ভালবাসার গল্প: ইচ্ছের প্রণয়! পৃথী আক্তার! পর্ব-৩
ইচ্ছে, তুমি কি আমার সাথে কথা বলবে না? আহাদ কোমল কন্ঠে শুধালো।
আহাদ অনেকক্ষণ ধরে ইচ্ছের কেবিনে এসেছে।
এসে থেকে ইচ্ছেকে এটা সেটা অনেক প্রশ্ন করছে কিন্তু ইচ্ছে তো কথা বলা দূর আহাদের দিকে ফিরেও
তাকায় নি । তাই ও উপরোক্ত কথাটি বললো।
"ইচ্ছে কখনো হ্নদয়হীন ডাক্তারদের সাথে কথা বলে না
ইচ্ছে ঠোঁট বাঁকিয়ে কথা টি বললো।"
আহাদ ইচ্ছের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলো। আবার সেই হ্নদয়হীন বললো ওকে। আচ্ছা আমি কি সত্যিই হ্নদয়হীন? মেয়েটি আমাকে কেন হ্নদয়হীন বলছে?
আহাদ মনে মনে কথাটি বলে ইচ্ছেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
"আচ্ছা ইচ্ছে আমি কি এমন করেছি যে যার জন্য তুমি আমাকে হ্নদয়হীন বলছো?"
আহাদের কথাটি শ্রবণেন্দ্রিয় হতে ইচ্ছে এবার মুখ ঘুরিয়ে আহাদের দিকে তাকালো । এবার যেন রাগেরা এসে ভিড় করলো। আহাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রেগে হিসহিসিয়ে বললো,
বারে ,আপনি জানেন না আপনি কেন হ্নদয়হীন? আপনি আসলেই একজন হ্নদয়হীন ডাক্তার নয়তো আমার হ্নদয়টাকে কেটে একবারও আমাকে দেখতে আসার প্রয়োজন মনে করেনি।আ.... আপনি একটা পাজি ডাক্তার। আর আমি পাজি পঁচা ডাক্তারদের সাথে কথা বলি না হু ।
আহাদ প্রথমে ইচ্ছের রেগে বলা কথাগুলো শুনে অবাক হলেও পরমুহূর্তে হো হো করে হেঁসে দিল।
আহাদের হঠাৎ হাসি দেখে ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে আহাদের দিকে তাকালো ।
আপনি এমন করে হাসছেন কেন ? আমি কি এমন হাসার কথা বলেছি?ইচ্ছে রাগে দাঁত কটমট করে বললো ।
আহাদ একবার ইচ্ছের রাগী মুখটা দেখে আবার হেসে বললো ,
সিরিয়াসলি ইচ্ছে !!!! তুমি এই সামান্য কারণে আমার সাথে কথা বলছো না। এতেই আমি হ্নদয়হীন হলাম।
আর কে বলেছে আমি তোমাকে দেখতে আসেনি নি ? আমি প্রতিদিন এসেছি আর তোমাকে দেখেও গেছি। কিন্তু তখন তুমি ঘুমের মাঝে ছিলে।তুমি আসলেই পিচ্চি মেয়ে। অবশ্য ছোট মানুষ বোঝে বেশি।
আহাদের কথায় তো ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আহাদের দিকে।
আ.. আপনি সত্যিই এসেছিলেন? ইচ্ছে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
আহাদ মুচকি হেসে মাথা নাড়াতে ইচ্ছে আবার ক্ষেপে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
এই...আ... আপনি আমাকে কি বললেন আমি পিচ্চি!
আমি ছোট!
