ভালবাসার গল্প: রূপকথার শহর! (নবনী নীলা)পর্ব-১৫
ইশা চুপ করে নিজের বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। রাতের আকাশে কোনো এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দরজা বন্ধের শব্দে সে পিছন ঘুরে তাকালো। আরহান তার রুমে ঢুকেছে। তার হাতে একটা ডালা সাজানো। আরহান ডালাটি ইশার বিছানায় রেখে বারান্দায় আসলো।
ইশা নীরবে আরহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরহান ঠিক ইশার সামনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে রইলো। ইশা শুধু একবার আরহানের দিকে তাকিয়েই আবার বাইরে তাকালো।
এইখানে দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। যাও গিয়ে তৈরি হও।”, আরহান গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
ইশা ভ্রু কুচকে বললো, “ কিসের জন্য তৈরি হবো?” ইশার চোখের মুখে নানা প্রশ্ন। তার অনুপস্থিতিতে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেটা সে জানে না।
বিয়ের জন্য তৈরি হও। —জলদি।”, আরহান শান্ত কন্ঠে বললো।
বিয়ে! কার বিয়ে ?--- কি আযেবাজে বকছেন?”, ইশা ভীষন রেগে গিয়ে বলল। কারণ সে জানেই না আজ রাতে সে আরহান আহমেদের বউ হতে চলেছে।
তোমার – আমার বিয়ে।” আরহানের কন্ঠ এখনও শান্ত।
কথাটা শুনে ইশা একটা ঢোক গিললো। আরহান বিয়েতে রাজি হয়েছে!
কিন্তু কেনো? শুধুমাত্র কায়ান সবার সামনে তার নাম নিয়েছে বলে!
আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? —এ বিয়ে আমি করছি না।”, ইশা বলেই হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
তার বিছানার উপরে একটি ডালা সাজানো। লাল শাড়ি, চুড়ি, গয়না আরো অনেক কিছু। ইশা হতবাক। সত্যিই কি!
এর মধ্যেই দরজায় কড়া নড়লো। ইশা ভ্রু কুচকে দরজার দিকে তাকাতেই আরহান দরজা খুললো। একে একে ডালা এনে সবাই ইশার বেডের উপর রাখছে। ইশা ভূত দেখার মতন হ্যাঁ করে তাকিয়ে আছে। এতকিছু কিসের জন্য? এই লোকটা কি পুরো মার্কেট তুলে এনেছে?
ইশার রাগী চোখে আরহানের দিকে তাকালো তারপর বললো, “ এইসব কি ?”
আরহান ঈশারায় ঘরে থাকা লোকদের বাইরে যেতে বলে দরজা আবার ভেতর থেকে আটকে দিয়ে বললো, “ এটা বিয়ের ডালা। এইখানে আজকের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে।” তারপর এগিয়ে এসে বললো, “ এইখানে পছন্দ করার জন্যে ৫টা সেট রয়েছে। পিক ওয়ান।”
আপনি মনে হয় আমার কথা বুঝতে পারেনি। —আমি —-আপনাকে বিয়ে করছি না।”, ইশা তীক্ষ্ম কন্ঠে বললো।
তাহলে আমার যেটা পছন্দ তুমি সেটাই পড়বে।” ইশার কথাকে সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে সে সবগুলো ডালা ভালো করে দেখতে লাগলো। হাল্কা, গাঢ় সব রঙের শাড়ির সাথে একটা করে সেট সাজানো, তবে আরহানের চোখ গেলো লাল জামদানির দিকে। “ হুম। আমি চাই তুমি লাল জামদানিটা পড়ো।”
ইশা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, “ প্রশ্নই উঠে না। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না আমি আপনাকে কি বলছি? আমি আপনাকে বিয়ে করব না। লাল জামদানি পড়া অনেক দূরের বিষয়।”
ইশার এবার ভীষন রাগ হচ্ছে।
আরহান নিঃশব্দে লাল ডালাটা খুলে জামদানিটা বের করে হাতে নিয়ে ইশার সামনে এসে দাড়ালো। তারপর স্পষ্ট গলায় বললো, “ যাও শাড়িটা পড়ে এসো।” বোঝাই যাচ্ছে আরহান না শুনতে প্রস্তুত নয়।
আপনার কি কথা কানে যাচ্ছে না?....”, রাগ দেখিয়ে বলে শেষ না করতেই আরহান ইশার একদম কাছে চলে আসে। ইশা দেওয়ালের সাথে পিষ্ট হতেই আরহান ইশার চোখে চোখ রেখে বললো, “ শাড়িটা তুমি নিজে পড়বে নাকি আমাকে পরিয়ে দিতে হবে?”
