সর্বনাশা ইন্টারনেট | অহনা রহমান

আমি আমার কারণেই ধ*র্ষিত হয়েছি। নিজের হাতেই নিজের পেটে আসা ভ্রুন টাকে হত্যা করেছি। বাচ্চাটাকে আমি মারতে চাইনি, কিন্তু এই সমাজেও তো আমাকে বাঁচতে হবে। তাই আমার আর কোন উপায় ছিল না।

তখন আমি নতুন ভার্সিটিতে উঠেছি কত কত বন্ধু-বান্ধব হয়েছে আমার। সবাই খুবই স্মার্ট। কিন্তু আমার একটা স্মার্ট ফোন পর্যন্ত নেই।বাবা-মা আগেরকার যুগের হাওয়ায় মোটেও স্মার্টফোন ব্যবহার পছন্দ করেন না। এইজন্য বারবার বলার পরেও কখনো কিনে দেননি। কিন্তু এখন ভার্সিটিতে উঠেছি এখন কি ফোন না হলে চলে? তাই বাবা-মাকে অনেক ভূগোল পড়ালাম। এসাইনমেন্ট, অনলাইন ক্লাস, এসবের কথা বলেই একটা স্মার্ট ফোন কিনলাম।

ফোন কেনার পরে এক বান্ধবীকে দিয়ে ইন্টারনেট চালানো শিখি। এই ইন্টারনেটের চক্করে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম,টিকটক, টেলিগ্রাম,ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, মোটামুটি সব ধরনের মোবাইল অ্যাপসই ব্যবহার করতে শুরু করি। বান্ধবীর সাহায্যে প্রায় তিন মাসের মধ্যেই সবকিছু আয়ত্ত করে ফেলি এসবের। কোথায় পড়াশোনা, কোথায় ক্লাস, সারাদিন শুধু ফোন নিয়ে পড়ে থাকি আমি।স্মার্ট ফোন ব্যবহারের ফলে আমারও অনেক বন্ধু বান্ধবী হয়েছে। তাদের সাথে সারাদিন রাত মেসেজে চ্যাটিং করেই সময় কাটে আমার। বাস্তবে তাদের কাউকেই চিনি না আমি। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় যখন আমার ইন্টারনেট ব্যালেন্স শেষ হয়ে যায়। তাই বাবা মাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় ওয়াইফাই লাইনও আনি।

অনেক অনেক বন্ধু বান্ধবের মধ্যে একজন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আমার সাথে বন্ধুত্ব হয় সৈকত নামের একটি ছেলের। তার সাথে একটু বেশি কথা বলি আমি। সে যদি এক ঘন্টা মেসেজ না দেয় ভালো লাগে না।  সে যেন আমার এক অন্যরকম আসক্তি হয়ে গেলো। সব সময় কথা বলি ছেলেটার সাথে। কথা না বলতে পারলে ভালোই লাগে না। দেখতে দেখতে কেটে যায় কয়েক মাস।এই কয় মাসে আমার এই ছেলে বন্ধুর সাথে কখনোই ভয়েসে বা ফোনে কথা হয়নি। সে এখনো আমাকে দেখে নি। আমিও তাকে দেখিনি।  কিন্তু আজ সে আবদার করেছে আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলার।

আমি তার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছি, কারণ সে আমাকে না দেখেই এতটা পছন্দ করে। এমন না যে আমি দেখতে অসুন্দর, আমি খুবই সুন্দর দেখতে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে আমি। এই প্রথম কোন পর পুরুষের সাথে কথা বলবো তাই কেমন অস্বস্তি লাগছে।  তার ভিডিও কলে কথা বলার আবদার আমি সরাসরি না করিনি। একটু অসম্মতি দেখিয়েছি প্রথমে। তার জন্যই সৈকত রেগে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। অনলাইনে আসলো না দুই ঘন্টা। তাতেই যেন আমার দম আটকে যাওয়ার উপক্রম।  খুবই অস্বস্তি হতে লাগলো আমার। সৈকত কেন জানি বুঝলোই না। তার রাগ যে আমাকে খুব কষ্ট  দিচ্ছিল। এই দুইঘন্টা যেন মনে হলো দুই বছরের সমতুল্য।  ২ ঘন্টা পরে সে যখন অনলাইনে আসলো। আমি প্রথম ভিডিও কল দিলাম তাকে। কল রিসিভ করতে ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো একটি সুন্দর সুদর্শন পুরুষের চেহারা। এরপর সে ফোনে হ্যালো বলতে শুনতে পেলাম জাদুময়ী সম্মোহিত এক কন্ঠ। কি সুন্দর সে কন্ঠ! (বস্তুত শয়তান সব সময় হারাম জিনিস বেশি আকর্ষিত করে তোলে।)