হুম তুমি তো পিচ্চি! একদম ছোট একটা বাচ্চা বলে আহাদ মুচকি হাসলো।
আ... আমি পিচ্চি না!!! ইচ্ছে এবার জোরে বললো
আমি পিচ্চি না । আমি অনেক বড়। নয়তো আপনি আমার অপারেশন করলেন কিভাবে?আমি বড় তাই আমি সাহসী সেজন্য আমি অপারেশন করেছি নয়তো কেউ আমাকে অপারেশন রুমের সামনেও নিয়ে যেতে পারতো না হু বলে ইচ্ছে মুখ বাঁকালো।
আহাদ হা করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা যে এভাবে কথা বলতে পারবে ও ধারণা করেনি
ভেবেছিল এই মেয়ে শান্ত স্বভাবের কিন্তু এ মেয়েতো পুরো ঝাঁসির রানী। আহাদ ইচ্ছের কথা গুলো শুনে মনে মনে ভীষণ হাসি পেল । নিজের হাসি টাকে মুখের আড়ালে লুকিয়ে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে মুখটা কে সিরিয়ার করে
ঠিক ই তো ইচ্ছে তো অনেক বড় !! আমি ভুল বলেছিলাম।
সরি!!!!! ইচ্ছে ! আহাদ ইনোসেন্ট ফেস নিয়ে বলে। আহাদ আবার বলতে শুরু করে,
আসলে ইচ্ছে যে এত বড় এবং সাহসী আমি তো জানতামই না। ইচ্ছে সাহসী বলেই তো অপারেশনের ভয়ে হসপিটালে স্টোর রুমে লুকিয়ে ছিল। সত্যি ইচ্ছে তুমি অনেক সাহসী!!!! বলে আহাদ এবার জোরে জোরে হেসে দিল।
প্রথমে ইচ্ছেকে আহাদ সাহসী বলায় ইচ্ছের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল,যেন ও বিশ্ব জয় করেছে। কিন্তু পরমুহূর্তে আহাদের কথা শুনে ইচ্ছের মুখের হাসি নীভে গেল সাথে বেশ রাগও হলো ,
এই হ্নদয়হীন ডাক্তার আপনি কি আমাকে ব্যঙ্গ করে কথা বলছেন ?
না !!!! একদম না...আমি কেন তোমাকে ব্যঙ্গ করে কথা বলবো ? আমি ভালো মানুষ কাউকে ব্যঙ্গ করিনা। কিন্তু তুমি বলো তুমি কি লুকিয়ে ছিলে না ওটির ভয়ে ?আহাদ নিজের হাসি কোন রকম থামিয়ে ইচ্ছেকে জিজ্ঞেস করল।আহাদের কথা শুনে ইচ্ছে থতমত খেয়ে গেছে । মুখটা একেবারে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। সত্যি তো
আমি লুকিয়ে ছিলাম। এই পঁচা ডাক্তার এগুলো বলে তোকে হেয় করছে ইচ্ছে। এই ডাক্তার তো ভীষণ বদমাইশ। তুই ঠিকই বলেছিস এই ডাক্তার খুবপাজি পঁচা কথাগুলো ইচ্ছে মনে মনে বলে মুখে আমতা আমতা করতে করতে বললো
ই....ইয়ে মানে...আ... আমি তো...
তুমি তো কি ইচ্ছে? আহাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ।
আমি ক... কই লুকিয়ে ছিলাম? বলে আহাদের দিকে তাকাতে দেখতে পেল আহাদ ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে । ইচ্ছে একটা ঢোক গিললো।
আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আ... আমি তো ছোট মানুষ । এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না। আর হ্যাঁ যে কেউই ভয় পাবে যদি সে জানে একটু পর তার দেহটাকে কাটাকাটি করা হবে। তাই আ.. আমি লুকিয়ে ছিলাম । আপনি আমার জায়গায় থাকলে একি কাজ করতেন ত...তাইনা বলুন ইচ্ছে আমতা আমতা করে বলে একটা মেকি হাসি দিল।
আহাদ ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল ।
এর পর হেসে বললো,
দেখেছ ইচ্ছে তুমি নিজে স্বীকার করলে তুমি ছোট । হুম হুম বলো বলো বলে আহাদ একচোখ টিপ দিয়ে হালকা হাসলো ।
ইচ্ছে তো এবার পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। নিজের কথায় নিজেই বলে বিপদে পড়লো।
আ.... আপনি একটা যাচ্ছে তাই । হ্নদয়হীন!!