ইশার এতক্ষণে হুস ফিরেছে। আরহানের কন্ঠ সিরিয়াস ইশা একটা ঢোক গিলে বললো, “ দেখুন। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।” ইশার গলার আওয়াজ নিচু করে বললো। আরহানের এতো নিকটে দাড়িয়ে থাকায় তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে।
আরহানের যেনো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো সে দেওয়ালের দুই পাশে হাত রেখে ঝুকে এসে কঠিন গলায় বললো, “তোমার ইচ্ছে কি সেটা জানতে আমি এইখানে আসিনি। বিয়েটা হচ্ছে –এবং আজকে রাতেই হচ্ছে।” বলেই আরহান ইশার বুকে থাকা ওড়নার দিকে তাকালো তারপর হুট করে ওড়নাটা টান দিয়ে মুহুর্তে নিচে ফেলে দিতেই, ইশা শিউরে উঠে তাকালো।
সে নিজের দুইহাত দিয়ে বক্ষ যুগল ঢেকে বললো, “ কি! কি.. করছে আপনি?” ইশার কন্ঠ কাপছে।
যেটা বিয়ের পর করবো ভেবেছিলাম। —কিন্তু তুমি আমাকে বাধ্য করছো,-- ইশা।”, বলেই আরহান ইশার একদম কাছে চলে এলো। তারপর ইশার বেঁধে রাখা চুলের খোপা এক টানে খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ইশার শরীরে একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেলো।
ইশা আরহানের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে বললো, “ আপনার লজ্জা করছে না, নিজের ছাত্রীকে বিয়ে করতে চাইছেন? শিক্ষক হলো পিতার সমতুল্য আর আপনি কিনা…!”
বলা শেষ না করতেই আরহান ইশার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ঘোরলাগা কন্ঠে ফিসফিস করে বললো, “ Call me daddy then…”
লজ্জায় ইশার গালদুটো লাল হয়ে গেলো। সে দুই হাত দিয়ে আরহানকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করতেই আরহান শক্ত করে ইশার কোমড় জড়িয়ে তার গলায় ছাপ বসিয়ে দিলো। ইশা ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কিন্তু তারপরও আরহান নিজের মুখ না তুলে ইশার চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলো। ইশা জীর্ণশীর্ণ হয়ে দাড়িয়ে আছে। মনে মনে আরহানকে অসভ্য, নির্লজ্জ বলে নিজের রাগ দমিয়ে রাখতে চাইছে কিন্তু তার শরীর যেন অবশ হয়ে আছে।
আরহান ইশার গলা থেকে মুখ তুলে ইশার চোখে চোখ রেখে বললো, “ এখন শাড়িটা নিজে পড়বে নাকি…”, থেমে ইশার কানের কাছে মুখ এনে বলল, “ আমি পড়িয়ে দিবো?”
কথা শেষ না করতেই ইশার এক ধাক্কায় আরহান কিছুটা দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ালো। ইশা ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে, তার গাল দুইটি টকটকে লাল হয়ে আছে।
আরহানের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির ঝলক দেখে ইশার বুকের ভিতরে যেনো কাঁপুনি শুরু হয়েছে। সে হনহনিয়ে শাড়িটা নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে সজোরে দরজা আটকে দিলো।
তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করলো।
এ কেমন বিপদে পড়লো সে! লোকটা যে আসলে একটা অসভ্য সেটা তো সে প্রায় ভুলেই গেছিলো। ইশা ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের গলার দিকে তাকালো। একদম দাগ বসিয়ে দিয়েছে। তারপর মনে মনে বললো, “ এই লোকটার জন্য না —কেঁদে ভাসিয়েছিস, এইবার বুঝ ঠেলা। বিয়ের আগেই যা শুরু করেছে …. বিয়ের পর!