এরপর থেকে আমার প্রায়ই কথা হতো তারসাথে।  ভিডিও কলে, অডিও কলে । আমাদের সম্পর্কটা আরও গভীর থেকে গভীর হতে লাগলো। 

একদিন সৈকত আমাকে ফোন করে বলল, আমাদের বাড়ির পাশের এক বাজারে আসতে। আমি একটু অবাক হলাম তার কথাই।সৈকত বলল সে আমাদের এখানে এসেছে কি একটা কাজের জন্য।আমাকে একটু দেখতে চাই। আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার। তার এই আবদারে আমি সরাসরি নাকচ করে দিলাম। বাসায় কি বলে ম্যানেজ করবো আমি? 

 সৈকত আমাকে বলল,

-- আমি কিছু জানি না। বাসায় যে কোনোভাবে ম্যানেজ করে আসো। না হলে আমার সাথে আর কথা বলা লাগবে না তোমার। 

 সৈকতের একথা শুনেই খুব ভয় লাগলো আমার। আমি তো তার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবো না। আর আমারও খুব ইচ্ছা ওকে সামনাসামনি দেখার।তাই বাবা মাকে মিথ্যা বলে গেলাম সেই বাজারে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে দেখা পেলাম সে কাঙ্খিত মানুষটার। সত্যি মানুষটা সামনাসামনি আরও বেশি সুন্দর।আর কি সুন্দর কথা বলার ধরন তার। আমি তার প্রেমে আরো বেশি করে পড়ে গেলাম। আমি অনেকক্ষণ যাবত ঘুরলাম তার সাথে।

এরপর থেকে প্রায়ই দেখা করতাম আমরা। ঘুরতে যেতাম, বাড়িতে মিথ্যার উপর মিথ্যা বলতাম তার জন্য। বাবা-মা কখনোই সন্দেহ করেননি আমায়। কারন আমি নিতান্তই ভালো মেয়ে। কোন ব্যাড রেকর্ড নেই আমার। হুট করেই প্রেমে পড়ে যাই এই সৈকত নামের ছেলেটার ওপর। ওর ব্যক্তিগত কোন বিষয়ে আমি জানিনা। সে আমাকে কখনো জানায়নি। সেকথা যাগ্গে, আমার ওর পার্সোনাল বিষয় জেনেও কোন কাজ নেই। কারণ ও বলেছে কয়দিন পরেই আমাকে বিয়ে করবে তখনই একবারে জানাবে সব। সারপ্রাইজ হিসাবে! 


এভাবে কেটে গেল অর্ধবছর। এর মধ্যে আমাদের সম্পর্ক আরো ভালো হয়েছে। ১৪ ই ফেব্রুয়ারি! আজ আবার যাবো সৈকতের সাথে দেখা করতে। ও বলেছে আজকে দূরে কোথায় যেন নিয়ে যাবে ঘুরতে আমাকে। একটু দেরি হবে বাড়ি ফিরতে, তাই আমিও বাবা-মাকে বোঝালাম,এক বান্ধবীর বাসায় যাবো গ্রুপ স্টাডি করতে। ফিরতে দেরি হবে।  বাবা মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রওনা হলাম এক অজানার উদ্দেশ্যে।