পঁচা ডাক্তার! গাল ফুলিয়ে ইচ্ছে এবার আহাদের কথার সাথে না পেরে বললো।
ঠিক আছে আমি যখন হ্নদয়হীন তাহলে তোমার জন্য আমি কি করতে পারি বলো?
তাহলে আমাকে রিলিজ দেন । আমি এখানে আর থাকতে চাই না । আমার খুব বোরিং লাগছে। আমি বাড়ি যেতে চাই বলে ইচ্ছে আহাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো ।
ইচ্ছের কথা শুনে আহাদের মুখের হাসিটা সরে গেল।ও এবার সিরিয়াস ভাবে বললো,
সরি ইচ্ছে এখন তোমাকে রিলিজ দেয়া যাবে না। তোমার শরীরের অবস্থা এখনো পুরোপুরি ভাবে ঠিক হয় নি। আর কিছু দিন পর তোমাকে রিলিজ দিব।আহাদ ইচ্ছের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো।
আহাদের কথা শুনে ইচ্ছের মুখে আঁধার নেমে এলো ও মুখটা নিচে নামিয়ে নিলো। আহাদ ইচ্ছের মন খারাপ দেখে ওরও কেমন জানি খারাপ লাগলো। মেয়েটিকে হাসি খুশি দেখতে ওর ভালো লাগে। তাই ওর মুখে হাসি ফোটাতে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,
আমার কাছে বোরিংনেস কাটানোর জন্য একটা দারুন উপায় আছে । তাছাড়া কেউ যদি চায় আমি তাকে ট্রিট দিতে পারি। কিন্তু সে কি আমার কাছে থেকে ট্রিট নেবে ?
ট্রিটের কথা শুনে ইচ্ছে মুখ উঠিয়ে আহাদের দিকে তাকালো এরপর গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল ,
কেমন ট্রিট?
হুম, কেমন ট্রিট তাইতো !!! ইচ্ছে যদি চায় তাহলে আমি ইচ্ছেকে হসপিটালের বাইরে একটু ঘুরিয়ে আনতে পারি
কিন্তু ইচ্ছে কি যাবে ?
ঘুরতে যাওয়া কথা শুনে তো ইচ্ছে মহাখুশি। সাথে সাথে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। ও হাসি হাসি মুখ নিয়ে আহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
এই হ্নদয়হীন ডাক্তার আপনি আমার সাথে মজা করছেন না তো?
"তোমার কি মনে হয় আমি মজা করছি?"
ইচ্ছে তো অবাক । আ... আপনি সত্যিই আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন সত্যি তো?
আহাদ ইচ্ছের কথায় মাথা নাড়ল, তিন সত্যি!!!
ইচ্ছেকে এবার পায় কে। ও তো খুশিতে নাচবে এমন ভাব।
ইচ্ছে সাবধানে!!!!
ইচ্ছে বেড থেকে নামতে নিলে পড়ে যেতে ধরে তৎক্ষণাৎ আহাদ ওর বাহু ধরে পড়ে যাওয়া থেকে আটকায় । ইচ্ছে আঁতকে উঠে আহাদকে খামচে ধরে।
ইচ্ছে তাকাতে দুজনের চোখাচোখি হয়।
এমন সময় একজন নার্স কেবিনে প্রবেশ করে। নার্স তো হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে ।নার্সের উপস্থিততে দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে । আহাদ কোন রকম ইচ্ছেকে সোজা করে দাড় করিয়ে কেবিন থেকে চলে যায় ।
আর এদিকে ইচ্ছের কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে।
ইশ! কি লজ্জা বলে ইচ্ছে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকে
বিকালে,
কিছুক্ষণ আগে ইচ্ছে ও আহাদ হসপিটাল থেকে একটু দূরে একটি সুন্দর ক্যাফেতে এসে। এটি ডেলাইট ক্যাফে নামে পরিচিত। এই ক্যাফের চার দিকে অনেক
সুন্দর বাহারি ফুল ও ঝলমলে আলো দিয়ে ঘেরা।
আবার এই ক্যাফের বাইরে একটি ছোট ঘাট বাঁধানো পুকুর আছে। ইচ্ছে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখে বিস্মিত। এর আগে কখনো এমন সুন্দর জায়গা দেখে নি
ইশ!!কি সুন্দর ! ইচ্ছে অস্ফুর্ত স্বরে বলে ওঠে।
পছন্দ হয়েছে?
