশ  তারই ছিল।

হঠাৎ গেটের বাইরে গাড়ির শব্দ শুনে ইশার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। সে ছুটে গেটের দিকে যেতে চাইলো, কিন্তু ভিতরের নিরাপত্তারক্ষী তাকে আটকে দিলো।

ইশা দাঁড়িয়েই বাইরে চোখ রাখলো—গাড়ি থেকে রাহি নামছে। কিন্তু…

আরহান নেই!

উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ইশা চিৎকার করে উঠলো,

“আরহান…! আরহান কোথায়?”

ইশার এই ডাকে ছুটে এলো রুদ্র। সে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

“স্যার আসেননি। আমাদের দুজনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

ইশার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেলো। চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ে বললো,

“আসেনি মানে? তোমরা ওনাকে একা রেখে চলে এসেছো?”

রুদ্র মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বললো,

“স্যারের আদেশ ছিল। আমরা বাধ্য।”

ইশার চোখে মুখে অস্থিরতা স্পষ্ট। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে, চোখে ভেসে উঠছে উৎকণ্ঠার ছাপ। ঠিক তখনই রাহি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালো।

নরম কণ্ঠে সে বললো,

“শান্ত হও, ইশা। স্যার ফিরে আসবেন… কিছুক্ষণ পরেই।”

রাহির নিজের অস্থিরতা লুকিয়ে ইশাকে সামলে রাখার চেষ্টা করলো।

আরহান গাড়ি চালিয়ে ফিরছে বাড়ির পথে। রাত অনেক হয়েছে, চারপাশ নিস্তব্ধ। কিন্তু তার ভিতরে চলছে এক তীব্র ঝড়—বাবার মৃত্যু।

যেই বাবার কোনো স্মৃতি তার মনে নেই, তবুও রক্তের গভীরে এক আগুন জ্বলছে, প্রতিশোধের আগুন।

সে এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো—পিছনে দু’টি বাইক অনেকক্ষণ ধরে তাকে অনুসরণ করছে। সন্দেহ জেগে উঠতেই আরহান সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিলো।

তাক লাগানো ব্যাপার হলো—পেছনের বাইক দুটোও থেমে গেলো। তারা পালানোর চেষ্টা করলো না, বরং নীরব দাঁড়িয়ে রইলো।

আরহান গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত নিজের বন্দুক বের করতেই বাইকে থাকা দু’জন সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে আত্মসমর্পণ করলো। আরহান ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলো। তার ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে।

“কে পাঠিয়েছে তোদের?” আরহান রীতিমতন হুমকি দিয়ে বললো।

তাদের একজন হেলমেট খুলে ধীরে বললো, “ কায়ান।…… আমরা আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।”

আরহান তাচ্ছিল্যভরে হেসে বললো, “মরতে না চাইলে এক্ষুনি সত্যি বল।”

তাদের পোশাক আর হাবভাব দেখে আরহান বুঝে গেল—এরা কায়ানের সাধারণ লোক নয়, এরা ছদ্মবেশে এসেছে।

“সত্যি বলছি,”।

আরহান বিরক্ত হয়ে ফোন বের করে কায়ানকে কল করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ঘুম জড়ানো কণ্ঠ—

“হ্যালো ব্রাদার।”

আরহান রাগে গর্জে উঠলো, “ তোর লোকেরা আমাকে ফলো করছে কেন?”

কায়ান হালকা হেসে জবাব দিলো, “রিল্যাক্স ব্রাদার। আগেরবার তো মরতে মরতে বেচেছিলি। আগে বাপ মরার প্রতিশোধটা তো নে, তারপর না হয় মরিস।”

বলেই কায়ান কল কেটে দিলো।

আরহান দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো।

বাইক দুটি আরহানের গাড়িকে অনুসরণ করতে করতে বাড়ি পর্যন্ত এসে থামে। রাত তখন প্রায় দুইটা। বিরক্ত ও সতর্ক হয়ে আরহান গাড়ি থেকে নামলো।

নিজেকে সে কঠিনভাবে মনে করিয়ে দিলো—কায়ানকে বিশ্বাস করার প্রশ্ন উঠছে না।

বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডকে নির্দেশ দিলো,“ওই বাইক দুটোকে নজরে রাখো। কোথায় যায়, কি করে—সব রিপোর্ট চাই।”