********


 সৈকত একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল আমাকে নিতে। আমি গাড়িতে উঠতেই গাড়ি শা শা করে চলতে শুরু করলো বাতাসের গতিতে। গাড়িতে সে আমাকে বিভিন্ন গল্পে মজিয়ে রাখল। হঠাৎ আশেপাশের চেয়ে দেখি, নির্জন এক রাস্তা দিয়ে চলছে গাড়ি। সবকিছু ধোঁয়াশা, আশেপাশে নির্জন জায়গা দেখে অজানা ভয় ঘিরে ধরলো আমাকে। সৈকতের চাহনি মতিগতিও আমার ভালো লাগলো না । আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম, "গাড়ি থামাও, কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়?" আমার কথা কেমন যেন সৈকতের কানে পৌঁছালো না। সৈকত গাড়ি থামালো এক পরিত্যক্ত কারখানার সামনে। সে গাড়ি থামাতে, বিশ্রী দেখতে তিনটা ছেলে এসে টেনে হিঁচড়ে নামালো আমাকে গাড়ি থেকে। আমার সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচালাম,  "আমাকে ছেড়ে দাও,কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? ছেড়ে দাও আমাকে তোমরা।" 


শয়তানগুলো শুনলো না আমার কথা। টানতে টানতে নিয়ে গেল ফ্যাক্টরির ভেতরে। চারিদিকে কেমন ঘুমোট গন্ধ। দম আটকে আসার কায়দা। সৈকত সহ তিনটে ছেলে আমাকে নিয়ে গেল ভেতরে একটা বন্ধ রুমে। সেখানে আরো দুজন বসে মদ খাচ্ছে। আমি সৈকতের পা জড়িয়ে ধরলাম আকুতি মিনতি করে বললাম,  


--"আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি? ছেড়ে দাও আমাকে, আমার সাথে এমন করো না তোমরা, দয়া করে যেতে দাও আমাকে। " 


আমার কথা শুনে সৈকত পৈশাচিক একটা হাসি দিয়ে বলল, 

--" হ্যাঁ সুন্দরী ছেড়ে দেবো তোমাকে আগে গ্রুপ স্টাডিটা করি।" 


 ওর কথা শুনে শয়তানগুলো হাসলো। প্রচন্ড ভয় আর গুমোট গন্ধে তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারালাম আমি। তারপর আর কি? যা হওয়ার তাই হলো।


আমার যখন জ্ঞান ফিরলো, নিজেকে আবিস্কার করলাম আমাদের বাড়ির পেছনে এক ঝোপের মধ্যে। সন্ধ্যা হয়নি তখনও, তাড়াতাড়ি উঠে পরনের জামা কাপড় গুলো কোনোমতে ঠিক করে, দৌড় লাগালাম বাড়ির দিকে। বাড়ি ফিরতেই মা হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে হাজির।তাকে কোনরকম বুঝিয়ে এক দৌড়ে গেলাম বাথরুমে। দিন দরিয়ার সবকিছু ভুলে ঝরনা ছেড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম আমি। কোথায় বাবা-মা কোথায় পড়াশোনা কোথায় কি? সবকিছু ভুলে অঝরে কাঁদতে লাগলাম দিনরাত। দিন যায় রাত আসে, আমার শুধু কান্না করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। আমার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে বাবা-মা ও অনেক চিন্তিত হয়ে পড়েন। 

সব সময় তারা আলোচনা করতে থাকেন কি করলে ভালো হয়। কি করা যায়। তারা তো আর জানে না তাদের মেয়ের এমন অবস্থা কেন হয়েছে। 

 

সময় থেমে থাকে না,চলতে থাকে তার নিয়মে। কেটেছে তিনটি মাস, নিজেকে কোনমতে শান্ত করেছি আমি। কাউকে জানতে দেয়নি আমার এই অবস্থার কারণ। এক বান্ধবীর সাহায্যে খবর নিয়ে জানতে পারি, সৈকত আসলে ধোকাবাজ, একটা নারী লিপ্সু।

 ওদের একটা গ্রুপও আছে, যারা আমার মত মেয়েদের ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করে। পুলিশে কমপ্লেন করেছিলাম আমি,কোন লাভ হয়নি।