অকস্মাৎ আহাদের কন্ঠ শুনে ইচ্ছে ঘুরে আহাদের দিকে তাকালো। মাথা উপর নিচ করে বললো ,
পছন্দ হবে না মানে আবার!!!কি সুন্দর জায়গা। আমি এর আগে কখনো এতো সুন্দর জায়গা দেখিনি। বলে ইচ্ছে মুচকি হাসলো। আহাদ ও ইচ্ছের খুশি দেখে মুচকি হেসে বললো, চলো বসি।
এই.....না.. না মানে আমি এখন এখানে বসবো না । আমাকে একটু ঐ নদীর পাড়ে নিয়ে যাবেন প্লিজ ?ইচ্ছে অনেকটা আবদারের সুরে বলল।
ইচ্ছে হাসি মুখটা দেখে আহাদ আর না করতে পারলো
না। ও হাসি মুখে বললো ,
ঠিক আছে চলো।
ওরা পুকুরের ঘাটে এসে ঘাসের উপরে বসলো। ইচ্ছে আহাদকে এটা সেটা বলছে। আহাদ চুপচাপ ইচ্ছে কথা শুনে যাচ্ছে যেন ও নিরব শ্রোতা।বিকালের রোদের মিষ্টি আলোয় পুকুরের পানি ঝলমল করছে। সামনে কতগুলো সাদা হাঁস দল বেঁধে এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে।ইচ্ছে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে হাঁসগুলোর দিকে। ঠোঁটে লেগে আছে কোমল মিষ্টি হাসি। আহাদ সে হাসির দিকে গভীর ভাবে চেয়ে আছে। মেয়েটিকে দেখলে একজনের কথা খুব গভীর ভাবে মনে পড়ে ।
সেও তো এভাবে হাসতো।সে হাসলে চোখ গুলোও যেন হাসতো। আহাদ অপলক তাকিয়ে থাকতো সে হাসির দিকে। আহাদের বুকের ভিতর হুট করে কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতর চাপা একটা বেদনা সৃষ্টি হলো। মুখ থেকে অস্ফুর্ত স্বরে বেরিয়ে এলো,
"মিশি"
আপনি কিছু কি বললেন আহাদ স্যার? আমি ঠিক শুনেতে পেলাম না? ইচ্ছের আহাদের মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ভাবুক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
আচমকা ইচ্ছের প্রশ্নে আহাদের হুঁ আসলো।
হু... কিছু বললে?
ইচ্ছে আহাদের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
বলছিলাম যে, আপনি এই মাত্র কিছু কি বললেন?
নাহ... নাতো আমি কিছু বলিনি আহাদ আমতা আমতা করে বলল।
কিন্তু আমার মনে হলো আপনি কিছু একটা বলেছেন? তাছাড়া আপনার গলাটা কেমন যেন শোনাচ্ছে?