অসভ্য লোকটার আজকে রাতেই বিয়ে করতে হবে। নির্লজ্জ, বেহায়া!
ইশাদের বাড়ির অবস্থা তুমুল। কেউ গেছে কাজী ডেকে আনতে, কেউ খাবার দাবারের দিকটা সামলাচ্ছে। কেউ আবার আপ্যায়নে ব্যাস্ত।
ছেলে পক্ষ মানে আরহানদের বাড়ি থেকে মাত্র তার বাবা উপস্থিত। তবুও প্রথমে তিনি ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে। হঠাৎ এই রাতে নাকি এই ছেলের বিয়ে করতে মন চেয়েছে। এই মেয়েকে যদি বিয়ে করার ছিল তাহলে আগেই রাজি হয়ে যেতো, তখন নাটক করেছিলো কেন?
যদিও ইশার বাবার সাথে তার ভালোই জমেছে। দুইজন ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছেন।
আর বাকি ইশাদের বাড়ি ঘিরে রেখেছে শ খানেক নিরাপত্তা কর্মী, অফিসার আরহানের বিয়ে বলে কথা। লাইটিংয়ের ব্যবস্থা রুদ্র নিজে করছে। বিয়ে বাড়ীতে আলোকসজ্জা হবে না তা কি করে হয়। ছোট খাটো বিয়ের অনুষ্ঠান হবে কিন্তু বিয়ে বিয়ে ফিল দিতে হবে।
অন্যদিকে একদল আরহানদের বাড়ি সাজানো নিয়ে ব্যস্ত। সেদিকে আরেক হইচই চলছে।
কাজী এসে বসে আছে। আরহান ও সেখানেই আছে। কিছুক্ষণ পর ইশাকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে লালটুকটুকে বউ লাগছে। আরহান অপলকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো।
ইশাকে এনে বসানো হলো আরহানের পাশে। তারপর আংটি বদল হলো। পরিশেষে বিয়েটাও হয়ে গেলো। যদিও কবুল বলার সময় ইশা একটু ইতস্তত করলো কিন্তু পাশ থেকে রাহি বললো, “ চুপ থাকাই সম্মতির লক্ষণ।
রাত এখন ৪টা, গাড়িতে ইশা আর আরহান। গন্তব্য ইশার শশুরবাড়ি। মেয়ের বাড়ি থেকে অনেক করে বলা হলো আজকের রাতটা থেকে তবেই যেনো রওনা হয়। কিন্তু না আরহান রাজি হয় নি। সে আর একমুহুর্ত দেরি করতে চায় না।
সম্পুর্ন রাস্তা ইশা গাল ফুলিয়ে ছিলো, এক রাতেই তাকে তার বাপের বাড়ি থেকে তুলে এনেছে লোকটা। মানুষের বিয়ে হয় কত সুন্দর করে এইদিকে তার নিজের বিয়েতে কাক পক্ষীও টের পেলো না। না হাতে আছে মেহেদী না গায়ে দিয়েছে হলুদ। এ কেমন পানসে বিয়ে!