 তারা আমার কাছে প্রমাণ চেয়েছে,কিভাবে ধর্ষিত হয়েছি। প্রাক্টিক্যালি জানতে চেয়েছে আমার কাছে। তাদেরকে বোঝানোর মত কোন সাধ্য ছিল না আমার। তাই কোন বিচার ও পাইনি আমি। এইসব ধকল সবে সামলিয়ে উঠেছি আমি। এর মধ্যেই পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় আমার। কই আগে তো কখনো এমন হয়নি। তবে কি আবারো ঝড়ের পূর্বাভাস? ভয়ে ভয়ে ঘরোয়া ভাবে পরীক্ষা করলাম আমি। যা ভেবেছিলাম তাই!


আমি অন্তঃসত্তা। আমার এই সন্তানের পিতা কে? কয়জন? 


আবারো ভেঙ্গে পড়লাম আমি, কিন্তু এইবার কিভাবে সামলাবো নিজেকে? এটা তো আমার মাতৃত্বের প্রশ্ন। এসব কথা যদি জানাজানি হয় কি হবে তাহলে?  সমাজে মুখ দেখাবোই বা কিভাবে? বাধ্য হয়ে এবরশন করিয়ে নিলাম। হত্যা করলাম নিজের পেটে আসা ভ্রুন টাকে। ভেবেছিলাম বাচ্চাটাকে দুনিয়ায় আসতে না দিয়ে, মেরে ফেললেই বোধ হয় সব সমস্যার সমাধান।


 কিন্তু তা আর হলো কই? নাড়ীর একটা টান আছে না? 

 বাচ্চাটাকে হারিয়ে আমার মনে হল এইবার আমি সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছি। এবার শুধু আমি ভেঙেই পড়লাম না,ভেঙে চুরমার হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম। 


এই কষ্ট কাকে দেখাবো আমি? এই কষ্ট যে একটা মায়ের কষ্ট। একজন নারীর কষ্ট। আমি তো নিজের কারণেই ধর্ষিত হয়েছি। নিজের সন্তানকেই মেরেছি আমি। আমার নিজের কবর আমি নিজে রচনা করেছি। এসব কারণে  মানসিকভাবে অসুস্থ হতে থাকি দিনকে দিন। 

বাবা-মা আমার এই ভয়ংকর অবস্থা দেখে আরো চিন্তিত হয়ে পড়লেন।নিজেকে একদম ঘর বন্দি করে ফেলেছি। মা দরজার সামনে এসে দেখে আবার চলে যান। মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। বাবার অবস্থাও খারাপ হতে থাকে আমার চিন্তায়। বাবা-মা প্রায়ই এসে আমার সাথে গল্প করতে চান। কিন্তু আমি চাই না কারো সাথে মিশতে, গল্প করতে। একাকীত্ব বেছে নিয়েছে আমি। কিন্তু কতদিন?  আশেপাশের মানুষ নানা আলোচনা  করতে থাকে আমাকে নিয়ে। নানা রকম  কথা বলে তারা। বাবা মাকে কথা শোনাতে থাকে। 


             " বাবা মা, তোমাদের মত ভালো মানুষের ঘরে আমার মত কলঙ্কিনীর শোভা পায় না। 

             তোমরা চিন্তা করো না তোমাদের দোয়ায় ভালো থাকবো আমি। " 


 ছোট্ট একটা কাগজে এটা লিখে বেরিয়ে পড়লাম শান্তির সন্ধানে। আজ আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী আমি, আমি, হ্যাঁ আমিই। 


না না শুধু আমি নই। আরো আছে, আইন ব্যবস্থা সেদিন যদি পুলিশগুলো আমার সহায় হইত। সৈকতের বিরুদ্ধে যদি কোন অ্যাকশন নিতো। তবে হয়তো  সৈকতের মত আর কোন জানোয়ার আর কোন মেয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করত না।  


আরো একজন আছে সে হলো, ইন্টারনেট!  আজ ইন্টারনেটের জন্যই আমার এই দশা। হ্যাঁ ইন্টারনেট।  হায়রে ইন্টারনেট!

Post a Comment

0 Comments