বলে ইচ্ছে আহাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।
ইচ্ছের কথা শুনে আহাদ একটু থতমত খেয়ে গেল।
নিজের ভেতরের চাপা কষ্টকে গিলে মুখে হাসি নিয়ে বললো,
হুম বলেছিলাম যে হাঁস গুলো সুন্দর ! কি সুন্দর সবাই একসাথে দলবেঁধে আছে যেন ওরা সবাই একটি পরিবার।
ইচ্ছে আহাদের কথায় আবার পুকুরে থাকা হাঁসগুলোর দিকে তাকালো। সত্যি হাঁস গুলো দল বেঁধে আছে যেন এঁরা একটি পরিবার। ওর কিছুক্ষণ পর হয়তো ঘরে ফিরে যাবে সেজন্য একসাথে আছে কারণ সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
আচ্ছা আহাদ স্যার আমি তো আমার পরিবার সম্পর্কে বলেছি এবার আপনি আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন? আপনার পরিবারে কে কে আছে? বলে ইচ্ছে আহাদের দিকে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকলো।
অকস্মাৎ পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করায় আহাদের ঠোঁটের হাসি ম্লান হলো। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। চোখ গুলো লাল লাল হয়ে গেলো।
আহাদ তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
ইচ্ছে হসপিটালের চলো আমরা অনেকক্ষণ ধরে এসেছি। তোমার বাবা হয়তো চলে এসেছে।
আহাদকে এমন হুট করে উঠতে দেখে ইচ্ছে ভরকে গেল । ইচ্ছেও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। আহাদের আকস্মিক এমন কাজে ইচ্ছে হতভম্ব।
আপনি কি কোনো ভাবে আমার প্রশ্নকে এড়িয়ে চলছেন ?বলুন না আহাদ স্যার আপনার পরিবার সম্পর্কে।
ইচ্ছে এতো কথা ভালো লাগছে না। হসপিটালে চলো!!!
আহাদ একটু কড়া গলায় বলে সামনে দিকে হাঁটা দিলে
ইচ্ছে তৎক্ষণাৎ আহাদের ডান হাতটা আকড়ে ধরলো,
আহাদ থেমে দাঁড়ায়। একবার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার ইচ্ছের দিকে তাকালো।
ইচ্ছে সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিল।
আমি দুঃখিত এভাবে আপনার হাত ধরার জন্য।
কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর আগে দিবেন আহাদ স্যার। নয়তো আমি কোথাও যাবো না বলে ইচ্ছে আবার ঘাসের উপর বসে পড়ল।
আহাদ হা করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে
তো সেই বিচ্ছু! আহাদ এগিয়ে গেল ইচ্ছের দিকে।
ইচ্ছে উঠো আমাদেরকে যেতে হবে ।
নাহ... আমি যাব না ।
ইচ্ছে উঠো বলছি !!
না.... উঠবো না আগে উত্তর দিন।
ইচ্ছে দেরি হচ্ছে!!!
হোক দেরি। এই হৃদয়হীন ডাক্তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন? নয়তো রাত পার হয়ে গেলেও আমাকে এখান থেকে নিতে পারবেন না বলে দিলাম কিন্তু।
আহাদ ইচ্ছের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর ইচ্ছের পাশে যেয়ে আবার ঘাসের উপর বসলো। ইচ্ছে পাশে ফিরে তাকালো।
কি শুনতে চাও তুমি ইচ্ছে ? আমার পরিবার সম্পর্কে?
তাহলে শোন ইচ্ছে , আমার পরিবার নেই।
আমি একা। আমি নিঃস্ব।
মানে!!! ইচ্ছে আহাদের কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আমার পরিবার প্রিয়জন বলতে কেউ নেই ইচ্ছে। তারা ....তারা আমাকে ফাঁকি দিয়ে এতিম করে চলে গেছে ঐ দূর আকাশে।আহাদের কন্ঠস্বর কেঁপে উঠলো।
ইচ্ছে আহাদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো ।