গেটের ভেতরে পা রাখতেই আরহানের চলার গতি থেমে গেল। দরজার সামনে, বারান্দার এক কোণে বসে আছে ইশা—গালে হাত দিয়ে, চোখে ঘুম আর ক্লান্তির ছায়া।

সেই দৃশ্যটা বুকের গভীরে আঘাত করলো আরহানের। এমনটা কি হবার কথা ছিল? সত্যিই কি সে পেরেছে এই মেয়েটিকে আগলে রাখতে! যাকে নিজের কাছে আগলে রাখবে বলে নিয়ে এসেছিল? প্রতিনিয়ত একটা অস্থিরতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাকে।

নিজের ভিতরে একরাশ অপরাধবোধ নিয়ে নিঃশব্দে ইশার পাশে এসে দাঁড়ালো সে।

ইশা চোখ মেলে তাকাতেই, মুহূর্তে তার মুখে ফুটে উঠলো প্রশান্তির রেখা—

যেন তার সমস্ত অপেক্ষা মিলিয়ে গেল এক দৃষ্টিতে।

এক সেকেন্ড দেরি না করে সে উঠে দাঁড়ালো, আর কোনো কথা না বলে মুহূর্তে জড়িয়ে ধরলো আরহানকে।

তার বুকের সাথে বুক মিশে গেল, নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠলো।ভয়, অস্থিরতা, অভিমান—সবকিছু যেন এক আত্মিক ছোঁয়ায় গলে গেল।

আরহানের বুকের মাঝে মুখ গুঁজে ইশা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো তাকে। আরহান নিঃশব্দে মাথা ঝুকিয়ে মুখ গুঁজে দিলো ইশার চুলে।তার বুকের গভীরে এক অজানা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়লো।

ইশা হালকা কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,

“আপনি… আমার কল ধরেননি কেন? এতো দেরি…”

কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেলো—কণ্ঠে ধরে এলো কান্না। আর তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে ভিজিয়ে দিলো আরহানের শার্টের বুকপাশ।

আরহানের বুকের ভিতরে একধরনের অসহ্য যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠলো।

সে ধীরে ইশার মুখ নিজের বুক থেকে তুলে, হাতের মুঠোয় চিবুক ধরে তার দিকে তাকালো।

ইশার চোখে তখনও টলটল করছে জল। হারিয়ে ফেলার ভয়।

আরহান আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না।এক তীব্র আবেগে সে ইশার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো নিজের ঠোঁটে—নিঃশব্দ এক আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি।

ইশাও আর নিজেকে সরিয়ে রাখলো না।

দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো আরহানের গলা,

আর তখনই ড্রয়িং রুমে বসে থাকা রাহি ও রুদ্র এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে গেলো।

রাহি মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিলেও, রুদ্র থতমত খেয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো— তার চোখদুটি যেন রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেছে।

রাহি তার অস্বস্তি চাপা দিতে না পেরে পাশের সোফার বালিশ তুলে রুদ্রের দিকে ছুঁড়ে মারলো।

"আউচ!" — রুদ্র আওয়াজ করে উঠলো। 

রুদ্রের আওয়াজে ইশা নিজেকে সরিয়ে এনে লজ্জায় আরহানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো। রাহি আর রুদ্র যে ভিতরে আছে ইশা একদম ভুলে গিয়েছিল।

হঠাৎ  অন্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে আরহান এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভিতরের দিকে তাকাতেই দেখলো—রাহি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে, আর রুদ্র সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমের ভান করছে, যদিও মুখের অদ্ভুত ভঙ্গি বলে দিচ্ছে—সবই নাটক।

আর কোনো কিছু না ভেবে, চুপচাপ, আরহান ইশাকে কোলে তুলে নিলো।

ইশা চমকে উঠলো, লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নিলো আরহানের কাঁধে। তার মনে হলো, এখনই যদি মাটি ফেটে যেত, সে লুকিয়ে পড়তো।

তারপর ফিসফিস করে বললো,“আবার কোলে তুলেছেন কেন? উফফ… ওরা দেখছে…”

আরহান একরকম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলো,

“দেখুক।” বলেই চোখ রাখলো ইশার ঠোঁটে— তার অভিপ্রায় স্পষ্ট।

ইশা লজ্জায় কাঁপতে কাঁপতে হাত বাড়িয়ে আলতো করে আরহানের মুখ ঘুরিয়ে দিলো অন্যদিকে।

আরহান সেই মুহূর্তে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বললো,“ওরা এখানে কি করছে?