গাড়ি আরহানদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ইশা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো।
গাড়ি এসে থামলো গেটের সামনে, আরহান ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে আছে। এই কয়েক ঘণ্টায় পুরো এলাকা জানিয়ে দিয়েছে তার মা। পুরো এলাকাবাসী দাড়িয়ে আছে আরহান আহমেদের বউকে বরণ করবে বলে।
আরহান ইশার দিকে তাকালো, ইশার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবুও এই শাড়িতে তাকে কি যে সুন্দর লাগছে, আরহান নিজেই চোখ সরাতে পারছে না।
আরহান সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নামলো। তারপর ইশার পাশের দরজা খুলেতেই ইশার ঘুমন্ত চেহারার মায়ায় পড়ে গেলো। সে হাত হাত দিয়ে ইশার মুখের সামনের চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে কানের পাশে গুজে দিলো। তারপর আরহান আহমেদ নিজের ঘুমন্ত বউকে কোলে তুলে নিলো।
আরহানদের বাড়ি ভর্তি লোকজন। এই কয়েকঘন্টার খবরে সবাই এসে হাজির। কিন্তু এমন কিছু দেখবে হয়তো কেউই আশা করেনি।
বাড়িতে নতুন বউ এসেছে ঠিকই কিন্তু জামাইয়ের কোলে করে, ঘুমিয়ে –ঘুমিয়ে।
আরহানের মেজাজ সম্পর্কে অবহিত থাকার কারণে এই ব্যাপার নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার সাহস কেউ দেখায়নি।
সবার সামনে কোলে করে ইশাকে নিজের রুমে নিয়ে এলো আরহান। তারপর ঘুমে অচেতন ছোট্ট দেহটি অতি যত্নে বিছানায় রাখলো।
এইদিকে সূর্যোদয় হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে সূর্য তার আলো দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আরহান প্রথমে দরজা বন্ধ করলো তারপর টেনে দিলো রুমের সকল পর্দা।
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ইশার কাছে এগিয়ে গেলো। শার্ট খুলে একপাশে রেখে ইশার পাশে বসলো। বিয়েটা এইভাবে হুট করে হবে সেটা আরহান চায়নি তবে এর চেয়ে সহজ আর কোনো উপায় ছিলো না—- ইশাকে নিজের কাছে এনে রাখার। বিয়ের অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেলে বাংলীরা মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয় শুধু কেনাকাটা হাবিজাবি নিয়ে। এতদিন অপেক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় তার পক্ষে।
আরহান ইশার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। মুখ ডুবিয়ে দিলো ইশার গলায় —আরেকটা হাত রাখলো ইশার পেটের উপর। তারপর ফিসফিস করে বললো, “তোমার কোনো ইচ্ছে আমি অপূর্ন রাখবো না। শুধু আমার একটু সময়ের প্রয়োজন।” তারপর ধীরে ধীরে ঘুমের ঘোরে তলিয়ে গেলো আরহান।
ইশার ঘুম ভাঙছে,-- ধীরে ধীরে –এখনো সম্পুর্ন ঘুম কাটেনি তবে পেটের উপর সে ভারী কিছু অনুভব করছে। ইশা আস্তে আস্তে চোখ খুললো।
আবছা আলোয় ঢাকা রুমটা তার কাছে অপরিচিত। তারপর ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান বুঝতে পারলো।
ইশা আরহানের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে তারপর চোখ গেলো আরহানের উদাম বলিষ্ঠ দেহের দিকে। ইশার চোখ বড় বড় করে তাকালো। এক মুহূর্তের জন্য যেনো সে জীর্ণশীর্ণ হলে গেলো। বুকের ভিতরে যেনো একটা শান্ত ঝড় উঠেছে।
তারপর চোখ গেলো তার পেটের উপর রাখা আরহানের বলিষ্ঠ হাতের দিকে।লোকটা কি তাকে লজ্জায় মেরে ফেলতে চাইছে?
কি আশ্চর্য!
সে এই রুমে এলো কি করে?
এটা কি তার শ্বশুরবাড়ি?
কিন্তু এতো শান্ত! –নিরব!
ইশা আরহানের দিকে তাকালো। লোকটা কিভাবে বেহায়ার মতন তার গায়ের উপর উঠে ঘুমিয়ে আছে। তাকে কি মানব কোলবালিশ পেয়েছে নাকি?