আহাদ ইচ্ছের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে আবার পুকুরের পানিতে দৃষ্টি দিলো। সূর্য হেলে পড়েছে
পশ্চিম আকাশে । সেই প্রতিবিম্ব পুকুরের পানিতে প্রতিফলিত হয়েছে। আহাদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মনে চলছে নানা কথা। কিছু তিক্ত বেদনা। আহাদ বলতে শুরু করে,
আমি মধ্যে বিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম। মা-বাবা আর ছোট্ট একটি বোন নিয়ে আমাদের একটি সুখের পরিবার ছিল । বাবার সাথে কত খুনসুটি বাজারে যাওয়া,মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্না, মায়ের বকা খাওয়া , আবার মায়ের মিষ্টি ভালোবাসা। বোনের ছোট ছোট আবদার।এভাবে চলছিল হাসি মজা আনন্দে। কিন্তু
হঠাৎ এক কাল বৈশাখী নেমে এলো আমাদের এই ছোট সুখি পরিবারে। নিঃস্ব করে দিয়ে গেল আমাকে ও আমার বোনকে। বলে আহাদ একটু থামল।
ইচ্ছে আহাদের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে
যেন সে কথাগুলো উপলব্ধি করতে পারে। আহাদ আবারো বলতে শুরু করে,
আ....আমরা চারজন ঈদ উপলক্ষে আমাদের গ্ৰামের বাড়ি যাচ্ছিলাম । আমাদের সবার মুখে সেদিন লেগেছিল আনন্দের হাসি। কিন্তু সে হাসি বেশিক্ষণ থাকেনি হুট করে একটি ট্রাক এসে আমাদের গাড়ির
সাথে ধাক্কা খায়। সময়টা যেন তখন থমকে যায়। ভাগ্যক্রমে আমি এবং মিশি বেঁচে থাকলেও আমাদের দুজনকে ছেড়ে চলে যায় আমাদের বাবা-মা।সতেরো বছর বয়সে আমি ও চৌদ্দ বছর বয়সে মিশি আমরা হলাম এতিম।
তখন থেকে শুরু হয় আমাদের জীবনের এক কঠিন পথচলা। মিশি খুব ছোট ছিল । সারাদিন বাবা -মার
জন্য খুব কান্না করতো। মিশির কান্নায় আমার বুকটা ফেটে যেতো। এরপর মিশি একটু স্বাভাবিক হলে
আমি কাজের জন্য খোঁজ করলাম কারণ আমাদের আয়ের উৎস ছিল বাবা। আমাকে কাজ দিতে চাইতো কেউ । তারপর আমি রুটির দোকানে কাজ করে
অল্প টাকা আয় করতাম। সে টাকায় আমার আর মিশির চলা খুব কষ্ট হতো। কতই বা টাকা পেতাম।
এদিকে আমার পড়ালেখা আবার মিশির পড়ালেখা সহ যাবতীয় খরচ এত কম টাকায় হতো না । আমি দিন রাত এক করে অনেক খেটেছি। নানা জায়গায় কাজ করেছি।এভাবে আমাদের দুজনের দিন পার হচ্ছিলো। আমি ইন্টার পরীক্ষা দিলাম খুব কষ্টে। আমার ভাগ্য ভালো ছিল দেখে আমি অনেক ভালো রেজাল্ট করি সাথে মেডিকেলে চান্স পাই। সেদিন মিশির মুখে মিষ্টি হাসি ছিলো।"
এতটুকু বলে আহাদ থেমে গেল । আহাদের গলাটা কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে কান্না গুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে।
ইচ্ছের চোখ গুলো দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
আহাদ ইচ্ছের দিকে তাকালো।
"জানো ইচ্ছে আমার না দুখের শেষ নেই। কেবল একটু
ভেবেছিলাম বোনকে নিয়ে সুখে থাকবো। কিন্তু আমার সে আসা জলে ফেলে দিয়ে বোনটাও আমাকে ছেড়ে পাড়ি দিলো ঐ দূর আকাশে। আহাদের গলাটা কেমন শুকিয়ে গেল । শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো,
হঠাৎ একদিন মিশির শরীর প্রচুর খারাপ করে। ওর নাকি বুকে ব্যথা করে।আমি ওকে আমার মেডিকেলে নিয়ে পরীক্ষা করাতে ডাক্তার জানায় মিশির হার্ট ব্লকেজ হয়েছে।
সেদিন আমি ঘাবড়ে যায়। এদিকে মিশির অবস্থা ধীরে ধীরে খুব খারাপ হতে থাকে । ইমিডিয়েটলি অপারেশন করতে হবে। কিন্তু অপারেশনের জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল। আমার কাছে এত টাকা ছিলো না। আমি
