গল্প: প্রিয় ইরাবতী| রাজিয়া রহমান| পর্ব-১
ইরার বুকের ভেতর কাঁপছে,একটু আগে সে একটা ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছে। আজকে কী যে হবে ভাইয়া ফিরলে!
সাগর অফিস থেকে ফিরতেই উপমা এসে বললো, “আজকে যদি তোমার বোনের বিচার না করছো তবে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে এখানে।”
সারাদিন অফিস করে সাগরের ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বাসায় ফিরতেই উপমার গোমড়া মুখ দেখে সাগরের মেজাজ তরতর করে বাড়তে লাগলো। গলা ফাটিয়ে ইরাকে ডাকলো সাগর।
চা'য়ের কাপ হাতে নিয়ে ইরা ভাইয়ের রুমে এলো।
“কি করেছিস তুই?”
ইরা মিনমিন করে বললো, “ভাবীর লিপস্টিকটা ভেঙে গেছে ভাইয়া আমার হাত থেকে পড়ে।”
সাগর নিজের ক্ষোভ মেটাতে ইরার গালে ভীষণ জোরে একটা থাপ্পড় মারে।
সারাদিনের খাটুনি, বসের বকুনি,বউয়ের ঘ্যানঘ্যানানি সবকিছুই ম্যাজিকের মতো নিমিষেই হারিয়ে গেলো।শুধু ইরার ছলছল আঁখিজোড়া ভেসে উঠলো চোখের সামনে। ঠিক যেনো জোড়া দিঘি।জল টইটম্বুর সেই দিঘি।
ধীর পায়ে ইরা বের হয়ে এলো ভাইয়ের রুম থেকে।ওড়না দিয়ে দুই চোখ মুছে নিলো।যেনো কিছু হয় নি কোথাও,সব ঠিক আছে।
শারমিন নামাজের বিছানায় বসে তসবিহ পড়ছে।ইরাকে দেখে বললো, “তোর ভাইয়া কেনো ডেকেছে তোকে?”
“চা'য়ের জন্য।”
“তুই চা নিয়ে গেছিস আজকেও?ওই নবাবজাদি কোথায়?রুমে ঢুকছস,অফিস থেকে আসতে কি নিয়ে আসছে দেখছস কিছু?”
ইরা জবাব দিলো না। ভাইয়া ফেরার সময় ড্রাগন ফল নিয়ে এসেছে, খাটের উপর রাখা ছিলো। মা'কে বললে আজ আর রক্ষা নেই।
বুকের ভেতর একটু একটু করে যন্ত্রণারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।বাম গাল এখনো গরম হয়ে আছে।
উপুড় হয়ে শুয়ে অস্ফুটস্বরে ইরা বাবাকে ডাকতে লাগলো। বাবা না থাকলে এই দুনিয়ায় সবার আসল রূপ চেনা যায়।
ভাবীর লিপস্টিকটা ইরা আবার জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলো ঠিকই। যদিও লিপস্টিকটা দামী,গোল্ডেন রোজের লিপস্টিক,৭০০ টাকা দিয়ে কিনেছে ভাবী।ইরার দৌড় ২০ টাকা দামের লিপলাইনার পর্যন্ত।
রাতে দেখা গেলো ইরার বাম গালটা লাল হয়ে উঠেছে। খাবার টেবিলে বসে শারমিন অবাক হয়ে বললো, “তোর গালে কী হইছে রে?”
সাগর আড়চোখে তাকায় বোনের দিকে।বোনের রক্তাভ গালের দিকে তাকিয়ে সাগরের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। মুহূর্তেই অপরাধবোধে বিদ্ধ হয়ে যায় সাগর। কেনো তখন মাথা ঠিক রাখতে পারলো না!