ইশা ঠোঁট কামড়ে আলতো করে আরহানের হাতটা নিজের পেটের উপর থেকে সরিয়ে নিতে চাইলো কিন্তু সাথে সাথে সে ইশার কোমড় ধরে নিজের আরো কাছে নিয়ে এলো। ইশার শরীরে কাঁপুনি উঠে গেলো।
আহ! কি করছেন? ছাড়ুন।” ইশা আরহানকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো।
আরহানের ঘুম এখনো কাটেনি সে কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের বাঁধন আরো শক্ত করলো।
একদম নাটক করবেন না। ছাড়ুন আমাকে।”, ইশা নিচু গলায় বললো।
তারপর হুট করে তার চোখ গেলো আরহানের পিঠে একটা ব্যান্ডেজ। ইশার বুকের ভিতরে ধুক করে উঠলো। ইশা হাত বাড়িয়ে ব্যান্ডেজ ধরতেই আরহান হুট করে ইশার কাছ সরে এলো। আরহানের চোখে এখনো ক্লান্তির ছাপ।
ইশা উঠে বসলো তারপর অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ কি হয়েছে আপনার পিঠে? ব্যান্ডেজ করা কেনো!” ইশার কন্ঠে চিন্তার চাপ।
আরহান শান্ত মুখে নিজের শার্ট গায়ে দিতে দিতে বললো, “ তেমন কিছু না।”
তেমন কিছু না মানে? আমি স্পষ্ট দেখলাম আপনার পিঠে ব্যান্ডেজ করা।”, ইশার চোখে মুখে অস্থিরতায় ভরে গেলো।
বললাম তো তেমন কিছু না।”, আরহান আবারো দৃঢ় গলায় বলল।
কিছু না?— নাকি আপনি আমাকে বলতে চাইছেন না কি হয়েছে।” ইশার ভীষন রাগ হচ্ছে। এমন চাপা স্বভাবের মানুষ সে আগে দেখেনি।
আরহান শান্ত চোখে ইশার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল রাতে —-যখন সে ইশার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
রাস্তায় একদল লোক তার উপর হামলা চালায়। প্রথমে মনে হতে পারে এটা কায়ানের পাঠানো লোক, আরহানও সেটাই ভেবেছিলো কিন্তু না।
সে লোকগুলো কায়ানের না।
তার মানে এইসবের পিছনে অন্য কেউ আছে। কিন্তু কে করতে পারে এমন কাজ?
এই ঘটনা এখন কাউকে জানানো যাবে না। ইশাকে তো একদমই না।
সে চায় না ইশার বিয়ের পরের দিনটি আতঙ্কে শুরু হোক।
আরহানের নীরবতা ভাঙ্গলো দরজার টোকা। আরহান উঠে যেতে যেতে বললো, “ বলার মতন কিছু হলে নিশ্চয়ই বলতাম।”
দরজা খুলতেই আরহান দেখলো তার মামাতো চাচাতো বোনেরা দরজার বাইরে।
আশ্চর্য এরাও এসে পড়ছে!
আরহানের এক বড় বোন দুস্টুমি করে বললো, “ দিনের বেলায় কি বাসর সেরে ফেললি নাকি? নতুন বউকে কোলে করে যেই রুমে ঢুকেছে মহাজনের বের হবার নাম নেই।”
আরহান প্রতিবারের মতো বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কেউ কথা বলবে এইটা সে একদম পছন্দ করে না।
পাশে থাকা তার আরেক মামাতো বোন ইশাকে দেখে বললো, “ এই সুন্দরী বুঝি –জাদু করেছে?”