আত্নীয় স্বজনের কাছে সেদিন টাকা চেয়েছিলাম কিন্তু
আমাকে সেদিন দুটো পয়সা দিয়ে কেউ সাহায্য করেনি।পরে আমি কিছু টাকা জোগাড় করেছি। বাড়িটাও বন্ধক দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। শেষ মুহূর্তে অপারেশনের আগে মিশির অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। আমি অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। সেদিন আমার অশ্রুরা যেন থামতে চাইছিলোনা। ধীরে ধীরে মিশি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো আমার বুকে। এভাবে মা বাবার মতো মিশিও আমার ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আর এদিকে আমি বাবা মাকে ও মিশিকে হারিয়ে হয়ে গেলাম নিঃস্ব। "
আহাদ থেমে এবার ইচ্ছের চোখের দিকে তাকালো
হালকা মলিন হেসে বললো,
"জানো ইচ্ছে মিশি যাওয়ার আগে আমাকে একটা কথা বলেছি ? বলেছিল আমি যেন অনেক বড় ডাক্তার হই তাও আবার হার্টের ডাক্তার। আমি মিশির কথা ফেলতে পারি নি। দেখো না ,আজ আমি অনেক বড় হার্ট সার্জন । আমার অনেক টাকা আছে !!বাড়ি আছে!! গাড়ি আছে!!আমার সব আছে !! অথচ সব থেকেও আমি নিঃস্ব । আহাদ তাচ্ছিল্য হেসে বললো।
আমি সেই হতভাগা ভাই যে বোনকে বাঁচাতে পারিনি টাকার জন্য বলে, আহাদ এবার কান্না করে দিলো। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
আজ অনেক দিন পর আহাদ মন খুলে কান্না করলো।"
ইচ্ছে তাকিয়ে আছে আহাদের দিকে । ইচ্ছের চোখ দিয়ে পানি পড়া যেন বন্ধ হচ্ছে না।
আহাদ হাতের আঙ্গুল দ্বারা চোখের পানি মুছে বললো,
তোমাকেও ঠিক মিশির মতো দেখতে। আমি সেদিন তোমার মুখে তোমার অসুখের কথা শুনে থমকে যায়।
ঠিক তখন বারবার মিশির মুখটা চোখের সামনে ভাসছিলো। তাই আমি মিশির মতো আরেকটি প্রাণ
অকালে হারিয়ে যায় সেটি চায়নি এবং দ্রুত তোমার অপারেশনের ব্যবস্থা করি।
ইচ্ছে আহাদের দিকে কান্না থামিয়ে তাকালো।
দুজনের চোখের দৃষ্টি মিলিত হলো ।
সরি.... ইচ্ছে খুব শান্ত গলায় বললো।
সরি কেন?
এই যে আমি আপনার দুঃখের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে
আপনাকে কষ্ট দিলাম তার জন্য। আমার জন্যই তো আপনি কষ্ট পেলেন।
আহাদ ইচ্ছের দিকে তাকাতে দেখতে পেল ইচ্ছের চোখ গুলো কান্নায় লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। আহাদ হালকা হেসে বললো,
ধুর!বোকা মেয়ে । আমি তোমার জন্য কেন কষ্ট পাবো
বরং তোমাকে কথা গুলো বলে আমার ভীষণ শান্তি লাগছে। আমার মনটা আজকের অনেক হালকা হলো।
আমি এই কথা গুলো আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি।
কিন্তু আজ তোমাকে বলে আমি হালকা অনুভব করছি।
আহাদ একটু থেমে আবার বলল,
চলো হসপিটালে যাই। রাত হয়ে আসছে।
আর তোমার চোখের পানি মুছে হাসো নয়তো তোমার বাবা দেখে বলবে তার মেয়েকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া নাম করে কাঁদিয়ে ছেড়েছি বলে আহাদ মুচকি হাসলো।
ইচ্ছে আহাদের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ওরা দুজন হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
চলবে?
কেমন লাগলো আর আপনাদের অনুভূতি কেমন?
0 Comments