ফর্সা মুখটা কেমন মলিন দেখাচ্ছে।
সাগরের গলায় খাবার আটকে যায়। ঢকঢক করে পানি পান করে সাগর।
উপমা নাক সিঁটকে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
ইরা আস্তে জবাব দিলো, “মশা কামড় দিয়েছে,এরপর চুলকানোতে এরকম হয়ে গেছে।”
“ডাকাত মশার উপর আল্লাহ লানত পড়ুক।হারামজাদা আর জায়গা পায় নাই।বেয়াদব মশা।”
সাগর কেঁপে উঠে মা'য়ের শাপশাপান্ত শুনে।
ইরা ভাইয়ের দিকে তাকায় না আর।খাওয়ার পর উপমা নিজের রুমে চলে গেলো। ইরা এটোঁ বাসন নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পরিষ্কার করার জন্য। অবশিষ্ট তরকারি জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে।
শারমিনের রাগ উঠে।
ব্যাপারটা সাগরের ও চোখে লাগে।প্রতিদিনই দেখা যায় ইরাকেই এসব কিছু করা লাগে।
আজকে বোধহয় ইরাকে থাপ্পড় মারায় ইরার কষ্টটা আজকে বেশি অনুভব করতে পারছে সাগর।
রুমে গিয়ে উপমাকে বললো, “শুয়ে পড়লে যে?আমাকে চা দাও এক কাপ।”
“ইরাকে বলো।ও করে দিবে।আমাকে ও দিতে বলো লেবু চা।”
“ইরা সন্ধ্যা বেলায় একবার করেছে চা।রাতের খাবার দাবার সবকিছু তো ইরাই সার্ভ করলো,এখন সব ক্লিন করছে।তুমি কী করছো?”
উপমা তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে বললো, “আমি কী করছি মানে?কি বলতে চাও তুমি? আমি কী করি না?তোমার বাড়িতে কয়টা কাজের লোক আছে যে সবকিছু করে দেয়? রান্নাবান্না সব কে করে?নাকি তুমি মনে করো তোমার মা বোনের মতো আমি পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাই শুধু?”
উপমার চিৎকার করে বলা কথাগুলো শারমিন,ইরা দু'জনের কানেই পৌঁছায়।ইরা মনে মনে আল্লাহকে ডাকে।ভাইয়া যাতে আর কথা না বাড়ায়।কথা বাড়ালেই কথা বাড়তে থাকবে এখন।
সাগর বলার আগেই শারমিন বললো, “কাজের লোকের কী দরকার!আমরা মা মেয়ে তো পটের বিবি সেজে বসে থাকি না।বেশিরভাগ দিন ইরা-ই রান্না করে। তাছাড়া রান্না না করলে সব কিছু কাটা-বাছা তো ইরাই করে। আমার মেয়েরেই তো কাজের লোক বানিয়ে রাখছো।”
উপমা বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বের হয়ে শাশুড়ীর মুখোমুখি হয়ে বললো, “আপনার বুড়ো দামড়ি মেয়েরে আমি কেনো বসাই বসাই খাওয়াতে যামু?কিসের দায় আমার?”
ইরার দুই চোখ ভিজে উঠে।আব্বাকে নিয়ে যাওয়ার সময় কেনো ইরাকেও নিয়ে গেলো না আল্লাহ!
ইরা ভেবে পায় না।
একটা সংসারে সে এতো বড় বোঝা হয়ে গেলো কীভাবে?
না-কি মাথার উপর থেকে বটগাছের ছায়া সরে গেলে সবাই এমন বোঝা হয়ে যায় অন্যের কাঁধে!
শারমিন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “কতো বড় সাহস তোর,ছোটলোকের বাচ্চা!তুই আমার মেয়েরে বোঝা বলস?তোর বাপের খায় আমার মাইয়া?”
“না,আমার জামাইয়ের খায়।লজ্জা করে না আপনার দামড়ি মেয়েরে ঘরে বসাই বসাই খাওয়াচ্ছেন আবার কথা ও বলেন বড় বড়!নিজে তো পোলার ঘাড়ে চেপে বসছেন আবার সাথে আরেকটারে ও জুটাইছেন!বুড়ি দামড়ি মেয়েরে বিয়ে দিয়ে দিতে পারেন না?”
সাগরের ইচ্ছে করছে নিজের মাথা নিজে ফাটিয়ে ফেলতে।সে তো উপমাকে বলতে এসেছেই তাহলে মা কেনো এর মধ্যে ঢুকতে গেলো!
আর উপমা এসব কী বলছে?
ইরা রান্নাঘরের কাজ শেষ করে বাহিরে এসে মা'কে বললো, “কী করছো মা?এরকম চিৎকার করছো কেনো?আশেপাশের মানুষ কী বলবে?”