ইশা আরহানের কাধে মাথা রেখে বললো,“ওরা আমার সাথে আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিল…”তারপর  হাত বাড়িয়ে আরহানের মুখে, গলায় আলতোভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুঁজে দেখতে লাগলো—কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা।

আরহান ঠোঁট কুঁচকে বললো,“উফফ… ওয়েট বেবি! রুমে যেতে দাও। এখানেই শুরু করবে নাকি?”

ইশা লজ্জায় তড়িঘড়ি করে হাত সরিয়ে নিয়ে আড়চোখে তাকালো তার দিকে।

আরহান মুচকি হেসে বললো,

“যদিও আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তুমি অস্বস্তিতে পড়ে যাবে।”

বলেই সে ঠোঁট প্রশস্ত করে এক রকম দুষ্টু হাসি দিলো।

ইশা গাল ফুলিয়ে বললো,

“আজেবাজে কথা বলবেন না। আর আজকে আপনার মেজাজ এত ভালো কি করে?”

আরহান চোখ নামিয়ে নিচু গলায় উত্তর দিলো,

“That kiss… and your lips…”

আরহান বাকিটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ইশা এক হাতে তার মুখ চেপে ধরলো,

“উফ! হয়েছে, আর কিছু বলতে হবে না।”

আরহান মৃদু হাসিতে কিছু না বলে ইশাকে রুমে নিয়ে গেলো। তারপর ধীরে, এক আলতো ছোঁয়ায়, নিজের কোল থেকে ইশাকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।

নিচের মুহূর্তটা মনে পড়তেই ইশা চোখ বন্ধ করে ফেললো লজ্জায়।

ইস! কি লজ্জার ব্যাপার…

আরহান তখন নিজের শার্টের বোতাম খুলছে—

আর হালকা দুষ্টু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ইশার লাল হয়ে যাওয়া গাল দুটো’র দিকে।

ইশা একবার গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে মনে মনে বোঝালো,“এটা স্বাভাবিক… নিজের জামাইকে আমি কিস করতেই পারি, এতে লজ্জার কিছু নেই। হ্যাঁ, স্বাভাবিক…”

কিন্তু চোখ যেই না গেলো আরহানের দিকে, মুহূর্তেই সেই স্বাভাবিকতা গলে গেলো তার ভেতরে।

মনটা হঠাৎ করে ভালো লাগায় ভরে উঠলো, আবার ঠিক তখনই এক অজানা আতঙ্ক এসে চেপে বসলো বুকের ওপর।

একটু থেমে  ইশা বললো—“আপনি কি… 

পেনড্রাইভটা কায়ানকে দিয়ে দিয়েছেন?”

ইশা একবার গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে মনে মনে বোঝালো,“এটা স্বাভাবিক… নিজের জামাইকে আমি কিস করতেই পারি, এতে লজ্জার কিছু নেই। হ্যাঁ, স্বাভাবিক…”

কিন্তু চোখ যেই না গেলো আরহানের দিকে, মুহূর্তেই সেই স্বাভাবিকতা গলে গেলো তার ভেতরে।

মনটা হঠাৎ করে ভালো লাগায় ভরে উঠলো, আবার ঠিক তখনই এক অজানা আতঙ্ক এসে চেপে বসলো বুকের ওপর।

একটু থেমে  ইশা বললো—“আপনি কি… 

পেনড্রাইভটা কায়ানকে দিয়ে দিয়েছেন?”

আরহান থেমে গিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ইশা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে, যেই আরহানকে সে চেনে, সে কখনো এত সহজে সমঝোতা করতে পারে না।

ইশা অবাক গলায় বলল, “এত সহজে মেনে নিলেন?”

কিছুক্ষণ নীরব থেকে আরহান আবারও হালকা মাথা নাড়ল। ইশার চোখে মুখে বিস্ময় দেখে সে ইশার পাশে গিয়ে বসে পড়ল।

নিজেই প্রশ্ন করল, “জানতে চাইবে না, কেনো দিয়েছি?”

ইশা শ্বাস আটকে প্রশ্ন করল, “কেনো দিয়েছেন?”

আরহান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে ইশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ইশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও পরক্ষণেই আরহানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আরহান স্থির দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ইশা আবার প্রশ্ন করল, “বলুন, কেনো দিয়েছেন?”