আরহান বিরক্তি চেপে রেখে রুমের একপাশে দাড়িয়ে রইলো। ইশা হতবাক হয়ে তার বোনেদের কথা শুনছে। তারপর হঠাৎ একজন ইশার হাত দেখে বললো, “ আহারে! আরহান আহমেদ বুঝি হাতে মেহেদি দেওয়ার সময়টাও দেয়নি।”
বিকেলের অনুষ্ঠানের অনেক দেরি। চল মেহেদী দিয়ে দেই। রাতে আবার —বাসর হবে, অনেক কাজ পরে সময় পাবে না।”, বলেই তারা হেসে উঠলো তারপর ইশাকে রুম থেকে বের করে আনলো।
ইশার বুকের ভিতরে ধুক ধুক করছে। রাতে বাসর হবে মানে কি? এ আবার কেমন নিয়ম। এমন আয়োজন করে বাসর করতে এর আগে দেখেনি সে। আর বিকেলে অনুষ্ঠান! কিসের অনুষ্ঠান। লজ্জায় ইশা কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
ইশাকে দুই হাতে মেহেদি পরিয়ে দিয়েছে আরহানের খালাতো বোন ফাইজা। দুইহাত ভর্তি মেহেদি নিয়ে ইশা পড়েছে এক মহা বিপদে।
না পারছে কিছু করতে, হাত দুটো ব্যথা হয়েগেছে।
যদিও এখনো তাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়নি। নিচে সবার সামনে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে বিকেলে। সেই প্রস্তুতি চলছে।
তবুও কিছু অতি আগ্রহী মানুষজন তাকে দেখতে উপরে এসে পড়েছে। তাদের কথা শুনতে শুনতে ইশার মাথা ধরে গেছে।
ধীরে ধীরে বিকেল ঘনিয়ে এসেছে।
ইশাকে তৈরি করা হচ্ছে।
একজন শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে আবার, একজন চুল ঠিক করে দিচ্ছে।
দুই হাত মেহেদি নিয়ে ইশা বসে আছে মহারানী হয়ে। মাঝে মধ্যে মেয়ে গুলো এমন দুষ্টু দুষ্টু কথা বলছে, ইশা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
ইশাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে সবাই নতুন বউকে দেখতে হাজির। আরহানের মা ইশাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
অনেকে অনেক উপহার দিলো।
ঘড়ির কাটায় রাত যত বাড়ছে ইশার অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। এমন অনুভূতি সে আগে কখনো অনুভব করেনি। তার কানে একটি কথা বাজছে, “ বাসর হবে!” কিন্তু আরহানের পিঠের ব্যান্ডেজটা।
লোকটা যদি তাকে কিছু না বলে তাহলে বাসরের কবর দিয়ে দিবে সে। ভেবেই রাগে ফুঁসতে লাগলো সে।
রাহি আরহানের রুম সাজাতে ব্যাস্ত। আরহানকে দেখে যতটা আনরোমান্টিক মনে হয় লোকটা তার একদম উল্টো। ফুল দিয়ে রুম সাজাতে কিছু লোক এসেছিল আরহান ঝাড়ি দিয়ে সবাইকে বিদেয় করেছে। তিনি ফুলের বাসর করবেন না। ভেবেই রাহি মনে মনে হাসলো।
রাহির সাথে নাসরিনও রয়েছে দুজনে পুরো ঘরে সেন্টেড ক্যান্ডেল জ্বেলে দিয়েছে।
বিছানার দুই পাশে জ্বলছে টেবিল ল্যাম্প। অন্ধকার ঘরটা এই আলো কি যে সুন্দর লাগছে। সাথে মোমবাতির সুগন্ধী….. অসম্ভব সুন্দর।
রাহি আর নাসরিন একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো। তখনই রাহির ফোন বেজে উঠলো। রাহি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, “ হ্যালো সুইটহার্ট।”
রাহির মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
“ কি সমস্যা? কি চাই তোমার?”, রাহি কিছুটা দূরে গিয়ে নিচু গলায় বললো।
কায়ান সিরিয়াস হয়ে বললো, “ তোমাকে চাই।”
“ মানে?”, রাহি হতবাক হয়ে বললো।
“মানে আমি আরহানের বাড়ির ঠিক সামনে আছি। আর আমি চাই তুমি এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের হয়ে এইখানে আসো।”, কায়ানের কন্ঠে রাহি একটা ঢোক গিলে বললো “কেনো?”
“Don't ask questions. Be fast —if you don't want me to ruin their wedding night.”, কথা শেষ হতেই কলটা কেটে গেলো।
আরোও পড়ুন: আরোও পড়ুন: রূপকথার শহর| নবনী নীলা পর্ব-১৬
0 Comments