শারমিন রাগ সংবরণ করতে না পেরে ইরার বাম গালে পরপর দুইটা থাপ্পড় মারে। চুলের মুঠো ধরে বলে, “হারামজাদি, মরতে পারস না তুই?বেঁচে আছস কেনো তুই এই দুনিয়ায়? তুই মরলে তো আমার চিন্তা কমতো।নিজের চিন্তায় বাঁচি না আবার তোর চিন্তা করা লাগে আমার। তোর জন্যই তো লোকের কথা শুনতে হয়।”
ইরা চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ফ্লোরে।মা'য়ের হাত ধরে বললো, “আচ্ছা, সে না হয় আমি মরবো।চলো ঘরে চলো।আর কথা বলবে না।ভাবী ঘরে যাও তুমি।”
“তোরে জিজ্ঞেস করমু আমি ঘরে যামু নাকি কোথায় যামু? আমার সংসার এটা,আমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে থাকমু।”
ইরা শারমিনের হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।শারমিন শুয়ে পড়লো বিছানায়। কিছুক্ষণ পর শারমিনের নাক ডাকার শব্দ শোনা যায়।
চারদিক কেমন নিরব,কোলাহলমুক্ত।
যেন কিছুই হয় নি।
বারান্দার প্লাস্টিকের চেয়ারটায় গিয়ে ইরা বসলো।বাহিরে সরু রাস্তাটার চারদিকের সোডিয়াম লাইটগুলো জ্বলছে।চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই ইরার হুহু করে কান্না পেলো।বুকের ভেতর জমে থাকা যন্ত্রণারা এই নিরব রাতে অশ্রু হয়ে বের হয়ে এলো ধরায়।
দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো ইরা।কেউ যাতে না শোনে।সারাদিন সব ভুলে থাকতে পারলেও রাত হলেই কেনো জানি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না ইরা।বুকের ভেতর ঝড় উঠে।
আকাশের তারারা নিরব সাক্ষী হয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে ইরার দিকে।
ইরার আর্তনাদে বাতাসে বারান্দার অপরাজিতার লতাটাও কেঁপে উঠে খানিক।
বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়লো ইরা সেভাবেই।
ভোরে ছাদে হাটাহাটি করা রাফির একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যেনো।হাটতে হাটতে সারাদিন কী কী করবে তা নিয়ে ভাবে রাফি।ভাবতে ভাবতেই চোখ যায় পাশের বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে।
কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে একটা মেয়ে বারান্দায় বসে। অপরাজিতা গাছের একটা ফুল চুলের উপর পড়ে আছে।
রাফি দ্বিধায় পড়ে যায়।
কে বেশি সুন্দর!
ফুল নাকি মেয়েটা!
মেয়েটাকে আরো কয়েকবার দেখেছে রাফি।অথচ আজকে মনে হচ্ছে মেয়েটা একটু বেশি সুন্দর।
এভাবে তো খেয়াল করে দেখে নি আগে।রাফির ভাবনার মধ্যেই ইরার ঘুম ভেঙে যায়।
ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় ইরা।ওড়নাটা এক পাশে রেখে চুলগুলো শক্ত করে হাতখোঁপা করে নেয় ইরা।যেতে যেতে ইরার মনে হয় কেউ যেনো ওকে দেখছে।চট করে ইরা সামনের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকায়।
ঠিকই ভেবেছে সে।ছাদে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
অদ্ভুত!
এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?
ভাবী একবার দেখতে পেলে আর ইরার রক্ষা নেই।সত্য মিথ্যা বানিয়ে ভাইয়ের কানে তুলবে।
দ্রুত বারান্দা থেকে চলে গেলো ইরা।নাশতা বানাতে হবে দ্রুত।কিছুক্ষণ পর লিনা আসবে।ভার্সিটিতে যেতে হবে ইরাকে।
রান্নাঘরে ঢুকতে আজ বোধহয় একটু দেরি হয়ে গেলো।উপমাকে দেখা যাচ্ছে মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। রুটি বানাচ্ছে উপমা।
ইরা এগিয়ে গিয়ে বললো, “ভাবী,আমি বেলে দিচ্ছি রুটি। তুমি সেঁকে নাও।”
“আমি যখন এই বাড়িতে দাসী হয়ে আসছি তাহলে আমিই পারবো সব।তোমরা সবাই রাজা,মহারানী।তোমাদের কাজ করা লাগবে না।দাসী তো পাইছোই একটা।যাও এখান থেকে।নাটক করবা না।”
ইরা জোর করে উপমার হাত থেকে বেলন নিয়ে নিলো।উপমা জিদ করে ইরার থেকে কেড়ে নিলো বেলন আবার।
গতরাতে সাগর তাকে যথেষ্ট গালাগাল করেছে।এমনকি আর একটু হলে বোধহয় চড় ও মারতো।উপমার মাথায় আগুন জ্বলছে।উপমার বড় ভাই এসআই। ভাইকে কী বলবে একবার?
0 Comments