আরহান  নিচু স্বরে বলল, “কায়ান নিজের বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায়। সেই কারণে পেনড্রাইভটা চেয়েছিল।” কথাটা বলেই আরহানের কণ্ঠ থমকে গেল। ইশা অবাক হয়ে রইল—কায়ানের বাবা… মানে? আরহানেরও বাবা!

ইশা শান্ত গলায় বলল, “হুম… বুঝলাম…” বলে কিছুক্ষণ চুপ করে আরহানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

একটু পরে আবার প্রশ্ন করল, “আপনার কি খারাপ লাগছে?”

আরহান গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “না! খারাপ লাগবে কেনো?”

ইশা আলতো স্বরে বলল, “আপনার বাবা…!” কথাটা শেষ না করেই চুপ করে গেল।

আরহান তিক্ত হেসে বলল, “কোন বাবার কথা বলছো? যাকে কোনোদিন দেখেছি কিনা মনে নেই, তার কথা?”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, “খারাপ লাগছে না, কিন্তু ভেতরে আগুন জ্বলছে… প্রতিশোধের আগুন। নিজেকে হিংস্র পশুর মতো লাগছে।”

ইশা ধীরে ঝুঁকে এসে আরহানের কপালে আদর করে চুমু দিল। আরহানের ঠোঁটের কোণে একফোঁটা শান্তির হাসি ফুটে উঠল। সে চোখ বন্ধ করে ইশার স্পর্শটুকু গভীরভাবে অনুভব করতে লাগল। ভালোবাসার উষ্ণতায় তার বিক্ষুব্ধ মনটা খানিকটা শান্ত হলো।

আরহান ধীরে হাত বাড়িয়ে ইশার গালের ওপর আলতো করে স্পর্শ রাখল। তার আঙুলের উষ্ণতা ইশার ত্বক ছুঁয়ে একটুখানি কাঁপুনি এনে দিল। আরহান হেসে মৃদু স্বরে বলল,

“দেখো, আমাকে তুমি কীভাবে তোমাতে বশ করে ফেলেছো।”

আরহানের কথায় ইশা ঠোঁট কামড়ে কোনোমতে হাসি চেপে রাখল। তারপর চোখ ছোট করে হাসি গোপন করে বলল,

“সবে তো শুরু। এরপর আমাকে ছাড়া নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসবে আপনার।”

আরহান শিউরে উঠে সাথে সাথে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভান করল। চোখ বড় বড় করে ইশার দিকে তাকিয়ে রইল। ইশা হঠাৎই ভয় পেয়ে গেল। আতঙ্কিত গলায় বলল,

“কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেনো!”

আরহান কষ্টের ভান করে ফিসফিসিয়ে বলল,

“নিশ্বাস নিতে পারছি না… সিপিআর লাগবে…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই সে ইশার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল। ইশা এক মুহূর্তের জন্য রাগ করবে নাকি লজ্জা পাবে—তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

আরহান হালকা চুমুর পর ইশার কাছ থেকে সরে এসে নিশ্বাস নিয়ে বলল,“ হুম, এবার ভালো লাগছে।”

ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল আরহানের। ইশা রাগে চোখ কুঁচকে তাকালেও পরক্ষণেই হেসে ফেলল—রাগ আর অভিমান মিশে তার মুখটা লাল হয়ে উঠল।

কায়ান ঘুম থেকে উঠেছে। নিজের রুমটা তার হঠাৎ ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। শুধু রুমই নয়—এই পুরো বাড়িটাই যেনো আজ বিষাদে ঢাকা। কেনো এমন লাগছে? রাহি নেই বলে?

এক মুহূর্তে নিজের উপরই বিরক্তি লাগলো কায়ানের। যে মেয়েটার চোখের কোণে তার জন্য কোনো দুর্বলতা নেই, তার জন্যই সে আজ এভাবে অস্থির! নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক এক হাসি, হেসে ফেললো সে।

আজকের দিনটা ছোট কোনো দিন নয়। আহাদ মির্জা নিজে দেখা করবে কায়ানের সাথে। আরহান যে পেনড্রাইভটা দিয়েছে, ওটা নিয়ে কথা হবে। 

তবে সমস্যা একটাই—আরহান কায়ানের পিছু একেবারে ছাড়ছে না। কী কথা হচ্ছে, কী হচ্ছে—সবই লাইভ দেখতে চায় সে। সেই জন্যই লোকেশনজুড়ে গোপনে সিসিটিভি, স্পিকার—হরেক রকম ডিভাইস বসানো হচ্ছে। আরহান যে এমনটা করবে, এতদূর যাবে—কায়ান ভাবতেও পারেনি আগে।

প্রীতিকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে কিছুদিন হলো। প্রতি রবিবার কায়ান ওকে দেখতে যায়। আজও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছে আর যাওয়া হবে না। আজ অনেক কিছু সামলাতে হবে তাকে। প্রীতির অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে—সেরে উঠবে কি না, কায়ানেরও আর ভরসা থাকে না।

শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে টেবিলের উপর রাখা চিঠিটা আর আংটিটার দিকে চোখ গেলো কায়ানের। কতটা শক্ত মনের হলে একটা মেয়ে এমন করতে পারে! রাহি কি আদৌ এই চিঠি খুলে দেখেছে—এখনো সন্দেহ হয় কায়ানের।

অবশ্য, একবার যদি সে স্থির করে ফেলে, তবে এক মুহূর্তও দেরি করবে না—সেকেন্ডেই তুলে নিয়ে আসবে রাহিকে। তার আগে নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করছে কায়ান।

কিন্তু তুলে এনেই বা কী হবে? রাহিকে সে কোনোদিন জোর করতে পারবে না। তাহলে…? এতদূর ভাবতেই কায়ানের মাথায় যেনো কিলবিল করে ব্যথা উঠে যায়।

ইশা রাহির সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ খেয়াল করলো, রাহির হাতের সেই পরিচিত আংটিটা নেই। অবাক হয়ে সে বলল,

“তোমার আংটিটা কোথায়?”

রাহি একটু অস্বস্তি বোধ করলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সবটুকু খুলে বলতেই ইশা হতভম্ব হয়ে গেলো। কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে ইশা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।

তারপর হালকা গলায় বলল, “কায়ান মনে হয় তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”

রাহি কঠিন দৃষ্টিতে ইশার দিকে তাকাতেই ইশা তাড়াতাড়ি ঠোঁট চেপে ধরে হাসি গিলে ফেললো। বুঝতে বাকি রইলো না, এই ধরনের কথা রাহির একদমই পছন্দ হচ্ছে না।

আরহান নিজের অফিসে বসে আছে। চোখ স্থির ল্যাপটপের স্ক্রিনে, কানে হেডফোন। চেহারায় অদ্ভুত এক শান্ত ভাব।

ছোট্ট, নির্জন রুমটা যেনো গোপন কথোপকথনের আদর্শ স্থান। বসার জন্য দু’টি সোফা আর মাঝখানে একটি টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। এক সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে কায়ান। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্যামেরার লেন্সের দিকে মাঝেমধ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে সে—ভালো করেই জানে, আরহান ও পাশের মনিটরে তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি দেখছে। আরহান বিরক্ত হবে, এটাই যেনো কায়ানের বিনোদন।

কায়ানের শার্টের বোতামে বসানো আছে সূক্ষ্ম মাইক্রোফোন। বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই, অথচ ভেতরে গোপন কথার ঝাঁপি খুলে যাচ্ছে আরহানের কাছে। পরিস্থিতি যত জটিলই হোক, এই খেলাটা কায়ানের কাছে বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে।

ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ঢুকলো আহাদ মির্জা। নাম শুনে কায়ান ভেবেছিলো কেউ ভদ্র, মার্জিত ধরনের হবে। বাস্তবে সে একদমই উল্টো। ঠোঁটের উপর ঘন লম্বা গোঁফ, গলায় মোটা কয়েকটা চেইন ঝুলছে। ঢিলেঢালা না, বরং টাইট ব্লেজার যেনো কোনোভাবে শরীরের ভাঁজ ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। পেটের মেদ শার্টের বোতাম ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে মরিয়া। যেনো এক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলবে, “ টুকি।”

কায়ানের মুখে মাস্ক—এ precaution ভীষণ দরকারি। কারণ সামান্য মুখ দেখলেই আহাদ মির্জা ঠিকই বুঝে যাবে, আরহান ও কায়ান দুই ভাই। অফিসার আরহানকে আহাদ মির্জা চিনে যার পিছনে গত পাঁচ মাস গাধার মতন দৌড়াতে হয়েছে তাকে। আর এই মুহূর্তে সেটাই সবচেয়ে বড় বিপদ।

Post a Comment

0 Comments